উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ
আবদূর রাজ্জাক খান বন্ধু বরেষু)
শেষ-হয়ে-আসা অক্টোবরে
শীতের দুপুরে নিউইয়র্কের অরচার্ড স্ট্রিটে ঘুরে ঘুরে
একটি দোকান দেখি মায়াপুরী, দোকানি ওয়াল্ট ডিজনির
আশ্চর্য ডবল, বলা যায়। দিলেন পরিয়ে গায়ে
স্মিত হেসে সহজ নৈপুণ্যে নীল একটি ব্লেজার। ব্লেজারের
বুকে জাগে অরণ্যের গহন শ্যামলপ্রসূ, সরোবর-উদ্ভুত অমর্ত্য
দূরায়নী তান।
সুনীল ব্লেজার ঝুলে আছে
আলনায়, কাঠের হ্যাংগারে একা আমার পুরানো ম্লান ঘরে
মালার্মের কবিতার স্তবকের মতো নিরিবিলি,
অথচ সংগীতময় সর্বক্ষণ অস্তিত্বের পরতে পরতে।
নানান সামগ্রী ঘরে থরে থরে, কিছু এলোমেলো; সামগ্রীর ভিড়ে
সুনীল ব্লেজার যেন বহু গদ্য-লেখকের মাঝে
বড় একা একজন কবি।
ব্লেজারের দিকে চোখ যায়
যখন তখন, দেখি সে আছে নিভৃত অহংকারে,
থাকার আনন্দে আছে, নিজের মতন
আছে; বলে সান্দ্র স্বরে, ‘এই যে এখানে আছি, এই
থাকা জানি নিজেই তাৎপর্যময় খুব’। এ মুহূর্তে
যদি ছুঁই তাকে, তবে মর্মরিত হবে সে এখন, উঠবে জেগে
স্বপ্ন-সুদূরতা থেকে।
কখনো ব্লেজার কৌতূহলে
দ্রুত জেনে নিতে চায় তরুণ রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীকে কখনো
তীব্র চুমো খেয়েছেন কিনা জোড়াসাঁকোর ডাগর অভিজাত
পূর্ণিমায়,
নব্য কবিসংঘ কী পুরাণ নিয়ত নির্মাণ করে মেধার কিরণে আর
শীতার্ত পোল্যান্ড আজ ধর্মঘটে রূদ্ধ কিনা কিংবা কোন
জলাভূমিতে গর্জায়
গেরিলার স্টেনগান, হৃদয়ের মগ্নশিলা, আর্ত চাঁদ
ইত্যাদিও জানা চাই তার।
ভোরবেলা ঘন
কুয়াশার তাঁবুতে আচ্ছন্ন চোখ কিছুটা আটকে গেলে তার
মনে হয় যেন সে উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।
কোথায় পাগলাঘণ্টি বাজে
ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে। হামলাকারীরা
ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে
এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।
দশদিকে কত রকাডেমিতে নিশীথে
গোর-খোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত, মানুষের মুখগুলি
অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জির মুখ।
গালিবের জোব্বা,
দিল্লির সূর্যাস্ত যেন, রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা অনুপম,
মৌলানা রুমির খিরকা, বোদলেয়ারের মখমলি
কালো কোট দুলে ওঠে আমার সুনীল ব্লেজারের কাছাকাছি।
কিছু অসন্তোষ গাঁথা সুতোয়, বিশদ কারুকাজে;
ইতিহাসবিদ্বেষী ব্লেজার পুণ্য নীল পদ্ম অকস্মাৎ,
অবাধ স্বাতন্ত্র্য চায় ব্যাপক নির্মুখতায় আজ।
নষ্ট হয়ে যাবে
ভেবে মাঝে মাঝে আঁৎকে ওঠে, টুপির মতন ফাঁকা
ভবিষ্যৎ কল্পনায় মূর্ত হয়ে কখনো কখনো,
কবরের অবরুদ্ধ গুহা তাকে চেটেপুটে খাবে
কোনো দিন, ভাবে সে এবং নীল পাখি হয়ে দূর
সিমেট্রির মিশকালো সাইপ্রেস ছেড়ে পলাশের রক্তাভায়
ব’সে গান গায়।
একটি দুপুরের উপকথা
সজীব সকালে চোখ মেলি, প্রতিদিনের পৃথিবী
আমাকে জানায় অভিবাদন। টাটকা রোদ,
পাখিদের ওড়াউড়ি, গাছের পাতার দুলুনি, বেলফুলের গন্ধ
ডেকে আনে আমার বালকবেলাকে।
রোদ আমার ভেতরে বাজতে থাকে মোহন বাদ্যযন্ত্রের মতো
আর আমি যেন নিভৃত আরোগ্যশালায়
একটু একটু করে স্বাস্থ্য ফিরে পাই। ভোর স্বপ্নের ভাষায়
অপরূপ কোলাহলময় আমার শিরায় শিরায়;
আমি সঙ্গমকালীন একাকিত্বের কথা ভুলে, ভুলে উঠোনের কথা
দিগন্ত আর ধাবমান অশ্বপালের কথা ভাবি।
এখন সেই জাগরণের মুহূর্তে
আমি কি জানতাম কী বিপুল আশ্চর্য অপেক্ষা করছে
আমার জন্যে? কয়েক ঘণ্টা পরেই ঝকঝকে দুপুরে
আমার অস্তিত্বকে উদ্ভাসিত করে একজন
সিঁড়ির ধাপ ছেড়ে
উঠে আসবে আমার বাঁ পাশে? তার দৃষ্টি আর হাসিতে
আমার পরমায়ু হবে গভীর সঞ্জীবিত?
তখন কি আমি জানতাম
দুপুর এমন বাঙ্ময় হতে পারে, হতে পারে কোনো পাখির দীর্ঘ ডাক?
হৃদের ছলছলানি? এমন সম্মোহনময়?
পুলিশের বাঁশি, মাইল মাইলব্যাপী বুটের শব্দ,
বম্ব্যরের মৃত্যুবর্ষী গর্জন, বাতিল শাসনতন্ত্রের হাহাকার
আর পাঁচসালা পরিকল্পনার আর্তনাদ ছাপিয়ে
একটা দুপুর চাইকোভস্কির সুর হতে পারে, আগে জানিনি।
একজন, বহুদিন আগেকার রাত্রির গহন থেকে আফ্রোদিতির মতো
উঠে-আসা একজন, দুপুরকে অনন্য উপহারে রূপান্তরিত করে
আমার উদ্দেশে। সেই উপহার
হাত বাড়ায় আমার দিকে, আমি মুগ্ধাবেশে
পান করি সেই দৃশ্য। দুপুর, আকাশের দিকে বাহু-তোলা গাছ,
রৌদ্রাক্রান্ত পথ, ধাবমান যান আর আমরা দুজন
নববর্ষের প্রথম দিন হয়ে যাই।
কী সুন্দর তুমি, দুপুর উচ্চারণ করে তোমার কানে কানে;
তুমি হাসো দুপুরকে অবিশ্বাস করে,
সেই হাসি দুপুরকে করে তোলে আরো প্রগলভ।
এই শহুরে দুপুরে অকস্মাৎ ভাবি-
এ দুপুর জানে প্রতিবিপ্লবীর ভ্রান্তির মতো কিছু কথোপকথন
আমাদের আছে,
এ দুপুর জানে ভূমিহীন কৃষকের স্বপ্নের মতো কিছু স্বপ্ন
আমাদের বাস্তবে লতিয়ে ওঠে,
এ দুপুর জানে গুপ্তহত্যার মতো নিঃশব্দ ভয়ংকর কিছু
বারংবার ঘটতে থাকে আমাদের ভেতর,
এ দুপুর জানে ল্যাজারাস আড়মোড়া ভাঙে উদাস প্রান্তরে,
তোমার অনাবৃত বাহুর মতো যেন কোন স্মৃতি
ঝুলে রয় মনের ঝোপঝাড়ে,
এ দুপুর জানে খরগোশেরও ঘাড়ে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি
মিশে থাকে,
কোথায় ব্যাপক জতুগৃহে অনেকানেক ঘোড়া পুড়ে যায়।
কী সুন্দর তুমি, মনে মনে বলি।
তখন আমার চতুষ্পার্শ্বে ট্রাফিকের মাতলামি,
রাস্তা উপচে-পড়া মানুষ, দোকানপাটের বিজ্ঞাপনী ইশারা,
চিত্রতারকার রঙচঙে ছবি,অথচ আমি
কিছুই দেখি না, শুনি না কিছুই। দুপুরে
আমার দু’চোখ জুড়ে তুমি শুধু তুমি।
কী সুন্দর তুমি, আবৃত্তি করি তোমার সৌন্দর্য
আর হঠাৎ মনে পড়ে, তোমাকে ধরে রাখতে পারব না কখনো।
হয়তো এমন দিন আসবে,
যখন আকাশে সূর্য হাসবে রাষ্ট্রদূতের মতো অথবা চাঁদ
আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক কর্মার মতো
গা-ঢাকা দেবে মেঘের ভূতলে,
কিংবা হলদে পাতার মতো হেমন্ত ছোঁবে আমাকে,
ঝমঝমিয়ে আষাঢ় নামবে এ শহরে
আর আমি নির্বাসিত হবো তোমার সান্নিধ্যের অলকাপুরী থেকে।
চাই, তোমাকেই চাই বলে আমার অস্তিত্ব এক-দীর্ঘ চিৎকারে
রূপান্তরিত হবে, দিনযাপন মনে হবে
নিরন্ধ্র কারাবাসের মতো; আর তোমার উদ্দেশে আমার ডাক
প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসবে আমারই কাছে বারে বারে।
যখন কোনো কোনো দুঃস্বপ্নসংকুল
রাতে ঘুমের বড়ি সেবন করার পরও ঘুম আসবে না তোমার,
তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তুমি, চোখ মেলে দিও
ক্ষুধিত অন্ধকারে,
তখন দেখতে পারবে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে একজন
তোমারই প্রতীক্ষায়; কোনো পাহারাদার তাকে ‘দূর হট’ বলে
তাড়াতে পারবে না,
এমনকি আজরাইলের অন্ধ, দুর্বিনীত ডানাও না।