আমি কি গলায় তবে
কী-যে হলো, ইদানীং অনেকেই ঘেঁষে না আমার
ত্রিসীমায়। একদা যাদের গল্পে-গানে উঠতো ভ’রে
আমার প্রহর অহর্নিশ, না চাইতে
দিতো যারা বাড়িয়ে চায়ের কাপ, বাগানের ফুল
আহ্লাদে সাজাতো
আমার ফ্লাওয়ার ভাসে, এখন তাদের ছায়া আর
পড়ে না আমার ঘরে। বস্তুত এখন
ওরা চমৎকা কায়দায়
দিব্যি পাশ কাটিয়ে কিছু না ব’লে চলে যায়
সাত হাত দূরে
নিপুণ নটের মতো। যেন যাদু বলে পরিচয়
লহমায় মিথ্যে হয়ে যায়। একদা এরাই খুব
ঘটা ক’রে আমার গলায় মালা দুলিয়ে তুমুল
করতালি দিয়ে কানে তালা
দারুণ লাগিয়েছিল, মনে পড়ে। আজ
আমার অস্তিত্বে ওরা হুল ফোটাতেই বড় দড়।
কী আমার অপরাধ? আমি এ শহরে
দিইনি আগুন কোনোখানে, কারো বাড়া ভাতে ছাই
দিয়েছি, এমন কথা বলবে না চরম শক্রও। দাঙ্গাবাজ
আমাকে যাবে না বলা। আশৈশব আছে
পক্ষপাত পায়রার প্রতি। আমি শুধু
নিভৃতে করেছি বিক্রি আমার আপনকার আর্ত হৃদয়ের
রক্ত-থেকে-ঝরা
কতিপয় বিশুদ্ধ গোলাপ
এবং হাতের মুঠো থেকে প্রায়শই ছেড়ে দিই
তোমাদের উদ্দেশে রঙিন প্রজাপতি সমুদয়।
কী আমার অপরাধ? এমনকি তুমিও সম্প্রতি
আমার নিকট থেকে দূরে চলে যাও
যে-কোনো ছুতোয়। হয়তো তোমার নিকট
আমার সকল স্মৃতি পুরানো, অজ্ঞাত
নটের ছবির মতো আবছা সুদূর
মনে হয় আজ।
শুনেছি অতীতকালে কুষ্ঠরোগীদের রাখা হতো
শহরের শেষ প্রান্তে, উপরন্তু ওদের গলায়
ঝোলানো থাকতো ঘণ্টা, যাতে স্মিত স্বাস্থ্য বায়ুসেবী
পথচারীগণ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে
করতে পারেন পর্যটন।
আমি কি গলায় তবে ঘণ্টা বেঁধে নেবো?
আর্জান সর্দার
প্রিয়তমা, তোমার চিঠির শেষ কথাগুলো খুব
বিঁধে আছে মর্মমূলে, কতিপয় কালো
অক্ষর কদিন ধ’রে দেখাচ্ছে আমাকে
ভয়, যেখানেই
যাই দুশ্চিন্তার মেঘ ঝুঁকে থাকে আমার ওপর
সকল সময়। তুমি লিখেছো, সম্প্রতি
কী একটা শব্দের ধমকে
খোকার দোলনা কেপে ওঠে ভয়-পাওয়া
পায়রার মতো আর
খুকির পুতুলগুলির মূর্ছা যায় কুলুঙ্গিতে প্রহরে প্রহরে।
লিখেছো সন্ধ্যার পরে ইদানীং কেউ
সহজে রাস্তায় বেরোয় না। দরজায় খিল এঁটে
যে যার আপন ঘরে থাকাটাই শ্রেয়
মনে করে। কেউ কেউ দেয়ালে নিজের ছায়া দেখে
ভীষণ চমকে ওঠে এবং ফাঁসির
আসামীর মতো
কাটাচ্ছে সময় অনেকেই। এমনকি ভালোবাসা
আঁধারে লুকায় মুখ, যেন
গভীর ভূগর্ভে গিয়ে নেবে শেষ শয্যা। কী ব্যাপক
হায়বত, হায়, দাঁত নখ বসিয়েছে লোকালয়ে।
অন্য সব শব্দকে ছাপিয়ে সেই শব্দ নিয়তির
মতো ছোটে এক প্রান্তে থেকে
অন্য প্রান্তে, যে শোনে, হৃদয় তার শিলীভূত হয়
লহমায় গোখরোর ফনার মতোই
সম্মোহন আছে সে শব্দের প্রায়শই
বিপুল অঙ্গার এক দেখা যায় এখানে সেখানে,
তার অভ্যন্তর থেকে দশদিক-কাঁপানো গর্জন
চকিতে বেরিয়ে আসে, ঘরদোরে ধরে
চিড় আর গাছের বাকল ছিঁড়ে যায়। লোকে বলে
চতুর্দিকে শবাতঙ্ক ছড়াচ্ছে প্রবল কেঁদো বাঘ।
যতদিন পারো, প্রিয়তমা,
খোকা আর খুকীকে হাসাও। তোমাদের
হাসি এই অন্ধকারে ছড়াবে আবীর, ভয় নেই,
এই তো আসছি আমি। যদিও কখনো
ধরি নি বন্দুক আমি, এমনকি গুলতির ঘায়ে
মারি নি শৈশবে পাখি, তবু
খুঁজে নেবো আঁটি, এ আমারই দায় ভাগ,
অবলোয় আমাকেই হতে হবে আর্জান সর্দার।
আলমারি
একটি চমৎকার কারুকাজময় আলমারি
ঘরের ভেতর আছে চুপচাপ বহু বছরের
প্রাচীনতা নিয়ে; আজকাল এরকম আলমারি
বানানো হয় না আর চাহিদার অভাবে এবং
আগেকার মতো কোনো কুশলী ছুতোর নেই, বলে
কেউ কেউ আক্ষেপের স্বরে। সেই কবে মাতামহ
আম্মাকে দিয়েছিলেন এই আলমারি ভালোবেসে
দহেজ হিসেবে। এখন সে আমার কাছেই আছে।
কাপড়-চোপড় কিংবা কাপ-ডিশ রাখি না কখনো
এই আলমারির ভেতরে। শুধু কিছু বই নিয়ে
বুকের ভেতর অভিভাবকের ধরনে দাঁড়িয়ে
থাকে এক কোণে, কোনো কোনো মধ্যরাতে জেগে শুনি
তার কণ্ঠস্বর, যেন ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রফেট
প্রশান্ত ভঙ্গিতে শোনাচ্ছেন গভীর সুসমাচার।
আশৈশব এক আলোকাতরতা
আশৈশব এক আলোকাতরতা লালন করছি
আমার ভেতর। পেঁপে গাছের পাতায় পাতায় ঝলমল
করে যে-আলো, ভোরবেলা
টেবিলে-উপচানো বই আর আমার কবিতার খাতায়
যে-আলো বুলোয় স্নেহার্দ্র আঙুল, অথবা
ডাগর বিকেলে আমার প্রিয়তমার চুলে যে-আলোর
নৃত্যুশোভা দেখি, তা মহান কোনো গ্রন্থের
পঙ্ক্তিমালার মতো আলোড়িত করে আমাকে। এবং এখন
আমি বুঝতে পারি
আলোর জন্যে কেন মৃত্যুপথযাত্রী কবির অমন ব্যাকুলতা।
সেদিন আমি আমার সেই বন্ধুর কাছে গেলাম,
একদা যার সঙ্গে কথা বললে
আমার অন্তর হয়ে যেতো রৌদ্রঝলসিত উপত্যকা। এখন তিনি
সাফল্যের শেষ ধাপে পৌঁছে দামী তামাকের গন্ধ শুষে-নেয়া
শরীর এলিয়ে দিয়েছেন বাণিজ্য লক্ষ্মীর কোলে। তাঁর
আলো-ঝলমলে ঘরে ঢুকলে চোখ ঝলসে যায় আসবাবপত্রের
জৌলুসে। যথাসময়ে এল ট্রলিভর্তি খাবার আর কফি।
বন্ধুর সিগারেট কেস
ঝিকিয়ে উঠলো জহরতের মতো আর আমি
ফিরে এলাম এক বুক অন্ধকার নিয়ে।
আমি আমার মৃত কবিবন্ধুর একটি পুরানো
কাব্যগ্রন্থ উল্টে পাল্টে দেখছিলাম, কোনো কোনো পঙ্ক্তিতে
বুলোচ্ছিলাম চোখ। হায়, একদা
যে পঙ্ক্তিমালা আলো ছড়াতো আমার
অস্তিত্বের তন্তুজালে, আর তারা এমন নিষ্প্রদীপ কেন? কেন সেই
বইয়ের একটি পাতাও তারা-জ্বলা আকাশের মতো
হয়ে উঠলো না? আমার মনে পড়লো বন্ধুর
মধুর হাসি, হাতের নড়া,
তাকানোর ভঙ্গি। একজন মানুষের এরকম
ছোটখাটো ব্যাপারইতো গাঁথা হয়ে যায় স্মৃতির
বড়শিতে। অঞ্জলিময়
একঝাঁক নিষ্প্রদীপ শব্দ নিয়ে বসে থাকলাম অন্ধকারে।
আমার অন্য এক বন্ধু আজ বন্দি
কেন্দ্রীয় কারাগারে। অন্ধকারাচ্ছন্ন এই দেশে
ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে
দেবার ব্রত নিয়ে তিনি রৌদ্রজলে হেঁটেছেন বাম দিকে।
বছরের পর বছর নিঃসঙ্গতা-ছাওয়া
কারা কুঠুরি ঠুকরে ঠুকরে তাঁকে ভীষণ ক্ষইয়ে দিয়েছে ক্রমাগত-
এখন তাঁর দাঁত নড়বড়, চোখের জ্যোতি
দ্রুত বিলীয়মান। অন্ধকার সেলে অষ্টপ্রহর
ধুঁকছেন তিনি স্বদেশের মতো,
অথচ তাঁর জীবন থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে
অলোকসামান্য যে-আলো
তাতেই আলোময় হয়ে উঠেছে আমার হৃদয়।