মধ্যবিত্তের পাঁচালি
এখানেও নেই, ওখানেও নেই-
মধ্যিখানেই বেঁধেছি ডেরা।
ধু-ধু পোড়ো মাঠে শরাহত ঘোড়া
জীবন নষ্ট স্বপ্নে ঘেরা।
সে কবে সুদূর বেঞ্চিতে ব’সে
বর্ণমালার জেলে দেয়ালি,
বিপর্যয়ের জ্বের টেনে আজ
খেটে খেটে হাড় করছি কালি।
একদা মজেছি মায়া সরোবরে,
জলকন্যার কুহকী গানে;
মধ্যরাত্রে লিখছি পত্র
নীল কাগজের মদির টানে।
জানলা-প্রেমের মধুর ঝিলিক
ছিল জাগরুক মনের কোণে,
শেষে অবশ্য সায় দিতে হ’ল
নাছোড় পিতার নির্বাচনে।
প্রাথমিক মোহ-মাধুর্য শেষে
বৎসরান্তে পাতে ভাত বাড়া হলে,
দুখিনী মায়ের অংশ কাড়ে।
ঊনসত্তরে দরাজ গলায়
দিয়েছি স্লোগান আমিও বটে…
গণতরঙ্গে শহীদের লাশ, মেতেছি ব্যাপক ধর্মঘটে।
অনেকের মতো আড়ালেই থেকে
মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছি সায়।
যে যাই বলুক, সারকথা এই-
বিশ্বে চলছে মাৎস্যন্যায়।
ঘোর সন্ত্রাস, ধর্ষিতা দেশ;
অগ্নিদগ্ধ একাত্তরে
প্রাণপক্ষীকে যুগিয়েছি ত্রাণ
যত্রতত্র কলমা পড়ে।
সকাল-সন্ধ্যা মুখে বিদ্রোহী,
বিপ্লবী বুলি আউড়ে চলি।
সম্মুখে দেখি মোক্ষ লাভের
চিরায়ত সেই অন্ধ গলি।
গোষ্ঠীভুক্ত প্রাণী আমি, তবু
হঠাৎ ব্যক্তিস্বরূপ জাগে;
আবার নিমেষে গড্ডলিকায়
মিশে যাই ম্লান অস্তরাগে।
সুবিধাবাদের ঝুটা খুঁটে খুঁটে
আমিও ঈষৎ মার্কসবাদী।
মধ্যে-মধ্যে দ্বিধা-খোয়ারিতে
সহজিয়া সুরে কণ্ঠ সাধি।
একি মরীচিকা বিলাসে মজেছি
যুগসন্ধ্যায় যৌথ ভ্রমে,
বিস্মৃত কিছু প্রাণীর মতোই
আমরা লুপ্ত হচ্ছি ক্রমে।
রঞ্জিতাকে মনে রেখে
রঞ্জিতা তোমার নাম, এতকাল পরেও কেমন
নির্ভুল মসৃণ মনে পড়ে যায় বেলা-অবেলায়।
রঞ্জিতা তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কোনো কে
গ্রীষ্মের দুপুরে দীপ্র কবি সম্মেলনে
কলকাতায় ন’বছর আগে, মনে পড়ে?
সহজ সৌন্দর্যে তুমি এসে বসলে আমার পাশে।
কবি প্রসিদ্ধির
অমেয় ভাণ্ডার থেকে রত্নরাজি নিয়ে
আজ আর সাজাব না তোমাকে রঞ্জিতা। শুধু বলি,
তোমার চোখের মতো অমন সুন্দর চোখ কখনো দেখিনি। ‘বিচ্ছিরি গরম’
বলেই সুনীল খাতা দুলিয়ে আমাকে তুমি হাওয়া
দিতে শুরু করেছিলে, সেই হাওয়া একরাশ নক্ষত্রের মতো
মমতা ছড়িয়ে দ্যায়। যদি আমি রামেন্দ্র সুন্দর
ত্রিবেদী হতাম, তবে বলতাম হে মেয়ে ‘ইহাই বাঙালিত্ব’।
কিছুই বলেনি একালের কবি, শুধু মুগ্ধাবেশে
দেখেছে তোমার মধ্যে তন্বী গাছ, পালতোলা নৌকো,
পদ্মময় দীঘি আর শহরের নিবিড় উৎসব।
রঞ্জিতা সান্নিধ্য বড় বেশি মোহময় চিত্রকল্প তৈরি করে,
দেখায় স্বপ্নের গ্রীবা-বুঝি তাই আমিও ভেবেছি,
ক’দিনের সান্নিধ্যের সুরা পান করে,
একান্ত আমারই দিকে বয়েছিল তোমার গোলাপি হৃদয়ের
মদির নিঃশ্বাস আর সে বিশ্বাসে আমরা দু’জন
অপরাহ্নে পাশাপাশি হেঁটে গেছি কলেজ স্ট্রিটের
অলৌকিক ভিড়ে, ফুটপাথে ফুটেছিল মল্লিকা, টগর, জুঁই
তোমার হৃদয়ে উন্মীলিত
আমারই কবিতা আর চোখের পাতায় শতকের অস্তরাগ।
বঞ্জিতা আবার কবে দেখা হবে আমাদের কোন
বিকেল বেলার কনে-দেখা আলোর মায়ায়, কোন
সে কবি সভায় কিংবা ফুটপাতে?
রঞ্জিতা তোমাকে আমি ডেকেছি ব্যাকুল বারংবার
ডেকেছি আমার।
নিজস্ব বিবরে। এই চরাচরব্যাপী অসম্ভব হট্ররোলে
অসহায় আমার এ কণ্ঠস্বর কি যাবে না ডুবে?
কী করে আমরা ফের হবো মুখোমুখি
বিচ্ছন্নতাবোধের পাতালে?
ছদ্মবেশী নানাদেশী ঘাতকের খড়্গের ছায়ায়
কী করে আমরা চুমো খাব?
কী করে হাঁটব আণবিক আবর্জনাময় পথে?
ভীষণ গোলকধাঁধা রাজনীতি, আমরা হারিয়ে ফেলি পথ
বার বার, পড়ি খানাখন্দে, মতবাদের সাঁড়াশি
হঠাৎ উপড়ে ফেলে আমাদের প্রত্যেকের একেকটি চোখ। যে ভূখণ্ডে
রঞ্জিতা তোমার আদিবাস, তার মাৎস্যন্যায় দু’চোখের বিষ
এবং আমার মধ্যে নেই কোনো বশংবদ ছায়া।
হয়তো কখনো আর কলকাতায় যাব না এবং
তুমিও ঢাকায় আসবে না। তাহলে কোথায় বলো
দেখা হবে আমাদের পুনরায় অচেনা পথের কোন মোড়ে?
মস্কো কি পিকিং-এ নয়, ওয়াশিংটনেও নয়, ব্যাঙ্কক জাকার্তা
জেদ্দা কি ইস্তামবুল, হামবুর্গ, কোনোখানে নয়।
আমরা দু’জন
হয়তো মিলিত হবো নামগোত্রহীন
উজ্জ্বল রাজধানীতে কোনো, যাকে ডাকব আমরা
মানবতা বলে,
যেমন আনন্দে নবজাতককে ডাকে তার জনক-জননী।
রাত্রির তৃতীয় যামে
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
এখন সে জলচর পাখির মতন
ঘুমের ডহরে ভাসে একা, অচেতন। হাত দুটি
যেনবা নিস্পন্দ মাছ নদীতীরে; মাঝে মাঝে নড়ে
ওঠে ঠোঁট হয়তোবা ঘোর
নিদ্রাতুর বিরানায় করছে আবৃত্তি
অমল আয়াত।
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
রাত্রির তৃতীয় যামে স্বপ্নের ভেতরে
দেখে সে নির্জন স্থানে দাঁড়ানো। অনেক
দূরে খুব উঁচু মিনারের মতো কিছু ঘন নীল
কুয়াশায় মোড়া।
হঠাৎ একটি ঘোড়া তাকে ঘিরে খায় তিন পাক, অনন্তর
চোরাবালি বাদামি ঘোড়াকে করে গ্রাস।
স্বপ্নের ভেতরে
দেয় সে কাটিয়ে নিরিবিলি কিছুক্ষণ
সিঁড়ির ওপরে ব’সে শুনে
ঘাসের নিবিড় গাথা। কণ্ঠে তার যুগ-যুগান্তের
তিমির আছে কি মজা? নইলে কেন এত
শুকনো গলা আজ? তবে কি সে দীর্ঘকাল ঝরনা,
পুকুর, ইঁদারা কিংবা সরোবর থেকে
করেনি ব্যাকুল পান আজঁলায় নিয়ে
এক ফোঁটা পানি?
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
স্বপ্নের ভেতরে তার দেখে না সে কোনো
লম্বাটে রঙিন কাচে ফোভ ছবি, গম্ভীর দেয়ালে
কখনো করে না পাঠ স্বীকারোক্তি। তার
স্বপ্নের জমিনে ভ্যানগঘী সাইপ্রেস
কখনো ফেলে না ছায়া কিংবা তাহিতির
অজর রমণী কোনো ফলময় থালা হাতে দাঁড়ায় না এসে
ক্ষণকাল। মাঝে-মাঝে ধু-ধু
বিবাহ, মরণময় কতিপয় ছবি দুলে ওঠে
রাত্রির তৃতীয় যামে। স্বপ্নের ভেতরে তার, স্নিগ্ধ মৌলবীর,
মনে হয়, কথা ছিল পুণ্য সুরে দশদিকে যে-ডাক দেবার
বারংবার প্রকৃত সে-ডাক মানবিক
এখনও হয়নি মূর্ত কণ্ঠে তার। দিকভ্রষ্ট কোনো
করুণ পাখির মতো যেন সে নিয়ত
ডেকে যায়, অথচ ঘুমের
ভেতরে গোঙানি শুধু, কণ্ঠস্বর রুক্ষ মরুভূমিতে হারায়।
রাত্রির তৃতীয় যামে জ্যোৎস্নাধোয়া মসজিদে মৌলবী ঘুমায়।
আলখাল্লা ফুটফুটে স্বপ্নের মতোই
লেপ্টে আছে গায়ে, খোলা মুখ যেন গায়েবী জানালা,
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
রাত্রির শূন্যতা নিচ্ছে টেনে
নিজের ভেতরে অস্তিত্বের গ্রন্থিমূলে এক নিঝুম মৌলবী।