- বইয়ের নামঃ উজাড় বাগানে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অত উঁচুতে তুলে দিয়েছ
আমি তো ছিলাম খুব নিচে
সামান্য
নিজস্ব নিয়ে। গুবরে পোকার
নিঃশব্দ চলা, কাছের
কলা গাছের পাতায় রোদের
চিকন পিছলে-যাওয়া,
হাওয়ায় পাতার নড়া দেখে,
বন্ধুর হাতে হাত রেখে,
কাগজের নৌকো বানিয়ে,
তা’ নিয়ে শিশুকে
আনন্দমেলায়
এনে চৌকো ছায়ায় কাটত
আমার বেলা। আমি তো
এমনই ছিলাম।
তোমরা আমাকে হঠাৎ করে
খুব উঁচুতে তুলে দিয়েছ।
এখন আমাকে মেঘ আদর
বুলোয় ক্ষণে ক্ষণে,
নক্ষত্রেরা প্রদক্ষিণ করে
আমাকে,
কালপুরুষ হাত রাখে আমার
মাথায়।
বড় বিব্রত আমি; তোমরা
আমাকে খুব উঁচুতে
তুলে দিয়েছ, ঈগলেরও সাধ্য
নেই আমাকে ছোঁয়,
বিমান আমার পায়ের অনেক
অনেক নিচে উড়ে যায় এবং
ছায়াপথে আমার নিত্যদিনের
হাঁটা।
নিচে তাকাতে পারি না, মাথা
বোঁ বোঁ লাটিম, ভয় হয় কখন
নক্ষত্রগুলো
ঠোকরাতে শুরু করে,
কালপুরুষ যায় ক্ষেপে। হয়ত
ছায়াপথ হবে ভাঙা সাঁকো,
পা হড়কে যাব প’ড়ে।
অত উঁচু থেকে ধুলোয় মুখ
থুবড়ে পড়ার আশঙ্কায়
সর্বক্ষণ কাঁপি তুষার-ঝড়ে
আটকে-থাকা
মানুষের মতো। আমার
নিদারুণ পতনে উল্লসিত
লোকজনের
হাঃ! হাঃ! হাসির কামড়ের
কথা ভেবে আমি দুঃস্বপ্নগ্রস্ত।
১২.৪.৯৪
অন্য কোনো সাক্ষী নেই
সত্তায় নিঝুম গোধূলির প্রলেপ
নিয়ে
নিঃশব্দে পা রাখলাম ঘরে।
তুমি একলা বসেছিলে খাটের
উপর
দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে।
নীরবতা কোনো
কোমল প্রাণীর মতো লেহন
করছিলো
তোমার হাত, মুখ, বুক,
নাভিমূল, নিতম্ব আর
পায়ের রাঙা পাতা। মনে
হলো, তুমি
নীরবতার লাল-ঝরানো আদর
বেশ
উপভোগ করছিলে আচার
খাওয়ার ধরনে। আমি
নিস্তব্ধতার জল কেটে এগিয়ে
গেলাম তোমার দিকে।
স্পর্শ করলাম তোমাকে,
যেমন কোনো
সুরসাধক গভীর অনুরাগে
তার বাদ্যযন্ত্রের তার
স্পর্শ করেন অভীষ্ট সুর বাঁধার
জন্যে।
যখন তোমাকে ছুঁই, মনে হয়
এবারই
আমার প্রথম ছোঁয়া। আমার
কেলিপরায়ণ হাত
তোমার হাতের কানে কানে
কী এক গানের নিভৃত কলি
গুন্গুনিয়ে যাত্রা করে স্তনের
দিকে।
আমার মুঠোর ভেতর তোমার
স্তন
পায়রার মতো ছটফট করে
নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যে।
তোমার ঠোঁটে আমার ঠোঁট,
কখনো আমার জিভ
তোমার মুখের ভেতরে মাছ
হয়, কখনো
তোমার জিভ আমার মুখের
গহ্বরে
অন্ধ পাখির মতো ডানা
ঝাপটায় এবং
আমার ভালোবাসা
সন্তের মতো প্রজ্বলনের বলয়
ভেদ করে
তোমার অস্তিত্বের গভীরতম
প্রদেশে নবীন অতিথি।
সেই মুহূর্তে তোমার শরীরে
ফোটে
প্রথম কদম ফুল, জ্বলজ্বল
করে হাজার তারা;
সেই মুহূর্তে তোমার শরীরে
জ্যোৎস্নাধোয়া আরণ্যক
শোভা। তোমার
শরীর তখন বরফ-গলা নদী।
কী ক’রে দেখাবো
অন্য কাউকে এই অনুপম
দৃশ্য? কাকে বিশ্বাস করাবো
এ-কথা?
দূরের আকাশ, চার দেয়াল,
শয্যার বিস্রস্ত চাদর বুক
শেল্ফ্ এবং
টিভি সেট ছাড়া অন্য কোনো
সাক্ষী নিএ এই গহন
সৌন্দর্যের।
আমার আঁজলা
সারা ঘরে মিশ্র গুঞ্জন, তুমি
এক কোণে বসেছিলে
সৌন্দর্যের তরঙ্গ তুলে।
টেবিলে তোমার হাত, হাতে
ডিম্বাকৃতি হ’য়ে পড়ছে
টেবিল ল্যাম্পের আলো,
তোমার খোঁপায় বেলফুলের
মালা
ঘোষণা করছে সজীবতা।
আলো, তোমার চুল,
গ্রীবা আর টেবিলে ব’য়ে
যাচ্ছে
ওস্তাদের ছায়ানট এবং তুমি
রূপান্তরিত হচ্ছো গীতধারায়,
যেখানে ভরে উঠল আমার
আঁজলা।
আমার জীবন আমি
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
আনন্দ নিবাসে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বিষাদের ঘরে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
পথের ধুলায় হেঁটে আর
ঘাসে শুয়ে থেকে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
নালনের আখড়ায়, হাসন
রাজার
উৎসবের ফুল্ল কলরবে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বদ্ধ ঘরে বড়ো একা-একা।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
গ্রীষ্মে পুড়ে-পুড়ে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
উন্মুক্ত মাথায় নিয়ে বুনো
বর্ষাকাল।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
ভীষণ নৈঃশব্দ্যে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
গানের ঝর্নাতলায় অস্তিত্ব
ভিজিয়ে
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বিপুল রবীন্দ্রবিশ্ব পর্যটন
ক’রে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
আধুনিকদের, সুন্দরের আর
সত্যের সন্ধানে।
আমার জীবন কাটিয়ে দিয়েছি
শক্রতার সঙ্গে দাবা খেলে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বন্ধুত্বের প্রসন্ন ছায়ায়।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
স্বপ্নের সোপান গ’ড়ে প্রহরে
প্রহরে
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
দুঃস্বপ্নের বহু চোরাবালিতে
তলিয়ে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
গদ্যময় এবড়োখেবড়ো দীর্ঘ
পথে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
কবিতা নামের কামিনীর সঙ্গে
রূপ-সরোবরে
কখনো সাঁতার কেটে, কখনো
গহীন
জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘুরে, কখনো
নৌকায় মুখোমুখি
অচিন নদীর খরস্রোতে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
জীবনের বাঁশি শুনে শুনে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
মরণের সঙ্গে প্রায় কানামাছি
খেলে।
২১.৩.৯৪
আমার মুঠোয়
ক’দিন ধ’রে আমার কবিতা
তোমাকে অবিরত
ডেকে-ডেকে গলা ক্ষতার্ত
ক’রে ফেলেছে, প্রিয়তমা।
তোমার জন্যে কেঁদে-কেঁদে
আমার হৃদয়ের চোখ
এখন ভয়ানক লাল আর
ফোলা।
তুমি কি জানো ক’দিন
ধ’রে
তোমার জন্যে আমার ঘরের
চার দেয়াল, জানালা,
বাতি আর বুকশেল্ফের মন
ভালো নেই?
এখনো কি আমি আবেগের
দাস হ’য়ে থাকবো?
কই, আজো তো তোমার
কোন সাড়া নেই। কতদিন
হ’য়ে গেলো, তোমার কোনো
তাড়া নেই
আমার উদ্দেশে অক্ষরের ফুল
ফোটাবার।
আমাকে সামান্য কিছু অক্ষর
উপহার
দেওয়ার ইচ্ছেটাই হয়তো
ম’রে গেছে তোমার।
এরই মধ্যে আমাকে দেখতে
হলো,
হায়, এরই মধ্যে আমাকে
দেখতে হ’লো আমার মুঠোয়
পুষ্পসারের বদলে চিতাভষ্ম!
আলোকলতার মূল
বড় রুখা সুখা সেই শহর,
অথচ সেখানে যাওয়ার সাধ
আমার চুড়াস্পর্শী।
বড় রুঠা সেই শহর,
তবু জানি সেখানে কোথাও
হৃদয়-জাগানো
স্মিত জলধারা বয় অষ্টপ্রহর,
সেখানে
লাবণ্য ব’সে থাকে আমার
কবিতার ওপারে,
মাধুর্য শয্যায় শুয়ে পত্র রচনা
করে
অস্তাচলের উদ্দেশে,
সুন্দরের কণ্ঠ সজীব হয়
গানে। সেখানে প্রোথিত
অলোকসামান্য
আলোকলতার মূল।
রুখা সুখা সেই শহরে ঘুরি
একা-একা
সারা দিনমান অমৃত ধারার
উৎস সন্ধানে।
এখানে যাই কায়ক্লেশে শ্রান্ত,
সেখানে শুধাই
ব্যাকুল কণ্ঠস্বর হ’য়ে; সবাই
নিরুত্তর।
কেউ কেউ, মনে হয়,
আমাকে প্রতারিত
করে ওদের ছায়াচ্ছন্ন
নীরবতায়।
ওদের উদাসীন দৃষ্টি আর
নীরবতাকে
পরাজিত করে আকণ্ঠ শুষে
নিই অন্ধকার,
রটনা আর বিদ্রুপকে
পুষ্পসার বানিয়ে দেখি,
আমি আলোকলতার মূলে
দাঁড়ানো
বিরস ঐ দূরের শহরে, অমৃত
ধারায় আমার অবগাহন।
উজাড় বাগানে
হাওয়ার হাত আমাকে
ঠেলতে-ঠেলতে
দাঁড় করিয়ে দিলো
এক উজাড় বাগানের মুখে।
শুনতে পেলাম না
কোনো পাখির গান, ফুলের
ঘ্রাণ
আমাকে জড়িয়ে ধরেনি বসন্ত
বাহারের তানের ধরনে,
সংলাপের ফিস ফিস পৌঁছেনি
কানে।
নিস্তব্ধতার জিভ আমাকে
লেহন করছে কোমন কোনো
প্রাণীর মতো,
আমার সারা শরীর বুজে
আসে। প্রায় টলতে-টলতে
প্রবেশ করি জনমানব শূন্য
বাগানে; এ কেমন
সাঁঝ আজ নির্জন পথের
গ্রীবায়
লেপ্টে থাকে? সময়ের কাঁধে
ঝুঁকে আছে স্মৃতির
জোনাকিপুঞ্জ
কয়েকটি গাছ দুর্ভিক্ষ পীড়িত
নারীর
কংকাল যেন, ত্রাণের
প্রত্যাশায়
বিশুষ্ক, কাতর। কবেকার
ক’টি শুকনো পাতা কুড়িয়ে
আবার রেখে দিই ঘাসমাটির
চোখের কোটরে। একটি আর্ত
স্বর আমার বুকে ভীষণ
হিম ঝরিয়ে মিলিয়ে যায়
হাওয়ার অন্ধকারে।
বেরিয়ে যেতে চাই বেগানা
বাগানা থেকে,
অথচ আমার পা দুটো অনড়।
গা ঝাড়া দেবো, তার জো
নেই; আমার হাতে
নিরাশার হাতকড়া, পায়ে
মনস্তাপের শেকল। গলা ছেড়ে
গান গাইতে
চাইলাম, কার কর্কশ হাত
চেপে ধরে আমার মুখ।
বাইরে কোথাও আমার জন্যে
অপেক্ষমাণ সুপ্রিয়া কবিতা,
শিরায় অনুভব করি
তার আবছা উপস্থিতি। বেশ
কিছুদিন তার মুখ
দেখি না; প্রাণ জিভের ডগায়
এনে
তাকে ডাকি। হঠাৎ আমার
চারদিকে
কয়েকটি দোয়েল, প্রজাপতি
আর ভ্রমরের চঞ্চলতা।
২০.১১.৯৪
এ এক রহস্য আমার কাছে
চাইকোভস্কির সোয়ান লেকের
প্রধান রাজহংসীর
ভঙ্গি আত্মস্থ ক’রে এগিয়ে
এলে
আমার কাছে। বললাম বটে,
কিন্তু এই অঙ্গসঞ্চালনে
সচেতন
প্রয়াসের কোনো চিহ্নই নেই।
পদ্মের উন্মীলনের মতো
সহজ আর স্বাভাবিক তোমার
হাতের নড়া,
গ্রীবার মুদ্রা।
তোমার হাতে লৌকিকতা
দোয়েলের মতো সঙ্গীতমুখর;
ট্রের বিস্কুট, মিষ্টান্ন আর
আপেলের ফালি
সন্ধ্যার গভীরতাকে আমার
চোখে
ভিন্ন মাত্রায় স্থাপন করেছিল,
মনে পড়ে। তোমার
ঈষৎ অসুস্থতা তোমাকে
আরো বেশি
মোহনীয় করার শপথ
নিয়েছিল যেন। টেবিলে রাখা
অখণ্ড
গীতবিতান তার সকল
ঐশ্বর্যকে
উজাড় ক’রে দিতে পারে
এত সহজে তোমার কণ্ঠে,
ভাবিনি।
আমি প্রায় কিছুই না খেয়ে
চায়ের কাপের দিকে হাত
বাড়াই
একটু চলকে উঠে সোনালী
চা, চুমুক দিয়ে তরল উষ্ণতা
জিভে ধারণ ক’রে তোমাকে
দেখে নিই এক ঝলক। এই
নিবিড় ব্যাকুল
তাকানো বহু মাইলের
দূরত্বকে মুছে ফেলে
লহমায়। তুমি আমার দিকে
তাকিয়ে হাসলে, আমার
সম্মুখে
খুলে গেল সুলেমানের
রত্নভাণ্ডারের দ্বার। তোমার
পায়ের কাছে
আমার শিষ্টাচার শীয়ামিজ
বেড়াল। তোমার নাভিমূল
ছুঁয়ে
একটি প্রজাপতি আমার
অধরের কম্পনকে জানিয়ে
দেয়
অপরূপ সরোবরের রহস্যময়
কামনা। প্রজাপতির বার্তা
আমি আমার
নিঃসঙ্গতার ছায়ায় লুকিয়ে
সুজনি-ঢাকা তক্তপোশ ছেড়ে
উঠে দাঁড়াই।
আধ ঘন্টার লোকাচারস্পৃষ্ট
এই একটুখানি দেখা
আমার কাছে হ’য়ে ওঠে
মোহন সবক। তোমার
দু’চোখের
চাউনি দর্শনের জটিল সূত্রকে
বেনেকাব ক’রে দেয়,
তোমার যুগল ভুরুর
সন্ধিস্থলের রহস্যময়তা
ইতিহাসের
কোনো লুপ্ত অধ্যায়কে
জাগিয়ে তোলে এবং তোমার
হাসির
বিদ্যুচ্চমক আমাকে পথ
দেখায় বিভ্রান্তির
গোলকধাঁধায়। তোমার
আবৃত্তি আর গান কী ক’রে
যে আমাকে
স্বদেশকে ঘনিষ্ঠ চিনতে
শেখায়, এ এক রহস্য আমার
কাছে।
২৪.৩.৯৪
এ জীবন আমার নয়
এই হৈ-হল্লা, দৌড় ঝাঁপ,
নানা দিকে
ছুটে বেড়ানো,
মাইক্রোফোনের
সামনে দাঁড়ানো যখন তখন,
বক্তার সামনে ব’সে পা
দোলানো,
আমার বক্তৃতার ফাঁকে হাই
তোলা ঝিমোনো-
এ জীবন আমার নয়।
গলির মোড়ে দাঁড়ানো,
যাত্রীময় ধাবমান বাস দেখা,
রিক্স-অলার সঙ্গে
ভাড়া ঠিক করা,
হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস
থেকে
ঝরা ফুল কুড়ানো,
অন্ধকারে শিস দিয়ে বাড়ি
ফেরা-
এ জীবন আমার নয়।
বইয়ে ডুবে-থাকা,
রোজ সকালে আদ্যোপান্ত
খররের কাগজ পড়া,
সংসারের ব্যয় কমানোর পন্থা
নিয়ে
স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করা
মাঝে-মাঝে আড্ডা দেওয়া,
সবুরে মেওয়া ফলার স্বপ্ন দেখা
-এ জীবন আমার নয়।
দু’বছরের শিশুকে খানিক
আদর করা,
চিঠির জবাব লেখা টেবিলে
ঝুঁকে,
দুপুরে পুকুরের জলে ঢিল
ছুঁড়ে
বিলীয়মান বৃত্ত দেখা,
মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে
জেগে উঠে
আকাশের দিকে তাকানো-
আমার ভেতরকার একজন
বলে সোজাসাপটা
-এ জীবন আমার নয়।
কী তবে আমার জীবন?
কী তবে আমার জীবন?
প্রশ্ন করি নিজেকে, নির্ঘুম
কাটাই
বিছানায়। চারদেয়াল আমার
দিকে হেঁটে আসে।
যে-জীবন আমি যাপন করেছি
এতকাল, যে-জীবন যাপন
করি
এ আমার জীবন নয় ব’লে
আমি তড়িঘড়ি
কুয়াশাময় প্ল্যাটফর্মে ভুল
ট্রেনে উঠে পড়ি।
৯.১২.৯৩
একজন বৃষ্টিভেজা লোক
সন্ধেবেলা একজন বৃষ্টিভেজা
লোক বহুদূর
থেকে তার পায়ের ঘুঙুর
বাজাতে বাজাতে এসে থামে
আমার নিবাসে। তাকে
স্বাগত জানাব নাকি
তাচ্ছিল্যের ছাঁটে
রাখব দূরত্বে,-এই দোটানার
দোলক থামিয়ে
বলি মৃদু হেসে, ‘আপনি কি
ক্লান্ত খুব হে বাউল?’
চায়ের উষ্ণতা তাকে পায়ের
ঘুঙুর তাৎক্ষণিক
বাজাতে উদ্বদ্ধ করে। বইপত্র,
দেয়ালের ছবি,
আসবাব-সব কিছু
উদাসীনতায়
নিঝুম ভাসিয়ে তিনি কথা
আর সুরের মঞ্জরী
ফোটালেন লহমায়। আমি
তার গৈরিক নৃত্যের
ঘূর্ণিত আভায় আচানক দেখে
ফেলি দাঁড়ানো লালন সাঁই।
৭.৩.৯৩
একটি বাদামি খাম
ভোরবেলা আবীরমাখা রাস্তার
মোড়ে দাঁড়িয়ে
আমি মেঘনার তীরভূমি আর
পাখি-ছাওয়া চরের কথা
ভাবছিলাম। আমার মনে
পড়ছিল বাস্কেটবল
খেলোয়াড়ের ত্বরিৎ
লাফিয়ে ওঠার মতো ঢেউ,
অনেকগুলো নৌকার
উজান যাত্রা, নানা রঙের
পাল আর
হঠাৎ তরুণ রুইয়ের
ঝলসানি। পলাশতলীর তীরে
দাঁড়ানো
যমজ দু’টি অস্পষ্ট গাছের
কথাও
আমার স্মৃতিতে ছায়া বিস্তার
করছিল।
তন্ময় আমি, ট্রাফিক তখনো
ক্রুদ্ধ জন্তুর মতো
গর্জে ওঠেনি। একটি পাখি
ঈষৎ সুর ঝরিয়ে উধাও
কোথাও; কে কখন
আমার হাতে একটি বাদামি
খাম ধরিয়ে দিয়ে গোয়েন্দার
ভঙ্গিতে হাওয়ায় মিশে গেলো
বুঝতে পারিনি। সেই খাম
আমার হাতে কবুতরের পাখার
মতো
কাঁপছে অভিমাত্রার
আকর্ষণে। বুঝলাম, নিজেরই
অজান্তে
এক হিরন্ময় বার্তা পৌঁছে
দেওয়ার গুরুভার বইছি।
কাকে বা কাদের এই
খামে-ঢাকা বার্তা আমাকে
পৌঁছে দিতে হবে, জানি না।
অন্তর্গত কুয়াশার
আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা
আলো আমাকে
জানিয়ে দেয়, ওরা অনেকজন
অনেকক্ষণ ধরে প্রতীক্ষারত
আমার হস্তধৃত বার্তার জন্যে।
আমার ভেতরকার
বার্তাবহ উদ্দাম চঞ্চল হয়ে
ওঠে আরবী ঘোড়ার পেশীর
মতো।
একটি পাখি কাঁধে বসে
আমাকে বলে, ‘এই বাদামি
খাম
আমাকে দাও, চঞ্চুতে গেঁথে
নিয়ে যাই কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়।
পাখির কথায় কর্ণপাত না
করে
আমি হাঁটতে থাকি সামনের
দিকে। ভোরবেলার হাওয়া
মিনতি জানায় বার্তাবহ
হওয়ার। আমি তার মিনতি
অগ্রাহ্য করে বাদামি খাম ধরে
রাখি শক্ত মুঠোয়।
দূরে কোথাও অনেকগুলো
ঘন্টা একসঙ্গে বাজতে থাকে,
যেন আমার
পূর্বপুরুষদের কণ্ঠস্বর।
বনজ্যোৎস্নায় বিলুপ্তপ্রায়
কৌমের বসন্তদিনের নাচ,
আমার মাথার উপর
দেবদূতের মুখমন্ডলের মতো
নিষ্কাম চাঁদ।
হেঁটে যেতে যেতে আমার পা
দু’টো ভীষণ ক্লান্ত রক্তবমনে,
আমার দু’চোখ জুড়ে নামছে
মহাস্থানগড়ের ঘুম,
খর তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুক।
হায় বিষাদসিন্ধু, তবু আমাকে
পৌঁছতে হবে
সুবর্ণ নদীর সেই মোহনায়,
যেখানে
হিরন্ময় এক বার্তার জন্যে
সেই কবে থেকে প্রতীক্ষারত
অগণিত মানুষ, যাদের পায়ের
উপর দিয়ে বয়ে চলেছে
আদিম জলধারা।
১৩.৩.৯৩
একটি ভুলের দাক্ষিণ্যে
যদি বলি, কী সুন্দর তুমি,
তবে কি
বিব্রত হবে খুব?
কোমল নত হবে তোমার
মাথা?
তুমিতো নিজেই জানো,
সৌন্দর্য তোমাকে সর্বদা
জড়িয়ে রাখে আদরে।
যখন তুমি অতি সাধারণ
কথাও বলো, নিমেষে
তুচ্ছতা স্পর্শ করে সুনীল
উচ্চতাকে। যখন তাকাও
গাছের পাতা,
সপ্তর্ষিমন্ডল অথবা আমার
দিকে, সৌন্দর্য ঝরে সবখানে।
তোমার
উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের
আড়ালে গড়ে ওঠে মধুচক্র।
তোমার বাচনভঙ্গি। কী উপমা
খুঁজব তার?
যেন ঝর্নাধারা বয়ে যায় সবুজ
উপত্যকায়,
কণিকার গায়কি হয়ে ওঠে
তোমার স্নিগ্ধ বাক্যের প্রতিটি
পর্ব আর যতি।
এই মুহূর্তে তুমি আমার কাছে
বসে নেই, কত দূরে তুমি।
তবু তোমাকে দেখছি আমি,
হাঁটছো সুরুচির
বাতাবরণে; তুমি মুদ্রিত
আমার ভেতর। মৃত্যু ছাড়া
কার এমন সাধ্য মুছে ফেলে
সেই অপরূপ প্রতিকৃতি?
আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি,
তুমি
বসে আছ একা, গুছিয়ে নিচ্ছ
শাড়ির আঁচল,
এই তো তোমার মাথা ঈষৎ
হেলে গেছে
পেছনে, জুড়োলো ভোরবেলার
কফি।
আগে কি জানতাম কী
মনোমুগ্ধকর হতে পারে
একটি বিভ্রাট?
যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না
এক মুহূর্ত আগেও,
তা হয়ে ওঠে চিরদিনের
অবলম্বন? কবিতার খাতা
মেলে ধরে
দেখছি প্রত্যাশার চূড়ায়
মোহন আলোর লুটোপুটি।
কী আশ্চর্য, একটি সামান্য
ভুলের দাক্ষিণ্যে
পেয়ে গেলাম তোমাকে,
যেমন কোনো নিঃস্ব ভবঘুরে
দৈবক্রমে
পেয়ে যায় অসামান্য ঐশ্বর্য।
সত্যি, পেলাম কি?
এই মুহূর্তে তোমার কাছে
পাঠিয়ে দিতে চাই
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর
বুলবুল,
দোয়েল আর শ্যামা। আমার
কণ্ঠস্বরকে
কোকিলের কুহুতান করে
পাঠাতে চাই তোমার উদ্দেশে,
সে-সুর রক্ত ঝরিয়ে তোমার
নাম ধরে ডাকবে অষ্টপ্রহর,
যা তুমি ছাড়া বুঝতে পারবে
না অন্য কেউ।
দেবদূতদের নির্দেশ দেবো
তোমার চারদিকে
হিরন্ময় তরবারি হাতে পাহারা
দিতে,
যাতে শয়তানের দল উত্ত্যক্ত
করতে না পারে তোমাকে,
যাতে অমঙ্গলের ছায়া ঘেঁষতে
না পারে তোমার ত্রিসীমানায়।
আর আমার ছন্নছাড়া
কবিতাগুলোকে পাঠাব
তোমার নিঃসঙ্গতায়। এখন
থেকে আমার কবিতা তোমার
হাত
স্পর্শ করবে, হাত ঢুকিয়ে
দেবে ব্রা-র ভেতর, পালতোলা
খর আবেগে
মুখ চুম্বন করবে তোমার,
বারণ করলেও শুনবে না।
২৩.৫.৯৪
একটি সংলাপ
‘বহু ক্রোশ হাঁটা হলো; এখন
বিশ্রাম নেওয়া যাক
এই স্নিগ্ধ গাছের ছায়ায়।
‘থামব না; কায়ক্লেশ আছে,
তবু চ’লে যেতে হবে।‘
‘পথে দেরি ভালো নয়।
চলো, আরো নদী বাকি
আছে,
দিতে হবে পাড়ি।
‘ফুটফুটে জ্যোৎস্না দেখ
চতুর্দিকে পেতেছে গালিচা
কী মধুর আমন্ত্রণে; অবহেলা
করা ঠিক নয়, এসো বসি।
‘জ্যোৎস্নার ওপারে যেতে
হবে।
‘শোনো বাউলের সুর বাজে
রঙিন টিলার ধারে,
এসো, শুনে নিই কিছুক্ষণ
শরীর এলিয়ে ঘাসে’।-
‘উঠবে অমর্ত্য সুর বেজে
পথে পথে, এখন এখানে
থামা চলবে না’।
‘তাহ’লে বলো তো, কবি,
আমাদের গন্তব্য কোথায়?’
‘এখনো জানি না; জানি,
আমাদের আছে শুধু চলা’।
৭.৩.৯৪
এখনো অনেক পথ
এখনো অনেক পথ পাড়ি
দিতে হবে। কখনো-বা
ভুল পথ নিয়ে যাবে ডেকে
দূরে, জলের অভাবে
ঝিমিয়ে পড়বে প্রাণ। কাঁটার
দেয়াল চতুর্দিকে
হঠাৎ গজিয়ে উঠে পথ রোধ
ক’রে দুঃস্বপ্নের
এলাকায় ঠেলে দেবে। রক্তাক্ত
শরীরে জেগে ওঠা,
ক্ষীণ কণ্ঠে অর্থহীন বাক্য
উচ্চারণ করা তপ্ত
ঘোরের ভেতর ভুল কবিতার
মতো-এভাবেই
কিছুকাল বুঝি বা কাটাতে
হবে বন্দীর স্বভাবে।
অকস্মাৎ বিস্ফোরণ; অনড়
দেয়াল ধসে যায়,
স্পর্শ পাই সতেজ হাওয়ার,
কণ্ঠস্বরে করে ভর
গুণীর গভীর তান প্রত্যুষের,
সত্য প্রতিমার
মতো এসে সমুখে দাঁড়ায়;
আমি নিজে খোলা পথে
দাঁড়াই প্রসন্ন মনে প্রকৃত
হদিশ পেয়ে আর
কবিতার হিরন্ময় কাল
মোবারকধ্বনি দেয়।
১৮.৩.৯৩
এখুনি আবার
এখন আমার একটু ঘুম না
হলেই নয়। অনেকদিন
ঘুর রাস্তায়, ফুটপাথে, খোলা
পথে,
মানুষের মুখর হাটে হেঁটে
হেঁটে বস্তুত
ক্লান্ত আমার হাড়-পাঁজর;
মগজের কোষে কোষে
গুঁড়ো গুঁড়ো রং আর কুয়াশা
আমাকে কিছুক্ষণ ঘুম
পাড়িয়ে রাখার গান বাঁধছে।
নির্জনতম এক জায়গায় পা
বাড়াই,
হারাই অনুশোচনা। খাড়াই
পেরিয়ে টলতে টলতে খুঁজে
নিই
ঝরা পাতার বিছানা। এখানে
নিঃশব্দতার
নিঃশ্বাস আমাকে ছোঁয়;
বনস্থলীর ডুকরে-ওঠা
বুকের মধ্যে এসে ভাবি,
হাঁটতে হাঁটতে এতদূর এসে
পড়েছি?
মাথার উপর দু’টি তারা
কাঁপছিল
প্রেমে ডগমগ কুমারীর চোখের
মতো, অথচ
সেদিকে বেশিক্ষণ তাকানোর
ধৈর্য তখন গায়েব। এখন
আমি কিছুই দেখব না,
কিছুই শুনব না, এখন আমার
শিশিরভেজা ঘাস-পাতায়
মাথা পেতে ঘুমোনো দরকার।
এখানকার নিঝুম গাছপালা
আমার পরিচয়
জানতে চায়নি, বনমর্মর
কৌতূহল প্রকাশ করেনি
আমার নাম ধাম এবং পেশার
ব্যাপারে।
শিয়রে ঝুঁকে-থাকা স্বপ্ন
জানালো না তার ঠিকানা;
আমি
আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসাকে
বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
কতক্ষণ ঘুমের ঢেউ বয়ে
গ্যাছে আমর উপর,
বুঝতে পারিনি; কানে তৃণের
সুড়সুড়ি
আর মানবকণ্ঠের গুঞ্জন
আমাকে জাগিয়ে দেয়,
আমার চোখে তখনো
চিকচিক করছে স্বপ্নকণা।
পথরেখা
এবং চঞ্চল মানুষগুলোর দিকে
তাকাতেই
মনে হলো, এখুনি আবার
বেরিয়ে পড়তে হবে।
৬.৪.৯৪
কবি তুমি
কবি, তুমি ধুলায় ধুলায় ঘাসে
ঘাসে মিশে থাকো,
মেঘে মেঘে, নক্ষত্রেও।
সরোবরে, পাথরে, কাঁকরে
তোমার সত্তার চিহ্ন রয়ে যায়
ঈষৎ আবছা।
লোকাচার দুঃসহ ভেবেও
কবি, তুমি হ’য়ে যাও
কখনো কখনো খুব
সামাজিক। তীক্ষ্ণ কপটতা,
ভাঁড়ামি, শঠতা সহ্য করে
স্মিত মুখে। মূঢ় নর,
স্থূল নারী তোমাকে উপেক্ষা
করে দূরে সরে যায়,
কবি, তুমি সবই মেনে নাও
অনিবার্য প্রাপ্য ভেবে।
তুমি কি কখনো অপমানে
বিদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ
পরায়ণ বনে যাও? কোনো
কোনো দিন বাঘনখ
বেরিয়ে পড়ে কি মিহি
অন্তরাল ভেদ ক’রে? আর
কখনো কি ভাবো যত্রতত্র হুট
ক’রে চলে-যাওয়া
সাঙ্গ ক’রে সকলের মুখের
উপর দরজাটা
বন্ধ রেখে অপমান বিরোধী
কবিতা লিখে যাবে?
২৪.৩.৯৪
কাঁটাও ব্যথিত হয়
সূর্যাস্তের কাছে এসে অকপট
বলা যেতে পারে-
কবির জীবন ঘিরে কত শত
ভ্রম ফুটে আছে।
অবশ্য মাশুল গুনে যেতে
হবে কিছুকাল, যদি দীর্ঘ বেঁচে
থাকে।
ঈষৎ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বাঁচতে
চেয়েছে কবি, তাই
সঙ্ঘের কলহ থেকে নিজেকে
বাঁচিয়ে
করুণ রঙিন পথে হেঁটে যায়,
দু’ধারে নিভৃতে
সপ্রেম রোপণ করে স্বপ্নময়
চারা,
যেসব হয়ত ছোঁবে নীলিমাকে
গভীর আস্থায়
কোনোদিন, বস্তুত কবির
কোনো অবিনয় নেই।
অপমানে বিদ্ধ হয় কবি বার
বার, দ্যাখে, অবলীলাক্রমে
প্রতিষ্ঠিত মিত্র শক্র হয়ে যায়
সঙ্ঘের বাচাল
পরামর্শে, ভাবনার ধোঁয়াশায়
শীতল মাথায়
কবিকে হনন করে প্রত্যহ
দু’বেলা। এইসব জেনে শুনে
প্রতারক বন্ধু তার চক্রব্যূহে
যায়, অনুরাগে
আলিঙ্গন করে নিত্যদিন কত
মুখোশধারীকে।
কোনো কোনো সুহৃদ সজীব
আর জাঁদরেল খুব,
তবু ওরা ফ্রিজে-রাখা
ছাগমাংসের মতই মৃত
কবির হৃদয়ে। সে তো কাঁটার
ওপর হেঁটে যায়
প্রায়শই, মাঝে-মাঝে পুষ্পবৃষ্টি
হয়, সকৃতজ্ঞ দৃষ্টি তার
প্রসারিত সত্যসন্ধ লোকদের
প্রতি
কীর্তিনাশা সময়ের ক্রুর তটে
একাকী দাঁড়িয়ে।
এখন কবির অপমানে
গোলাপের
কাঁটাও ব্যথিত আর নক্ষত্রেরা
হয় অশ্রুজল।
৯.৩.৯৪
কে থাকে দাঁড়িয়ে
যেতে চাইলেই কি যাওয়া
যায়? যায় না
কে থাকে দাঁড়িয়ে দরজার
ওপারে?
চিনি বটে তাকে, এগোলেই
ছুঁতে পারি, অথবা
চুম্বন আঁকতে পারি ঠোঁটে,
অথচ
পা বাড়ালেই ছায়ায় ডুবে
যায়। হাওয়ায়
তার উপস্থিতির ঈষৎ কাঁপন
জড়িয়ে থাকে।
পথে পাথর, ঝোপকাঁটা
পাজামা আঁকড়ে ধরে,
জোনাকির জ্বলে ওঠা
অন্ধকারকে
আরো বেশি অন্ধকার করে;
অন্ধের মতো
পথ চলি। মনে হয়, কে যেন
দাঁড়ায় পাশে, দেখি না
মুখ তার; পাথর পায়ের তলায়
হিংস্র বাজতে থাকে, প্রাণে
তাকে ভালোবাসার দ্যুতি।
ঘাটে নৌকো বাঁধা। এ গহন
রাত্তিরে
নদীতে নৌকো ভাসানোর
মতো কেউ নেই, দাঁড়িয়ে
আছি ঠায়, জলজ হাওয়া
বুকে ধাক্কা দেয়। গলুইয়ে
আছে যে দাঁড়িয়ে,
জল ভেঙে ছুটে গিয়ে তাকে
বুকে জড়িয়ে
ধরতেই অনেকগুলো অক্ষর
ঝর ঝর ঝরে পড়ে।
১৩.৫.৯৪
কোনো এক শীত সন্ধ্যায়
শীত রাজধানীকে জাপটে
ধরেছে। সন্ধেবেলা শার্ট,
গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার ধূসর
ট্রাউজার পরে
বেরিয়েছি বন্ধুর মোটর কারে।
শীতের কামড়
টের পাচ্ছি না তেমন। বাইরে
হাড়-কাঁপানো শীত। পথের
ধারে একটি প্রায়-নগ্ন
বালিকা তার অসুস্থ, উলঙ্গ
ভাইকে কোলে নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে শহুরে মেকী
বৈভবকে
বিদ্রুপ ক’রে। শীতের দাঁত
ওদের শরীরকে
দংশন করছে ক্রমাগত।
বালিকার এক হাত
সামনের দিকে বাড়ানো করুণ
প্রত্যাশায়।
আমার শার্ট, গাঢ় নীল রঙের
ব্লেজার,
ধূসর ট্রাউজার আর পশমি
মোজা
বিছে হ’য়ে কামড়াতে থাকে
আমাকে ইচ্ছে হলো,
এক ঝটকায় গা থেকে সব
পোশাক
খুলে ফেলে সম্পূর্ন উলঙ্গ
হ’য়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে
দৌড় শুরু ক’রে দিই। অথচ
সুরক্ষিত
মোটর কারের ঈষৎ উষ্ণতায়
বসে থাকি। নিজের ব্যর্থতায়
মনের হাত কামড়াই।
ঘরের নামকরণ
তুমি কি জানো, আমার এই
ঘর শূন্যতার প্রহারে
হাঁপানি রোগীর মতো খুব
শ্বাসকষ্টে আছে? তুমি কি
বুঝতে পারো আমার ঘরে
চেয়ার টেবিল খাট আর প্রচুর
বইপত্র সমেত কেমন খাঁ খাঁ
ধোঁয়াটে শ্মশানের মতো?
আমার ঘর তুমি দেখে গ্যাছো,
চোখ বুলিয়েছো
এর দেয়ালে, জানালা দিয়ে
তাকিয়েছো বাইরে,
বারান্দার রেলিঙে রেখেছিলে
হাত?
গাছের সতেজ পাতাগুলো কি
ছুঁয়ে দেখেছিলে? তোমার স্পর্শ
পেয়েছিলো
এই শয্যার চাদর, তোমার
আঁচল
লুটিয়ে পড়েছিল বালিশে।
তোমার হাতে কবিতার বই
সাইবেরিয়ার হাঁস হ’য়ে
খাচ্ছিল আদর।
তুমি কি জানো তোমার-দেখা
সেই ঘর আর
আগেকার আকৃতি ধারণ
করে না? কেমন বিদঘুটে
হতচ্ছাড়া হ’য়ে গেছে, ভীষণ
এক শৈত্যপ্রবাহে
উবে গেছে সবটুকু সজীবতা।
দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ার
খাট আর বুক শেল্ফ্ আজ
প্রলম্বিত হাহাকার।
তোমার দৃষ্টির দাক্ষিণ্যহীন
আমার এই ঘর।
সাপের খোলসের মতো অথবা
তোমার
পরিত্যক্ত শাড়ির মতো প’ড়ে
আছে। এ ঘরের নাম
কা’রো ইচ্ছে হ’লে
দিব্যি রাখতে পারে নিঃসঙ্গতা
কিংবা দীর্ঘশ্বাশ, যা খুশি।
চুল
বইমেলায় ঘুরছিলাম তরুণ
কবির সঙ্গে। ধুলো
লাগছিল জুতো-মোড়া পায়ে
এবং গায়ে
গা ঠেকে যাচ্ছিল দারুণ
ভিড়ে। বড় একা আমি;
কে যেন, মনে পড়ছে না,
বলল, ‘আপনাকে চিনতে
ভারি কষ্ট হচ্ছে। চুল ছাঁটালেন
কবে?’
কোনো উত্তর না দিয়ে ঈষৎ
হাসি, অজান্তে নিজের
হাত চলে যায় মাথায়। খুব
ছোট হয়ে গেছে আমার
স্যামসনী চুল কাচির দাপটে।
সেলুন থেকে ফেরার পর
আমার নিজের কাছেই
নিজেকে কেমন উটকো
লাগছে।
আমি যেন আমি নই আর,
অন্য কোনো মানুষ
প্রবেশ করেছে আমার ভেতর।
এখন আমি গাছের সঙ্গে,
নদীর সঙ্গে, ঝোপঝাড়ের
জোনাকি, বাঁশ বাগান এবং
নক্ষত্রের সঙ্গে
কথা বলতে ভুলে গেছি।
কীভাবে
দেবদূতের সঙ্গে আলাপ করতে
হয়, তা-ও যেন
মনে নেই আমার। যখন
আমার চুল অনেক
দীর্ঘ ছিল, ঘাড়ে ছিল
ক্রীড়াপরায়ণ
উত্তর মেরুর শাদা চালুকের
শাবকের ধরনে,
তখন কবিতার নানা শব্দ
আসতো অবলীলায়
আমার কাছে, যেমন জলের
উপরিতলে আসে মাছ। এখন
আমি আগেকার
ব্যক্তিত্ব-রহিত,
কবিতা-বঞ্চিত।
মাথা ভরা খাটো চুল নিয়ে
বিব্রত আমি
অধুনা শয্যায় ছটফট
করতে-করতে ক্লান্ত। হঠাৎ
কে এক আদিম পুরুষ আমার
চুল ধ’রে
টানতে থাকে রাতভর। আমি
তার উৎপীড়নের কাছে
নতজানু; ছায়াপথ,
সপ্তর্ষিমন্ডল, দিগন্তজোড়া
স্তব্ধতা আমাকে এক নতুন
খেলার আমন্ত্রণ জানায়।
১.৩.৯৪
তোমরা আমাকে আর
আমার কাছের এবং দূরের
বন্ধুগণ,
মিনতি জানাই করজোড়ে,-
তোমরা আমাকে আর কখনো
আমার নিজের লেখা কবিতা
পড়তে বলো না।
গা ঘুলিয়ে ওঠে, ভয়ানক বমি
আসে, ওয়াক্ ওয়াক্ ক’রে
তলপেট চেপে ধরি অসহ্য
যন্ত্রণায়, কী যেন
দলা দলা বেরিয়ে আসতে চায়
কণ্ঠনালী ফুঁড়ে।
কীভাবে করব কবিতা পাঠ?
তোমরা আমাকে আর কখনো
আমার নিজের লেখা কবিতা
পড়তে বলো না।
চাঁদকে পনির ভেবে অগণিত
ধেড়ে ইঁদুর
কুট কুট খেয়ে ফেলছে
অবিরত,
আমাদের স্বপ্নগুলোকে দাঁতাল
শুয়োরের পাল
ঢেকে ফেলছে ওদের মলে,
আমাদের মুক্ত চিন্তার গলা
টিপে ধরছে কিছু ভৌতিক
হাত,
আমি ওদের তাড়াতে পারছি
না।
বাগানকে দ্রুত ভাগাড়
বানাচ্ছে যারা,
হায়, ওদের বারণ করতে
গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি বেজায়।
কবিতার বইয়ের শব্দগুলো
উপেক্ষার
ত্র্যাসিডে ভীষণ ক্ষয়ে গেছে,
একটি পংক্তির ভগ্নাংশ থেকে
অন্য পংক্তির ভগ্নাংশ
কোন্ মুদ্রায় আলাদা, আমি
ঠাহর করতে অক্ষম!
যখন কবিতা পড়ার জন্য
কাব্যগ্রন্থ হাতে তুলে নিই,
তখন অনেক লোক প্রাণ
হারাচ্ছে
ধর্মান্ধ ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে;
যখন কবিতার অপরূপ
ডৌলের কথা ভাবি,
তখন বহু ঘরবাড়ি পুড়ে যাচ্ছে
দুর্বৃত্ত, সাম্প্রদায়িক আগুনের
লালসায়।
যখন কবিতা পাঠের
সুশোভিত মঞ্চের কথা ভাবি,
তখন লকলকে পিশাচেরা বহু
নারীকে
মারাত্মক অগোছালো করছে
ধর্ষণে;
যখন কবিতার দ্যুতিময়
উপমার অপরিহার্যতা
এবং চিন্তার গভীরতা
বিবেচনায় রাখি,
তখন হাজার হাজার অভুক্ত
শিশু কাতরায়
ক্ষুধার নেকড়ে-দাঁতের
কামড়ে।
আমি আমার কবিতাবলীতে
স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের অবিন্যস্ত
পদচারণা শুনতে পাই;
আমাকে তোমরা আমার
নিজের লেখা কবিতা
পড়তে বলো না কখনো,
পড়তে বলো না।
যাদের হিংস্র উত্থানে বিজয়
দিবসের উৎসবেও
বিষণ্ন, বড় বিপন্ন হয়ে যায়
স্বাধীন মানুষ,
যাদের হাতে এখনো আমার
শিক্ষকের,
আমার ভায়ের রক্তের ছোপ
আর্তনাদ করছে,
যাদের ফতোয়ার তুলট
কাগজে
বহু নারীর লাঞ্ছনা, বিপর্যয়,
হাহাকার, বুকফাটা চিৎকার
মুদ্রিত স্পষ্টাক্ষরে, যারা
অহর্নিশ
আমাকে বধ্যভূমিতে টেনে
নেয়ার ভাবনায় মশগুল
ধিক্ ধিক্ আমাকে, আজো
ওদের শাস্তি বিধান করতে
পারিনি।
আমার নিজের লেখা কবিতা
পাঠের
অধিকার আমি অনেক
আগেই হারিয়ে ফেলেছি।
১১.১২.৯৩
তোমার এই মিথ্যা
রোগশয্যায় তুমি কখনো
শীতের শীর্ণ নদী,
কখনো অনেক দূরের
ছায়াপথ।
তুমি টিপয়ে-রাখা ওষুধের
শিশিকে বলছো-
‘আমি একা।‘
তুমি বাম পাশে ফিরে ভীষণ
আশ্রয়কাঙাল
চড়ুইয়ের চাঞ্চল্যকে বলছো-
আমি ভারী একা।‘
তুমি হাত বাড়িয়ে অখন্ড
‘গীতবিতান’
বুকের খুব কাছে নিয়ে
অজর পংক্তিময় পাতাগুলোকে
বলছো-
‘আমি একা, বড় একা
আমি।‘
তুমি শীতগোধূলিকে আর
রাত্রির কুহকছড়ানো
ঝিল্লীরবকে বলছো-
‘এই একাকিত্ব নিয়ে পারি
না আর।
এই মিথ্যাকে তুমি প্রশ্রয় দিচ্ছ
ব’লে
আমি অভিমানে ছন্দের
লালিত্যকে এক ঝটকায় খুব
ক’রে বলি,
তোমার সঙ্গে সর্বক্ষণ আছে
লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের
দু’জনের রচিত স্মৃতি আর
আমার ভালোবাসা,
তবু কি নিজেকে বলবে তুমি
একাকিনী?
তোমার চোখে
তোমার চোখে অনুবিশ্ব
আবিষ্কারের
নেশায় আমি বুঁদ। সেই কখন
থেকে
তোমার চোখের ভেতর
এই পর্যটক উত্তর মেরু থেকে
দক্ষিণ মেরু এবং
দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরু
পাড়ি দিয়ে চলেছে।
পথের শেষ কোথায়?
কোথায় সেই অনুবিশ্ব, যার
সন্ধানে বার বার এই পর্যটক
হায়, হারিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়?
নীল এক পাহাড়ের গুহায়
হঠাৎ
প্রবেশ ক’রে দেখি অতিকায়
মাকড়সার জালে দশমীর চাঁদ
আটকা প’ড়ে হাঁসফাস
করছে।
৪.৩.৯৩
তোমার দিকেই আমার মুখ
আমি যে কাঁটাঝোপে নানা
রঙের
ফুল ফোটাতে চাই
হাত দুটো রক্তাক্ত ক’রে,
হৃৎপিণ্ড থেকে
ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরিয়ে
দিনরাত,
এ নিয়ে বিদ্রূপের হুল্লোড় ওঠে
কোনো কোনো বাঁকা মহলে।
আমি যে এই ছন্নছাড়া বয়েসে
তোমার হৃদয়ের ডালপালায়
মুখ রেখেছি
এ_ও অনেকের জিভে
চমৎকার নাচিয়ে
এই শহরে।
যেখানেই থাকি, তোমার
দিকেই আমার মুখ।
তোমার কাছে পৌঁছেনোর
আকাঙ্ঘা
রক্তগোলাপ আমার হৃদয়ে।
তোমার
ভাবনা আমাকে সর্বক্ষণ
বাজায়
বাউলের গোপীযন্ত্রের মতো।
তোমার মুহূর্তেগুলি
পাথরের নুড়ি হ’য়ে গড়ায়
প্রতীক্ষার ঝর্নাতলে।
আমার স্বপ্নভঙ্গের ছাই মেঘে
উড়িয়ে,
তোমার অনুপস্থিতির দুঃসহ
মুহূর্তগুলিকে
দূরে হটিয়ে কী এক তীব্রতায়
হন্তদন্ত ছুটলাম তোমার
নিবাসের উদ্দেশে।
যে এলাকায় তুমি থাকো
সেখানে এখন লোড
শেডিং-এর মিশমিশে
বোরখা; আমার সমস্ত শরীরে
দীর্ঘ ভ্রমণের স্বেদ, ধুলোর
গন্ধ। আমি
দোতলার অন্ধকার সিঁড়িতে
দাঁড়িয়ে দ্বিধার
অঙ্কুশে বিদ্ধ হবো আর
ম্যাক্সিপরা তুমি আলতো
আমার মুখের দিকে তুলে
ধরবে পিদ্দিম।
আমার চোখের সমুখে
তখন থরথর রহস্যের
উদ্ভাসন।
৭.৪.৯৪
তোমার দিকেই এই যাত্রা
প্রত্যুষের পাখি আমাকে দেখে
গান ভুলে
প্রশ্ন করে নিজেকে, এই সাত
একালে
কোথায় চলেছে লোকটা?
আকাশ সূর্যের মুকুট পরে
ঝলসাচ্ছে খুব,
আকাশে চক্কর দিচ্ছে যে চিল
সে ভাবে, এই ভরদুপুরে
কোন্ দিকে যাচ্ছে দিশেহারা
পুরুষ।
বিকেলের কোমল নদীর
জিজ্ঞাসা,…
কোথায় গন্তব্য এই ক্লান্ত
পথিকের?
গোধূলি বেলার গরুর গলার
ঘুন্টি
আমার উদ্দেশে উচ্চারণ
করে…
কোথায় চলেছেন কবি?
সন্ধ্যারাতের জোনাকির
সওয়াল,
কোন্ নিবাসে যাবে লোকটা?
মধ্যরাতির গোরস্তানের
আবছা বাতি
আমাকে লক্ষ্য ক’রে শুধায়,
পথের শেষ কোথায় এই
ধুলোময়
লোকটার? কোথায়?
ওরা কি জানে না প্রতি
মুহূর্তে, অন্তর্গত
ঐশ্বর্য আমার, তোমার দিকেই
এই যাত্রা?
১৭.২.৯৪
দু’হাতে জড়িয়ে ধরি
এ জীবন ক্রমাগত এলিয়ে
পড়ছে
পশ্চিমের দিকে।
দুঃখবোধ আছে, তবু এখন
আনন্দ পেতে লাগে না আমার
খুব বেশি আয়োজন।
টিকটিকি দম্পতি দেয়ালে
নীরবে বেড়াচ্ছে দেখে কিংবা
হাওয়ায় গাছের পাতাগুলি
নেচে উঠলে হঠাৎ,
শ্রাবণ-বৃষ্টির পরে রঙধনু দেখা
দিলে আর
দু’বছর নয় মাস বয়সের
শিশু
আমাকে চঞ্চল চুমু খেলে,
সহজেই আমি
আনন্দ-সাম্পানে চ’ড়ে পাড়ি
দিতে পারি
ঝড়ক্ষুব্ধ নদী।
প্রিয়তমা, বস্তুত তুমিই ওগো
আমার মনের
প্রান্তরে এনেছ সবুজিমা,
স্পর্শে যার
পথের ধূসর ধূলি হয় স্বর্ণরেণু
আমার মুঠোয় আর আমার
শরীর থেকে জরা
মুছে যায় লহমায়,
আলো-অন্ধকারে
যখন তোমার কণ্ঠস্বর বেজে
ওঠে
হৃদয়ে আমার, আমি যুবকের
মতো
দু’হাতে জড়িয়ে ধরি
তোমাকে অর্থাৎ পৃথিবীকে।
১৫.৮.৯৪
নিজেকে বলেন কবি
খুব নাক-উঁচু এক অধ্যাপক
সেদিন বাসায় এসে বলে
গেলেন কবিকে, ‘আর কত,
এবার থামিয়ে দিন
লেখনীকে।‘ একজন নিম
কবি আসর মাতিয়ে
বলেছেন, ‘লোকটাকে নিয়ে
পারা যাচ্ছে না কিছুতে,
এক্ষুণি থামানো দরকার খর্বুটে
বৃদ্ধটিকে।‘
‘থামো বাপু, ঢের জঞ্জালের
স্তূপ তুমি
কাব্য মালঞ্চের কোণে জড়ো
ক’রে লুটেছ তারিফ সুপ্রচুর
অনর্থক, ঝুলিয়েছ গলায়
মেডেল। তাড়াতাড়ি কেটে
পড়ো’ বলে তাকে
কবিসভা গুলজার-করা বুড়ো,
আধবুড়ো আর জবর জোয়ান
পদ্য লিখিয়ের দল, বহুরূপী
কাব্যবিশারদ।
থামো থামো রব বর্ষীয়ান
কবিটিকে ঘিরে
ঘোরে মৌমাছির মতো,
ফোটায় সুতীক্ষ্ণ হুল; তিনি
খাতার পাতার দিকে দৃষ্টি
রেখে নিজেকে বলেন
খুব শান্ত কণ্ঠস্বরে-যে যাই
বলুক যত তুলুক আওয়াজ,
থামব না। যতদিন পলাশ,
কোকিল,
বাবুই পাখির বাসা, লতা
পাতা, মধ্যরাত, সকাল
বেলার
আলো, বয়ে-যাওয়া জলধারা,
মাছরাঙা, সপ্তর্ষিমন্ডল
থামতে বলে থামব না
ততদিন।
এই উচ্চাবচ রুক্ষ জীবনের
অনলস শ্রমের কসম
কবিতা ঝটিতি কেড়ে না
নিলে কলম থামবে না
কিছুতেই।
১৯.৩.৯৩
নিজের নিকট থেকে
চোখের অসুখ তাই কিছু ঠিক
দেখতে পারি না।
এ কীসের গন্ধ লাগে নাকে?
এ কাদের
পদশব্দ স্তব্ধতাকে ভীষণ
আঘাত করে? কাকে
আমার অত্যন্ত কাছে বসিয়ে
জিগ্যেস করি আজ?
কার ঘরে হৈ-হুলোড় করে
কেরোসিন ঢেলে ছুঁড়ে
দিচ্ছ প্রজাপতি মার্কা কাঠি?
হায়, একি
আমারই শরীরে লাগে তাপ;
যেন আমি
চিতায় রয়েছি শুয়ে, জীবন্ত
পুড়িয়ে দেবে বুঝি!
কলহ বিবাদ নেই কারুন
সাথেই, তবু কেন গায়ে পড়া
কাইজার হিংস্র কোলাহল
চতুর্দিকে?
শুধু বেঁচে থাকবার সাধ ধুক
ধুক
বুকে নিয়ে দিনযাপনের
শরশয্যা বেছে নিই।
চক্ষুঃপীড়া হেতু ঠিক দেখি না
কিছুই। অন্ধকারে
মিত্রকে সরিয়ে দূরে শক্রকে
নিবিড় বুকে টানে,
কারো বাড়া ভাতে ছাই দিইনি
কখনো,
অথচ আমার থালা ভেঙে
ফেলে দুর্জনেরা, বুক হয়
ছাই।
আবছা নিজের হাত, নিমগাছ
নিঝুম নিশীথ,
আছে না কি নেই, বোঝা
দায়, যদুবংশ-যুবকেরা
মদমত্ত,
নারী হরণের পালা শুরু করে।
আমি অসহায়
অশক্ত শরীরে আজ নিজের
নিকট থেকে পালিয়ে বেড়াই।
১৭.৩.৯৩
পাথরগুলো হবে ফুল
তুমি এসেছ, বড় ভুল সময়ে
এসে গ্যাছো তুমি।
বলব না, এই অসময়ে আসা
উচিত হয়নি তোমার;
ঘোর অবেলায় বিষ্ঠার স্তূপ
আর মান্ধাতার
পচা আবর্জনায় আবীর ছড়ায়
ঝলমলে রোদ, তবে কি তাকে
বারণ করার
কোনো অর্থ দাঁড়ায়?
তোমার দিকে অজস্র তীর
ছুঁড়ছে চৌদিক থেকে
কবন্ধ তীরন্দাজের দল,
তোমাকে ওরা তীর-জর্জরিত
দুলদুল বানিয়ে
হিংস্র উৎসবে মেতে উঠতে
চায়, রপ্তানি করতে চায়
ওদের উলঙ্গ জয়োল্লাস
বর্বরতার চূড়ায়। তোমার
অন্তর্লোকে
ওরা ছড়িয়ে দিয়েছে বিষাদের
মিশমিশে মেঘ।
যদি পারতাম এই নিষ্ঠুউরতম
দহনে
আমি তোমার জন্যে নিভৃতে
রচনা করতাম ছায়া,
যদি পারতাম তোমার
বুক-পিঠে বর্ম
এবং মাথায় শিরস্ত্রাণ হয়ে
ঝলসে উঠতাম, যদি
পারতাম।
আমার বড় সাধ হয়, তোমার
হৃদয়ের, মননের বিকাশমান,
সৃজনশীল ডালপালাকে মূঢ়
ক্রুর আগুন থেকে বাঁচিয়ে
রাখি।
না সরযু নদীর জল, না
ফোরাতের পানি-
কিছুই পারবে না তোমার
অন্তর্গত ক্ষতগুলো ধুয়ে দিতে।
আমি তোমার যাবতীয়
ক্ষতকে লাল গোলাপ বানিয়ে
দিতাম,
যদি পারতাম। আজ তুমি বড়
একা, যেদিকে তাকাও
সেদিকেই মুদ্রিত প্রগাঢ়
বেদনা। তোমার চোখ থেকে
অশ্রুজল ঝরলে পুড়ে যায়
করতল, দুব্বো ঘাস।
চৈত্রের রৌদ্রের মতো তোমার
গান ছড়িয়ে পড়ছে
নদীমুখে, খোলা রাস্তায়,
প্রান্তরে, দিগন্তে থেকে দিগন্তে।
কোনো নির্দিষ্ট জাত কিংবা
ধর্মের উদ্দেশে নয় তোমার
গান;
যে-গানে ধ্বনিত ভালোবাসার
মহিমা,
বিশ্বমানবের নিলনোৎসব।
তুমি জীবনের স্তব
রচনা করো বলেই ওরা
তোমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে
মরণ-ফাঁস।
ভয় পেও না মূঢ়তার
প্রেতনৃত্য দেখে-
দ্যাখো, তোমার খুব কাছেই
সাদা আলখাল্লা পরে দাঁড়ানো
সোক্রাতেস,
তোমার বিষাদ তিনি সস্নেহে
মুছে দেবেন সত্যসন্ধ হাতে।
জানি, কষ্ট তোমার মর্মমূলে,
অথচ শিরদাঁড়া খাড়া সর্বক্ষণ;
তুমি ছাড়া কে লিখতে পারত
‘আয় কষ্ট ঝেঁপে জীবন
দেবো মেপে?
ঘাতকের দল ব্যানারে লিখছে
তোমার নাম
হিংসার হরফে,
তোমার কণ্ঠস্বরকে ওরা
লোমশ পা দিয়ে মাড়িয়ে
থেঁতলে দিতে চায়, অথচ
যে-পথ তাদের পদশব্দে
আজ সন্ত্রস্ত খরগোশের মতো
কম্পমান,
সে-পথ একদিন তোমার
কণ্ঠস্বরের জন্যে
উৎকর্ণ হয়ে থাকবে সর্বক্ষণ,
বুকে ধারণ করবে
তোমার জন্যে ভালোবাসার
গোলাপ। সূর্যমুখী হবে
ভবিষ্যৎ।
ভেব না একা তুমি। দূরের
আকাশ নেমে এসে
সঙ্গ দেবে তোমাকে, গাছপালা
আর নক্ষত্র
তোমার নির্জন, শূন্য
মুহূর্তগুলোকে কানায় কানায়
ভরিয়ে তুলবে
বিলাপ-তড়ানো সংলাপে।
তোমার দিকে
ছুটে আসবে তোমার হাজার
হাজার ভাইবোন
তোমার উদ্দেশে কাসিদা
গাইতে-গাইতে, নিক্ষিপ্ত
পাথরগুলো হবে ফুল।
প্রকৃত মানব
গহন কুয়াশা ফুঁড়ে ক’জন
মানুষ স্পষ্টালোকে
এসে যায়, তাকায় এ ওর
দিকে, হাসি
ফোটে সকলের ঠোঁটে। ওরা
দেখেছে অনেক গৃহদাহ,
দেখেছে মানুষ কত
সহজে চালায় ছুরি মানুষের
বিপন্ন গলায়,
নারী লুণ্ঠনের কৃষ্ণ উৎসবও
তাদের
দেখতে হয়েছে বার বার
অসহায়
প্রহরে বলির পাঠা হ’য়ে।
এখন সহজে তারা একই
পাত্রে ভাগ ক’রে খেতে
পারে একই খাবার প্রত্যহ,
কুণ্ঠাহীন
নামের পদবী বদলের
বেলায়; ফলত সাহা রাহমান
আর খান গুণ
হ’য়ে যায়। অথচ ওদের
চোখগুলো
চোখই থাকে, নাক মুখ
অবিকল আগের মতোই
রয়ে যায়; নিশ্বাস প্রশ্বাসে নেই
কোনো হেরফের, যে-প্রেম
ওদের
প্রবল উদ্বেল করে, তার
কোনো গোত্র নেই, নেই
কোনো
আলাদা পদবী। অগ্নিশুদ্ধ
হ’য়ে, দীর্ঘকাল ঘন
কুয়াশায় হেঁটে হেঁটে ওরা
আজ প্রকৃত মানব।
১৭.২.৯৪
প্রত্যুত্তর
একজন চিত্রকর সাতদিন
ঘরের ভেতর খুব একা
কাটিয়ে বিকেলবেলা সারসের
মতো ধবধবে
পোশাক চাপিয়ে গায়ে
বেরুলেন শহুরে রাস্তায়।
হঠাৎ কোত্থেকে এক অসিত
কুকুর এসে ইস্ত্রি
করা পাজামাটা ক্ষিপ্র ভিজিয়ে
পালায় দৌড়ে আর
একজন বদখৎ লোক কাদার
কলঙ্ক লেপে
দিয়ে শিল্পীটির পাঞ্জাবিতে
হেসে ওঠে, মজা লোটে
ইয়ার বক্সির সঙ্গে। উদাসীন
চিত্রকর একা
ধীর স্থির হেঁটে যান। কেউ
কেউ তার দিকে চেয়ে
সহানুভূতির আভা ছড়িয়ে
দিলেন। কেউ কেউ
তাকে বেশ উত্তেজিত ক’রে
তোলার মশলা কিছু
জোগান দেয়ায় চেষ্টাশীল।
কাউকে কিছু না ব’লে
তিনি ঘরে ফিরে দোরে খিল
এঁটে চৈত্র পূর্ণিমার
মতো নগ্নতায় জ্ব’লে
ক্যানভাসে সৌন্দর্য আঁকেন।
১৮.৩.৯৩
ফুঁসে ওঠে ফতোয়া
তোমরা যারা পরের খেয়ে
নিজের ঘরের জৌলুস বাড়াও,
তোমরা যারা কখনো গা’
থেকে ঝরাওনি
শ্রমের স্বেদ, তোমরা যারা
নারীদের অষ্টপ্রহর
দম আটকানো চারদেয়ালের
ঘেরে
বন্দী রাখার বিধান দাও,
যাতে রৌদ্র জ্যোৎস্না চুমো
খেতে না পারে
ওদের শরীরে, তোমরা যারা
কাউকে
ভাতকাপড় দিতে পারো না,
তারাই
অন্যের রুজিতে নিষেধাজ্ঞা
সেঁটে দাও।
তোমরা যখন হেঁটে যাও,
তোমাদের পায়ের নিচে
ডুকরে ওঠে মাটি,
তোমরা যখন কথা বলো
ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে
মোড়লদের সঙ্গে, সতেজ
লতাগুল্মের মুখ শুকিয়ে যায়,
বুক কাঁপে শস্যক্ষেতের।
তোমরা যারা একটি সুন্দর
বাক্যও উচ্চারণ
করতে পারো না তুলির
আঁচড়ে
ফোটাতে পারো না প্রকৃতির
রূপ,
তোমরাই ফতোয়া দাও আলো
ঝলোমলো
কবিতার বিরুদ্ধে, চিত্রের
বিরুদ্ধে।
যারা, গলিত অন্ধ সমাজকে
বদলে ফেলার কাজে
মগজ খাটায়, হাত লাগায়,
তারা তোমাদের পথের কাঁটা,
যাদের সত্তায় শস্যরাজির
হাসি ছড়ানো,
তোমাদের ফতোয়া ফুঁসে ওঠে
তাদের বিরুদ্ধে।
পারলে তোমরা একঘরে
করতে
গোলাপ, চামেলী আর
কৃষ্ণচূড়াকে।
পারলে তোমরা পাহাড়-চূড়া,
নদীর ঢেউ
পাখির বাসা, জোনাকি আর
দু’টি হৃদয়ের মিলনের রঙিন
সাঁকোর বিরুদ্ধে
লটকে দিতে হিসহিসে
ফতোয়া।
৬.৪.৯৪
বিমান বন্দর
এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা
মধ্যিখানে নয় কোনো চর।
তার চেয়ে ভিন্নতর
মফস্বলের এক বিমান বন্দর।
বিমান বন্দরটার নেই কোনো
বাহারি আদল,
নেহাতই শাদামাটা; অনুজ্জ্বল
দরজার কাছে জলকণাময়,
শোনো,
মৎস্যকন্যা নয় কোনো,
তার চেয়েও আশ্চর্যজনক
মধ্য দুপুরে নিছক
তুমি, ঐশ্বার্যশীলা, শাড়ি পরা,
চুল
কালো আগুনের শিখা, হাতে
ফুল,
ছিলে দাঁড়ানো। তোমার
শরীরে,
লক্ষ করি ঈষৎ ভিড়ে,
গুণীর তান। সেই বিমান বন্দর
বন্দনীয়
এবং চিরপ্রিয়
হয়ে ওঠে আমার শুধু তুমি
ছিলে ব’লে
আমাকে স্পর্শ করেছিলে
ব’লে কথাচ্ছলে।
মনোজ মৌচাক থেকে
আজ রাতে ঘুম আর হবে না
আমার। করোটির
ভেতর কীসের গুঞ্জরণ;
বিছানায়
নিজের শরীর নেই।
এককোণে রয়েছি দাঁড়িয়ে,
হেঁটমাথা,
একাকী, দুর্জেয় অপরাধীর
ধরনে। বেড়ালের
থাবার আঘাতে আর নিশাচর
পেঁচার চিৎকারে
ঘড়ি কাঁপে নিরন্তর, নিশীথ
গোঙায়।
কিছুক্ষণ এভাবেই কাটে,
ক্রমাগত রাতের নিশ্বাস লাগে
সত্তায় আমার, ঝর্না কলম
এবং খাতাহীন
অক্ষরের খেলা নিয়ে বসি
নিভিয়ে ঘরের বাতি।
শব্দগুলো নর্তকীর মতো,
যেমন রয়েছে মাতিসের
ক্যানভাসে,
এ ওর শরীরে ঝুঁকে থাকে
অন্তহীন বেদনার বৃত্তে।
অক্ষরেরা উঁকিঝুঁকি দিতে
থাকে, আমি
লালবাতি দেখালেও ওরা
মানে না সঙ্কেত; অপরূপ
কোলাহল
করে মগজের কোষে কোষে,
আজ ঘুমোতে দেবে না
আমাকে, করোটি যেন বিয়ে
বাড়ি, পূর্ণ চাঁদ মাতালের
চোখ;
মনোজ মৌচাক থেকে নির্ঘুম
ছড়াতে থাকি শব্দের বিভূতি।
১৪.৫.৯৪
মরমী আঙ্গিক
সৌন্দর্যকে তর্জমা করার
অভিলাষে প্রজাপতি,
খরগোশদের লাফ, দিঘির
কম্পন,
জোনাকির জ্বলে-ওঠা,
নারীমুখ নিয়ে মগ্ন হই।
অকস্মাৎ
গোধূলির পাখি এক বার্তা
পৌঁছে দেয় নিরিবিলি
আমার বোধের সীমানায়।
তড়িঘড়ি
গেলাম দেখতে মাকে অনুবাদ
অসম্পূর্ণ রেখে।
জরার আঁচড়ে কিছু, কিছু
অসুখের
পীড়নে এখন ম্লান তিনি,
জননী আমার; তার
ক্লান্ত চোখে খেলা করে নিভৃত
বিভূতি-
যেন তিনি খুঁজছেন পলাতকা
বালিকা বয়স।
পদ স্পর্শ করে বিছানার ধারে
বসতেই তিনি
মাথায় রাখেন হাত দোয়ার
মুদ্রায়। আমি সেই
অনাবিল ভঙ্গিটিকে, সকলের
অগোচরে তর্জমায় মাতি।
মা আমাকে নিজেরই অজ্ঞাতে
গোধূলিতে দেন উপহার
শিল্পের নিজস্ব মহিমায় স্নাত
মরমী আঙ্গিক।
১২.৫.৯৪
মিহিরের উদ্দেশে
মিহির, তোমার কি মনে পড়ে
জামিলের কথা?
হ্যাঁ, আমিই সেই জামিল,
যে তোমার, বলা যেতে পারে,
প্রায় অষ্ট প্রহরের
সঙ্গী ছিল। ওরা বলতো,
আমরা দু’জন মানিকজোড়।
এক সঙ্গে আমরা যেতাম
স্কুলে, খেলার মাঠে,
কখনো যেতাম বেলাবেলি
পাশের গাঁয়ের মেলায়।
গুরুজনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে
দেখতে যেতাম যাত্রা
কুয়াশাঢাকা পথে
আমরা জু’জন হাত ধরাধরি
ক’রে। যখন
যে যার বাড়িতে ফিরতাম,
তখন ঘাসের ডগায়
চিকচিক করছে ভোরের
শিশির, তোমার মনে পড়ে
মিহির?
আমি, আজকের জামিল
আখতার,
কিছুতেই ভুলতে পারি না
সেসব দিনের কথা।
রাজহাঁসের মতো
গ্রীবা উঁচিয়ে আমার দিকে
এগিয়ে আসে অনেকগুলো
বছর।
মিহির, তোমাদের বাড়ির
সমুখে ছিল
কনকচাঁপার গাছ। একবার
এক স্বর্ণলতা আমাকে
জড়িয়ে ধরেছিল অবিকল
তোমারই মতো। তুমি মৃদু
হেসে
আমাকে নিয়ে গেলে তোমার
পড়ার ঘরে। কাকিমা,
মানে তোমার মা আমার
জন্যে ঝকঝকে কাঁসার
বাটিতে
নিয়ে এলেন নারকেলের নাড়ু
আর মোয়া। কাকিমার মুখ
মনে পড়লেই দেখি আকাশের
কিনারে
কল্যাণ ছড়িয়ে রয়েছে।
আত্মভোলা কাকা বাবু
তোমার বাবা, আমার
অজান্তেই আমাকে জীবনের
গভীর সবক দিয়েছিলেন তাঁর
উদার দৃষ্টি,
নিষ্কম্প মানবিকতাবোধ এবং
জন্মভূমির প্রতি
আরাধনাপ্রতিম ভালোবাসা
দিয়ে? কী ক’রে ভুলব
তাঁর কথা? জানি না, তিনি
বেঁচে আছেন কি না,
থাকলেও
তিনি কোনোদিন জানবেন না,
আমি একলব্যের মতো
আজো দূর থেকে অনুসরণ
করে চলেছি তাঁর নীতি।
মিহির,
তোমাকে কোনোদিন বলি নি
এ-কথা।
মিহির, তুমি কী সুন্দর আবৃত্তি
করতে জীবনানন্দের কবিতা,
আমি তন্ময় হ’য়ে শুনতাম
আর চলে যেতাম
রাঙা রাজকন্যাদের দেশে। বন
জ্যোৎস্নায়, স্পষ্ট দেখতে
পেতাম,
ভেসে উঠছে মৃণালিনী
ঘোষালের শব। মিহির,
তুমি, হ্যাঁ তুমিই আমাকে
দীক্ষিত করেছিলে আধুনিক
কবিতায়।
বাংলা কবিতা যে কী মধুর
সঙ্গীতময়, তা আমি
জেনেছিলাম
তোমার আবৃত্তির গুণে,
কবিতার পংক্তিমালা আমার
চিত্তে বয়ে যেতো ঢেউয়ের পর
ঢেউয়ের মতো,
আমি শুধু অবাক হ’য়ে
শুনতাম। তোমার সুরেলা
কণ্ঠস্বর
আজো আমার স্মৃতিতে গুণীর
তান।
এর পরের ঘটনা বর্ণনা করার
মুখ নেই
আমার কলমের। ধর্মান্ধতা
মানুষকে কীভাবে অমানুষ
ক’রে তোলে,
একে অন্যের গলায় ছুরি
চালায়, সম্ভ্রম লুট করে
সস্তা পণ্যের মতো, ভাই
ভায়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে
উল্লাসে ফেটে পড়ে, এ-কথা
আমরা এই উপমহাদেশের
অসহায় মানুষ জেনেছি চড়া
দামের বিনিময়ে। দাঙ্গা
অসংখ্য মানুষের ঘর ভাঙার
কলংকিত ইতিহাসই শুধু নয়,
মানবতার কুৎসিত হন্তারকও
বটে।
তোমরা, মিহির, দেশান্তরী
হ’লে তোমার বোন শেফালী
যেদিন হ’য়ে গেল দলিত
শিউলির মতো। আমার প্রিয়
দেশ থেকে
সংখ্যালঘুদের এই নীরব
প্রস্থান কী ক’রে ঠেকাবো
কোন্ আশ্বাসের দেয়ালি
জ্বেলে? দস্যুরা কখনো সবচনে
কর্ণপাত করে না। ওদের
বর্শার ফলায়
বিদ্ধ হয় মৈত্রী এবং
সহমর্মিতার হৃৎপিণ্ড।
মিহির, সেদিন, তোমাদের
বাস্তুভিটায় গিয়ে দেখলাম,
সেখানে আমাকে গ্রীবা
বাড়িয়ে
স্বাগত জানানোর মতো
কোনো রাজহাঁস নেই।
সেখানে এখন
এক ধুরন্ধর শেয়াল তার
পরিবার নিয়ে বাস করছে।
আরেকটি খবর তোমাকে না
ব’লে পারছি না,
এখন নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের
কায়ক্লেশে ভোটকেন্দ্রে
যেতে হয় না আর, অদৃশ্য
সংকেতে
অন্যেরা তাদের ভোট দিয়ে
দেয় মহানন্দে, সগৌরবে!
কী অদ্ভুত বিবেচনা! চাঁদের
কষ্ট হবে ভেবে হয়ত একদিন
ওরা তাকে নিজেরাই ঠেলে
ঠুলে আসমানের এপার থেকে
ওপারে পাঠিয়ে দেবে।
২৯.৩.৯৪
মৃত্যুবোধ
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই ভয়
কাঁকড়ার মতো
আমার উপর হেঁটে যায়,
যেতে থাকে। মৃত্যুবোধ হঠাৎ
আমাকে
ভীষণ কাতর করে। বিছানায়
লেপের বাইরে
নিজের একলা হাতটিকে
নির্বোধ, অচেনা লাগে, যেন
মৃত্যু ওকে আলগোছে
ছুঁয়ে গেছে। বড় দুঃখময় হাত
গাঢ় অবসাদে
নিমজ্জিত এক পাশে; বুকে
পাথরের ভার।
পেয়ারা গাছের ডালে-বসা
পাখিটার
মৃত্যুবোধ নেই, আকৃতিতে
ওর বেদনার কোনো
ছাপ নেই; অচিন সুরের ছায়া
আছে। ওকে প্রীতি
জানাবার সাধ জাগে;
আমাকে শুঁকতে
থাকে মৃত্যু ক্রমাগত, বুঝি বা
পচন-ধরা মাছ
এই আমি। সুদূরিকা, ঢেউময়
যৌবন তোমার
এ মুহূর্তে যদি ঘরে প্রবল
দেয়ালি
জ্বেলে দেয় ভয়ের কুয়াশা
যাবে কেটে। যদি তুমি
আমাকে বাহুতে বাঁধো এসে,
মাথায় বুলিয়ে দাও
হাত, ঠোঁট চেপে ধরো বাসি
ঠোঁটে, নিমেষে মরণ ম’রে
যাবে।
মেঘ না চাইতে
মেঘ না চাইতে জল পেয়ে
যাওয়ার মতো
আমার হাত তোমার হাতে।
এই প্রথমবারের মতো তোমার
স্পর্শ পেলাম।
কী-যে হলো আমার ভেতর,
কে ব’লে দেবে আমাকে?
আকাশে গোল চাঁদ খুব
চকচক করছিল
শাহী মুদ্রার মতো, অথচ
আমি দেখছিলাম তোমাকে
চাঁদের রূপ উপেক্ষা ক’রে।
তোমার শরীরে
জড়ানো ছিল এক টুকরো
নীল আকাশ।
আমার হাত তোমার
করতলের কানে কানে
কিছু একটা ভিন্ন মাত্রায়
বলার চেষ্টা করছিল
জ্যেৎস্নার ভাষা ধার ক’রে।
তোমার সরু, সুন্দর
আঙুলগুলো কি উদ্ধার করতে
পেরেছিল সেই সান্ধ্যভাষা?
তোমার হাতের স্পর্শ আমার
সমগ্র সত্তায়
ফুটিয়ে দিলো রঙ বেরঙের
ফুল, অনুভব করলাম
আমার হৃদয়ে অজস্র নক্ষত্রের
নাচ, আমার শরীর
নিমেষে হয়ে ওঠে স্বর্গীয়
পাখির গান।
তোমার সোনালী হাত নিঝুম
মাছ
রূপালি সরোবরে, পর মুহূর্তে
গুণীর তান।
তোমার সঙ্গীতময় হাত
আমার শিরায় শিরায়
কবিতা তৈরি করতে থাকে
আমাকে বিহব্বলতায় ডুবিয়ে।
আমি তোমার শরীরের সুঘ্রাণে
যখন বুঁদ
যখন আমি তাকিয়ে আছি
জ্যোৎস্নার চুম্বনে বিহ্বল
গাছের দিকে,
সেই গাছের মধ্যে খেলে যায়
এক প্রশ্নের বিদ্যুৎ।
হাওয়ার ঝলক সেই প্রশ্ন
পৌঁছে দেয়
আমার শ্রুতিতে-‘কবি, এত
অল্পে তুষ্ট তুমি?’
২৫.৫.৯৪
যদি সেই ঝড়কে
আমার ক্ষণকালের
নীরবতাকে ভুল বুঝে
তোমার ব্যাকুলতা সেদিন
সন্ধ্যার অন্ধকারে
আমার নিঃশব্দতাকে প্রশ্ন
করল,
‘সে কি ক্লান্ত আমাকে
ভালোবেসে?’
সেই প্রশ্নের বিদ্যুৎ-প্রবাহে
চমকে ওঠে
আমার অস্তিত্ব। আমি তোমার
ব্যাকুলতার উদ্দেশে
বলি, বোলো, তাকে বোলো,
যদিন গোলাপের সৌন্দর্য
আমাকে
ক্লান্ত করবে, যেদিন
জ্যোৎস্নারাতের বিহ্বল
ঐশ্বর্যের প্রতি নিঃসাড় থাকব,
যেদিন কোকিলের ডাক
আমার শোণিতধারাকে চঞ্চল
করবে না,
যেদিন নদীর ঢেউ দেখেও
নিস্পৃহ থাকব,
যেদিন ভোরবেলার আবীর
আমার মনকে আর
রাঙিয়ে তুলবে না,
যেদিন স্বাধীনতা আমাকে
উদ্দীপ্ত করবে না আর,
যেদিন জীবনের চুম্বন ব্যর্থ
হবে আমার ওষ্ঠে,
সেদিন, শুধু সেদিন ভালবাসা
আমাকে অবসন্ন করতে
পারবে, তার আগে কিছুতেই
নয়।
কী ক’রে থামাবো তোমার
ব্যাকুলতার ঝড়?
আমার নিরপরাধ নীরবতাকে
শত বাঙ্ঘয় ক’রেও
ব্যর্থতার বালিয়াড়িতে মুখ
থুবড়ে প’ড়ে থাকব,
যদি সেই ঝড়কে তুমি নিজে
না পাঠাও নির্বাসনে।
১০.৩.৯৪
যাচ্ছো, যাও
যাচ্ছো, যাও। পথ রোধ করে
দাঁড়াবার
নেই অধিকার
আমার। তোমার
চ’লে-যাওয়া
জানে দূর মফস্বলগামী বাস,
প্রত্যুষের হাওয়া,
লেজঝোলা পাখি, সবচেয়ে
বেশি জানে
এ কবির বিদীর্ণ হৃদয়। কোনো
মানে
এখন পাই না খুঁজে কোনো
কিছুতেই।
শুধু নেই নেই
ধ্বনি ওঠে সবখানে; রক্তমাংস
করে আর্তনাদ,
শ্যাওলার মতন বিষাদ
আমাকে দখল করে, প্রতি
রোমকূপে দীর্ঘশ্বাস,
আমার না-লেখা কবিতার
চোখে ঘাস।
চ’লে গ্যাছো। আমাকে
বিদ্রুপ করে দেয়াল,
জোনাকি,
আমি তো বিচ্ছেদ নাম্নী ভীষণ
নিষ্ঠুর রমণীকে নিয়ে থাকি।
যৌবনোত্তর বিলাপ
বনতুলসীর গন্ধ, হঠাৎ হাঁসের
চই চই শব্দ আর
ধানের সবুজ ক্ষেতে ধ্যানী
সাদা বক, দোয়েলের শিস,
ফিঙে
পাখিটির নাচ, কুটিরের
ধোঁয়া, আর মফস্বলী
স্টেশনের রাত,
চিলেকোঠা আমাকে ফিরিয়ে
দেয় আমার শৈশব।
জীর্ণ আস্তাবলে
হাড়-পাঁজর-বেরুনো শীর্ণ
ঘোড়া,
হার্নি সাহেবের কুকুরের রাগী
চোখ, বাগানের ফুলদল,
টাটকা কের্কের ঘ্রাণ, তুঁত
গাছ, মহল্লার ক্ষয়িষ্ণু পুকুর,
লাভ লেন,
ভার্সিটির করিডর, মধুর
ক্যান্টিন, আমতলা, আসমান
লাল-করা কৃষ্ণচূড়া, রমনার
সর্পিল লেক, ক্লাশ রুমে
জীবনানন্দের
বনলতা সেন আর
রবীন্দ্রনাথের
দূরে বহু দূরে স্বপ্নলোকে
উজ্জ্বয়িনীপুরে, শেষের
কবিতা,
বাংলার বিদ্রোহ, রাজপথে
পদধ্বনি,
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়া
বাঙালিনী উদ্দাম আঁচল,
কারফিউ আমাকে ফিরিয়ে
দেয় আমার যৌবন।
যৌবন কি সত্যি ফিরে আসে?
দর্পণের স্বচ্ছতায়
পরিস্ফুট যে বাস্তব প্রতিকৃতি,
তার
দিকে চোখ পড়ে যদি, যদি
সিঁড়ি বেয়ে
ওঠার সময় হাঁফ ধরে খুব,
তবে মনে হয়-
যৌবন ফেরে না আর, শুধু
যৌবনের হাহাকার
ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে
মনের গুহায়। ঝাঁক ঝাঁক
ক্ষুধার্ত ইঁদুর ছুটে আসে কী
ক্ষিপ্র যৌবনোত্তর
মানুষের দিকে মহা ভোজের
আশায়। ইঁদুরের
তীক্ষ্ণ দাঁত মাংস ছিঁড়ে নেয়,
হৃৎপিণ্ডে বিকট ফুটো করে,
সে মুহূর্তে মনে হয়-
এই যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু ঢের
ভালো।
নিঃসঙ্গতা কৃষ্ণকায় ধাঙড়
যুবার মতো সারা গায়ে সাদা
কাদা মেখে আমাকে ভীষণ
জব্দ করে। নেশা ভরে
বাংলা আর হিন্দি
মিশিয়ে কীসব কথা বলে
ব্রাত্য ছন্দে,
কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না।
সরোবরে হাত ধুই বার বার,
তবু হায়, রুক্ষতা কমে না
কিছু, যৌবন ফেরে না।
২১.৩.৯৪
শওকত ওসমানের জন্যে
এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি,
আপনি আহত
শার্দুলের মতো বসে আছেন
আপনার নিজস্ব বিবরে।
বাইরে এখন অন্ধকার গাঢ়
হচ্ছে ক্রমাগত, রক্তখেকো
নেকড়েগুলোর তৎপরতা
ভীতি সঞ্চার করছে
অনেকের মনে। আপনি
আহত, অথচ অন্তর্গত
রক্তক্ষরণ আপনাকে
অবসন্ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আপনি, অনুমান করি,
তাকিয়ে আছেন ঘরের
দেয়ালের দিকে,
যেখানে আপনার না-লেখা
পংক্তিগুলো মাঝে-মধ্যে
ঝিকিয়ে উঠছে, চক্ষুষ্মান
আপনি সহজে
দেখতে পাচ্ছেন কালান্তরের
অপরূপ অভিষেক।
আপনার জীবন এক অবিরাম
সংগ্রাম বাঁচবার
ক্লান্তি আর হতাশা যাদের
কুঁজো করে ফেলেছে তাদের
বাঁচিয়ে তুলবার। আপনি ইচ্ছে
করলেই
গোলাপের সুঘ্রাণে বুঁদ হয়ে
নক্ষত্রের গুঁড়ো সারা শরীরে
মেখে
কাটিয়ে দিতে পারতেন
অবলীলাক্রমে, কিন্তু যে
আপনি জীবনকে
দেখেছেন নানা মাত্রায়, বিভিন্ন
স্তরে,
তাঁর পক্ষে কী ক’রে সম্ভব
পদ্মভুক হ’য়ে থাকা? ক্ষুরধার
আপনার লেখনী, তার
আঘাতে
অন্ধকার কাতরাতে থাকে
পশুর মতো। আপনার
অক্ষরমালার দ্যুতিতে চোখ
ধাঁধিয়ে যায়
মধ্যযুগচারী লোকদের, ওরা
বুঝতেই পারে না
আপনার সীমাহীন অভীপ্সা,
আপনার স্বপ্নের বলয়ে
কী ঐশ্বর্য জ্বলজ্বল করছে!
এ দেশের প্রতিটি বিবেকী
মানুষ আপনার
রচনা সমূহের পক্ষে, হে
প্রেরণাসঞ্চারী অগ্রজ,
এ দেশের প্রতিটি সাহসী,
অগ্রসর মানুষ
আপনার সুদীর্ঘ জীবনের
পক্ষে, আপনার কাঁটার মুকুটে
ঝরুক পুষ্প বিকাশের সুর,
আমাদের কৃতজ্ঞ চিত্তের
আনন্দধারা।
২৮.১২.৯৪
শাস্তি দাবি করে
কখনো এমন সময় আসে,
কিছুই
ভাবা যায় না। সাতটি ময়ূর
পেখম মেলে
নাচে, তিনটি ঘোড়া ছুটতে
থাকে
সবুজ ঘাসের শিশির ঝরিয়ে,
পাঁচটি দোয়েল শিস বাজিয়ে
নিসর্গকে
সঙ্গীতময় ক’রে তোলে,
অথচ আমি
বন্ধ্যা সময়ের মুখোমুখি
ব’সে থাকি ভাবনাহীন।
একখণ্ড পাথরের মতো
আমার অবস্থান। কে আমাকে
নীরেট পাথরের স্তব্ধতায় ঢেকে
রাখে?
হঠাৎ কখন যে পাথর ফুঁড়ে
জাগে ফোয়ারা
আমি আমার চতুর্দিকে দেখি
জ্যোতির্ময় এক বলয়,
যেখানে
মুনীর চৌধুরীর হস্তধৃত তীক্ষ্ণ
কলম,
শহীদুল্লাহ কায়সারের স্মিত
ঠোঁট,
আলীম চৌধুরীর একজোড়া
চোখ,
ফজলে রাব্বির হৃৎপিণ্ড,
গোবিন্দ দেবের নির্মোহ উদার
বাহু,
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার
বুদ্ধিদীপ্ত ললাট
আনোয়ার পাশার নাক
আলতাফ মাহমুদের সুরাশ্রয়ী
কণ্ঠ
এক বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে
বিজয়োৎসব হ’য়ে যায়।
আমরা এই উৎসবে আনন্দিত
হ’তে হ’তে
বেদনার্ত হ’য়ে যাই আর
কিছু লোক
উৎকট ভঙ্গিতে হাসতে থাকে
শ্লেষের তুবড়ি ছুটিয়ে
ওদের মুখ থেকে গলগলিয়ে
বেরিয়ে আসে
বহু বছরের রক্ত। আকাশের
নক্ষত্র, ঝোপের
জোনাকি, নদীর ঢেউ,
ক্ষেতের ফসল
পায়ে-চলা পথ, কৃষকের
কুটির, জেলের ডিঙি
গণকবরের ঘাস একযোগে
ওদের বিচার দাবি করে
বিচার দাবি করে,
শাস্তি দাবি করে;
চরম শাস্তি দাবি করে।
যারা উদাসীন, নীরব তাদের
উদ্দেশে
নিসর্গ এবং জনবসতির
ধিক্কার ছাড়া কিছু নেই,
কিছু নেই,
কিছু নেই।
১৫.১২.৯৩
সহমর্মী
বিকেল পুরোনো বেনারসীর
মতো মৃদু জ্বলজ্বলে।
এরকম সময়, যখন অবসাদ
দিনের আঁচলে জড়িয়ে থাকে,
আমার চায়ের তৃষ্ণা
বেড়ে যায়। তখন আমি
সচরাচর পর পর
দু’কাপ চা খাই; আজ
দ্বিতীয় কাপের চা টুকু শেষ
করার
সময় লক্ষ্য করি, বিলীয়মান
দিনের আভায়
পিরিচে রাখা বিস্কুটগুলো যেন
বাদশাহী আমলের আশরফি
আর আকাশে দুলছে ঢেউয়ের
পিদিমের মতো পাখির ঝাঁক।
দূরগামী পাখির বুক আমাকে
জীবনের বিশেষ কোনো
রহস্যের প্রতি উৎসুক করে
তোলে। আমার
জৈবিক তৃষ্ণা হয়ে যায়
মননের ক্ষুধা। গতকাল
কুরিয়ার সার্ভিসে আসা চিঠির
অনুপম এক শব্দগুচ্ছ আমার
বুকের ভেতর কখনো
ফুল ফোটায়, কখনো তারা,
কখনো-বা গ্রীষ্ম দুপুরে এক
ঝলক
ঠান্ডা হাওয়ার মতো বয়ে যায়
আমার সত্তায়।
শব্দগুলো আমাকে অনেক্ষণ
বন্দী করে রাখে
এক অলৌকিক পুষ্পিত
কারাগারে। সেই বন্দীদশা
ঘোচাতে
অনিচ্ছুক আমি চোখের সমুখে
শব্দগুচ্ছের প্রতিমা ছাড়া
কিছুই দেখি না।
দেকার্তের ‘আমি চিন্তা করি,
তা-ই আমি আছি’
বাক্যটির
অনিবার্যতা মান্য করে আমার
চিন্তায় যিনি সর্বেশ্বরী,
তাকে উপমার, অলঙ্কারের
আড়ম্বরের
ওপারে রেখে হৃদয়ের
কিংবদন্তী রচনা করি। চোখ
বুজলে দেখি
সঙ্ঘবদ্ধ কাদাখোঁচাদের
পীড়নে
কোকিলের কণ্ঠরোধ হয়ে
আসে, গলা চিরে বেরোয়
রক্তধারা। আমি আহত
কোকিলটিকে কাদাটে ঝোপ
থেকে
কুড়িয়ে নিয়ে তার শুশ্রূষার
ভার দিই
গাছের সতেজ পাতা, ফুলের
পাপড়ি, সরোবরের জল,
জোনাকি আর নক্ষত্রের
উপর। কোকিল
আমার দিকে তাকায় সুহৃদের
দৃষ্টিতে। তাকে আমি কেন
জানি
নিজের ভেতর ধারণ করি
প্রাতঃস্মরণীয় শ্লোকের মতো।
২২.৩.৯৪
সে এক ধোঁয়াশায়
কতিপয় কুঁদুলে লোক সে
এক ধোঁয়াশায় ঘোঁট পাকায়
বনগ্রামে, হাঁকায় বেঢপ গাড়ি,
যার জঠর থেকে বেরোয়া
গাদা গাদা ছাই, কাদা এবং
নিষ্ঠীবন, কখনো
পুরোনো বিষ্ঠা। ঘন ঘন ওরা
বুক চাপড়ায় হিংস্রতায়।
আকাশে চাঁদ দেখলে,
গোলাপের উন্মীলন দেখলে
মুখ বেঁকে যায় ওদের।
হাওয়ার ফোয়ারায়
করছে স্নান, নিজের খুব কাছে
ডেকে আনছে
নক্ষত্র, পাখি, অচিন পাথর,
সুস্নিগ্ধ জলধারা,
তার তিন কুড়ি চার বছরকে
ফুঁয়ের তোড়ে উড়িয়ে দিতে
ওরা
কানাঘুষো করে, চেঁচায়,
কটমট তাকায়, দাঁত ঘষতে
থাকে।
এতগুলো বছর শুভঙ্করের
ফাঁকি নয়,
নয় শূন্যের গুণক কিংবা
পাতলা ছেঁড়া কাগজ, শুষ্ক
অঙ্কের
আড়ালে আছে পায়ে চলা
পথের ধুলো, বহু সূর্যোদয়,
বহু সূর্যাআস্ত,
অসংখ্যা রাত্রির জাগরণ,
শিশুর আলিঙ্গন, নারীর চুম্বন,
নিসর্গের শুশ্রূষা, খোলা পথের
ধারে
কবিতার আসা-যাওয়া, গ্রন্থের
সাহচর্য, খন্ড খন্ড লড়াইয়ের
স্বাক্ষর, নানা পল্লীর মানুষের
ভালোবাসা,
বিশ্বাসের নিশ্বাস, ধ্যান আর
নান্দনিক আরাধনার দীর্ঘ
ইতিহাস।
এসব নিমেষে নিশ্চিহ্ন করা
যায় এক ফুঁয়ে,
সঙ্ঘের ঝাপ্টায় কিংবা
জটলার মাটি-কাঁপানো
হুঙ্কারে?
সেই লোকটা-যার দিকে
ধাবমান ছাইয়ের গাদা
ডাঁই ডাঁই কাদা, পুরনো বিষ্ঠা
আর নিষ্ঠীবন,-
সন্ত্রাসের উন্মত্ত থাবা থেকে
হাড় পাঁজরাগুলো বাঁচিয়ে
এখনো খাড়া আছে
পাগলা ঘন্টির চিৎকারে
অন্তর্গত উদাসীনতাকে দর্লভ
প্রতিমা বানিয়ে।
৪.৩.৯৪
সৌন্দর্য বিচার
বসেছিলাম এক বাইরে দৃষ্টি
মেলে।
টকটকে তাজা এক গোলাপ
দুলতে দুলতে এসে আমাকে
প্রশ্ন করে-
‘বলো, আমি কি খুব
সুন্দর?’
আমি ফুটন্ত গোলাপের সুঘ্রাণ
নিয়ে বলি-
তোমর সৌন্দর্য তো
ভুবনখ্যাত।
এক চিলতে বারান্দায়
ঝুঁকে-থাকা গাছের পাতা
ঝিলমিলিয়ে শুধায়-
‘শোনো, তুমি কি সুন্দর
বলবে আমাকে?’
আমি তার সজীব সবুজাভার
উদ্দেশে বলি নির্দ্বিধায়,
তোমাকে আমি সুন্দর ব’লেই
জানি।
নিজের শরীরের অপরূপ রঙ
ছড়িয়ে,
সারা ঘরে সুর ঝরিয়ে প্রশ্ন
করে এক পাখি-
‘আমার সৌন্দর্যের কদর
করো তুমি?
আমি তার চোখে চোখ রেখে
স্বপ্নাচ্ছন্ন স্বরে বলি, আমি
তোমার
সৌন্দর্যের বয়ান আমার
কবিতায় ছন্দোবদ্ধ করেছি।
দূর আকাশের নক্ষত্র জ্বলজ্বল
করতে-করতে
আমাকে জিগ্যেস করে,
‘আমার রূপের
স্বীকৃতি কি দাও তুমি,
মানব?’
আমি ওর দূরত্বকে তাচ্ছিল্য
ক’রে
ওর দিকে নিভৃতে পাঠাই
আমার বাণী-
কে আছে এমন যে তোমার
রূপ অস্বীকার করবে?
অনন্তর ওরা স্বরের ঐকতান
সাজিয়ে প্রশ্ন করে-
‘কে সবচেয়ে বেশি সুন্দর?’
আমি নিমেষে অকুণ্ঠ জবাব
দিই- যে আমার কথা
ভেবে-ভেবে
সারা রাত কাটায় নির্ঘুম, যে
আমার বিচ্ছেদে
কান্না হয় প্রহরে প্রহরে,
মনোকষ্টে গভীর অসুখের
বন্দিনী,
সেই-ই তো আমার একান্ত
সুন্দরীতমা।
হে পদ্মপারের তরুণী
পদ্মার দিকে মুখ রেখে তুমি
বসে আছো
বিকেল বেলা। এইমাত্র
গীতবিতান বন্ধ ক’রে নিজের
কণ্ঠস্বরকে ভাসিয়ে দিয়েছ
বিশ্রামের মেঘে, তোমার
অভিমান ঝুলে আছে
পশ্চিমাকাশের আভায়।
আমাকে মনে না রাখার
চেষ্টায় অবসন্ন তুমি পা রাখতে
চাইছো
পদ্মাতীরের পরিকীর্ণ
বালুরাশিতে।
তোমার আলুথালু ভাবনায়
আমি খুব
লুটোপুটি খাচ্ছি; তোমার
ম্যাক্সিতে আমার আঙুলের
মাতলামি দেখে চমকে উঠছ
নিজের অজ্ঞাতে। তোমার
কাছে আমি নেই, অথচ
আমার দশটি অত্যন্ত উৎসুক
আঙুল
তোমার ম্যাক্সি আকর্ষণ
করছে তুমুল, এ কী ক’রে
সম্ভব, ভেবে-ভেবে তুমি
আকুল, হে পদ্মাপারের
তরুণী।
বাতাসে ঈষৎ আন্দোলিত
তোমার চুলে
আশ্চর্য কিছু উপমা,
তোমার মুখমন্ডলে
অনেকানেক অপরূপ
চিত্রকল্প,
তোমার বুকে, অধরে বহু
উৎপ্রেক্ষা-
সবাই একাট্রা হ’য়ে আমাকে
আমন্ত্রণ জানায়
পদ্মাতীরে, যেখানে এক দারুণ
শুষ্কতায় আমার
স্বপ্নেরা তোমার পদ চুম্বনের
আশায়
উড়তে থাকে গাংচিলের
মতো। তোমার নিশ্বাস,
হৃৎস্পন্দন, পদছাপ, রাতের
মতো চাউনি, নিঝুম তন্দ্রা,
ভোরবেলার জাগরণ,
সন্ধ্যাকালের গীতধারা
আমার কবিতাকে নিয়ে যায়
করুণ রঙিন পথে,
আমাকে পূর্ণ ক’রে তোলে
বার বার।
তোমার হৃৎগোলাপে আমার
কামনার চাতক
মুখ রেখে আবৃত্তি করে,
‘ফটিক জল, ফটিক জল।‘
এই মুহূর্তে তুমি পদ্মাতীর
থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে
এক শহুরে বিবর্ণ বিপন্ন কবির
দিকে তাকাও,
তার কাতর আঁজলা ভ’রে
দাও তৃষ্ণার জলে,
যার শিরার প্রতিটি রক্তকণিকা
মনসুর হাল্লাজের
নিমগ্ন রক্ত বুদ্বুদের মতো
উচ্চারণ করছে-
আমিই ঐশ্বর্য, আমিই ঐশ্বর্য।
৮.৩.৯৪