- বইয়ের নামঃ দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অক্ষরের ধারণ ক্ষমতা
যখন তোমাকে দেখি আমি পাঁচ হাজার বছর নিষ্পলক
তাকায় তোমার দিকে; অথচ আমার
দৃষ্টিকে করেছে বন্দি ওরা
অদৃশ্য দেয়াল গেঁথে। রাশি রাশি সিমেন্ট এবং
বালি চোখে পুরে দিতে চায় সকল সময়। যেন আমি
অন্ধ হলে ছিল ভালো, নদীতে হতো না ভরাডুবি।
ভালো ছিল, শৈশবের শ্যামল ছায়ায়
ছিলে তুমি কোনোদিন। তখন তোমাকে ছুঁলে কারো
ধিক্কারের বাজ
পড়তো না আমার মাথায়।
আর আজ চক্ষু মিলনেই ঢি ঢি পড়ে যায় দশদিকে; কেউ
কেউ এমন কি রায় বেঁশে হয়ে ওঠে।
ইচ্ছে হয় চলে যাই এ শহর ছেড়ে ছুড়ে। কেন না আমার
চোখের সম্মুখে তুমি খুব পরিপাটি
সাজাবে অন্যের ঘর, শোবে রাত্তিরে বেগানা বিছানায়-
এই দৃশ্য দেখে
সুন্দর হবে না চোখ কখনো আমার। ভয় হয়
এখন তোমাকে প্রিয়তমা বলতেও ভয় অতিশয়।
তুমি নও নর্তকী, অথচ প্রায়শই ফুটে ওঠে সাবলীল
নাচের মোহন মুদ্রা তোমার শরীরে, ছন্দোচ্ছল
তোমার পায়ের নিচে ধুলো,
ঘাস কার্পেটের মোলায়েম আঁশ খুব
স্নিগ্ধ নেচে ওঠে, আর নিমেষে আমার
কবিতার পঙ্ক্তিমালা হয় নানা উদয়শঙ্কর।
যখন ঘুমাই আমি, অতিকায় দাঁড়কাক এক কাছে এসে
চঞ্চু রাখে ভুরুতে আমার,
এবং ধাতব ঘাস ফড়িং-এর ঝাঁক নিমেষে দখল করে
সমস্ত শরীর। চতুর্দিকে আমার স্বপ্নের রোঁয়া
ক্রমশ উড়তে তাকে। দুধ দোয়ানোর
শব্দে ঘুম ভাঙার আশায় থাকি ঘুমের ভেতর।
যে-কোনো আওয়াজে ঘুম ভাঙুক অথবা এমনিতে অকস্মাৎ
ছিঁড়ে যাক ঘুমের রেশমি পাড়, যেন জেগে উঠে
তোমাকেই দেখি। এ জীবনে
খুব অল্প দেখেছি তোমাকে। তাই আজ অক্ষরের
প্রতিমা বানিয়ে তাতে তোমাকেই রাখি
আর ভাবি অক্ষরের ধারণ ক্ষমতা কতটুকু?
অনাশ্রয়ে
কী করে দিনের পর দিন কাটে এবং রাতের
পর রাত চাঁদ ভেসে যায়
পানা পুকুরের
বুকে? দ্যাখো ময়ূরের বিশদ কলাপ
লহমায়
দুপুরে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লেগেছে রাজধানীর হৃদয়ে,
তুমি আজ কার জন্যে করবে বিলাপ?
অনেকেই ভয়ে
মন্দিরে মস্জিদে ঢোকে এবং গির্জায়
নতজানু হয়।
ক’জন সাহসী লোক সাত তাড়াতাড়ি
আগুন নেভাতে যায়।
সারি সারি বাড়ি
এবং দোকানপাটে বয়
আগুনের স্রোত। তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে
কাঁদছো সেখানে জব্দ
দগ্ধ
রাজহাঁস পাখা
ঝাপটাচ্ছে, ওকে বুকে নিবিড় জড়িয়ে
সরে যাও। শহর পড়েছে অঙ্গারের আংরাখা।
অকস্মাৎ
দুপুরের চোখে মেঘ পরায় কাজল,
এক্ষুনি নামবে ঢল
শ্রাবণের, আকাশের বুকে ঝলসায়
বিদ্যুতের সর্পিল করাত;
পাখির বুকের রোম বিস্ফারিত ধারালো হাওয়ায়।
এ মুহূর্তগুলি তুমি মনে
গেঁথে নাও। এই বাড়িটার
বুক আর
পাঁজরের ওপর দু’চোখ
বিশদ বুলিয়ে নাও। সন্ধ্যা হয় হোক,
না জ্বলুক বাতি, এই সাঁঝ
হয়ে থাক ধ্বংসের পরের কারুকাজ,
আকাশ উঠবে ভরে ফের নক্ষত্রের গুঞ্জরণে।
দু’দিন পরেই কোথায় যে চলে যাবে
ধোয়া মোছা ফেলে টেলে, তুমি ফের অনাশ্রয়ে কোথায় দাঁড়াবে?
আমার ঘুমের মধ্যে
আমার ঘুমের মধ্যে শুনি পদধ্বনি গাঢ় রাতে
ঘুম ভাঙে, একবার নয়,
দশবারও নয়,
কেবলি।
দেয়ালে ছায়া দেখে প্রাণের শেকড়ে
লাগে টান, কে এল আমার ঘরে মনের খেয়ালে,
নাকি অন্তর্ধানা কারো
না পেয়ে আমার সাড়া! সাত তাড়াতাড়ি
শয্যা ছেড়ে উঠি, যাই দরজার কাছে,
বারান্দায় কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে? প্রখর শূন্যতা
আমাকে কামড়ে ধরে। ফিরে আসি, আধপড়া বই
হাতে শূই,
বাসি-হয়ে-আসা
ঘুমের ভেতরে যদি বাঁশি বেজে ওঠে অতীতের
বিকেল বেলায়
বিনম্র মাঠের
ঘুম ভেঙে যাবে কি তখন?
রাত্রির ললাটে যার স্পর্শে ফের ফুটবে কুঙ্কুম,
সে এখন অন্তরালে। এখন তো পদধ্বনি শুধু
পদধ্বনি ঘুমের ভেতরে।
যার পদধ্বনি শুনি তাকে যেতে হবে বহুদূরে,
আমিও কি থাকবো এখানে
সারাবেলা ম’জে গেরস্থালি সুরে? যাবো
আমি দূরে তোমারই উদ্দেশে,
হয়তো লঞ্চে যেতে যেতে
তোমার নিবাস
নিমেষে পেরিয়ে যাবো, জানবো না। তুমি
হয়তো কূয়োতলায় মুখ
ধুচ্ছো কিংবা পাল্টাচ্ছো রাতের
বালুচরী শাড়ি, কাঁঠালের গাছে একটি অচিন
পাখি অতিথির নাম ধ’রে ডেকে যাবে,
মনে হবে তোমার এবং
আমি একা ধাবমান লঞ্চ থেকে তাকাবো তোমার
ভূরুর মতোই
দূরবর্তী গ্রামটির দিকে।
আমার ঘুমের মধ্যে শুনি পদধ্বনি, যেন তুমি
আসছো স্তিমিত আঁধারকে
চমকিয়ে, দেখি
বাগ্দি-পাড়া, চার বেহারার ডুলি, জামতলা, পর্দা-
পেরুনো চকিত দৃষ্টি, আমার হৃদয় জুড়ে তোমার কোমল
পদচ্ছাপ। ভোরবেলাকার
মাছের মতোই
তোমার হাতের নড়া দেখলাম, মনে
হলো আর যে-ঘাটে ভিড়লো
লঞ্চ, সেখানে তো ঠিক নামতে চাইনি। এ কোথায়
চলেছি আচ্ছন্নতায়? আমার হাতের ব্যাগ হাঁস
হয়ে উড়ে যায় দূরে; একটি পাখির
গীতাভায় চমকিত চোখ
স্বাগত জানায়, তুমি সাঁঝবাতি জ্বেলে
দাঁড়াও দাওয়ায় একা
এবং আমার ঘুম দীপান্বিতা হয়,
আমার ঘুমের মধ্যে তোমার নিশ্বাস জেগে ওঠে,
আমাকে ক্ষইয়ে দিতে থাকে
ক্রমশ তোমার পদধ্বনি, অন্ধকারে মঞ্জরিত পদধ্বনি।
তোমাকে দেখি না আমি, দেখি
তোমার নির্জন রাত্রিরূপময় পদধ্বনিকেই।
আমি উঠে এসেছি সৎকারবিহীন
একজন আধবুড়ো লোক, চাঁদকপালি গরু,
কতিপয় পাখি আর মুর্গির বাচ্চার জন্যে কান-খাড়া করা
বালক,
আকাশী রঙের শাড়িপরা বানডাকা নদীর মতো
এক তন্বী তৈরি করেছিল চমৎকার দৃশ্য।
এখন সেখানে হারিয়ে-যাওয়ার নিঃস্ব হাহাকার।
ওরা কেউ আজ নেই, সাঁঝবাতি নিয়ে দাওয়ায়
দাঁড়াবে কে? ওরা যেন
অনেক আগেকার সুর, পুরানো সারিন্দায় বাজানো,
কোনো আনাড়ি বাদকের হাত থেকে নিঃসৃত।
যে-ভাষা নদীর, হাওয়ার, নদী তীরবর্তী কাশফুলের,
কবরের ঘাসের, যে ভাষা নীরবতার,
সে ভাষায় আমি আজ কথা বলছি
হে নগরবাসী। হে ঝলমলে শহরের নাগরিকবৃন্দ,
আমিও নেই,
তবু উঠে এসেছি, সৎকারবিহীন। আমি কোনো অভিযোগ
নিয়ে আসি নি, আমার কোনো দাবি নেই
সরকারি বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে। শুধু চাই,
একবার আমার দিকে তাকান
ভালো ক’রে, চোখ-কান খোলা রাখুন; আমিও
পুরুষোত্তমের মতো করাতে পারি বিশ্বদর্শন। কেউ
আমার প্রতি করুণা বর্ষণ করুন
চাই না আমি; সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আমি আসি,
চলে যাই হাওয়ার ঝাপটার মতো।
এখন অগ্নি আমাকে পোড়াতে পারে না, জলেরও ক্ষমতা নেই
আমাকে ডোবানোর, মাটি
করতে পারে না গ্রাস। আমার পায়ের পাতা নেই যে,
মাছ ঠোকরাবে, চোখের মণি নেই যে,
উপরে নেবে দাঁড়কাক, আমার মেদমজ্জা নেই যে
খুবলে নেবে শেয়াল কুকুর।
অথচ দেখতে পাই সবকিছু, শুনতেও অসুবিধা হয় না;
যেখানেই যাই
কানে আসে বাঁচাও বাঁচাও ধ্বনি, অথবা হতে পারে
আমি নিজেই সেই ধ্বনি। সারাক্ষণ দেখি,
একটা রেসক্যু বোট পাক খাচ্ছে মধ্যযুগের রাত্রির ঘূর্ণিস্রোতে,
কেবলি দূরে সরে যাচ্ছে আমার প্রসারিত হাত থেকে, বহু দূরে।
অথচ এখন আমার
কোনো রেসক্যু বোট কিংবা লাল বয়ার প্রয়োজন নেই।
খুব বেশিদিন কি বেঁচেছিলাম?
এখন আমি ভাবি একটা নিকানো উঠোনের কথা,
পুকুরে নুয়ে-পড়া ডাল, ডাগর লাউয়ের মাচান,
মাদুরে মনসুর বয়াতীর কথা, ধোঁয়া-ওঠা
লালচে ভাত, সোনালি শুরুয়ায় ডুবে থাকা
এক টুকরো মাছের কথা। লোকে বলে,
গানের গলা ছিল আমার আমি সেই গানের কথাও ভাবি।
কিন্তু আমার সব কিছু ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে,
এমনকি আমার কণ্ঠস্বরও। আজ আমি
কথা বলি নদী, হাওয়া, কাশফুল, কবরের ঘাস আর
নীরবতার ভাষায়।