রেডক্রসের গাড়ি এবং তুমি
রেডক্রসের গাড়ি ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো
চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল
মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে।
সেই গাড়িটার ভেতরে আশ্রয় পেলে আপাতত
বেঁচে যেতাম। ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী
আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, নতজানু…
রেডক্রসের গাড়ি আমাকে নিয়ে যাক
মেঘে মেঘে, দূর নীলিমায়।
রেডক্রসের গাড়ি এ মুহূর্তে আমার মন্ত্রোচ্চারণ,
অকস্মাৎ এই মরু-মধ্যাহ্নে মনে হল,
তুমি তোমার হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে
একটা চিকচিকে মরীচিকাকে মুছে ফেলে
হৃদয়ের মতো অন্তরঙ্গ হাতের তালুতে।
এই শহরের সবচেয়ে সুন্দর পাখি, ইদানীং
পাখি বড় একটা চোখে পড়ে না-
গান গেয়ে আমাকে বলেছিল ফিরে এসো।
একটি বেহালা করুণ সুরে আর্তনাদ করে উঠেছিল-
তোমার প্রতীক্ষায় আমি বাজব অষ্টপ্রহর;
পার্ক ডেকে বলেছিল, তোমার জন্যেই উন্মাচিত আমি,
ফিরে এসো। আমি ওদের ডাকে সাড়া দিইনি।
তোমার ওষ্ঠ যদি বলি, তবে আমি
কোনো সেবাসদন কিংবা রেডক্রসের গাড়ির স্বপ্ন দেখব না,
ছুটে আসব আবার।
আমি লিখছি অন্ধকার রাত্রির হৃৎপিণ্ডের ভেতরে ব’সে।
কবেকার রাস্তায় দেখা ঘোড়ার জৈবিক গন্ধ, একলা ঘরে
একজন বামনের কড়িকাঠ-ছোঁয়া উল্লাস,
আর সেসব পাখি যারা বিল ছেড়ে উড়ে যায়
আমার স্বপ্নের ভেতরে,
ক’জন তাসুড়ের বর্মী টেবিল ঘিরে ঘণ্টা ঘণ্টাব্যাপী বসে-থাকা,
হাওয়ায় ফুলে-ওঠা জকির রঙিন জামা আর রাজপথে
বয়ে-যাওয়া তরুণ বীরের রক্তস্রোত
মেশে আমার পঙ্ক্তিমালায়, কখনো কখনো
কাগজ-কলম নিয়ে সে থাকি সারারাত,
সাদা পাতার দিএক চেয়ে থাকি প্রহরের পর প্রহর
যেমন কৃষক তার শূন্য ক্ষেতের দিকে-কী করুণ আর ক্লান্ত।
একটা রেডক্রসের গাড়ি ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো
চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল রাত্রিকে
টুকরো টুকরো করে।
হঠাৎ আমার চোখে মুখে রাগে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস,
আমার কবিতার খাতায় ঠিকরে পড়ে
তোমার চোখের জ্যোতি , তোমার চোখের জ্যোতি,
তোমার চোখের জ্যোতি।
সে এক মাটির ঘর
আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম এই শহরের অখ্যাত গলির
এক মাটির ঘরে;
এতকাল পরেও হঠাৎ যখন আমার হাত
নিজের অজান্তেই নাকের কাছে এসে যায়,
একটা মন-কেমন করা সোঁদা গন্ধ পাই।
যে ঘরে প্রথম চোখ মেলেছিলাম
কার্তিকের রৌদ্রে, সে-ঘরে পড়ত একটা গেয়ারা
গাছের ছায়া,
সে ছায়া এখনও ঘন হয়ে আছে আমার চোখে।
এখনও পেয়ারা গাছের আনন্দিত সবুজ পাতাগুলি
মর্মরিত আমার শিরায় শিরায়।
গাছটার ডালে অনেক দূর থেকে-আসা পাখি
যে সুর ঝরিয়ে দিত ঋতুতে-ঋতুতে
তা’ এখনও খুব গুঞ্জরণময় স্মৃতিতে আমার।
যে-ঘরে আমি জন্মেছিলাম তাকে
কিছুতেই বলা যাবে না গানের ঘর। সে ঘরে
সেতার কি সরোদ,
এস্রাজ কি সারেঙ্গি গুমরে ওঠেনি কোনো দিন।
কখনো বোল ফোটেনি তবলায় কিংবা কারো কণ্ঠে
জাগেনি চমকিলা কোনো তানকারি।
তবে ছেলেবেলায় আমাদের সরু গলিতে
সেই কবে কোন মধ্যরাতে কে পথিক আমার মনের ভেতর
সুদূর এক নদীতীরের ছবি জাগিয়ে
হেঁটে গিয়েছিল, আজও মনে পড়ে।
আজও কোনো-কোনো রাতে যখন আমার ঘুম আসে না
কিংবা মন ভালো থাকে না, হঠাৎ
আমি শুনতে পাই
রাতের গলায় দরবারি কানাড়া, পায়ে স্বপ্নের নূপুর।
এবং একজন মানুষের পুতুলনাচ
ঝলসে ওঠে বারংবার। হ্যাঁ, চিনতে পারছি এঁকে;
এই লোকটাই কৈশোরে চুল ছেঁটে দিত আমার
সাবান, ফিটকিরি আর সস্তা পাউডারের
ঘ্রাণময় সেলুনে। ওর মাথায় পাগড়ি, যুগল ভোজালির মতো
উচ্চকিত গোঁফ, তার সালোয়ারের ভাঁজে ভাঁজে সুদূর
পাহাড়ি কোনো দেশের নানা চিত্রকল্প।
এখন আমার ঘর কাঁটা চুলের স্তূপে নিমজ্জিত; সেই স্তূপ
থেকে এই মাত্র উঠে এলো এক নারী, যার গ্রীবায়
মীরার ভজনের ছায়া, দু’চোখের যমজ গোলাপ,
ওষ্ঠে চন্দ্রভস্ম। সে এক মাটির ঘরে প্রবেশ করে
আস্তেসুস্থে আমার অভিলাষকে উসকে দিয়ে।
কখনো দেখি, সে মাটির ঘরের দিকে স্মৃতি ফিরিয়ে দেখি,
আমার আশার গুচ্ছ-গুচ্ছ মঞ্জরি
ইলেকট্রিকের তারে আটকে-থাকা ঘুড়ির মতো
ক্রমশ বিবর্ণ হচ্ছে, কখনোবা চাঁদকে বিশ্বাস করে দেখি
পূর্ণিমা চাঁদের মতো টেবিলের দু’দিকে দু’জন নাবিক
খেলছে রামি; একজনের চোখ থেকে ঝুলছে
অত্যন্ত পাথুরে স্বপ্ন, অন্যজনের ঠোঁট থেকে ঝুলছে
ঈগলের চঞ্চুর মতো পাইপ।
মেশকে আম্বরের অস্পষ্ট ঘ্রাণময় আতরদানি,
হুঁকোর দীঘল নল, পোষা পায়রা, তাকে-রাখা বিষাদসিন্ধু,
একটি চোখ
আমার নানার কণ্ঠনিঃসৃত সুবে-সাদেকের মতো আয়াত,
নানীর দীর্ঘশ্বাসসমেত
সেই মাটির ঘর এখন আমার উদরে।
সেই ঘরের কথা ভাবতে গিয়ে আমি সে ঘর আর দেখি না।
সে কোন সুদূরে
কোনো কোনো ভোর কীভাবে যে শুরু হয়!
লগ কেবিনের বাইরে এলেই পর্বতমালা,
শুভ্র পাগড়ি-পরা কতিপয় সান্ত্রীর মতো
নিথর দাঁড়ানো। তুষারবন্দি হ্রদের সীমানা
পেরিয়ে সহসা ভেসে আসে দূর পর্বতী নিঃশ্বাস।
আমাকে জড়ায় সে কোন সুদূর মরুবাসিনী ছায়া!
কাঠবিড়ালিটা কেবিনের দোরে মৃদু ছুটে আসে,
ভিনদেশী এক মানুষের দিকে কেমন তাকায়
আবার পালায়। মনে পড়ে দূরে ফেলে-আসা পথ,
মুখের ওপর চুলের প্লাবন, কালো রাত্তির-আলো করা হাসি।
আমার হৃদয়ে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
জায়গাটা গুণী কম্পোজারের সিম্ফনি যেন।
কফি শপে ভাসে নানা দেশী ভাষা। কারো কারো চোখে
চোখ পড়ে কারো। রুপালি চামচ প্লেটের বাজে আর
বাইরে এখন ঝলমলে দিন। মনে পড়ে সেই
বোস্টনে-দেখ কোন সে বিহানে ফুটপাতে একা
অন্ধ যুবার ত্র্যাকর্ডিয়ানে নিকেল-কুড়ানো সুর।
সত্তায় নামে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
কোনো কোনো ভোর কীভাবে যে শুরু হয়!
সুকান্ত সেই কিশোরের মুখ করোটি আজকে
আমার টেবিলে করোটি কেবলি চেয়ে থাকে আর
বলে দ্যাখো ঐ কবরেও দ্যাখো পুষ্পের বিপ্লব।
যে যায় অমন উদাস একলা, সে কি একেবারে
একা একা যায়? যায় না কি তার সঙ্গে কিছুটা
আলোছায়া কিছু মনে-পড়া আর বিধুর বেহাগী রেশ?
আমাকে নাওয়ায় সে-কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
কখনো-সখনো ধূসর পূর্ব পুরুষের কালো গোরস্তানের
পাশ দিয়ে আমি শিস দিয়ে যাই, চমকে তাকাই
কখনো হঠাৎ। ছিলেন তো ওরা আটচালা ঘরে,
পুকুরে রোজানা
করতেন ওজু, মসজিদে ছিল যৌথ সেজদা।
পুকুরের দিকে
তাকাতেন আর দেখতেন কিছু মাছের রুপালি লাফ।
আমার ওপরে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
উদাস পুকুর এমন হিংস্র আগে কে জানত?
আমার পায়েও খেয়েছে সে চুমো, নিয়েছে আমার
নানা বয়সে মাথাটার ঘ্রাণ শত শতবার।
হঠাৎ কেন সে আমার বুকের কিশোরকে নিল?
মেটাতে তার সে উনিশ শতকী রহস্যময় খলখলে ক্ষুধা
আমাকেই কেন দিতে হ’ল ভোগ, দিতে হল ভোগ আজ?
আমার দু’চোখে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
ট্রেন থেকে মুখ বাড়িয়ে এবং গুডবাই হাত
নাড়তে নাড়তে চলে যাই আমি ছায়ার মতোই।
কোথায় যে যাই। আকাশের চাঁদ মাতালের চোখ,
আমার মগজে দাবানল আর সত্তার সব তন্তু ছিন্ন-
একটু শান্তি পাব কি কোথাও এমন দগ্ধ
পারিপার্শ্বেকে? সম্মুখে নেই ওয়েসিস কোনো, শুধু মরুভূমি
উগড়ে দিচ্ছে বিষধর সাপ আর নৃসিংহ দারুণ উগ্রতায়।
আমার নিয়তি সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!