- বইয়ের নামঃ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অনিবার্য ঘরে ফেরা
এইমতো স্থিতি তার, স্পন্দনরহিত সর্বক্ষণ,
পতিত ফলের মতো ম্লান।
এভাবেই থাকে সে প্রায়শ
রাত্রিদিন এমন নিঃসাড়
পারিপার্শ্বিকের
প্রতি উদাসীন।
টেলিফোন বাজে,
বেজে চলে ক্রমাগত বেলা অবেলায়;
পোস্টম্যান, বালকের রঙিন মার্বেল
অথবা উড়ন্ত ঘুড়ি, উদ্ভিন্ন মল্লিকা,
সোমত্ত গাছের
বাকলের ঘ্রাণ,
অকাল বৃষ্টির জুঁই-
কিছুই পারে না তার শিরায় জাগাতে কোনো গান।
এভাবেই থাকে; রৌদ্র লাগে গালে, স্বেচ্ছাচারী জ্যোৎস্না
ধুয়ে দ্যায় মুখ, অথচ সে আপাতত
একটি খোলস শুধু।
সাংকেতিক ভাষার মতন
আছে স্থির সারাক্ষণ কণ্ঠস্বরহীন
এবং এখন কে বলবে করেছে সে
রোপণ বিস্তর
স্বপ্নবীজ ছন্নছাড়া মাঠে পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া?
কে বলবে তার আঙুলের চকিত ছোঁয়ায় নারী
হয়ে যায় স্মরণীয় নিবিড় লিরিক?
কোন ইন্দ্রজালে
সহসা খোলস ছিঁড়ে জেগে ওঠে অন্য একজন
কেমন সহজ ভঙ্গিমায়,
যেনবা বিপথগামী পথিকের ভালোয় ভালোয়
বেলাশেষে এক অনিবার্য ঘরে ফেরা।
আমার নিবাস
কখনো গিয়েছি আগে সেখানে, মানে সে বহুদূরে
মফস্বলী পুরানো মহলে?
দুপুর, নিবিড় হয় চোখের পাতায় আর উদাস পুকুরে;
সিঁড়িতে পা রাখতেই উষ্ণ করতলে
তার হাত চলে আসে। কার? আজ ছায়াচ্ছন্ন নিস্তব্ধ দুপুরে,
নিসর্গের অন্তঃপুরে
গাছগাছালির
মাঝে দৈববলে
সহসা পেয়েছি যাকে, তার? নাকি ভুলে-যাওয়া কোনো পাঁচালির
সুন্দরীতমার? সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাই, পাশে হাঁটে
আমার জাগর স্বপ্ন শাড়ির আঁচলে
নিয়ে অতীতের ঘ্রাণ। কে যেন রয়েছে বসে শ্যাওলাঢাকা পুকুরের ঘাটে
বড় একা, অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে তার
কিছু আলো, কিছু অন্ধকার।
পঞ্জিকার পাতা ওড়ে উল্টাপাল্টা, মাঝে-মধ্যে দোলে ঝাড়বাতি
প্রাচীন অট্রালিকার হঠাৎ হাওয়ায়, পাখি তার সাথী
খুঁজতে খুঁজতে ফের কী মসৃণ সবুজে লুকায়,
সে আমাকে ডাকে মনে মনে, আমি তাকে ডাকি;
শিউলিতলার ছায়া স্মৃতি খুঁটে খায়।
ঘরের ভেতরে ইতিহাস অলৌকিক কলরবে
জেগে ওঠে বর্ষীয়ান কান্তিমান কথকের গাঢ় কণ্ঠস্বরে
পুরানো গানের মতো। দেয়ালে হরিণ শিং বাতিল গৌরবে
যেনবা কৌতুকপ্রদ, তাতে মায়া আছে; মায়া আছে সারা ঘরে।
বৃষ্টিগুঁড়ো দুপুরকে করে বুটিদার; মনে পড়ে
আরেক বর্ষার গান, অবিকল এই সিঁটি কবেকার, এমন চত্বরে,
মনে পড়ে, নিরিবিলি ঘরে কারো ওষ্ঠে ওষ্ঠ রেখে অমরতা
খুঁজেছি ব্যাকুল;
বুঝি তারও রাত্রিময় গহন খোঁপায় ছিল ফুল
এবং পরনে চাঁপারঙ শাড়ি, তাকেও দিয়েছি কথা,
টেনেছি বুকের কাছে, আমার ত্বকের গান বেজেছে সুদূর তার ত্বকে!
সে মুখ পড়লে মনে রক্তে লতাগুল্ম গান হয়, চোখ হয়
কণ্ঠস্বর, হস্তদ্বয় কালহীন স্পন্দিত হৃদয়,
আর মাঝে-মধ্যে মনে হয়, সব কিছু জাতিষ্মর দীর্ঘশ্বাস,
মনে হয় আমার নিবাস,
ছিল সেখানেই, সেই প্রাচীন মহলে দূর বিস্মৃত শতকে।
আমার সত্তা শ্লোক হয়ে
তোমার আমার মধ্যে ক্রমাগত রচিত হচ্ছে মাইল মাইলব্যাপী
তৃষ্ণার্ত জিহ্বার মতো গা ছমছম প্রান্তর। অদূরে
অনেক ক্ষুধার্ত শকুন
অপেক্ষমাণ, আর আমি ওদের দৃষ্টি থেকে,
শবগন্ধী চঞ্চু থেকে নিজেকে আড়াল করে হাঁটছি
ভারি পা টেনে টেনে।
কোথাও এমন কোনো পাখি নেই,
যার গানে দিকগুলি মাধুর্যের আভায় হবে রঙিন,
নেই কোনো ঝরনা, যার ছলছলে হাসি
আমার ক্লান্ত তৃষ্ণার অন্ধকারকে
মুছে ফেলবে নিমেষে।
এখন আমি তোমার দিকে মুখ রেখে এই বেয়াড়া প্রান্তর
পেরুনোর জন্যে বিশ্রামের কোটর
তছনছ করে ফেলেছি,
আমার স্বস্তি ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছে এক দূরন্ত ঈগল,
তার ডানার ঝাপটা আমার নিত্যসঙ্গী।
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে
যার মধ্যে মেদুর অপরাহ্নে
অলৌকিককে গ্রীবা বাড়াতে দেখেছি,
যার মধ্যে শুনেছি সুন্দর ভবিষ্যতের নিঃশ্বাস,
যার কণ্ঠে শুনেছি মৃত্যু-ভোলানো উচ্চারণ?’
আমি কী করে না দেখে থাকব সেই তোমাকে,
যার চোখ আমার প্রৌঢ়ত্বের অন্তরালে ধ্রুবতারা;
যার ওষ্ঠে সেই নদীর গান শুনি, যাকে আমি
দেখেছিলাম
অনেক আগে, সূর্যোদয় পেরিয়ে
গাছগাছালির ঘ্রাণ নিতে নিতে,
যার বুকের দ্যুতি কখনো আমাকে অন্ধ করে,
কখনোবা চক্ষুষ্মান, যার শরীরের প্রতিটি বাঁকে
সদ্য যুবার মতো মুখ রাখে আমার বাসনা?
এখন আমি আমার একাকিত্বের প্রবাসে
তলোয়ার মাছের মতো
নিয়ত সন্ধানী আর উদাস-নিষ্ঠুর।
মনে পড়ে
ঈষৎ উজ্জ্বল লাল বারান্দায় তুমি দাঁড়ানো-
আমি দেখছি তোমাকে, যেমন বয়স্ক বাজপাখি
চোখ তুলে চাঁদ। তুমি সেই মুহূর্তগুলিকে সাজালে
বিদেশী কবিতার পঙ্ক্তিমালায়;
সেই শব্দগুচ্ছে ছিল না কোনো বিদায়ী শ্লোকের বিচ্ছুরণ,
অথচ আমি বিচ্ছেদকে ডানা মেলতে দেখলাম
ঈষৎ উজ্জ্বল দীর্ঘ বারান্দায়
আমার অস্তিত্বে তোমার হাতের অন্তরঙ্গ তাপ সঞ্চয় করে
দৃষ্টিতে তুমিময় ছবি গেঁথে,
পথ চলি, ভালোবাসায় দেখি সত্যের মুখ।
দূর থেকে আমি হাত নাড়ি, তোমার স্মৃতির ভোরে বিভোর
এখন তোমার সান্নিধ্য থেকে নির্বাসিত আমি আর
অন্ধকার কুকুরের মতো
লেহন করছে আমাকে। মাঝে-মধ্যে এই রাত্রি
জন্মান্ধ গায়কের সুরে বেজে ওঠে
আমার শিরায় শিরায়, আশ্চর্য এক ফোয়ারা
আমার ভেতরে তরলিত মণিরত্ন ছড়াতে থাকে,
এবং তোমার অনেকানেক আসা-যাওয়া
স্মৃতির ঝোপঝাড়ে জোনাকি।
‘কখনো নয়, বিলুপ্তি, মনে-না-পড়া, ফিরব না’
ঝরে আমার চোখের পাতায়, স্বপ্নে তোমার শরীর
লতাগুল্মময়, পাতালে ভাসে,
আমাকে ছোঁয় তোমার কণ্ঠস্বর,
আমার সমগ্র সত্তা শ্লোক হয়ে জড়িয়ে যায়
তোমার কণ্ঠস্বরে, আমার হৃদয়
মরীচিকার মতো কাঁপে শূন্যতায়, রুক্ষ শূন্যতায়।
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ
আবদূর রাজ্জাক খান বন্ধু বরেষু)
শেষ-হয়ে-আসা অক্টোবরে
শীতের দুপুরে নিউইয়র্কের অরচার্ড স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে
একটি দোকান দেখি মায়াপুরী, দোকানি ওয়াল্ট ডিজনির
আশ্চর্য ডবল, বলা যায়। দিলেন পরিয়ে গায়ে
স্মিত হেসে সহজ নৈপুণ্যে নীল একটি ব্লেজার। ব্লেজারের
বুকে জাগে অরণ্যের গহন শ্যামলপ্রসূ, সরোবর-উদ্ভুত অমর্ত্য
দূরায়নী তান।
সুনীল ব্লেজার ঝুলে আছে
আলনায়, কাঠের হ্যাংগারে একা আমার পুরানো ম্লান ঘরে
মালার্মের কবিতার স্তবকের মতো নিরিবিলি,
অথচ সংগীতময় সর্বক্ষণ অস্তিত্বের পরতে পরতে।
নানান সামগ্রী ঘরে থরে থরে, কিছু এলোমেলো; সামগ্রীর ভিড়ে
সুনীল ব্লেজার যেন বহু গদ্য-লেখকের মাঝে
বড় একা একজন কবি।
ব্লেজারের দিকে চোখ যায়
যখন তখন, দেখি সে আছে নিভৃত অহংকারে,
থাকার আনন্দে আছে, নিজের মতন
আছে; বলে সান্দ্র স্বরে, ‘এই যে এখানে আছি, এই
থাকা জানি নিজেই তাৎপর্যময় খুব’। এ মুহূর্তে
যদি ছুঁই তাকে, তবে মর্মরিত হবে সে এখন, উঠবে জেগে
স্বপ্ন-সুদূরতা থেকে।
কখনো ব্লেজার কৌতূহলে
দ্রুত জেনে নিতে চায় তরুণ রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীকে কখনো
তীব্র চুমো খেয়েছেন কিনা জোড়াসাঁকোর ডাগর অভিজাত
পূর্ণিমায়,
নব্য কবিসংঘ কী পুরাণ নিয়ত নির্মাণ করে মেধার কিরণে আর
শীতার্ত পোল্যান্ড আজ ধর্মঘটে রূদ্ধ কিনা কিংবা কোন
জলাভূমিতে গর্জায়
গেরিলার স্টেনগান, হৃদয়ের মগ্নশিলা, আর্ত চাঁদ
ইত্যাদিও জানা চাই তার।
ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।
কোথায় পাগলাঘণ্টি বাজে
ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা
ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে
এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।
দশদিকে কত রকাডেমিতে নিশীথে
গোর-খোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলি
অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জির মুখ।
গালিবের জোব্বা,
দিল্লির সূর্যাস্ত যেন, রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা অনুপম,
মৌলানা রুমির খিরকা, বোদলেয়ারের মখমলি
কালো কোট দুলে ওঠে আমার সুনীল ব্লেজারের কাছাকাছি।
কিছু অসন্তোষ গাঁথা সুতোয়, বিশদ কারুকাজে;
ইতিহাসবিদ্বেষী ব্লেজার পুণ্য নীল পদ্ম অকস্মাৎ,
অবাধ স্বাতন্ত্র্য চায় ব্যাপক নির্মুখতায় আজ।
নষ্ট হয়ে যাবে
ভেবে মাঝে মাঝে আঁৎকে ওঠে, টুপির মতন ফাঁকা
ভবিষ্যৎ কল্পনায় মূর্ত হয়ে কখনো কখনো,
কবরের অবরুদ্ধ গুহা তাকে চেটেপুটে খাবে
কোনো দিন, ভাবে সে এবং নীল পাখি হয়ে দূর
সিমেট্রির মিশকালো সাইপ্রেস ছেড়ে পলাশের রক্তাভায়
ব’সে গান গায়।
একটি দুপুরের উপকথা
সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
রোদ আমার ভেতরে বাজতে থাকে মোহন বাদ্যযন্ত্রের মতো
আর আমি যেন নিভৃত আরোগ্যশালায়
একটু একটু করে স্বাস্থ্য ফিরে পাই। ভোর স্বপ্নের ভাষায়
অপরূপ কোলাহলময় আমার শিরায় শিরায়;
আমি সঙ্গমকালীন একাকিত্বের কথা ভুলে, ভুলে উঠোনের কথা
দিগন্ত আর ধাবমান অশ্বপালের কথা ভাবি।
এখন সেই জাগরণের মুহূর্তে
আমি কি জানতাম কী বিপুল আশ্চর্য অপেক্ষা করছে
আমার জন্যে? কয়েক ঘণ্টা পরেই ঝকঝকে দুপুরে
আমার অস্তিত্বকে উদ্ভাসিত করে একজন
সিঁড়ির ধাপ ছেড়ে
উঠে আসবে আমার বাঁ পাশে? তার দৃষ্টি আর হাসিতে
আমার পরমায়ু হবে গভীর সঞ্জীবিত?
তখন কি আমি জানতাম
দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?
হৃদের ছলছলানি? এমন সম্মোহনময়?
পুলিশের বাঁশি, মাইল মাইলব্যাপী বুটের শব্দ,
বম্ব্যরের মৃত্যুবর্ষী গর্জন, বাতিল শাসনতন্ত্রের হাহাকার
আর পাঁচসালা পরিকল্পনার আর্তনাদ ছাপিয়ে
একটা দুপুর চাইকোভস্কির সুর হতে পারে, আগে জানিনি।
একজন, বহুদিন আগেকার রাত্রির গহন থেকে আফ্রোদিতির মতো
উঠে-আসা একজন, দুপুরকে অনন্য উপহারে রূপান্তরিত করে
আমার উদ্দেশে। সেই উপহার
হাত বাড়ায় আমার দিকে, আমি মুগ্ধাবেশে
পান করি সেই দৃশ্য। দুপুর, আকাশের দিকে বাহু-তোলা গাছ,
রৌদ্রাক্রান্ত পথ, ধাবমান যান আর আমরা দুজন
নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে যাই।
কী সুন্দর তুমি, দুপুর উচ্চারণ করে তোমার কানে কানে;
তুমি হাসো দুপুরকে অবিশ্বাস করে,
সেই হাসি দুপুরকে করে তোলে আরো প্রগলভ।
এই শহুরে দুপুরে অকস্মাৎ ভাবি-
এ দুপুর জানে প্রতিবিপ্লবীর ভ্রান্তির মতো কিছু কথোপকথন
আমাদের আছে,
এ দুপুর জানে ভূমিহীন কৃষকের স্বপ্নের মতো কিছু স্বপ্ন
আমাদের বাস্তবে লতিয়ে ওঠে,
এ দুপুর জানে গুপ্তহত্যার মতো নিঃশব্দ ভয়ংকর কিছু
বারংবার ঘটতে থাকে আমাদের ভেতর,
এ দুপুর জানে ল্যাজারাস আড়মোড়া ভাঙে উদাস প্রান্তরে,
তোমার অনাবৃত বাহুর মতো যেন কোন স্মৃতি
ঝুলে রয় মনের ঝোপঝাড়ে,
এ দুপুর জানে খরগোশেরও ঘাড়ে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি
মিশে থাকে,
কোথায় ব্যাপক জতুগৃহে অনেকানেক ঘোড়া পুড়ে যায়।
কী সুন্দর তুমি, মনে মনে বলি।
তখন আমার চতুষ্পার্শ্বে ট্রাফিকের মাতলামি,
রাস্তা উপচে-পড়া মানুষ, দোকানপাটের বিজ্ঞাপনী ইশারা,
চিত্রতারকার রঙচঙে ছবি,অথচ আমি
কিছুই দেখি না, শুনি না কিছুই। দুপুরে
আমার দু’চোখ জুড়ে তুমি শুধু তুমি।
কী সুন্দর তুমি, আবৃত্তি করি তোমার সৌন্দর্য
আর হঠাৎ মনে পড়ে, তোমাকে ধরে রাখতে পারব না কখনো।
হয়তো এমন দিন আসবে,
যখন আকাশে সূর্য হাসবে রাষ্ট্রদূতের মতো অথবা চাঁদ
আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক কর্মার মতো
গা-ঢাকা দেবে মেঘের ভূতলে,
কিংবা হলদে পাতার মতো হেমন্ত ছোঁবে আমাকে,
ঝমঝমিয়ে আষাঢ় নামবে এ শহরে
আর আমি নির্বাসিত হবো তোমার সান্নিধ্যের অলকাপুরী থেকে।
চাই, তোমাকেই চাই বলে আমার অস্তিত্ব এক-দীর্ঘ চিৎকারে
রূপান্তরিত হবে, দিনযাপন মনে হবে
নিরন্ধ্র কারাবাসের মতো; আর তোমার উদ্দেশে আমার ডাক
প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে আমারই কাছে বারে বারে।
যখন কোনো কোনো দুঃস্বপ্নসংকুল
রাতে ঘুমের বড়ি সেবন করার পরও ঘুম আসবে না তোমার,
তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তুমি, চোখ মেলে দিও
ক্ষুধিত অন্ধকারে,
তখন দেখতে পারবে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে একজন
তোমারই প্রতীক্ষায়; কোনো পাহারাদার তাকে ‘দূর হট’ বলে
তাড়াতে পারবে না,
এমনকি আজরাইলের অন্ধ, দুর্বিনীত ডানাও না।
একদা তোমার আমি
একদা, তোমাকে আমি অহংকারী বলে জানতাম। মনে পড়ে,
কোনো এক পঁচিশে বৈশাখে
তুমি আর আমি পাশাপাশি ছিলাম কী মুগ্ধ বসে।
চিনতে পারনি তুমি পাশে-বসে-থাকা জবুথবু
তরুণকে যার
কবিতা তখন এ শহরে যত্রতত্র
বাচ্চা রাজহাঁসের মতন
পাখা ঝাপটাত, সেই পদাবলি পাঠক গোষ্ঠীকে দিয়েছিল
ভীষণ ভড়কে আর উদাসীন পণ্ডিতবর্গের
টেরিকাটা দামি মাথা চুলকোতে বাধ্য করেছিল।
তুমি একবারও তার দিকে, এমনকি তাচ্ছিল্যভরেও, ফিরে
তাকাওনি; দৃষ্টি ছিল মঞ্চে, কখনোবা কিছু দর্শকের প্রতি।
প্রকৃত রানীর মতো ছিলে তুমি সে আসরে
অমন সুদুর একাকিনী। কী মদির তাপ গোলাপি নেশার মতো
তোমার নিজস্ব পারফিউমের মতো
আমার সত্তায় হল সঞ্চারিত; সকালের আকাশের মতো
কী সহজ আভিজাত্য ছিল তোমার অস্তিত্বে ব্যাপ্ত
এবং আমার ঠোঁট দুটি অদৃশ্য পাখির মতো
গান গাইছিল স্মিত তোমার শরীরে সারাক্ষণ।
সে রাতে তরুণ কবি অর্জিত মোহন কাম তার
অন্য কারো নিবেদিত শরীরে উৎসর্গ করেছিল,
অথচ তুমিই ছিলে, শুধু তুমি তার
অস্তিত্বে অণুপরমাণুময়।
তোমাকে দেখেছি আমি দূর থেকে ঊনসত্তরের
পদধ্বনিময় দিনে, করেছি আবৃত্তি
তোমার উজ্জ্বল মুখ, চকচকে চোখ, কালো চুলের গৌরব,
মধ্যরাতে বৈমাত্রের পরিবেশে কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে।
একাত্তরে গুলিবিদ্ধ ঈগলের মতো রক্তাপ্লুত
বিধ্বস্ত শহরে থেকে সবুজ গ্রামের অভ্যন্তরে
পলাতক হয়েছি যখন,
তখনও তোমার কথা হৃদয়কে বলেছি নিভৃতে
দীর্ঘশ্বাসসহ-যে উতল দীর্ঘশ্বাসে মিশ্র স্মৃতি,
পঁচিশে বৈশাখ, চৈত্রপাতা, বৃষ্টিপাত, ধু-ধু মাঠ,
প্রেতায়িত ঘোড়াদের লাফ,
ধ্বংসস্তূপ সেতারের ব্যাকুল বেহাগ, দেয়ালের
কী বিমূর্ত দাগ, ছত্রভংগ মিছিলের প্রজ্বলিত আর্তনাদ-
মাছরাঙা পাখি, মাছ, শাপলা শালুক দেখার সময়।
এখন কেমন আছ তুমি? এখন তো
আঁধার চিৎকার করে অগ্নিদগ্ধ ঘোড়ার মতন।
যখন আলিজিরিয়া যুদ্ধক্ষুব্ধ ছিল, জামিলাকে
নেকড়ের পাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে মেতেছিল খুব পৈশাচী উল্লাসে,
ফিলিস্তিনি লায়লাকে ঝাঁক ঝাঁক ডালকুত্তা তুমুল তাড়িয়ে
বেড়িয়েছে রাত্রিদিন, তখন কোথায় ছিলে তুমি?
তখন কেমন ছিলে তুমি?
যখন চেগুয়েভারা ছিলেন কাদায় পড়ে বলিভিয়ার জঙ্গলে তাঁর
নিঃসাড় তর্জনী রেখে মুক্তি ও সাম্যের দিকে, দীপ্র
সূর্যোদয়ের উদ্দেশে
তখন কোথায় ছিলে তুমি?
তখন কেমন ছিলে তুমি?
ও দৃষ্টির সরিয়ে নাও আমার অস্তিত্ব থেকে, আমি
পুড়ে যাচ্ছি, হে মহিলা, মদির অনলে।
এ দাহ অসহ্য তবু তোমার কাছেই যেতে চাই বারংবার,
তোমার নিঝুম ঘাটে তুলে নিতে চাই
আঁজলা আঁজলা জল অকূল তৃষ্ণায়।
কখনো ভাবিনি আগে এতকাল পরে দেখা হবে পুনরায়,
কখনো ভাবিনি আগে কোনো দিন বসব তোমার
মুখোমুখি, আমাদের সংলাপে মুখর হবে অনেক প্রহর,
কাফকা ডস্টয়ভস্কি এসে বসবেন অপরাহ্নে চায়ের সময়,
চায়ের পেয়ালা তুমি সুন্দর ভঙ্গিতে তুলে দেবে
আমার ব্যাকুল হাতে, অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
আমাকে ফেরত দেবে ভুলে ফেলে-আসা।
পকেট চিরুনি।
তোমার গ্রীবার ডালে প্রত্যহ রজনীগন্ধা ফোটে,
দেখি আমি দেখি।
চারদিকে নিদ্রামগ্ন ফেরেশতার মতো জ্যোৎস্না, তুমি
জ্যোৎস্নার অধিক স্নিগ্ধতায় স্বপ্ন হয়ে আছ, দেখি
আমি দেখি।
জ্যোৎস্নার নেকাব ছিঁড়ে মাঝে-মাঝে কাক উড়ে যায়।
কত কথা বলো তুমি, অথচ যে-কথা
শোনার আশায় আমি থাকি প্রতীক্ষায় প্রতিদিন,
কাটাই নির্ঘুম রাত্রি, সে-কথা সর্বদা ভার্জিনিয়া উলফের
দূর বাতিঘরের আড়ালে, স্যামুয়েল
বেকেটের নরকের অন্তরালে চাপা পড়ে যায়।
কয়েদির খুপরির ঘুলঘুলি পেরুনো আলোর মতো
কার্পণ্য তোমার,
এবং আমিও যে গোপন উচ্চারণ চাই আমার আপনকার ঠোঁটে
তা-ও নিমেষেই
প্রস্তর যুগের স্তব্ধতার মতো অনুচ্চার থেকে যায়, জানি
অন্তর্গত বাসনার বসন্ত আমার
পুষ্পিত হবে না কোনো দিন।
জ্যোৎস্নার নেকাব ছিঁড়ে মাঝে মাঝে কাক উড়ে যায়।
কাদামাখা অবেলায়
এখনও এখানে অশেষ পুঞ্জীভূত
গ্রাম ও শহরে কুটির অট্রালিকায়,
রাজপথে আর অলিতে গলিতে আর
শহরতলিতে টিনশেড কলোনিতে
মধ্যযুগের বেঘোর অন্ধকার।
জংধরা এক টিনের তোরঙে ওরা
পুরুষানুক্রমে রেখেছে ঊর্ধ্ব তুলে
পোকা দংশিত আদ্যিকালের পুঁথি।
কখনো সখনো অতি ভক্তিতে মজে
জীর্ণ কেতাব মাথায় ঠেকায় শুধু।
ছেঁড়া কাঁথা আর মলিন বালিশ পেতে
ঘুমায় নোংরা ভাড়াটে বাড়িতে ওরা।
সেই কবেকার তুরানী স্বপ্ন আজও
কেরানি মনের তল্লাটে দ্যায় উঁকি।
সাতপুরুষের ভিটায় ময়াল সাপ।
আয়েশী স্বভাবে এখনও অটুট কিছু;
অথচ অভাব পোষা বেড়ালের মতো
পায়ে পায়ে ঘোরে। সোনাদানা, ঘটি-বাটি
বন্ধক রেখে জুড়ায় জঠরজ্বালা,
বসন্ত দিনে দেনায় ডুবেছে মাথা।
শিরায় শিরায় জুয়োর বনেদী নেশা,
বোঝে না নিজেই দাবার নিরঙ ঘুঁটি।
আত্মায় জমে ইট-সুরকির কণা,
হঠাৎ কখনো গহন সন্ধেবেলা
মনে পড়ে যায় বনতুলসীর ঘ্রাণ।
যুক্তিকে ওরা পাঠিয়েছে বনবাসে,
এখানে চিরায়ু ভাববিলাসের যুগ।
জ্ঞানীর বাণীতে কখনো পাতে না কান,
শুধু চুমো খায় আলখাল্লায় তাঁর।
নানা মরীচিকা দেখে দেখে কাটে বেলা।
অতীতের পানা পুকুরে প্রেতের মতো
সকাল-সন্ধ্যা বুড়বুড়ি কাটে মন।
শ্যাওলা-বিছানো বদ্ধ পানিতে ভাসে
রঙ-বেরঙের কিংবদন্তি কত,
কিংবদন্তি লেহনে ধন্য ওরা।
পঞ্জিকা আর গঞ্জিকা সম্বল
করে ওরা ধরে গায়েবী ঘোড়ায় বাজি।
চারপাশে জ্বেলে লোবান, আগরবাতি
পুরানো ক্ষতের গন্ধ মুছতে চায়,
হৃদয় ওদের উদ্ভট হানাবাড়ি।
সম্মুখে খোল রাস্তার সংকেত,
ওরা পড়ে যায় বিচ্ছিরিভাবে পথে,
হাঁটুভাঙা ভীরু হরিণের মতো ধু-ধু
ডানে বাঁয়ে দ্যাখে নেকড়ের শত চোখ।
কে তুলবে টেনে কাদামাখা অবেলায়?
কোনো কোনো কবিতা
আঙুল বুলিয়ে শূন্যে নিদ্রাহীন রাতে শুদ্ধ সাঙ্গীতিক ধ্যানে
কবিতার কথা ভাবি। কে যেন সোনালি জলধারা
কেবলি গড়িয়ে দিচ্ছে অদৃশ্য সুরাই থেকে; আঁজলা পেতেছি
ঝাঁক ঝাঁক সজারুর বিরোধিতা করে।
কবিতা দেখাতে পারে মাঝে মাঝে ক্লাউনের খেলা
হলঘরে ঝাড় লণ্ঠনের নিচে, আবার কখনো
কবিতা চটিয়ে দিতে পারে ময়-মরুব্বিকে রকবাজ যুবার ধরনে;
কোনো কোনো কবিতার প্রকৃতি বিষাদে ছায়াচ্ছন্ন অতিশয়।
কখনো কবিতা। সুরামত্ত নাবিকের মতো গান
গেয়ে ওঠে রাঙা গণিকার গলা জড়িয়ে। আবার
কখনো উদাস দরবেশ যেন ঘূর্ণি নাচে এবং মস্তিতে
ভরপুর; কোনো কোনো কবিতার এমনই স্বভাব,
শিশুর সারল্যে প্রজাপতিদের রঙিন পেছনে ছোটে, ভাঙে
বাবুই পাখির বাসা। কোনো কোনো কবিতার বুকে
বিলের হাঁসের উষ্ণ বুকের স্পন্দন শোনা যায়।
কখনো কবিতাবলি সংবাদপত্রের দিকে পিঠ দিয়ে বেড়ালের চোখে
বিশ্বরূপ দ্যাখে, খরগোশের মতো লাফিয়ে বেড়ায়
ঘাসে ঘাসে, কখনোবা কমলালেবুর রস হয়ে
রোগীর তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে ঝরে যায়, ইবনে সিনার
মনীষার মতো জ্বলজ্বলে, সদ্য তন্বী, গানে-পাওয়া।
কোনো কোনো কবিতা রহস্যময় বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে
জ্যোৎস্না রাতে কোনো কোনো কবিতাকে মনে হয় একান্ত পথিক
ধুলোময় পায়ে দূর তীর্থে চলেছেন একা। কোনো কোনো
কবিতা প্রকৃত
বিপ্লবীর মতো তার প্রিয়তমা রমণীর স্তনচূড়া, নাভিমূল থেকে
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বয়ম্ভর দুর্গম টানেলে সরে যায়।
কোনো কোনো কবিতা কী সুখে ঘর-গেরস্থালি করে,
কখনো কবিতা এক মুখ ব্যান্ডেজের ফাঁকে দুই ফোঁটা চোখ,
কোনো কোনো কবিতা কখনো উপদ্রুত এলাকায়
ত্রাণ সামগ্রীর মতো সেবাপরায়ণ।
খাঁচা
এ কোন খাঁচায় আছি? চাবি দেয়া পুতুলের মতো
ঘুরি ফিরি, মাথা নাড়ি; ক্লান্ত হ’লে শিক গুনে গুনে
ঘুমের খাঁচায় ঢুকি। বস্তুত এমন খাঁচাব্রত
একনিষ্ঠ সাধকেরও সাধ্যাতীত। যতদূর শুনে
কিংবা গ্রন্থপাঠে জানি দীপঙ্কর অথবা মেধাবী
শ্রীজ্ঞান, ইবনে সিনা ছিলেন না এমন খাঁচায়
কোনো দিন, সত্যসন্ধ ইতিহাস করবে না দাবি
ওরা খুটেছেন করুণার ছোলা দৈনিক বাঁচায়।
আমি তো ভালো আছি, কী বিমূঢ়; যা খুশি রটাক
নিন্দুকে, পাতি না কান কিছুতেই। যদি তর্ক ওঠে
বলব বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে, ‘বুঝেছ হে, এই
দুনিয়ায় সকলেই নিজস্ব খাঁচায় বন্দি’; যাক,
দিন মন্ত্রেতন্ত্রে কেটে যাক, স্বপ্ন শিকে মাথা কোটে
কুটুক, এখন দ্বার খুললেও থাকব খাঁচাতেই।
চাঁদ সদাগর
আমি কি এখন সত্যি বেঁচে আছি? না কি জীবন্মৃত
পড়ে আছি বিড়ম্বিত মাস্তুলের মতো। বণিকের
খ্যাতি আছে কিছু টিকে, অথচ যাই না বাণিজ্যেতে
কতকাল, কতকাল সপ্তডিঙ্গা ভাসে না তরঙ্গে
সমুদ্রের জ্বলজ্বলে প্রাসাদের মতো হা আমার
মধুকর সেই কবে গেছে ডুবে কালীদহে। শুধু
আমি একা মাঝিমাল্লাহীন নির্বান্ধব খরস্রোতে
ভেসে ভেসে জলচর প্রাণীর লোভের বিভীষিকা
নিয়ত প্রত্যক্ষ করে পৌঁছে গেছি তীরে, কী বিহ্বল
ঠেকিয়ে মাটিতে মাথা ঘুরেছি শ্মশানের কানি পরে।
বিপথে, অচেনা লোকালয়ে সম্বলহীন পথে
একমুঠো তণ্ডুলের জন্যে কাঠুরের সঙ্গে কাঠ
কেটেছি গহন বনে ঝরিয়ে মাথার ঘাম পায়ে,
পথকে করেছি ঘর। কতবার চ্যাঙড়ামুড়ি কানি
নানা ছলে কেড়ে নিয়ে আমার ঘর্মাক্ত দিনান্তের
কষ্টার্জিত অন্ন খলখল ব্যাপক উঠেছে হেসে,
ভেবেছে অভুক্ত আমি ক্ষুধার করাতে চেরা, ভয়
পেয়ে হবো নতজানু, ঘটে তার ঠেকাব আমার।
অবসন্ন মাথা দীন
ভিক্ষুকের মতো। তা হবার
নয় কোনো দিন; সত্য চাঁদ সদাগর যুবা নয়
আর, আগেকার উদ্দামতা শিরায় করে না খেলা
যখন তখন, এখন সে হন্তদীপ্তি, হীনবল,
সেই কবে অস্তমিত মহাজ্ঞান। একটি কি দুটি
নয়, ছয় ছ’টি ছেলে কালবিষে হয়ে গেছে নীল,
আমার সপ্তম পুত্র লখিন্দর, সে-ও সর্পাঘাতে
নেউল, ময়ূরময় সুরক্ষিত সাঁতালি পর্বতে
লোহার বাসর ঘরে কেমন মৃত্যুর মতো স্তব্ধ
হয়ে গেল, গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেলা অবেলায়
কলার মান্দাসে ভাসে লখিন্দর, বেহুলা বহুড়ী।
জীয়ন মন্ত্রের খোঁজে দয়িতের গলিত শরীর
আঁকড়ে তরঙ্গে নাচে সায়বেণে-নন্দিনী নাচুনি।
রাহুগ্রস্ত ঘর ছেড়ে
উঠোনে বেরিয়ে উন্মাদিনী
সনকা লুটিয়ে পড়ে পথের ধুলায় বারংবার।
‘কোথায় আমার লেখা’ বলে নিজেরই পাঁজরে করে
নির্দয় আঘাত আর নিঃসন্তার হরিণীর মতো
ঘোরে কত জনহীন আদাড়ে বাদাড়ে। আমি নিজে
বিকৃত মস্তিষ্ক এক জেদী, একরোখা লোক বলে
চম্পক নগরে পরিচিত আজ। হায়, দীপ্র, প্রিয়
নগরী আমার, একি দশা দেখি আজকে তোমার।
কেমন আন্ধার এলো নিষ্করুণ দশদিক ব্যেপে
চম্পক নগরে। সূর্যাস্তের পরে গেরস্ত রাখে না।
পা তার নিজস্ব গৃহকোণ ছাড়া অন্য কোনোখানে
আজ, আর পথে পথে বঙ্গদাড়া, বিড়ঙ্গিনী আর
তক্ষক, শঙ্কর আর মহিজঙ্গ সাপের বসতি।
ঘরে ঘরে, এমনকি প্রত্যেকের মগজের কোষে
কোষে দোলে ফণা, নিত্য দিন-দুপুরেই
পথিক লুণ্ঠিত হয় জনাকীর্ণ চৌরাস্তায় আর
প্রহরী নিশ্চল দিকচিহ্ন শুধু। এখন বাছে না
ঠগ কেউ, পাছে গাঁ উজাড় হয়ে যায়, উপরন্তু
নারীর শ্লীলতাহানি করে না অবাক কারুকেই।
সৎ অসতের ভেদাভেদ লুপ্ত, মিথ্যার কিরীট
বড় বেশি ঝলসিত দিকে দিকে, লাঞ্ছিত, উদভ্রান্ত
সত্য গেছে বনবাসে। বিদ্বানেরা ক্লিন্ন ভিক্ষাজীবী,
অতিশয় কৃপালোভী প্রতাপশালীর। নব্য কত
ক্রোড়পতি করে ক্রয় সাফল্যের অন্দর বাগান,
দরিদ্র অধিকতর দরিদ্র হবার ফাঁদে পড়ে
কাঁদে, করে করাঘাত দিনরাত সন্ত্রস্ত কপালে,
নীতির বালাই নেই, ঔদার্য, মহত্ত্ব ইত্যাদির
কানাকড়ি মূল্য নেই আর। আদর্শ বিনষ্ট ফল
যেন, নর্দমায় যাচ্ছে ভেসে; মতিভ্রম স্ফীতোদর
সফল বণিক, নগ্ন ক্ষমতার লড়াই চৌদিকে
উন্মুখের ভয়ংকর উৎসবের মতো আর দ্বৈত
শাসনের খাঁড়া ঝোলে দিনরাত মাথার ওপরে।
আন্ধার প্রথার কাছে আনুগত্য করেছে স্বীকার
স্বেচ্ছায় সবাই প্রায়, অদ্ভুত আচার, কুসংস্কার
মেলেছে অদৃশ্য ছাতা সুবিশাল, শিবিরে শিবিরে
ভীষণ বিভক্ত আজ বিপন্ন মানুষ।
মোদ্দা কথা,
চম্পক নগরে সর্বনাশ পরাক্রান্ত জোতদার
আর আমি ধূলিম্লান পরাস্ত, বিফল ছন্নছাড়া
আন্ধার ভাঁটার টানে সে কোথায় উধাও আমার
সপ্তডিঙ্গা মধুকর, বুকের মানিক লখিন্দর।
আমি একা ডিঙির মতন ভাসি দুঃখের সাগরে,
এই আমি চন্দ্রধর বণিক আমারই রিক্ত ছায়া।
কোথায় নর্তকী আর কোথায় বিদ্যুৎ বাজিকর?
প্রকৃতই পরাভূত আমি? কপালে গ্লানির টিকা
বয়ে নিয়ে সারাক্ষণ কাটাব জীবন অচেতন
কীটপতঙ্গের মতো? যদিও ধ্বংসের পদচ্ছাপ
আমার জীবন জুড়ে রয়েছে করাল, তবু আমি
নিজেকে পরাস্ত বলে ভাবতে পারি না কিছুতেই।
মতিচ্ছন্নতায় অলৌকিক চালচিত্র দেখে ভাবি
জীবন সনকা তবু সনকাও নয়, দরিয়ায়
মধুকর, তবু মধুকরও নয়। তবে কি জীবন
শুধু ধু-ধু সমুদ্দুরে পাড়ি দেওয়া? কালবৈশাখীর
ঝড়ে কাষ্ঠখণ্ড ধরে ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে-যাওয়া?
বুঝি তাই আজও আমি সাঁতালি পর্বতে ঘুরে ঘুরে
মধ্যরাতে পাঁড় মাতালের মতো আরো এক ভাঁড়
মদিরার স্বাদ পেতে চাই খাদের কিনারে ব’সে।
জীবন জটিল এক
অরণ্যের মতো জায়মান,
কখনো ভাবিনি আগে। প্রৌঢ়ত্বের তামাটে প্রহরে
কত কথা মনে পড়ে। স্মৃতিও জটিল বড়, জানি
যা ঘটে এবং যা ঘটবে ভবিষ্যতে, সবকিছু
মানুষের চৈতন্যের অন্তর্গত, অবচেতনের
গোধূলিতে লীলায়িত ক্ষণে ক্ষণে। সেই যে প্রথম
গাঙ্গুড়ের জলে আমি ভাসিয়েছিলাম সপ্তডিঙা,
সনকার আগে যার সঙ্গে গোপনে করেছি কেলি,
তার স্তনচূড়া ত্রিবলির মদির চমক আর
কারুকাজ-খচিত বাসর ঘরে সনকার কালো
চোখের প্রথম চাওয়া, আলিঙ্গন, সলজ্জ চুম্বন,
গৃহকোণে পড়ে থাকা সুবর্ণ চিরুনি, উষাকালে
ভোরের আলোর মতো নবজাতকের আগমনী
চিৎকার এবং কালীদহে সঙ্গীদের বিপন্নতা,
গহিনে তলিয়ে যাওয়া, বিষধর সাপের অব্যর্থ
ছোবলে অকালমৃত পুত্রের শরীর, অবেলায়
গাঙ্গুড়ের জলে ভাসমান ভেলা এবং ভাঁড়ারে
খাদ্যান্বেষী মুষিকের নৈশ চঞ্চলতা, নিষ্ঠাবান,
সেবাপরায়ণ ন্যাড়া, দুঃখের দিনের সহচর,
তার পদ্ধতি, কিংবা বাণিজ্যেতে লভ্য চমৎকার
মুদ্রার ঝংকার, নরসুন্দরের গোঁফ, দূরাগত
ঝঞ্ঝাহত নাবিকের রহস্য-কাহিনী, মধ্যরাতে
শোনা কারো কণ্ঠস্বর-সবই তো আমাতে অন্তর্গূঢ়।
যা দেখি এবং যা দেখি না হয়তোবা অন্তঃস্তলে
করি অনুভব, তার মিশেলে যা গড়ে ওঠে, তাকে,
হ্যাঁ, তাকেই তো স্মৃতি বলে জানি। স্বরণ নাছোড় বড়;
সে তবে কোমল কোনো স্পর্শ লেগেছিল ত্বকে, সেই
সুখ আজও সঞ্চারিত হয় অনিবার্য মাঝে মাঝে
অভিজ্ঞ শিরায় আর যত স্বর শুনেছি একদা,
ওরা বেজে ওঠে শূন্য প্রহরের প্রহরে, সে গুঞ্জন
দেয় না আমাকে একা থাকতে কখনো। কিংবা যত
সুন্দর কুৎসিত দৃশ্য করেছি প্রত্যক্ষ, তার ছায়া
খুব ঘন হয়ে করে বসবাস আমার ভেতরে;
হঠাৎ ঢাকের শব্দ শুনি যেন, নাকি আমি
মদ্যপান-জনিত বিভ্রমে শুনি তীব্র বিস্ফোরণ-
মূলক আওয়াজ শুধু। এই তো সমুদ্র দিল ডাক
বাজিয়ে তরঙ্গশাঁখ; এ কোনো নিপুণ জাদুকর
বানায় নতুন ডিঙা সারি সারি চোখের পলকে?
কী এক আক্রোশে আজ
আমার জীবন অকস্মাৎ
প্রচণ্ড চিৎকার হয়ে ফেটে পড়তে চায়, পুনরায়
কালীদহে যেতে চায় এ জীর্ণ শরীর ভয়াবহ
সর্পকুণ্ডলীর মতো ঘূর্ণিজলে লড়বার খর
আকাঙ্ক্ষায়; জরার তমসা ঘিরে ধরেছে আমাকে;
মাথায় কালোর চেয়ে রৌপ্যবর্ণ কেশই বেশি আর
চক্ষুদ্বয় ছানিগ্রস্ত দীপ যেন, সাগ্রহে তাকাই,
অথচ দেখি না স্পষ্ট কিছু, শুধু দেখি অমঙ্গল
এসেছে ঘনিয়ে চতুর্দিকে এই চম্পক নগরে।
যেন এ নগরী আজ সম্পূর্ণ অচেনা পরদেশ,
যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি নেই আর,
যেখানে নাগিনী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নেই, আর,
যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কবির অভীষ্ট
কোনো জয়গাথা নেই, কাকতাড়ুয়ার মূর্তি ছাড়া
অন্য কোনো মূর্তি নেই, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রেত ছাড়া
অন্য কোনো বাসিন্দার আনাগোনা নেই। তবু আমি
বাঁচার উপায় নেই জেনেও এখনও আছি বেঁচে
হিন্তাল কাঠের কারুকাজ-খচিত লাঠিতে ভর
দিয়ে আর সমুদ্দুরে পাড়ি দেবার দুর্মর স্বপ্নে
সর্বদা বিভোর হয়ে। আর এই শ্মশানের কালো
ভস্মময় মাটিতে উবুড়-হয়ে-থাকা কলসের
মতো থাকব না পড়ে এক কোণে, এই তো আবার
আমাতে প্রত্যক্ষ করি বলিয়ান নবীন উত্থান।
উধাও বাতের ব্যথা, স্বচ্ছ দৃষ্টি, রক্তের ভেতরে
কেমন চাঞ্চল্য জাগে, যেন এক সম্পন্ন তরুণ
সদাগার চকিতে আমার সঙ্গে করেছে বদল
আপন অস্তিত্ব তার। এভাবেই কখনো কখনো
অন্য কেউ, দূরবর্তী কেউ এসে এসে যায় আমাদের
মধ্যে আর আমরা তখন তার মতো আচরণে
কিছুটা অভ্যস্ত হই, তার শক্তি, শৌর্য করে ভর
আমার ওপর পেয়ে যাই ভিন্ন দ্বিতীয় জীবন
বস্তুত অস্থায়ীভাবে। তারপর দক্ষ অভিনেতা
যেমন যাত্রার বেশভূষা ছেড়ে ফিরে আসে ফের
একান্ত আপন অবয়বে, তেমনি আমাদেরও ঘটে
করুণ প্রত্যাবর্তন; রাত্রির রুপালি স্বপ্ন মুছে
যায় অকস্মাৎ রূঢ় দিনে। অপার বিস্ময়, আজও
সাপের স্পর্শের মতো চমকিত অস্তিত্ব আমার।
যতদিন হিন্তাল কাঠের
লাঠি আছে হাতে, আছে
ধমনীতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে
আমার মুহূর্তগুলি ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে
নিমেষে উঠবে ভেসে কোনো শোভাযাত্রার মশাল,
করব না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন,
যতই দেখাক ভয় একশীর্ষ, বহুশীর্ষ নাগ,
ভিটায় গজাক পরগাছা বারংবার, পুনরায়
ডিঙার বহর ডোবে ডুবুক ডহরে শতবার,
গাঙ্গুড়ের জলে ফের যাক ভেসে লক্ষ লখিন্দর।
জাতিসংঘে অবিরল তুষার ঝরলে
জাতিসংঘে অবিরল তুষার ঝরলে
পৃথিবীতে বসন্তের ফুল
চাপা পড়বে না।
বাংলাদেশে ভূমিহীন চাষীর সংসার
ছারখার হলেও নিশ্চিত
জাতিসংঘে প্রার্থনার ঘরে নিমগ্নতা
থাকবে অটুট।
কে সুন্দরী ডলারের শূন্য মালা গাঁথে
স্বপ্নের গহনে?
নিউইয়ের্কের পূর্ণ সুপার মার্কেটে ঝলমলে
দ্রব্যের জগতে
মনে পড়ে, তাকে মনে পড়ে, নিগ্রো ঘেটোর মতন।
হৃদয় আমার অকস্মাৎ আর্তনাদ করে ঘোর অবেলায়।
এখানে কী করে মনে পড়ে তাকে? কেমন নাছোড়
খাপছাড়া মন, তাই অবচেতনায়
চিত্রল হরিণ চিতাবাঘ, তার কী ফুল্ল শরীর
ভেসে ওঠে বারংবার। আমার দু’দিকে বাহরাইন, বাহামা
বার্বাডোস, পারমাণবিক ভস্মরাশি
কে ছড়াল
কোথায় কোন সে পাতালের
নির্জন অতলে,
নিঝুম সীমান্তে দিল হানা কারা উর্দি-পরা
তা নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি। এরই মাঝে
সহসা সে উঠে আসে আফ্রোদিতির মতন
শরীরে স্বপ্নের ফেনা নিয়ে।
মেশিন দলিল দস্তাবেজ সংঘ সংস্থা
ব্যক্তিকে নিয়ত টানে কী ধূসর নামহীনতায়।
জাতিসংঘ পরিণামহীন দেবতার মতো ডানা
ঝাপটায় শূন্যতায়। জাতিসংঘের ঠক বন্ধ
হলেও তৃতীয় বিশ্বে নবজাতকের নতুন চিৎকার বেজে
উঠবে নিয়ত, শীর্ণ হাত প্রসারিত হবে ক্রমে
সভ্যতার দিকে।
তুমি কি আসবে ফের
ভোরের গোলাপ দ্যাখো মেলেছে কী পূর্ণ দৃষ্টি তাজা,
টেবিলে রোদের গাথা, হলতে পর্দা দোলে মাত্রাবৃত্তে;
উড়িয়ে-আঁচল, ঢেউ তুলে বায়ুস্তরে একাকিনী
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
বাগানে পাখির ঝাঁকে, পাতায়-পাতায় আনন্দের
গুঞ্জরণ, আলনায় শার্ট আর পাজামায় জাগে
শিহরণ অব্যক্ত স্বপ্নের মতো। সুগন্ধি নিঃশ্বাস নিয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
পুরোনো কবরে সাদা কবুতর ঝরিয়ে পালক
উড়ে যায় আসমানে, গোর-খোদকের শক্ত হাতে
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে গন্ধরাজ, মাধুর্যে সুস্মিতা,
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
এই তো ডালিম গাছে কত যে স্বপ্নিল টেলিগ্রাম,
টেলিফোন যেন মেঘচর পাখি বিমুগ্ধ উড্ডীন,
তোমার চন্দ্রালোকিত কণ্ঠস্বর হওয়ায় ঝরিয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
বৃষ্টিতে পাখির কান্না, আমার হাতের নখ থেকে
ভুরু থেকে, ওষ্ঠতট থেকে নিঃসঙ্গতার মতন
বৃষ্টি ঝরে অবিরল, কালো বৃষ্টি-জাল ছিন্ন করে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
যে-দরজা নেই তা খোলার জন্যে একটি সোনালি
চাবি পেয়ে গেছি গোধূলিতে, একজন আলুথালু
কিশোর সারস হাতে রয়েছে দাঁড়িয়ে-সেই পথে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
রেশমি পতাকা হয়ে ওড়ে খবর কাগজ আর
কফির বাতিল কৌটো, পিলসুজ স্বপ্নে ভরপুর;
কবি শব্দহীনতার ছায়ায় ঘুমোয়, বাণী হয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
পতাকারই মতো গহন সৌন্দর্যে একা
কাউকে কিছু না বলে কখন যে ফাল্গুন হঠাৎ
সটকে পড়েছে। এখন তো বাংলাদেশ
চৈত্রের চিৎকার
পাতার আড়ালে, শ্রমিকের
পাতের গরম ভাতে, নিউজপ্রিন্টের ভাঁজে ভাঁজে
পঙ্গু প্রেমিকের হাহাকারে,
নিশাচর কুকুরের চোখে,
চন্দ্রাহত হা ভাতে বস্তির
অরক্ষিতা তরুণীর যৌবনের উদগ্র চিতায়।
মুংকের চিত্রের চিৎকারের মতো একটি চিৎকার,
চরাচরব্যাপী,
ইদানীং এ শহরে কী ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছে, মনে হয়,
মূক বিপর্যয়বোধ নিয়ে।
বিপর্যয়ে অনেকেই ভীষণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বারংবার
নানান উদ্ভট চিত্রকল্প ঘিরে ধরে
তাদের এবং ওরা ভয় পায়, বড় ভয় পায় এমনকি নিজেদের
ছায়া দেখলেও।
কেউ কেউ উন্মাদের মতো আচরণে
পাড়া-পড়শিকে আরও বেশি
করুণ ভয়ার্ত করে তোলে। বিপর্যয়ে কেউ কেউ
মাথা ঠাণ্ডা রাখে, থাকে স্থির,
যেনবা নক্ষত্র এক, দিগ্দর্শনের আলো আছে,
স্বতন্ত্র স্বভাবে
এক কর্তব্যরত প্রহরীর মতো কেউ কেউ সুষ্ঠুভাবে
শিবিবের তদারক করে। অকস্মাৎ
রসদ ফুরিয়ে গেলে, শিরায় শিরায়
কুয়াশার হিম
ছড়িয়ে পড়লে দাঁতে দাঁত চেপে, কষে ধরে মুঠোয় পতাকা
সটান দাঁড়িয়ে থাকে পতাকারই মতো গহন সৌন্দর্যে একা।
বিপুল ধ্বংসের তাণ্ডবেও কবিতার ডানা লীলায়িত হয়,
বিধ্বস্ত ছাদের নিচে, ভাঙা দেয়ালের
আড়ালে জ্যোৎস্নায় তীব্র চুমো খায় যুবক-যুবতী।
বসন্ত বরের মতো আসে ভাঙাচোরা পথে অভ্যর্থনাহীন,
বৃদ্ধেরও সংগমস্পৃহা খুব বেড়ে যায় রাতারাতি।
ধ্বংসস্তূপ থেকে কেউ তুলে নেয়
পিতলের বাঁশি,
কেউবা নিঃসীম প্রেতায়িত পূর্ণিমায় কী ব্যাকুল
কণ্ঠস্বরে পাষাণপুরীর
পাথুরে বাসিন্দাদের স্তব্ধ ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করে প্রহরে প্রহরে।
প্রকৃত প্রস্তাবে
ভালোই আছি আজ, জ্বরের নেই তাপ;
সময় ভালো বটে শীতের কিছু পরে।
হঠাৎ চেয়ে দেখি এসেছে কোত্থেকে
চড়ুই পাখি দুটি এসেছে এই ঘরে।
এ ঘরে বসবাস আমার বহুকাল।
স্মৃতির মেঘমালা বেড়ায় ভেসে মনে :
কেটেছে ক’দিন নানান বই পড়ে,
কখনো গান শুনে, কখনো চুম্বনে।
এ ঘরে কত রাত ভালেরি এসেছেন,
কখনো কালিদাস, বোদলেয়ার, রুমি।
পেরিয়ে স্বপ্নের সুনীল সেতু আর
টানেল কুহকের কখনো আসো তুমি।
এখানে এই ঘরে সকালে মাঝরাতে
টেবিলে ঝুঁকে লিখি; হারিয়ে ফেলি পথ
কখনো শব্দের গহিন জঙ্গলে।
কখনো পাই কত পঙ্ক্তি মৃগবৎ।
চড়ুই নীড় বেঁধে এখানে এই ঘরে
রাখতে চায় তার প্রেমের স্বাক্ষর।
অথচ জানে না সে বিপুল চরাচরে
প্রকৃত প্রস্তাবে আমারই নেই ঘর।
ফাঁসি
কাল তার ফাঁসি হবে। কেন হবে, তা সে জানে না এবং
জানে না বলেই অস্বস্তির পোকা তার
মগজের কোষে কোষে ঘোরে। পাঁজরে কী যেন পোড়ে,
ঘন ঘন বৃক্ক স্ফীত হয় আর
কখনো নিজেকে তার আনাজের বাকলার মতো মনে হয়
দেয়ালে ঠেকলে পিঠ।
এখন সে স্মৃতির ব্যাপক বেড়াজালে
আটকা পড়েছে। পেতলের বাসনের মতো ঝন্ ঝন্
বেজে ওঠে তৃতীয় এবং মনে পড়ে তার একদা দেয়ালে
লিখেছিল সে আবেগে কম্পমান; ‘ভুলব না কখনো তোমাকে’।
কাকে ভুলবে না?
অন্ধ সেলে দ্যাখে কবেকার বইয়ের পাতার
ফটোগ্রাফ থেকে
আসেন কী রাজসিক উঠে ক্ষুদিরাম; ফুচিকের
কাঁটাতারে বিদ্ধ টকটকে
গোলাপ-হৃদয় জ্বলে ওঠে অন্ধকারে। আর কিছু
পারস্পর্যহীন ছবি খেলা করে নির্ঘুম প্রহরে।
মৃত্যু তার মাথার ওপর
অচিন পাখির মতো চক্রাকারে ওড়ে বারে বারে;
তুড়ি মেরে উড়িয়ে সে দিতে চায় ওকে,
অথচ নাছোড় পাখি নেয় না গুটিয়ে তার ছায়া
কিছুতেই সেল থেকে। হঠাৎ সে দ্যাখে
ধূসর পাজামা তার কখন যে ভিজে গেছে উদাস পেশাবে।
দেয়ালে ঠেকিয়ে মাথা বলে নিজেকেই,
তোমার অস্তিত্ব আজ, বুঝছ, হে, তুমুল নিঃশব্দ অট্রহাসি।
আজ তার মনে হল-দরজায় মাধবীলতার
স্পন্দন, পাখির নাচ, পূর্ণিমার উচ্ছল চন্দন,
বিড়ালের চোখ, পাথরের মূর্তি,
রেকারি, কাচের গ্লাস, একটি মুখের রেখা, টুকরো
কথার এমন আকর্ষণ
কখনো জানেনি আগে। আজ অকারণ
বুকের ভেতরে তার যে কাঁদে একাকী
তার প্রতি এত ভালোবাসা এতকাল
কোথায় লুকিয়ে ছিল?
কাল তার ফাঁসি হবে।
শেষ ইচ্ছা পূরণের ছলে কারুকে সে
দেখতে চায়নি, এমনকি
একটি অন্তিম সিগারেটও করেনি প্রার্থনা। শুধু
মনে-মনে চেয়েছিল দেখে নিতে পৃথিবীর রূপ
পুনর্বার। এখন সে কয়েদখানার
ঘুলঘুলি থেকে চুয়ে-পড়া
বখিল আলোয় রাখে ওষ্ঠ থরথর, যেন
চুমু খেল দয়িতার ঠোঁটে।
বন্ধুকে প্রস্তাব
এই যে ইয়ার খানিক দাঁড়াও। এমন হনহনিয়ে
কোথায় যাচ্ছ? এত তাড়া
কিসের মানিক? আখেরে কথায় পৌঁছতে চাও?
এতকাল পরে
এ-শহরে হঠাৎ তোমার সঙ্গে মোলাকাত;
দু-দণ্ড বাতচিত করা যাক কোথাও আরামসে ব’সে
যৎকিঞ্চিৎ ভেজানো যাক গলা। নাকি
এভাবেই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে
কিস্সা খতম করে দেবে, ভেবেছ।
চলো না যাই, চা খাই ব’সে আমাদের সেই
চেনা চা-খানায়! বিলকুল আগের মতোই আছে বেবাক;
শুধু চেয়ার আর টুলগুলো আরও নড়বড়ে
হয়েছে, টেবিলগুলো রোঁয়া-ওঠা
কুকুরের মতো আরও বয়স্ক। সেই কোঁকড়া-চুল
বেয়ারাটা-মনে পড়ে ওর কথা-গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে
তিন বছর আগে। আজ থেকে-থেকে কত স্মৃতিই না জাগে
তোমার দিকে তাকিয়ে,
তোমার ছাই ঝাড়ার ভঙ্গি দেখে।
তো, মাই ডিয়ার ফেলো, আজকাল
কী হাল-হকিকত তোমার, মঞ্চে-টঞ্চে কেমন
বোলচাল দিচ্ছ, বলো। লেখা-টেখার ময়ূরপঙ্খী নাও
বাইছ কোন খালে? এখনও কি হর-হামেশা
পুরোনো নেশায় মজে মেতে হুজুগে
তেমন মালই চালাচ্ছ যা চার যুগ আগেই
বস্তাপচা বলে বাতিল করেছে ইউরোপ। দাদাবাদের ভূত
আজও কি নামেনি ঘাড় থেকে?
উড়ো কথা কানে আসে, তুমি নাকি
কবিতা লেখার ফাঁকে-ফাঁকে সস্তা চিটচিটে
উপন্যাসের ঊর্ণাজালে পাঠক আটকে
কেল্লাফতে করছো। তাহলে কী হিল্লে হবে
আমাদের অহল্যা কাব্যের
সত্যি দোস্ত, তোমার রকম-সকম
ভালো ঠেকছে না। খাতায় খাতায় আদুরে পায়রার
চোস্ত বকবকম বুলি ছিটিয়ে
চালাবে আর কতকাল? একদিন যারা
তোমার এই কানামাছি খেলা হাতে-নাতে ধরে ফেলবে,
তারা বাড়ছে ঘরে-ঘরে। আচ্ছা,
তোমার এত কেমন খেয়াল বলো তো, প্রহরে-প্রহরে
মিথ্যের সাজি ভরে তুলে কী আনন্দ পাও তুমি? বরং
যা কিছু সাচ্চা তার জন্যে
উঠোন নিকিয়ে রাখো, মাধুর্যের রঙ ছড়িয়ে আলপনা আঁকো,
খুলে রাখো দরজা।
এবার তোমার ক্রীতদাস লেখনীকে
স্পার্টাকাসের মতো ঘাড় ঝাঁকিয়ে, শক্ত, ঠাণ্ডা শেকল ছিঁড়ে
আয়ামে জাহেলিয়াতের দম-বন্ধ করা অন্ধকারে
নতুন কথার স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে বলো।
ভ্রাতৃসংঘ
(অগ্রজ জনাব আজিজুর রাহমান চৌধুরীকে)
আমার প্রথম ভাই কান্তিমান, স্কুল-ছুট, সতত বালক
(এমনকি মধ্যবয়সেও)
নবাববাড়ীর নওশা, আলাভোলা, প্রখর, যৌবনে
ছিলেন উড়নচণ্ডী। পরিণীতা, পুত্র রইল পড়ে
এবং হলেন তিনি দেশান্তরী, ঘুরে বেড়ালেন
সার্কাস পার্টির সঙ্গে। সাত ঘাটে আঁজলা ভরিয়ে,
ভিজিয়ে পায়ের পাতা একদিন শেষে
ঘরের উধাও ছেলে ফিরে এলো ঘরে। তারপর
কাটে তাঁর অনুজ্জ্বল বৈচিত্র্যরহিত দিনগুলি
সংসারের ভাঙ্গা
খাঁচায় এবং অকস্মাৎ
কোনো মধ্যরাতে খাঁচার ভিতর থেকে
অস্থির অচিন পাখি উড়ে গেল অনন্তের দিকে।
আমার দ্বিতীয় ভাই, আবাল্যে তুখোড় ডানপিটে,
দীর্ঘকায়, সুদর্শন, পৌরুষে ভাস্বর।
ভ্রমণবিলাসী তিনি কলেজ পালিয়ে মেহগনি বাক্স ভেঙে
ঘুরেছেন দাক্ষিণাত্যে মন্দিরে মন্দিরে, অজন্তার
বিখ্যাত গুহায় আর দিলেন কাটিয়ে
দিল্লিতে ভক্তিতে মজে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে
দু’তিন বছর। গত বিশ্বযুদ্ধে পাঠাতেন তারবার্তা
ব্রিটিশ জাহাজ থেকে, মনে পড়ে। হঠাৎ খেয়ালে
জাহাজের খোল ছেড়ে সেই যে এলেন
নিজের ডাঙায় ফিরে, তাকে আর ভোলাতে পারেনি
সমদ্রের গান; এমনকি যে ইহুদি রমণী বিদেশে
ছিলেন দয়িতা, তার ঘাগড়ার রেশমি টান, চোখের কুহক
ফেরাতে পারেনি তাঁকে ভবঘুরে জীবনের বাঁকে
বাঁকে, অনন্তর সমুদ্রের ঢেউ নয়, কোনো রমণীয় শরীরের
চড়াই-উতরাই নয়, তরুণ ঘোড়ার
পেশি-তরঙ্গের প্রতি
কী দুর্মর আকর্ষণ তাঁর। রেসের মরীচিকায়, তাসের আড্ডায়
রেখেছেন জীবন বন্ধক।
এখন যখন তিনি আরমানীটোলার পথ দিয়ে
হেঁটে যান ক্লান্ত, রুগ্ন, ভীষণ একাকী,
যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো,
তখন মুখাবয়বে তাঁর ছয় দশকের আর্তি,
বহ্নুদ্যৎসব, হাহাকার,
প্রমাদ, চিৎকার জেগে থাকে অবেলায়।
আমার তৃতীয় ভাই ছিলেন মাঝারি গড়নের,
ইস্পাতি শরীর তার ঝলসাত মাঠের রোদ্দুরে গোল্লাছুট
কাবাডি খেলায়,
ক্রোধের ভিমরুল তাঁকে কামড়ালে, কালো কপালের
কাটা দাগ আরও চিকচিকে আর গাঢ় হয়ে যেত।
কখনো কখনো তিনি নাকীসুরে খুব দুলে দুলে
গাইতেন ফিল্মি গান এবং বন-বাদাড়ে একা-একা
কাটত সময় আর বলতেন তাঁর
চোখ ভেসে ওঠে কত
সুন্দর আজীব গাছপালা, জীব-জানোয়ার কিমাকার আর
অতল পাতাল।
যখন এ. আর. পি.-তে লেখালেন নাম,
উর্দি-পরা তাঁকে
দিব্যি বীর-বীর লেগেছিল। ছিলেন অকৃতদার আর
অকস্মাৎ এ কি বজ্রপাত
আমাদের ঘরে-
আমার তৃতীয় ভাই ক্রূর পিত্তশূলে হলেন অকালমৃত
প্রেমিকার চুম্বনবিহীন,
সন্তানের আলিঙ্গনহীন।
আমার চতুর্থ ভাই পিতার মিনিয়েচর, তেজী
একরোখা, স্পষ্টভাষা! ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ডে
সর্বদা নিবদ্ধ দৃষ্টি তার, উপার্জনে নিয়ত সংগ্রামশীল,
সামাজিক নিমন্ত্রণে অকুণ্ঠ, উদার;
ভোজনবিলাসী, নীড়প্রিয়
বাবুই পাখির মতো গোছায় সংসার প্রতিদিন।
পুরানো প্রথাম প্রতি নতজানু; এই শতকের
রোদে পিঠ দিয়ে ভালোবাসে মধ্যযুগী মায়াবী আঁধার।
নিত্য সুরে-সাদেকের আলো-আঁধারিতে
করে পাঠ কলমা দরুদ।
আমার পঞ্চম ভাই সুকান্ত, সৌজন্যময় আর
রুচিবান এবং সবার প্রীতিসাধনে তৎপর
সর্বক্ষণ, পরমতসহিষ্ণু অথচ সুতাকিক।
গোঁড়ামির প্রতি সায় নেই তার, গ্রন্থপ্রিয় মন
করে বিচরণ মুক্তবুদ্ধির মিনারে, উপরন্তু,
সংগীত-নির্ঝরে স্নাত নিয়মিত, আদালতে
সাজিয়ে কথার পিঠে চোস্ত কথা কুড়ায় বাহবা,
দীপ্ত অধ্যাপকও বটে। বস্তুত সে স্নিগ্ধ বুদ্ধিজীবী।
আমার কনিষ্ঠ ভাই চটপটে, বেপরোয়া, বড় ঝলমলে;
নিখুঁত টাইয়ের নট, গায়ে হাল-ফ্যাশনের নানা
পোশাক-আশাক।
আকৈশোর অভিযানে মাতাল। তাই সে
প্রায়শ জমায় পাড়ি দূর দেশে, যেন
কোনো নামহীন দ্বীপ থেকে
আনবে নির্যাস ছেঁকে রহস্যের কিংবা অতল পাতাল থেকে
মণিরত্ন, যেন নিমেষেই নেমে যাবে তুড়ি মেরে
দুর্গম খনিতে একা। নৈরাশ্যের থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে জোরে
‘যে যাই বলুক আমি বাণিজ্যেতে যাবোই’ বলে সে
আমার কনিষ্ঠ ভাই ভাসিয়েছে সমদ্রে জাহাজ।
কখনো-কখনো ভাবি আমার ভ্রাতৃ-সংঘের কতটুকু আছে
নিহিত আমার মধ্যে? কার চোখ, কার মুখভঙ্গি
হুবহু প্রতিফলিত আমার সত্তায়?
কার কোন আচরণ করি ব্যবহার মুদ্রাদোষের মতন
আমিও অজান্তে মাঝে মাঝে?
আর মাঝে-মধ্যে আমাদের
বংশের প্রাচীন
নামহীন কত পুরুষের অজ্ঞাত জীবনী
মন্ত্রের মতন গুঞ্জরিত হতে চায়
আমার নিজস্ব অবচেতনের রহস্য-শোষক তন্দ্রাচ্ছন্ন স্তরে স্তরে।
মধ্যবিত্তের পাঁচালি
এখানেও নেই, ওখানেও নেই-
মধ্যিখানেই বেঁধেছি ডেরা।
ধু-ধু পোড়ো মাঠে শরাহত ঘোড়া
জীবন নষ্ট স্বপ্নে ঘেরা।
সে কবে সুদূর বেঞ্চিতে ব’সে
বর্ণমালার জেলে দেয়ালি,
বিপর্যয়ের জ্বের টেনে আজ
খেটে খেটে হাড় করছি কালি।
একদা মজেছি মায়া সরোবরে,
জলকন্যার কুহকী গানে;
মধ্যরাত্রে লিখছি পত্র
নীল কাগজের মদির টানে।
জানলা-প্রেমের মধুর ঝিলিক
ছিল জাগরুক মনের কোণে,
শেষে অবশ্য সায় দিতে হ’ল
নাছোড় পিতার নির্বাচনে।
প্রাথমিক মোহ-মাধুর্য শেষে
বৎসরান্তে পাতে ভাত বাড়া হলে,
দুখিনী মায়ের অংশ কাড়ে।
ঊনসত্তরে দরাজ গলায়
দিয়েছি স্লোগান আমিও বটে…
গণতরঙ্গে শহীদের লাশ, মেতেছি ব্যাপক ধর্মঘটে।
অনেকের মতো আড়ালেই থেকে
মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছি সায়।
যে যাই বলুক, সারকথা এই-
বিশ্বে চলছে মাৎস্যন্যায়।
ঘোর সন্ত্রাস, ধর্ষিতা দেশ;
অগ্নিদগ্ধ একাত্তরে
প্রাণপক্ষীকে যুগিয়েছি ত্রাণ
যত্রতত্র কলমা পড়ে।
সকাল-সন্ধ্যা মুখে বিদ্রোহী,
বিপ্লবী বুলি আউড়ে চলি।
সম্মুখে দেখি মোক্ষ লাভের
চিরায়ত সেই অন্ধ গলি।
গোষ্ঠীভুক্ত প্রাণী আমি, তবু
হঠাৎ ব্যক্তিস্বরূপ জাগে;
আবার নিমেষে গড্ডলিকায়
মিশে যাই ম্লান অস্তরাগে।
সুবিধাবাদের ঝুটা খুঁটে খুঁটে
আমিও ঈষৎ মার্কসবাদী।
মধ্যে-মধ্যে দ্বিধা-খোয়ারিতে
সহজিয়া সুরে কণ্ঠ সাধি।
একি মরীচিকা বিলাসে মজেছি
যুগসন্ধ্যায় যৌথ ভ্রমে,
বিস্মৃত কিছু প্রাণীর মতোই
আমরা লুপ্ত হচ্ছি ক্রমে।
রঞ্জিতাকে মনে রেখে
রঞ্জিতা তোমার নাম, এতকাল পরেও কেমন
নির্ভুল মসৃণ মনে পড়ে যায় বেলা-অবেলায়।
রঞ্জিতা তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কোনো কে
গ্রীষ্মের দুপুরে দীপ্র কবি সম্মেলনে
কলকাতায় ন’বছর আগে, মনে পড়ে?
সহজ সৌন্দর্যে তুমি এসে বসলে আমার পাশে।
কবি প্রসিদ্ধির
অমেয় ভাণ্ডার থেকে রত্নরাজি নিয়ে
আজ আর সাজাব না তোমাকে রঞ্জিতা। শুধু বলি,
তোমার চোখের মতো অমন সুন্দর চোখ কখনো দেখিনি। ‘বিচ্ছিরি গরম’
বলেই সুনীল খাতা দুলিয়ে আমাকে তুমি হাওয়া
দিতে শুরু করেছিলে, সেই হাওয়া একরাশ নক্ষত্রের মতো
মমতা ছড়িয়ে দ্যায়। যদি আমি রামেন্দ্র সুন্দর
ত্রিবেদী হতাম, তবে বলতাম হে মেয়ে ‘ইহাই বাঙালিত্ব’।
কিছুই বলেনি একালের কবি, শুধু মুগ্ধাবেশে
দেখেছে তোমার মধ্যে তন্বী গাছ, পালতোলা নৌকো,
পদ্মময় দীঘি আর শহরের নিবিড় উৎসব।
রঞ্জিতা সান্নিধ্য বড় বেশি মোহময় চিত্রকল্প তৈরি করে,
দেখায় স্বপ্নের গ্রীবা-বুঝি তাই আমিও ভেবেছি,
ক’দিনের সান্নিধ্যের সুরা পান করে,
একান্ত আমারই দিকে বয়েছিল তোমার গোলাপি হৃদয়ের
মদির নিঃশ্বাস আর সে বিশ্বাসে আমরা দু’জন
অপরাহ্নে পাশাপাশি হেঁটে গেছি কলেজ স্ট্রিটের
অলৌকিক ভিড়ে, ফুটপাথে ফুটেছিল মল্লিকা, টগর, জুঁই
তোমার হৃদয়ে উন্মীলিত
আমারই কবিতা আর চোখের পাতায় শতকের অস্তরাগ।
বঞ্জিতা আবার কবে দেখা হবে আমাদের কোন
বিকেল বেলার কনে-দেখা আলোর মায়ায়, কোন
সে কবি সভায় কিংবা ফুটপাতে?
রঞ্জিতা তোমাকে আমি ডেকেছি ব্যাকুল বারংবার
ডেকেছি আমার।
নিজস্ব বিবরে। এই চরাচরব্যাপী অসম্ভব হট্ররোলে
অসহায় আমার এ কণ্ঠস্বর কি যাবে না ডুবে?
কী করে আমরা ফের হবো মুখোমুখি
বিচ্ছন্নতাবোধের পাতালে?
ছদ্মবেশী নানাদেশী ঘাতকের খড়্গের ছায়ায়
কী করে আমরা চুমো খাব?
কী করে হাঁটব আণবিক আবর্জনাময় পথে?
ভীষণ গোলকধাঁধা রাজনীতি, আমরা হারিয়ে ফেলি পথ
বার বার, পড়ি খানাখন্দে, মতবাদের সাঁড়াশি
হঠাৎ উপড়ে ফেলে আমাদের প্রত্যেকের একেকটি চোখ। যে ভূখণ্ডে
রঞ্জিতা তোমার আদিবাস, তার মাৎস্যন্যায় দু’চোখের বিষ
এবং আমার মধ্যে নেই কোনো বশংবদ ছায়া।
হয়তো কখনো আর কলকাতায় যাব না এবং
তুমিও ঢাকায় আসবে না। তাহলে কোথায় বলো
দেখা হবে আমাদের পুনরায় অচেনা পথের কোন মোড়ে?
মস্কো কি পিকিং-এ নয়, ওয়াশিংটনেও নয়, ব্যাঙ্কক জাকার্তা
জেদ্দা কি ইস্তামবুল, হামবুর্গ, কোনোখানে নয়।
আমরা দু’জন
হয়তো মিলিত হবো নামগোত্রহীন
উজ্জ্বল রাজধানীতে কোনো, যাকে ডাকব আমরা
মানবতা বলে,
যেমন আনন্দে নবজাতককে ডাকে তার জনক-জননী।
রাত্রির তৃতীয় যামে
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
এখন সে জলচর পাখির মতন
ঘুমের ডহরে ভাসে একা, অচেতন। হাত দুটি
যেনবা নিস্পন্দ মাছ নদীতীরে; মাঝে মাঝে নড়ে
ওঠে ঠোঁট হয়তোবা ঘোর
নিদ্রাতুর বিরানায় করছে আবৃত্তি
অমল আয়াত।
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
রাত্রির তৃতীয় যামে স্বপ্নের ভেতরে
দেখে সে নির্জন স্থানে দাঁড়ানো। অনেক
দূরে খুব উঁচু মিনারের মতো কিছু ঘন নীল
কুয়াশায় মোড়া।
হঠাৎ একটি ঘোড়া তাকে ঘিরে খায় তিন পাক, অনন্তর
চোরাবালি বাদামি ঘোড়াকে করে গ্রাস।
স্বপ্নের ভেতরে
দেয় সে কাটিয়ে নিরিবিলি কিছুক্ষণ
সিঁড়ির ওপরে ব’সে শুনে
ঘাসের নিবিড় গাথা। কণ্ঠে তার যুগ-যুগান্তের
তিমির আছে কি মজা? নইলে কেন এত
শুকনো গলা আজ? তবে কি সে দীর্ঘকাল ঝরনা,
পুকুর, ইঁদারা কিংবা সরোবর থেকে
করেনি ব্যাকুল পান আজঁলায় নিয়ে
এক ফোঁটা পানি?
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
স্বপ্নের ভেতরে তার দেখে না সে কোনো
লম্বাটে রঙিন কাচে ফোভ ছবি, গম্ভীর দেয়ালে
কখনো করে না পাঠ স্বীকারোক্তি। তার
স্বপ্নের জমিনে ভ্যানগঘী সাইপ্রেস
কখনো ফেলে না ছায়া কিংবা তাহিতির
অজর রমণী কোনো ফলময় থালা হাতে দাঁড়ায় না এসে
ক্ষণকাল। মাঝে-মাঝে ধু-ধু
বিবাহ, মরণময় কতিপয় ছবি দুলে ওঠে
রাত্রির তৃতীয় যামে। স্বপ্নের ভেতরে তার, স্নিগ্ধ মৌলবীর,
মনে হয়, কথা ছিল পুণ্য সুরে দশদিকে যে-ডাক দেবার
বারংবার প্রকৃত সে-ডাক মানবিক
এখনও হয়নি মূর্ত কণ্ঠে তার। দিকভ্রষ্ট কোনো
করুণ পাখির মতো যেন সে নিয়ত
ডেকে যায়, অথচ ঘুমের
ভেতরে গোঙানি শুধু, কণ্ঠস্বর রুক্ষ মরুভূমিতে হারায়।
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
আলখাল্লা ফুটফুটে স্বপ্নের মতোই
লেপ্টে আছে গায়ে, খোলা মুখ যেন গায়েবী জানালা,
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
রাত্রির শূন্যতা নিচ্ছে টেনে
নিজের ভেতরে অস্তিত্বের গ্রন্থিমূলে এক নিঝুম মৌলবী।
রেডক্রসের গাড়ি এবং তুমি
রেডক্রসের গাড়ি ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো
চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল
মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে।
সেই গাড়িটার ভেতরে আশ্রয় পেলে আপাতত
বেঁচে যেতাম। ভীষণ অসুস্থ আমি, শ্বাসরোধকারী
আমার ব্যাধির কথা জানে নীলিমা, পাখির ঝাঁক, নতজানু…
রেডক্রসের গাড়ি আমাকে নিয়ে যাক
মেঘে মেঘে, দূর নীলিমায়।
রেডক্রসের গাড়ি এ মুহূর্তে আমার মন্ত্রোচ্চারণ,
অকস্মাৎ এই মরু-মধ্যাহ্নে মনে হল,
তুমি তোমার হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে
একটা চিকচিকে মরীচিকাকে মুছে ফেলে
হৃদয়ের মতো অন্তরঙ্গ হাতের তালুতে।
এই শহরের সবচেয়ে সুন্দর পাখি, ইদানীং
পাখি বড় একটা চোখে পড়ে না-
গান গেয়ে আমাকে বলেছিল ফিরে এসো।
একটি বেহালা করুণ সুরে আর্তনাদ করে উঠেছিল-
তোমার প্রতীক্ষায় আমি বাজব অষ্টপ্রহর;
পার্ক ডেকে বলেছিল, তোমার জন্যেই উন্মাচিত আমি,
ফিরে এসো। আমি ওদের ডাকে সাড়া দিইনি।
তোমার ওষ্ঠ যদি বলি, তবে আমি
কোনো সেবাসদন কিংবা রেডক্রসের গাড়ির স্বপ্ন দেখব না,
ছুটে আসব আবার।
আমি লিখছি অন্ধকার রাত্রির হৃৎপিণ্ডের ভেতরে ব’সে।
কবেকার রাস্তায় দেখা ঘোড়ার জৈবিক গন্ধ, একলা ঘরে
একজন বামনের কড়িকাঠ-ছোঁয়া উল্লাস,
আর সেসব পাখি যারা বিল ছেড়ে উড়ে যায়
আমার স্বপ্নের ভেতরে,
ক’জন তাসুড়ের বর্মী টেবিল ঘিরে ঘণ্টা ঘণ্টাব্যাপী বসে-থাকা,
হাওয়ায় ফুলে-ওঠা জকির রঙিন জামা আর রাজপথে
বয়ে-যাওয়া তরুণ বীরের রক্তস্রোত
মেশে আমার পঙ্ক্তিমালায়, কখনো কখনো
কাগজ-কলম নিয়ে সে থাকি সারারাত,
সাদা পাতার দিএক চেয়ে থাকি প্রহরের পর প্রহর
যেমন কৃষক তার শূন্য ক্ষেতের দিকে-কী করুণ আর ক্লান্ত।
একটা রেডক্রসের গাড়ি ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো
চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল রাত্রিকে
টুকরো টুকরো করে।
হঠাৎ আমার চোখে মুখে রাগে তোমার সুগন্ধি নিঃশ্বাস,
আমার কবিতার খাতায় ঠিকরে পড়ে
তোমার চোখের জ্যোতি , তোমার চোখের জ্যোতি,
তোমার চোখের জ্যোতি।
সে এক মাটির ঘর
আমি ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম এই শহরের অখ্যাত গলির
এক মাটির ঘরে;
এতকাল পরেও হঠাৎ যখন আমার হাত
নিজের অজান্তেই নাকের কাছে এসে যায়,
একটা মন-কেমন করা সোঁদা গন্ধ পাই।
যে ঘরে প্রথম চোখ মেলেছিলাম
কার্তিকের রৌদ্রে, সে-ঘরে পড়ত একটা গেয়ারা
গাছের ছায়া,
সে ছায়া এখনও ঘন হয়ে আছে আমার চোখে।
এখনও পেয়ারা গাছের আনন্দিত সবুজ পাতাগুলি
মর্মরিত আমার শিরায় শিরায়।
গাছটার ডালে অনেক দূর থেকে-আসা পাখি
যে সুর ঝরিয়ে দিত ঋতুতে-ঋতুতে
তা’ এখনও খুব গুঞ্জরণময় স্মৃতিতে আমার।
যে-ঘরে আমি জন্মেছিলাম তাকে
কিছুতেই বলা যাবে না গানের ঘর। সে ঘরে
সেতার কি সরোদ,
এস্রাজ কি সারেঙ্গি গুমরে ওঠেনি কোনো দিন।
কখনো বোল ফোটেনি তবলায় কিংবা কারো কণ্ঠে
জাগেনি চমকিলা কোনো তানকারি।
তবে ছেলেবেলায় আমাদের সরু গলিতে
সেই কবে কোন মধ্যরাতে কে পথিক আমার মনের ভেতর
সুদূর এক নদীতীরের ছবি জাগিয়ে
হেঁটে গিয়েছিল, আজও মনে পড়ে।
আজও কোনো-কোনো রাতে যখন আমার ঘুম আসে না
কিংবা মন ভালো থাকে না, হঠাৎ
আমি শুনতে পাই
রাতের গলায় দরবারি কানাড়া, পায়ে স্বপ্নের নূপুর।
এবং একজন মানুষের পুতুলনাচ
ঝলসে ওঠে বারংবার। হ্যাঁ, চিনতে পারছি এঁকে;
এই লোকটাই কৈশোরে চুল ছেঁটে দিত আমার
সাবান, ফিটকিরি আর সস্তা পাউডারের
ঘ্রাণময় সেলুনে। ওর মাথায় পাগড়ি, যুগল ভোজালির মতো
উচ্চকিত গোঁফ, তার সালোয়ারের ভাঁজে ভাঁজে সুদূর
পাহাড়ি কোনো দেশের নানা চিত্রকল্প।
এখন আমার ঘর কাঁটা চুলের স্তূপে নিমজ্জিত; সেই স্তূপ
থেকে এই মাত্র উঠে এলো এক নারী, যার গ্রীবায়
মীরার ভজনের ছায়া, দু’চোখের যমজ গোলাপ,
ওষ্ঠে চন্দ্রভস্ম। সে এক মাটির ঘরে প্রবেশ করে
আস্তেসুস্থে আমার অভিলাষকে উসকে দিয়ে।
কখনো দেখি, সে মাটির ঘরের দিকে স্মৃতি ফিরিয়ে দেখি,
আমার আশার গুচ্ছ-গুচ্ছ মঞ্জরি
ইলেকট্রিকের তারে আটকে-থাকা ঘুড়ির মতো
ক্রমশ বিবর্ণ হচ্ছে, কখনোবা চাঁদকে বিশ্বাস করে দেখি
পূর্ণিমা চাঁদের মতো টেবিলের দু’দিকে দু’জন নাবিক
খেলছে রামি; একজনের চোখ থেকে ঝুলছে
অত্যন্ত পাথুরে স্বপ্ন, অন্যজনের ঠোঁট থেকে ঝুলছে
ঈগলের চঞ্চুর মতো পাইপ।
মেশকে আম্বরের অস্পষ্ট ঘ্রাণময় আতরদানি,
হুঁকোর দীঘল নল, পোষা পায়রা, তাকে-রাখা বিষাদসিন্ধু,
একটি চোখ
আমার নানার কণ্ঠনিঃসৃত সুবে-সাদেকের মতো আয়াত,
নানীর দীর্ঘশ্বাসসমেত
সেই মাটির ঘর এখন আমার উদরে।
সেই ঘরের কথা ভাবতে গিয়ে আমি সে ঘর আর দেখি না।
সে কোন সুদূরে
কোনো কোনো ভোর কীভাবে যে শুরু হয়!
লগ কেবিনের বাইরে এলেই পর্বতমালা,
শুভ্র পাগড়ি-পরা কতিপয় সান্ত্রীর মতো
নিথর দাঁড়ানো। তুষারবন্দি হ্রদের সীমানা
পেরিয়ে সহসা ভেসে আসে দূর পর্বতী নিঃশ্বাস।
আমাকে জড়ায় সে কোন সুদূর মরুবাসিনী ছায়া!
কাঠবিড়ালিটা কেবিনের দোরে মৃদু ছুটে আসে,
ভিনদেশী এক মানুষের দিকে কেমন তাকায়
আবার পালায়। মনে পড়ে দূরে ফেলে-আসা পথ,
মুখের ওপর চুলের প্লাবন, কালো রাত্তির-আলো করা হাসি।
আমার হৃদয়ে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
জায়গাটা গুণী কম্পোজারের সিম্ফনি যেন।
কফি শপে ভাসে নানা দেশী ভাষা। কারো কারো চোখে
চোখ পড়ে কারো। রুপালি চামচ প্লেটের বাজে আর
বাইরে এখন ঝলমলে দিন। মনে পড়ে সেই
বোস্টনে-দেখ কোন সে বিহানে ফুটপাতে একা
অন্ধ যুবার ত্র্যাকর্ডিয়ানে নিকেল-কুড়ানো সুর।
সত্তায় নামে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
কোনো কোনো ভোর কীভাবে যে শুরু হয়!
সুকান্ত সেই কিশোরের মুখ করোটি আজকে
আমার টেবিলে করোটি কেবলি চেয়ে থাকে আর
বলে দ্যাখো ঐ কবরেও দ্যাখো পুষ্পের বিপ্লব।
যে যায় অমন উদাস একলা, সে কি একেবারে
একা একা যায়? যায় না কি তার সঙ্গে কিছুটা
আলোছায়া কিছু মনে-পড়া আর বিধুর বেহাগী রেশ?
আমাকে নাওয়ায় সে-কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
কখনো-সখনো ধূসর পূর্ব পুরুষের কালো গোরস্তানের
পাশ দিয়ে আমি শিস দিয়ে যাই, চমকে তাকাই
কখনো হঠাৎ। ছিলেন তো ওরা আটচালা ঘরে,
পুকুরে রোজানা
করতেন ওজু, মসজিদে ছিল যৌথ সেজদা।
পুকুরের দিকে
তাকাতেন আর দেখতেন কিছু মাছের রুপালি লাফ।
আমার ওপরে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
উদাস পুকুর এমন হিংস্র আগে কে জানত?
আমার পায়েও খেয়েছে সে চুমো, নিয়েছে আমার
নানা বয়সে মাথাটার ঘ্রাণ শত শতবার।
হঠাৎ কেন সে আমার বুকের কিশোরকে নিল?
মেটাতে তার সে উনিশ শতকী রহস্যময় খলখলে ক্ষুধা
আমাকেই কেন দিতে হ’ল ভোগ, দিতে হল ভোগ আজ?
আমার দু’চোখে সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!
ট্রেন থেকে মুখ বাড়িয়ে এবং গুডবাই হাত
নাড়তে নাড়তে চলে যাই আমি ছায়ার মতোই।
কোথায় যে যাই। আকাশের চাঁদ মাতালের চোখ,
আমার মগজে দাবানল আর সত্তার সব তন্তু ছিন্ন-
একটু শান্তি পাব কি কোথাও এমন দগ্ধ
পারিপার্শ্বেকে? সম্মুখে নেই ওয়েসিস কোনো, শুধু মরুভূমি
উগড়ে দিচ্ছে বিষধর সাপ আর নৃসিংহ দারুণ উগ্রতায়।
আমার নিয়তি সে কোন সুদূর মরুবাসিনীর ছায়া!