কৃতাঞ্জলি
হেঁটে যেতে যেতে মধ্যপথে অকস্মাৎ
বলেছিলে, ‘ওদিকে যেও না তুমি কস্মিনকালেও,
সেদিকে অনেক
খানাখন্দ, চোরাপথ আছে’ আর তখুনি আমার
চোখ থেকে ঝরে গেলো ফুলের পাপড়ি সমুদয়
তোমার উদ্দেশে।
‘সেখানে সন্ধ্যায় তুমি যেও না কখনো
সেখানে বাঘের ভয় আছে’, ব’লে তুমি
সতর্ক করেছো
আমাকে সূর্যাস্ত; আমি চোখে বেলাশেষের আবীর
মেখে নিয়ে, বাজিয়ে সোনালি ঘণ্টা তোমার উদ্দেশে
ফিরে গেছি লোকালয়ে মূলত আশ্বস্ত পর্যটক।
অথচ আমার পাশে সেরে নেয় মধ্যাহ্ন ভোজন মাঝে মাঝে
যে-জন, মেলায় গলা আমার গলায়, শিস দিয়ে
বাজায় পুরানো সুর, সে-জনই শীতল হন্তারক,
এ সরল সত্য আমি তোমার চোখের
ভাষা এতবার পাঠ করেও হে বন্ধু, হে শুভার্থী সহচর,
ঘুণাক্ষরে জানতে পারি নি।
কোথাও পাবে না খুঁজে কেউ
এখানে দাঁড়াও তুমি প্রবীণ অশথতলে, দাঁড়াবার প্রয়োজন থাক
আর না-ই থাক, দাও খানিক বিশ্রাম
পা দু’টোকে, ছায়া মাখো গায়ে, বন দোয়েলের ডাক
শোনো, দেখে নাও গ্রাম
গ্রামান্তের শোভা। কতদিন
আসো নি এমন ছায়াস্নিগ্ধ পরিবেশে।
তোমার পড়ে কি মনে এরকম বিকেলে মলিন
হয়ে-আসা দিগন্তের রেখা থেকে ভেসে
এসেছিল হৃদয়ের তন্তুজাল আলোড়নকারী
সুর, দুটি চোখ
তার দূর শতাব্দীর গহনতা নিয়ে ঝুঁকেছিল জলে, তারই
ছায়া পান ক’রে, তুমি ভুলেছিলে শোক?
তোমার পড়ে কি মনে? মনে
পড়ুক অথবা না-ই পড়ুক, এখন ছায়াবোনা পথে কিছুক্ষণ
থাকো অপেক্ষায়, দূর নীলাকাশ তারার স্পন্দনে
পাবে অন্য মানে, মায়াবন
চকিতে উঠবে জেগে পথপ্রান্তে। উড়ুক্কু মাছের ঝাঁকে ছেয়ে
যাবে দশদিক, অস্তগামী
সূর্যের ললাট বেয়ে
নামবে রঙিন সুতো, হৃদয়ে বুলোবে তুলি কে শিল্পী বেনামি।
অথচ এখানে তুমি খুব বেশিক্ষণ পারবে না
দাঁড়াতে, হঠাৎ ভয়ে কাঁটা
দেবে গায়ে; কেমন অচেনা
লাগবে সকল কিছু এক লহমায়; পায়ে হাঁটা
পথ হয়ে যাবে ঝড়ক্ষুব্ধ খর নদী, এ গ্রাম নিমেষে
ভীষণ তলিয়ে যাবে পৌরাণিক অন্ধকারে। তুমি
থাকবে দাঁড়িয়ে ঠায় বাজপোড়া মানুষের মতো অবশেষে;
কোথাও পাবে না খুঁজে কেউ এতটুকু চেনা ভূমি।
গল্পটি আমার প্রিয়
(বদরুদ্দীন উত্তম বন্ধুবরেষু)
গল্পটি আমার প্রিয়, আপনার কেউ
সে-গল্প জানেন কিনা জানি না, যদিও দীর্ঘকাল
আগেই শুনেছি আমি,
শুনেছি অনেকবার। প্রকৃত প্রস্তাবে, বলা যায়,
গল্পটি পুরানো খুব, লোক মুখে প্রকাশিত, ভিন্ন ভিন্ন দেশে
ভিন্ন ভিন্ন এর রূপ, সারবস্তু অভিন্ন যদিও।
গল্পটি রাজার বটে, তবু
সেটাই আসল কথা নয়। রাজার জায়গায় অন্য
কোনো প্রভু, ধ’রে নিলে
ক্ষতি নেই, হেরফের হবে না কিছুই।
গল্প বলবার কলাকৌশল আমার
অনায়ত্ত, তাই
যদি হয় ভুলচুক, যদি বাদ পড়ে যায় কোনো
গূঢ় কথা কিংবা খুঁটিনাটি,
তাহলে মিনতি করি, আমাকে মার্জনা
করবেন।
শুনুন তাহলে বলি, একদা কোথাও কোনো দেশে-
দেশটির নাম পেটে আছে, মুখে নেই-
ছিলেন সুকান্ত এক রাজা, মস্ত বড় রাজ্যপাটে
তাঁর ছিল শান্তি মৃত পায়রার মতো। রাজদণ্ড
ধরতে ছিলেন তিনি দড়, যদি কেউ
বলতো সে দণ্ড
ঈষৎ রয়েছে ঝুঁকে ডানে, তা হলেই
দ্বিধাহীন তিনি পাঠাতেন তাকে কারাগারে হাওয়া
খেতে, বিবেচনা ছিল তাঁর;
না হলে শূলেই চড়াতেন হেসে খেলে। সে-দেশের
কারাগার ছিল বড়োসড়ো,
কানায় কানায় ভরা বানডাকা নদীর মতন।
প্রজারা একান্ত বশম্বদ, বিশেষত
আমাত্য প্রবর যারা এ-ব্যাপারে তারা
তুলনা-রহিত আর কবিরা দাক্ষিণ্যে তাঁর, সকলেই নয়,
পুষ্ট, অতি তুষ্ট; ধনী মহিলার কোলাশ্রয়ী সুশ্রী
কুকুরের মতো ওরা। কলাবিৎদের
ছলাকলা দেখে তাঁর
কাটতো সময় বেশ, দিতেন বাহবা প্রায়শই,
কখনো হতেন হেসে কুটি কুটি, যেন কৌতূহলে
দেখছেন মঞ্চে সুসজ্জিত রঙচঙে
ভাঁড়ের মিছিল।
আবার মার্জনা চাই, গল্পটি মূল
বিষয়ের থেকে আমি এসেছি কিঞ্চিৎ দূরে সরে।
আসলে সে মহারাজ দানখয়রাতে
ছিলেন উৎসাহী বড়ো, দয়ার শরীর তাঁর, দীন
দুঃখীদের কষ্টে অতিশয়
বিচলিত হয়ে নিয়মিত গণভিক্ষা
দিবস পালন ক’রে মনোভাব কমাতেন কিছু। মহারাজ
অকাতরে বিলোতন ধন
প্রজাদের মাঝে, ধনী কি নির্ধন সকলেই খুব
হন্তদন্ত হয়ে
জুটতো বিশাল দানসত্রে যথারীতি। কাড়াকাড়ি
শুরু হতো প্রসাদলোভীর সে দঙ্গলে।
একদিন
একটি বালক ছিল সেই সম্মিলনে, তার চোখে
দুপুরের রৌদ্র-ঝলসিত
নদীর পানির মতো দৃষ্টি ছিল, সমস্ত শরীরে
আরণ্যক রহস্যের স্পর্শ ছিল। কেউ তাকে
আমলে আনে নি,
উটকো বালক ভেবে দিয়েছে সরিয়ে দূরে তবু
সে বালক ঘোরে আশেপাশে,
দ্যাখে জমকালো দৃশ্যাবলি। কখনো-বা
বাজায় সে ভেঁপু,
নদীর ঢেউয়ের মতো আসে আর যায়,
যেনবা মজার খেলা পেয়ে গেছে ভিক্ষার উৎসবে।
গৃহদাহ
একজন অতিশয় নিরালা কবির
কবিতা পাঠের ভিড়ময়
মজলিশে সারা গায়ে রজনীগন্ধার
শুভ্রতা জড়িয়ে ফুল্ল স্তনভার নিয়ে
তুমি এসেছিলে, যেন লোড শেডিং এর রাতে
বিদ্রোহী পূর্ণিমা। সুকণ্ঠের প্রতি এমনকি অনামন্ত্রিত
লতাগুল্ম পাতা কান পাতে;
তখন নিসর্গ প্রীত ছিল।
কপালে খয়েরি টিপ, হাতে আধপড়া
কবিতার বই, বুকে চাঁদ
নিয়ে তুমি খুব অন্তরালে
থেকেও সেখানে বড় বেশি প্রকাশিত
ছিলে; জ্বলজ্বলে টিপ বাসনার ডালে
পাখি হয়ে ডাকে, সে ডাকের হাতছানি পেয়ে কবি ভীত নন
জতুগৃহে যেতে;
আপাতত বাসের টিকিট কেটে যান তিনি বাল্যকাল পেতে।
গভীর রাত্তিরে আসমান ফেটে ধু-ধু বৃষ্টি পড়ে
অবিরল। কবি ঘরে নেই;
যদিও কোথাও নেই তার ঘর, তবু জলের প্রবাহস্নাত
রাতে হলো তার গৃহদাহ।