জাতিসংঘে অবিরল তুষার ঝরলে
জাতিসংঘে অবিরল তুষার ঝরলে
পৃথিবীতে বসন্তের ফুল
চাপা পড়বে না।
বাংলাদেশে ভূমিহীন চাষীর সংসার
ছারখার হলেও নিশ্চিত
জাতিসংঘে প্রার্থনার ঘরে নিমগ্নতা
থাকবে অটুট।
কে সুন্দরী ডলারের শূন্য মালা গাঁথে
স্বপ্নের গহনে?
নিউইয়ের্কের পূর্ণ সুপার মার্কেটে ঝলমলে
দ্রব্যের জগতে
মনে পড়ে, তাকে মনে পড়ে, নিগ্রো ঘেটোর মতন।
হৃদয় আমার অকস্মাৎ আর্তনাদ করে ঘোর অবেলায়।
এখানে কী করে মনে পড়ে তাকে? কেমন নাছোড়
খাপছাড়া মন, তাই অবচেতনায়
চিত্রল হরিণ চিতাবাঘ, তার কী ফুল্ল শরীর
ভেসে ওঠে বারংবার। আমার দু’দিকে বাহরাইন, বাহামা
বার্বাডোস, পারমাণবিক ভস্মরাশি
কে ছড়াল
কোথায় কোন সে পাতালের
নির্জন অতলে,
নিঝুম সীমান্তে দিল হানা কারা উর্দি-পরা
তা নিয়ে তুমুল তর্কাতর্কি। এরই মাঝে
সহসা সে উঠে আসে আফ্রোদিতির মতন
শরীরে স্বপ্নের ফেনা নিয়ে।
মেশিন দলিল দস্তাবেজ সংঘ সংস্থা
ব্যক্তিকে নিয়ত টানে কী ধূসর নামহীনতায়।
জাতিসংঘ পরিণামহীন দেবতার মতো ডানা
ঝাপটায় শূন্যতায়। জাতিসংঘের ঠক বন্ধ
হলেও তৃতীয় বিশ্বে নবজাতকের নতুন চিৎকার বেজে
উঠবে নিয়ত, শীর্ণ হাত প্রসারিত হবে ক্রমে
সভ্যতার দিকে।
তুমি কি আসবে ফের
ভোরের গোলাপ দ্যাখো মেলেছে কী পূর্ণ দৃষ্টি তাজা,
টেবিলে রোদের গাথা, হলতে পর্দা দোলে মাত্রাবৃত্তে;
উড়িয়ে-আঁচল, ঢেউ তুলে বায়ুস্তরে একাকিনী
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
বাগানে পাখির ঝাঁকে, পাতায়-পাতায় আনন্দের
গুঞ্জরণ, আলনায় শার্ট আর পাজামায় জাগে
শিহরণ অব্যক্ত স্বপ্নের মতো। সুগন্ধি নিঃশ্বাস নিয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
পুরোনো কবরে সাদা কবুতর ঝরিয়ে পালক
উড়ে যায় আসমানে, গোর-খোদকের শক্ত হাতে
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে গন্ধরাজ, মাধুর্যে সুস্মিতা,
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
এই তো ডালিম গাছে কত যে স্বপ্নিল টেলিগ্রাম,
টেলিফোন যেন মেঘচর পাখি বিমুগ্ধ উড্ডীন,
তোমার চন্দ্রালোকিত কণ্ঠস্বর হওয়ায় ঝরিয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
বৃষ্টিতে পাখির কান্না, আমার হাতের নখ থেকে
ভুরু থেকে, ওষ্ঠতট থেকে নিঃসঙ্গতার মতন
বৃষ্টি ঝরে অবিরল, কালো বৃষ্টি-জাল ছিন্ন করে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
যে-দরজা নেই তা খোলার জন্যে একটি সোনালি
চাবি পেয়ে গেছি গোধূলিতে, একজন আলুথালু
কিশোর সারস হাতে রয়েছে দাঁড়িয়ে-সেই পথে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
রেশমি পতাকা হয়ে ওড়ে খবর কাগজ আর
কফির বাতিল কৌটো, পিলসুজ স্বপ্নে ভরপুর;
কবি শব্দহীনতার ছায়ায় ঘুমোয়, বাণী হয়ে
তুমি কি আসবে ফের সান্নিধ্যে আমার?
পতাকারই মতো গহন সৌন্দর্যে একা
কাউকে কিছু না বলে কখন যে ফাল্গুন হঠাৎ
সটকে পড়েছে। এখন তো বাংলাদেশ
চৈত্রের চিৎকার
পাতার আড়ালে, শ্রমিকের
পাতের গরম ভাতে, নিউজপ্রিন্টের ভাঁজে ভাঁজে
পঙ্গু প্রেমিকের হাহাকারে,
নিশাচর কুকুরের চোখে,
চন্দ্রাহত হা ভাতে বস্তির
অরক্ষিতা তরুণীর যৌবনের উদগ্র চিতায়।
মুংকের চিত্রের চিৎকারের মতো একটি চিৎকার,
চরাচরব্যাপী,
ইদানীং এ শহরে কী ব্যাপক ছড়িয়ে পড়েছে, মনে হয়,
মূক বিপর্যয়বোধ নিয়ে।
বিপর্যয়ে অনেকেই ভীষণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বারংবার
নানান উদ্ভট চিত্রকল্প ঘিরে ধরে
তাদের এবং ওরা ভয় পায়, বড় ভয় পায় এমনকি নিজেদের
ছায়া দেখলেও।
কেউ কেউ উন্মাদের মতো আচরণে
পাড়া-পড়শিকে আরও বেশি
করুণ ভয়ার্ত করে তোলে। বিপর্যয়ে কেউ কেউ
মাথা ঠাণ্ডা রাখে, থাকে স্থির,
যেনবা নক্ষত্র এক, দিগ্দর্শনের আলো আছে,
স্বতন্ত্র স্বভাবে
এক কর্তব্যরত প্রহরীর মতো কেউ কেউ সুষ্ঠুভাবে
শিবিবের তদারক করে। অকস্মাৎ
রসদ ফুরিয়ে গেলে, শিরায় শিরায়
কুয়াশার হিম
ছড়িয়ে পড়লে দাঁতে দাঁত চেপে, কষে ধরে মুঠোয় পতাকা
সটান দাঁড়িয়ে থাকে পতাকারই মতো গহন সৌন্দর্যে একা।
বিপুল ধ্বংসের তাণ্ডবেও কবিতার ডানা লীলায়িত হয়,
বিধ্বস্ত ছাদের নিচে, ভাঙা দেয়ালের
আড়ালে জ্যোৎস্নায় তীব্র চুমো খায় যুবক-যুবতী।
বসন্ত বরের মতো আসে ভাঙাচোরা পথে অভ্যর্থনাহীন,
বৃদ্ধেরও সংগমস্পৃহা খুব বেড়ে যায় রাতারাতি।
ধ্বংসস্তূপ থেকে কেউ তুলে নেয়
পিতলের বাঁশি,
কেউবা নিঃসীম প্রেতায়িত পূর্ণিমায় কী ব্যাকুল
কণ্ঠস্বরে পাষাণপুরীর
পাথুরে বাসিন্দাদের স্তব্ধ ঘুম ভাঙাবার চেষ্টা করে প্রহরে প্রহরে।
প্রকৃত প্রস্তাবে
ভালোই আছি আজ, জ্বরের নেই তাপ;
সময় ভালো বটে শীতের কিছু পরে।
হঠাৎ চেয়ে দেখি এসেছে কোত্থেকে
চড়ুই পাখি দুটি এসেছে এই ঘরে।
এ ঘরে বসবাস আমার বহুকাল।
স্মৃতির মেঘমালা বেড়ায় ভেসে মনে :
কেটেছে ক’দিন নানান বই পড়ে,
কখনো গান শুনে, কখনো চুম্বনে।
এ ঘরে কত রাত ভালেরি এসেছেন,
কখনো কালিদাস, বোদলেয়ার, রুমি।
পেরিয়ে স্বপ্নের সুনীল সেতু আর
টানেল কুহকের কখনো আসো তুমি।
এখানে এই ঘরে সকালে মাঝরাতে
টেবিলে ঝুঁকে লিখি; হারিয়ে ফেলি পথ
কখনো শব্দের গহিন জঙ্গলে।
কখনো পাই কত পঙ্ক্তি মৃগবৎ।
চড়ুই নীড় বেঁধে এখানে এই ঘরে
রাখতে চায় তার প্রেমের স্বাক্ষর।
অথচ জানে না সে বিপুল চরাচরে
প্রকৃত প্রস্তাবে আমারই নেই ঘর।