গোলাপ গাছ
কৈশোরের একটি গোলাপ গাছ আজো
আমার ভেতরে কিছু গোলাপ ফোটায়। মাঝে-মাঝে
বিষাদের মেঘে এসে বসে, বিবাগী স্মৃতির মতো
উড়ে যায়; কখনো আবার বুকে খুলে
দেখায় রুগ্ণতা, পদর্শনী
বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভেবে গোলাপ আমার কাছে
স্বপ্ন দাবি করে,
দাবি করে তৃতীয় প্রহরে গূঢ় গোপন শুশ্রুষা।
আমার বুকের রক্তে তার
হোলি খেলা দরকার ব’লেই প্রতীক্ষায়
পাপড়ি মেলে রাখে,
কামাবিষ্ট তরুণীর স্তানাগ্রের মতো
যাবতীয় কুঁড়ি তুলে ধরে,
কখন আমার বুক হয়ে উঠবে কাটার বাসর।
সকল সময় নয় কখনো সখনো,
যখন সর্বস্ব
খুইয়ে একাকী বসে থাকি বাসনার কবরের এক পাশে,
সে গোলাপ গাছ দুলে ওঠে, পুরানো বন্ধুর মতো
দূর মরীচিকা ঠেলে এসে
আমাকে নিবিড়
আলিঙ্গন করে, আমি তাকে শরীরের
প্রতি রোমকূপ দিয়ে দেখি। পিকাসোর
ছবির মতোই পেয়ে যায় নানা মাত্রা কিউবিস্ট আচরণে
ফুলের রমণী আর এও তো জেনেছি
কাল বৈশাখীর ক্রুর ক্রীড়ায় দলিত
মথিত হয় সে বারংবার, কিন্তু হয় না নির্মূল।
তার পাতা ঝরে গেলে ঝরে
হৃদয়ের পল্লব আমার; নিমীলিত হলে তার
চোখ, জ্যোতিহীন হয়ে যায় আমার দু’চোখ, আমি
তার শাখা প্রশাখায় যখন দেখি না
উন্মীলন অপরূপ, দেখি কৃষ্ণ মেঘ,
তখন আমাকে স্থবিরতা শ্মশানে বসিয়ে রাখে,
স্বপ্নগুলি ভাঙা কলসের মতো দু’পায়ের ফাঁকে ইতস্তত
পড়ে থাকে। সে আমার কবিতার সমান বয়সী।
ঘর-বাড়ি ধ্বসে পড়ে
জ্যোৎস্নায় কোথাও আচমকা ঘর-বাড়ি ধ্বসে পড়ে।
ঘর আর থাকে না ঘরের
ভেতরের, দেয়ালগুলি হতাশার মতো পড়ে থাকে
ইতস্তত, বাস্তুসাপ চোরা
গর্তে ঢুকে অন্ধকারকেই
সমর্থন করে।
স্টেচারে সারল্য শুয়ে আছে, ব্যাণ্ডেজের অন্তরাল
থেকে প্রস্ফুটিত করুণার মুখ, অ্যাম্বুলেন্সে ঘোরে
স্টিয়ারিং আজরাইলের
হাতে, ভেঁপু বাজে বারবার। পথচারী
বিস্মিত দাঁড়ায় ঘুরে, পুরানো কাগজ
সংকীর্ণ, রাস্তার দীর্ঘশ্বাসে ওড়ে, ডাস্টবিন চাটে ধৈর্যশীল
কুকুর, ট্রাম্পেটে বাজে বিশ শতকের
একটানা ক্লান্ত অস্তরাগময় গহন পূরবী।
গ্রামীণ জমির আলে, হলুদের বিস্তৃত শোভায়,
ঝোপঝাড়ে সূর্যোদয়-ঝলসিত বিলে,
শহরের ফ্যাক্টরিতে, সিনেমায়, পার্কে, কলোনিতে, আদালতে
অথবা ট্রাফিক আইল্যান্ডে-
কোথায়ও নিশ্চিন্তি নেই। সেই কবে থেকে
হুলিয়া হয়েছে জারী পলাশের রঙের বিরুদ্ধে, কারাগারে
ঠেলে দেয়া হয়েছে যুবার
স্বপ্ন মঞ্জরীকে, কিশোরীর শুচিতাকে যুপকাটে
বলি দেয়া হচ্ছে প্রকাশ্যেই। স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠার
প্রক্রিয়া বিষয়ে যারা
প্রত্যহ কথার বুটিফুল ফোটার জনসভায়
তারাই সহজে
বানায় নরক আশেপাশে। পথে-ঘাটে
ভিড়ে বাড়ে প্রতিদিন, লোকে লোকারণ্য চতুর্দিকে,
অথচ কী এক নিঃসঙ্গতা
ছেয়ে থাকে ঘন কুয়াশার মতো, প্রত্যেকে বিছিন্ন প্রত্যেকের
থেকে, হাত ধরবার মতো হাত নেই
কোনোখানে, যদিও নিয়ত সেতুবদ্ধনের গান
মঞ্জরিত গলায় গলায়,
প্রকৃতি দেখার মতো চোখ নির্বাসিত,
অনুভব করবার মতো
হৃদয়ের বড়ই অভাব আজ পাথরের দেশে।
আমাদের ক্লান্ত ছায়াগ্রাস্ত চোখে আনে
মরীচিকা আজকের ইতিহাস প্রহরে প্রহরে;
রক্তাক্ত কাদায় পা আমার
ডোবে বারবার, দৃষ্টি যায় গুল্মোরের ডালে ডালে,
কখনো বা মজা খালে। মনে হয় আমি যেন তাদেরই মতন,
মৃত যারা খৃষ্টের মৃত্যুর ও বহু আগে।
চিবুক ঠেকিয়ে হাত বিষাদ নিমগ্ন, এমনকি
পাখির খুশির নাচ,
পদ্মের সংরাগও তাকে পারে না ফেরাতে
উল্লাসের দিকে। এ শহরে ক’জন মানুষ আছে
যাদের জিভের
ডগায় সাপের
জিভের তীক্ষ্মতা নেই? ক’জন মানুষ হেঁটে যায় কুটপাতে
যারা কেউটের বিষ ঠোঁটের আড়ালে
জমিয়ে রাখে নি? আজ ক’জন স্বজন পাবে অলিতে গলিতে,
যাদের দেখলে নেকড়ের পাল যাবে না পালিয়ে?
ভয় বিস্ফারিত চেখে চেয়ে থাকে সকল সময়; কেউ যেন
বলে যায়, এখন কোথাও কারো পরিত্রাণ নেই।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা এখন
কোন্ সেই খাদের কিনারে আত্মবিস্মৃত সবাই
কেউ তা বোঝে না। অপভাষা।
অতিশয় কোলাহল করে, আমাদের
প্রিয় খুঁটিগুলি কী ভীষণ নড়ে যায় বৃদ্ধের দাঁতের মতো
সারাক্ষণ। নৈরাজ্যের পূর্বাভাস পাই
ঈশানের মেঘঢাকা কোণে, ভয় হয়
কোথায় কখন ফের কারুকাজময় ঘরবাড়ি ধ্বসে পড়ে।
চিত্রনাট্য
ভেবেছিল লোকজন এরকম ব্যাপার স্যাপারে
পরস্পর যা বল্যাবলি করে, অবিকল তা-ই
আসবে তোমার কানে, অলিগলি কিংবা হাটে মাঠে
পল্লবিত হবে স্বাদু সাত কাহন কাহিনী।
শ্মশানের ধুলো থেকে উড়ে-আসা বিদঘুটে পাখি
আমাকে ভীষণ ঠোকরাবে, চাঁড়ালের ভাঙ্গাচোরা
কলসের মতো আমি থাকব বিস্রস্ত প’ড়ে আর
পালতোলা নৌকা দ্রুত এগোবে নদীর পানি কেটে,-
এবং আমার আর্তনাদ অবসন্ন মাঝি কেউ
শুনতে পাবে না, এরকম চিত্রনাট্য মনে মনে
করেছিল তৈরি, লঙশটে আমাকে দেখবে তুমি
বোতল, গ্লাসের সঙ্গে, এমন প্রত্যাশা ছিল কিছু।
চিত্রনাট্য ওলোট পালোট হলো। দিন কাটে আজো
গুণীর তানের মতো, দাড়ি কাটি প্রত্যহ সন্ধ্যায়,
বন্ধু বান্ধবের কাছে যাই, অবশ্য স্বীকার করি
নিজের ভিতরে পুড়ি, ফিনিক্সের মতো একা পুড়ি।
চিড়িয়াখানার কিউরেটার সমীপে
প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আমরা
শহরবাসীরা চিড়িয়াখানার এরকম
উন্নয়নে যারপরনাই আনন্দিত। নগরপ্রান্তে
আপনারা স্থাপন করেছেন আরণ্যক সৌন্দর্য। নিসর্গের
সাবলীল তানে মুগ্ধ হয়ে সেখানে
কাটানো যায় প্রহরের পর প্রহর। নানা ধরনের
গাছপালা উৎপীড়িত স্নায়ুর শুশ্রূষা করে
আর নতুন ব্লেডের মতো চকচকে ঝিল শরতের রোদে
ঝিলমিল, সেখানে ডেরা বেঁধেছে বহুদূর থেকে আসা
জলচর পাখির ঝাঁক।
সত্যি বলতে, আপনাদের প্রশংসনীয় ব্যবস্থাপনায়
বেশ ভালোই আছে বাঘ, ভালুক, সিংহ
হাতি, গণ্ডার, জলহস্তী আর
রঁদার ভাবুকের মতো শিম্পাঞ্জী আর অনেক কিসিমের
বানর, ওরাং ওটাং মাঝে মাঝে
দোল খায়। খাঁচায় ফিরে আসে আরণ্যক স্মৃতি।
জিরাফ, জেব্রা আর এমু নিজেদের
স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দিন কাটায় নিজ নিজ এলাকায়,
বিভিন্ন হরিণ সৌন্দর্যের ঢেউ বইয়ে দেয়
ঘাস-অলা জমিতে। হরিণের কাছাকাছি চরে
সম্বর, নীল গাই। ময়ূর, সারস, টিয়ে, ক্যানারি
আর অন্যান্য পাখি দেখে কৌতূহলী দর্শকদের
চোখ জুড়ায়। খুব দক্ষতার সঙ্গে, বলা যায়,
এদের দেখভাল করা হচ্ছে। চিড়িয়াখানার
প্রতিটি বাসিন্দার জন্যেই
বারাদ্দ হয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবার,
ঘড়ি দেখে ওদের খাওয়ানো হয় প্রতিদিন। তাছাড়া
ওরা অসুস্থ হ’লে আছে নামী-দামী চিকিৎসকের বিধান।
চিড়িয়াখানার এই সুপরিকল্পিত সৌন্দর্য,
যা আমাদের মোহগ্রস্ত করে,
যা আমাদের ভেতরে আদিমতার আড়মোড়া ভাঙার
অবকাশ তৈরি করে, জীবজগতের সঙ্গে
আমাদের সম্পর্কের ঝালর সৃষ্টিতে এক কুহকপ্রবণ
সিনারিও নির্মাণে উদ্দীপনা-জাগানিয়া,
আপনাদেরই সুকৃতির নিদর্শন। এ-জন্যে সকল প্রশংসা
আপনাদের অবশ্যপ্রাপ্য।
যদি কিছু মনে না করেন, তাহ’লে
আপনাদের বিবেচনার জন্য সামান্য একটি প্রস্তাব
পেশ করতে পারি। নিসর্গের শপথ, উদার
আরণ্যক সৌন্দর্যের শপথ, আপনাদের কমিটিতে
এই প্রস্তাব গৃহীত হ’লে
চিড়িয়াখানা সবদিক থেকে নিখুঁত হয়ে উঠবে।
আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, এ শহরে
এমন কিছু প্রাণী আছে, যারা দেখতে অবিকল
মানুষের মতো। ওরা বড়ই হা-ভাতে, দোরে দোরে
ধর্না দেয় একটু ভাতের জন্যে, পাড়ায় পাড়ায়
ছড়ায় বিরক্তি, যা নোংরা,
দেখলেই বিবমিষা হয়। মাদার তেরেসার সম্মান দয়া করে ওদের একটু
ঠাঁই দিন আপনাদের চিড়িয়াখানায়। বানিয়ে দিন
বড়োসড়ো একটা খাঁচা, সংখ্যায় ওরা নেহাত
কম নয়। নিয়মিত কিছু খাদ্য বরাদ্দ করুন ওদের জন্যে।
তাছাড়া উপরি হিসেবে ওরা পেয়ে যাবে
দর্শকদের কাছ থেকে ছোলা আর কলা। দেখবেন
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওরা আপনাদের
সুন্দর, সুশোভিত চিড়িয়াখানার
জীবজন্তুরদের মতোই হয়ে উঠবে নান্দনিকভাবে দর্শনীয়।