একদা তোমার আমি
একদা, তোমাকে আমি অহংকারী বলে জানতাম। মনে পড়ে,
কোনো এক পঁচিশে বৈশাখে
তুমি আর আমি পাশাপাশি ছিলাম কী মুগ্ধ বসে।
চিনতে পারনি তুমি পাশে-বসে-থাকা জবুথবু
তরুণকে যার
কবিতা তখন এ শহরে যত্রতত্র
বাচ্চা রাজহাঁসের মতন
পাখা ঝাপটাত, সেই পদাবলি পাঠক গোষ্ঠীকে দিয়েছিল
ভীষণ ভড়কে আর উদাসীন পণ্ডিতবর্গের
টেরিকাটা দামি মাথা চুলকোতে বাধ্য করেছিল।
তুমি একবারও তার দিকে, এমনকি তাচ্ছিল্যভরেও, ফিরে
তাকাওনি; দৃষ্টি ছিল মঞ্চে, কখনোবা কিছু দর্শকের প্রতি।
প্রকৃত রানীর মতো ছিলে তুমি সে আসরে
অমন সুদুর একাকিনী। কী মদির তাপ গোলাপি নেশার মতো
তোমার নিজস্ব পারফিউমের মতো
আমার সত্তায় হল সঞ্চারিত; সকালের আকাশের মতো
কী সহজ আভিজাত্য ছিল তোমার অস্তিত্বে ব্যাপ্ত
এবং আমার ঠোঁট দুটি অদৃশ্য পাখির মতো
গান গাইছিল স্মিত তোমার শরীরে সারাক্ষণ।
সে রাতে তরুণ কবি অর্জিত মোহন কাম তার
অন্য কারো নিবেদিত শরীরে উৎসর্গ করেছিল,
অথচ তুমিই ছিলে, শুধু তুমি তার
অস্তিত্বে অণুপরমাণুময়।
তোমাকে দেখেছি আমি দূর থেকে ঊনসত্তরের
পদধ্বনিময় দিনে, করেছি আবৃত্তি
তোমার উজ্জ্বল মুখ, চকচকে চোখ, কালো চুলের গৌরব,
মধ্যরাতে বৈমাত্রের পরিবেশে কবিতা লেখার ফাঁকে ফাঁকে।
একাত্তরে গুলিবিদ্ধ ঈগলের মতো রক্তাপ্লুত
বিধ্বস্ত শহরে থেকে সবুজ গ্রামের অভ্যন্তরে
পলাতক হয়েছি যখন,
তখনও তোমার কথা হৃদয়কে বলেছি নিভৃতে
দীর্ঘশ্বাসসহ-যে উতল দীর্ঘশ্বাসে মিশ্র স্মৃতি,
পঁচিশে বৈশাখ, চৈত্রপাতা, বৃষ্টিপাত, ধু-ধু মাঠ,
প্রেতায়িত ঘোড়াদের লাফ,
ধ্বংসস্তূপ সেতারের ব্যাকুল বেহাগ, দেয়ালের
কী বিমূর্ত দাগ, ছত্রভংগ মিছিলের প্রজ্বলিত আর্তনাদ-
মাছরাঙা পাখি, মাছ, শাপলা শালুক দেখার সময়।
এখন কেমন আছ তুমি? এখন তো
আঁধার চিৎকার করে অগ্নিদগ্ধ ঘোড়ার মতন।
যখন আলিজিরিয়া যুদ্ধক্ষুব্ধ ছিল, জামিলাকে
নেকড়ের পাল ছিঁড়ে-খুঁড়ে মেতেছিল খুব পৈশাচী উল্লাসে,
ফিলিস্তিনি লায়লাকে ঝাঁক ঝাঁক ডালকুত্তা তুমুল তাড়িয়ে
বেড়িয়েছে রাত্রিদিন, তখন কোথায় ছিলে তুমি?
তখন কেমন ছিলে তুমি?
যখন চেগুয়েভারা ছিলেন কাদায় পড়ে বলিভিয়ার জঙ্গলে তাঁর
নিঃসাড় তর্জনী রেখে মুক্তি ও সাম্যের দিকে, দীপ্র
সূর্যোদয়ের উদ্দেশে
তখন কোথায় ছিলে তুমি?
তখন কেমন ছিলে তুমি?
ও দৃষ্টির সরিয়ে নাও আমার অস্তিত্ব থেকে, আমি
পুড়ে যাচ্ছি, হে মহিলা, মদির অনলে।
এ দাহ অসহ্য তবু তোমার কাছেই যেতে চাই বারংবার,
তোমার নিঝুম ঘাটে তুলে নিতে চাই
আঁজলা আঁজলা জল অকূল তৃষ্ণায়।
কখনো ভাবিনি আগে এতকাল পরে দেখা হবে পুনরায়,
কখনো ভাবিনি আগে কোনো দিন বসব তোমার
মুখোমুখি, আমাদের সংলাপে মুখর হবে অনেক প্রহর,
কাফকা ডস্টয়ভস্কি এসে বসবেন অপরাহ্নে চায়ের সময়,
চায়ের পেয়ালা তুমি সুন্দর ভঙ্গিতে তুলে দেবে
আমার ব্যাকুল হাতে, অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
আমাকে ফেরত দেবে ভুলে ফেলে-আসা।
পকেট চিরুনি।
তোমার গ্রীবার ডালে প্রত্যহ রজনীগন্ধা ফোটে,
দেখি আমি দেখি।
চারদিকে নিদ্রামগ্ন ফেরেশতার মতো জ্যোৎস্না, তুমি
জ্যোৎস্নার অধিক স্নিগ্ধতায় স্বপ্ন হয়ে আছ, দেখি
আমি দেখি।
জ্যোৎস্নার নেকাব ছিঁড়ে মাঝে-মাঝে কাক উড়ে যায়।
কত কথা বলো তুমি, অথচ যে-কথা
শোনার আশায় আমি থাকি প্রতীক্ষায় প্রতিদিন,
কাটাই নির্ঘুম রাত্রি, সে-কথা সর্বদা ভার্জিনিয়া উলফের
দূর বাতিঘরের আড়ালে, স্যামুয়েল
বেকেটের নরকের অন্তরালে চাপা পড়ে যায়।
কয়েদির খুপরির ঘুলঘুলি পেরুনো আলোর মতো
কার্পণ্য তোমার,
এবং আমিও যে গোপন উচ্চারণ চাই আমার আপনকার ঠোঁটে
তা-ও নিমেষেই
প্রস্তর যুগের স্তব্ধতার মতো অনুচ্চার থেকে যায়, জানি
অন্তর্গত বাসনার বসন্ত আমার
পুষ্পিত হবে না কোনো দিন।
জ্যোৎস্নার নেকাব ছিঁড়ে মাঝে মাঝে কাক উড়ে যায়।
কাদামাখা অবেলায়
এখনও এখানে অশেষ পুঞ্জীভূত
গ্রাম ও শহরে কুটির অট্রালিকায়,
রাজপথে আর অলিতে গলিতে আর
শহরতলিতে টিনশেড কলোনিতে
মধ্যযুগের বেঘোর অন্ধকার।
জংধরা এক টিনের তোরঙে ওরা
পুরুষানুক্রমে রেখেছে ঊর্ধ্ব তুলে
পোকা দংশিত আদ্যিকালের পুঁথি।
কখনো সখনো অতি ভক্তিতে মজে
জীর্ণ কেতাব মাথায় ঠেকায় শুধু।
ছেঁড়া কাঁথা আর মলিন বালিশ পেতে
ঘুমায় নোংরা ভাড়াটে বাড়িতে ওরা।
সেই কবেকার তুরানী স্বপ্ন আজও
কেরানি মনের তল্লাটে দ্যায় উঁকি।
সাতপুরুষের ভিটায় ময়াল সাপ।
আয়েশী স্বভাবে এখনও অটুট কিছু;
অথচ অভাব পোষা বেড়ালের মতো
পায়ে পায়ে ঘোরে। সোনাদানা, ঘটি-বাটি
বন্ধক রেখে জুড়ায় জঠরজ্বালা,
বসন্ত দিনে দেনায় ডুবেছে মাথা।
শিরায় শিরায় জুয়োর বনেদী নেশা,
বোঝে না নিজেই দাবার নিরঙ ঘুঁটি।
আত্মায় জমে ইট-সুরকির কণা,
হঠাৎ কখনো গহন সন্ধেবেলা
মনে পড়ে যায় বনতুলসীর ঘ্রাণ।
যুক্তিকে ওরা পাঠিয়েছে বনবাসে,
এখানে চিরায়ু ভাববিলাসের যুগ।
জ্ঞানীর বাণীতে কখনো পাতে না কান,
শুধু চুমো খায় আলখাল্লায় তাঁর।
নানা মরীচিকা দেখে দেখে কাটে বেলা।
অতীতের পানা পুকুরে প্রেতের মতো
সকাল-সন্ধ্যা বুড়বুড়ি কাটে মন।
শ্যাওলা-বিছানো বদ্ধ পানিতে ভাসে
রঙ-বেরঙের কিংবদন্তি কত,
কিংবদন্তি লেহনে ধন্য ওরা।
পঞ্জিকা আর গঞ্জিকা সম্বল
করে ওরা ধরে গায়েবী ঘোড়ায় বাজি।
চারপাশে জ্বেলে লোবান, আগরবাতি
পুরানো ক্ষতের গন্ধ মুছতে চায়,
হৃদয় ওদের উদ্ভট হানাবাড়ি।
সম্মুখে খোল রাস্তার সংকেত,
ওরা পড়ে যায় বিচ্ছিরিভাবে পথে,
হাঁটুভাঙা ভীরু হরিণের মতো ধু-ধু
ডানে বাঁয়ে দ্যাখে নেকড়ের শত চোখ।
কে তুলবে টেনে কাদামাখা অবেলায়?