বৃহস্পতিবার, মে 15, 2025
  • Login
BnBoi.Com
No Result
View All Result
No Result
View All Result
BnBoi.Com
No Result
View All Result

উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে – শামসুর রাহমান

Udbhot Utter Pithe Choleche Sodesh by Shamsur Rahman

 ফাঁসি

কাল তার ফাঁসি হবে। কেন হবে, তা সে জানে না এবং
জানে না বলেই অস্বস্তির পোকা তার
মগজের কোষে কোষে ঘোরে। পাঁজরে কী যেন পোড়ে,
ঘন ঘন বৃক্ক স্ফীত হয় আর
কখনো নিজেকে তার আনাজের বাকলার মতো মনে হয়
দেয়ালে ঠেকলে পিঠ।
এখন সে স্মৃতির ব্যাপক বেড়াজালে
আটকা পড়েছে। পেতলের বাসনের মতো ঝন্‌ ঝন্‌
বেজে ওঠে তৃতীয় এবং মনে পড়ে তার একদা দেয়ালে
লিখেছিল সে আবেগে কম্পমান; ‘ভুলব না কখনো তোমাকে’।
কাকে ভুলবে না?
অন্ধ সেলে দ্যাখে কবেকার বইয়ের পাতার
ফটোগ্রাফ থেকে
আসেন কী রাজসিক উঠে ক্ষুদিরাম; ফুচিকের
কাঁটাতারে বিদ্ধ টকটকে
গোলাপ-হৃদয় জ্বলে ওঠে অন্ধকারে। আর কিছু
পারস্পর্যহীন ছবি খেলা করে নির্ঘুম প্রহরে।

মৃত্যু তার মাথার ওপর
অচিন পাখির মতো চক্রাকারে ওড়ে বারে বারে;
তুড়ি মেরে উড়িয়ে সে দিতে চায় ওকে,
অথচ নাছোড় পাখি নেয় না গুটিয়ে তার ছায়া
কিছুতেই সেল থেকে। হঠাৎ সে দ্যাখে
ধূসর পাজামা তার কখন যে ভিজে গেছে উদাস পেশাবে।
দেয়ালে ঠেকিয়ে মাথা বলে নিজেকেই,
তোমার অস্তিত্ব আজ, বুঝছ, হে, তুমুল নিঃশব্দ অট্রহাসি।

আজ তার মনে হল-দরজায় মাধবীলতার
স্পন্দন, পাখির নাচ, পূর্ণিমার উচ্ছল চন্দন,
বিড়ালের চোখ, পাথরের মূর্তি,
রেকারি, কাচের গ্লাস, একটি মুখের রেখা, টুকরো
কথার এমন আকর্ষণ
কখনো জানেনি আগে। আজ অকারণ
বুকের ভেতরে তার যে কাঁদে একাকী
তার প্রতি এত ভালোবাসা এতকাল
কোথায় লুকিয়ে ছিল?

কাল তার ফাঁসি হবে।
শেষ ইচ্ছা পূরণের ছলে কারুকে সে
দেখতে চায়নি, এমনকি
একটি অন্তিম সিগারেটও করেনি প্রার্থনা। শুধু
মনে-মনে চেয়েছিল দেখে নিতে পৃথিবীর রূপ
পুনর্বার। এখন সে কয়েদখানার
ঘুলঘুলি থেকে চুয়ে-পড়া
বখিল আলোয় রাখে ওষ্ঠ থরথর, যেন
চুমু খেল দয়িতার ঠোঁটে।

 বন্ধুকে প্রস্তাব

এই যে ইয়ার খানিক দাঁড়াও। এমন হনহনিয়ে
কোথায় যাচ্ছ? এত তাড়া
কিসের মানিক? আখেরে কথায় পৌঁছতে চাও?
এতকাল পরে
এ-শহরে হঠাৎ তোমার সঙ্গে মোলাকাত;
দু-দণ্ড বাতচিত করা যাক কোথাও আরামসে ব’সে
যৎকিঞ্চিৎ ভেজানো যাক গলা। নাকি
এভাবেই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে
কিস্‌সা খতম করে দেবে, ভেবেছ।

চলো না যাই, চা খাই ব’সে আমাদের সেই
চেনা চা-খানায়! বিলকুল আগের মতোই আছে বেবাক;
শুধু চেয়ার আর টুলগুলো আরও নড়বড়ে
হয়েছে, টেবিলগুলো রোঁয়া-ওঠা
কুকুরের মতো আরও বয়স্ক। সেই কোঁকড়া-চুল
বেয়ারাটা-মনে পড়ে ওর কথা-গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে
তিন বছর আগে। আজ থেকে-থেকে কত স্মৃতিই না জাগে
তোমার দিকে তাকিয়ে,
তোমার ছাই ঝাড়ার ভঙ্গি দেখে।

তো, মাই ডিয়ার ফেলো, আজকাল
কী হাল-হকিকত তোমার, মঞ্চে-টঞ্চে কেমন
বোলচাল দিচ্ছ, বলো। লেখা-টেখার ময়ূরপঙ্খী নাও
বাইছ কোন খালে? এখনও কি হর-হামেশা
পুরোনো নেশায় মজে মেতে হুজুগে
তেমন মালই চালাচ্ছ যা চার যুগ আগেই
বস্তাপচা বলে বাতিল করেছে ইউরোপ। দাদাবাদের ভূত
আজও কি নামেনি ঘাড় থেকে?
উড়ো কথা কানে আসে, তুমি নাকি
কবিতা লেখার ফাঁকে-ফাঁকে সস্তা চিটচিটে
উপন্যাসের ঊর্ণাজালে পাঠক আটকে
কেল্লাফতে করছো। তাহলে কী হিল্লে হবে
আমাদের অহল্যা কাব্যের

সত্যি দোস্ত, তোমার রকম-সকম
ভালো ঠেকছে না। খাতায় খাতায় আদুরে পায়রার
চোস্ত বকবকম বুলি ছিটিয়ে
চালাবে আর কতকাল? একদিন যারা
তোমার এই কানামাছি খেলা হাতে-নাতে ধরে ফেলবে,
তারা বাড়ছে ঘরে-ঘরে। আচ্ছা,
তোমার এত কেমন খেয়াল বলো তো, প্রহরে-প্রহরে
মিথ্যের সাজি ভরে তুলে কী আনন্দ পাও তুমি? বরং
যা কিছু সাচ্চা তার জন্যে
উঠোন নিকিয়ে রাখো, মাধুর্যের রঙ ছড়িয়ে আলপনা আঁকো,
খুলে রাখো দরজা।

এবার তোমার ক্রীতদাস লেখনীকে
স্পার্টাকাসের মতো ঘাড় ঝাঁকিয়ে, শক্ত, ঠাণ্ডা শেকল ছিঁড়ে
আয়ামে জাহেলিয়াতের দম-বন্ধ করা অন্ধকারে
নতুন কথার স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে বলো।

ভ্রাতৃসংঘ

(অগ্রজ জনাব আজিজুর রাহমান চৌধুরীকে)

আমার প্রথম ভাই কান্তিমান, স্কুল-ছুট, সতত বালক
(এমনকি মধ্যবয়সেও)
নবাববাড়ীর নওশা, আলাভোলা, প্রখর, যৌবনে
ছিলেন উড়নচণ্ডী। পরিণীতা, পুত্র রইল পড়ে
এবং হলেন তিনি দেশান্তরী, ঘুরে বেড়ালেন
সার্কাস পার্টির সঙ্গে। সাত ঘাটে আঁজলা ভরিয়ে,
ভিজিয়ে পায়ের পাতা একদিন শেষে
ঘরের উধাও ছেলে ফিরে এলো ঘরে। তারপর
কাটে তাঁর অনুজ্জ্বল বৈচিত্র্যরহিত দিনগুলি
সংসারের ভাঙ্গা
খাঁচায় এবং অকস্মাৎ
কোনো মধ্যরাতে খাঁচার ভিতর থেকে
অস্থির অচিন পাখি উড়ে গেল অনন্তের দিকে।
আমার দ্বিতীয় ভাই, আবাল্যে তুখোড় ডানপিটে,
দীর্ঘকায়, সুদর্শন, পৌরুষে ভাস্বর।
ভ্রমণবিলাসী তিনি কলেজ পালিয়ে মেহগনি বাক্স ভেঙে
ঘুরেছেন দাক্ষিণাত্যে মন্দিরে মন্দিরে, অজন্তার
বিখ্যাত গুহায় আর দিলেন কাটিয়ে
দিল্লিতে ভক্তিতে মজে হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে
দু’তিন বছর। গত বিশ্বযুদ্ধে পাঠাতেন তারবার্তা
ব্রিটিশ জাহাজ থেকে, মনে পড়ে। হঠাৎ খেয়ালে
জাহাজের খোল ছেড়ে সেই যে এলেন
নিজের ডাঙায় ফিরে, তাকে আর ভোলাতে পারেনি
সমদ্রের গান; এমনকি যে ইহুদি রমণী বিদেশে
ছিলেন দয়িতা, তার ঘাগড়ার রেশমি টান, চোখের কুহক
ফেরাতে পারেনি তাঁকে ভবঘুরে জীবনের বাঁকে
বাঁকে, অনন্তর সমুদ্রের ঢেউ নয়, কোনো রমণীয় শরীরের
চড়াই-উতরাই নয়, তরুণ ঘোড়ার
পেশি-তরঙ্গের প্রতি
কী দুর্মর আকর্ষণ তাঁর। রেসের মরীচিকায়, তাসের আড্ডায়
রেখেছেন জীবন বন্ধক।
এখন যখন তিনি আরমানীটোলার পথ দিয়ে
হেঁটে যান ক্লান্ত, রুগ্ন, ভীষণ একাকী,
যুদ্ধাহত সৈনিকের মতো,
তখন মুখাবয়বে তাঁর ছয় দশকের আর্তি,
বহ্নুদ্যৎসব, হাহাকার,
প্রমাদ, চিৎকার জেগে থাকে অবেলায়।

আমার তৃতীয় ভাই ছিলেন মাঝারি গড়নের,
ইস্পাতি শরীর তার ঝলসাত মাঠের রোদ্দুরে গোল্লাছুট
কাবাডি খেলায়,
ক্রোধের ভিমরুল তাঁকে কামড়ালে, কালো কপালের
কাটা দাগ আরও চিকচিকে আর গাঢ় হয়ে যেত।
কখনো কখনো তিনি নাকীসুরে খুব দুলে দুলে
গাইতেন ফিল্মি গান এবং বন-বাদাড়ে একা-একা
কাটত সময় আর বলতেন তাঁর
চোখ ভেসে ওঠে কত
সুন্দর আজীব গাছপালা, জীব-জানোয়ার কিমাকার আর
অতল পাতাল।
যখন এ. আর. পি.-তে লেখালেন নাম,
উর্দি-পরা তাঁকে
দিব্যি বীর-বীর লেগেছিল। ছিলেন অকৃতদার আর
অকস্মাৎ এ কি বজ্রপাত
আমাদের ঘরে-
আমার তৃতীয় ভাই ক্রূর পিত্তশূলে হলেন অকালমৃত
প্রেমিকার চুম্বনবিহীন,
সন্তানের আলিঙ্গনহীন।

আমার চতুর্থ ভাই পিতার মিনিয়েচর, তেজী
একরোখা, স্পষ্টভাষা! ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ডে
সর্বদা নিবদ্ধ দৃষ্টি তার, উপার্জনে নিয়ত সংগ্রামশীল,
সামাজিক নিমন্ত্রণে অকুণ্ঠ, উদার;
ভোজনবিলাসী, নীড়প্রিয়
বাবুই পাখির মতো গোছায় সংসার প্রতিদিন।
পুরানো প্রথাম প্রতি নতজানু; এই শতকের
রোদে পিঠ দিয়ে ভালোবাসে মধ্যযুগী মায়াবী আঁধার।
নিত্য সুরে-সাদেকের আলো-আঁধারিতে
করে পাঠ কলমা দরুদ।

আমার পঞ্চম ভাই সুকান্ত, সৌজন্যময় আর
রুচিবান এবং সবার প্রীতিসাধনে তৎপর
সর্বক্ষণ, পরমতসহিষ্ণু অথচ সুতাকিক।
গোঁড়ামির প্রতি সায় নেই তার, গ্রন্থপ্রিয় মন
করে বিচরণ মুক্তবুদ্ধির মিনারে, উপরন্তু,
সংগীত-নির্ঝরে স্নাত নিয়মিত, আদালতে
সাজিয়ে কথার পিঠে চোস্ত কথা কুড়ায় বাহবা,
দীপ্ত অধ্যাপকও বটে। বস্তুত সে স্নিগ্ধ বুদ্ধিজীবী।

আমার কনিষ্ঠ ভাই চটপটে, বেপরোয়া, বড় ঝলমলে;
নিখুঁত টাইয়ের নট, গায়ে হাল-ফ্যাশনের নানা
পোশাক-আশাক।
আকৈশোর অভিযানে মাতাল। তাই সে
প্রায়শ জমায় পাড়ি দূর দেশে, যেন
কোনো নামহীন দ্বীপ থেকে
আনবে নির্যাস ছেঁকে রহস্যের কিংবা অতল পাতাল থেকে
মণিরত্ন, যেন নিমেষেই নেমে যাবে তুড়ি মেরে
দুর্গম খনিতে একা। নৈরাশ্যের থুতনি নাড়িয়ে দিয়ে জোরে
‘যে যাই বলুক আমি বাণিজ্যেতে যাবোই’ বলে সে
আমার কনিষ্ঠ ভাই ভাসিয়েছে সমদ্রে জাহাজ।

কখনো-কখনো ভাবি আমার ভ্রাতৃ-সংঘের কতটুকু আছে
নিহিত আমার মধ্যে? কার চোখ, কার মুখভঙ্গি
হুবহু প্রতিফলিত আমার সত্তায়?
কার কোন আচরণ করি ব্যবহার মুদ্রাদোষের মতন
আমিও অজান্তে মাঝে মাঝে?
আর মাঝে-মধ্যে আমাদের
বংশের প্রাচীন
নামহীন কত পুরুষের অজ্ঞাত জীবনী
মন্ত্রের মতন গুঞ্জরিত হতে চায়
আমার নিজস্ব অবচেতনের রহস্য-শোষক তন্দ্রাচ্ছন্ন স্তরে স্তরে।

Page 6 of 9
Prev1...567...9Next
Previous Post

উজাড় বাগানে – শামসুর রাহমান

Next Post

এক ধরনের অহংকার – শামসুর রাহমান

Next Post

এক ধরনের অহংকার - শামসুর রাহমান

এক ফোঁটা কেমন অনল - শামসুর রাহমান

মন্তব্য করুন জবাব বাতিল

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

সাম্প্রতিক প্রকাশনাসমূহ

  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৫: ভূমিকম্প – শামসুদ্দীন নওয়াব
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৮: বিভীষিকার প্রহর – রকিব হাসান
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৭: বড়দিনের ছুটি – রকিব হাসান
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৭: আলাস্কা অভিযান – রকিব হাসান
  • তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৭: আমিই কিশোর – রকিব হাসান

বিভাগসমূহ

© 2023 BnBoi - All Right Reserved

No Result
View All Result

© 2023 BnBoi - All Right Reserved

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In