মৃত্যুবোধ
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই ভয়
কাঁকড়ার মতো
আমার উপর হেঁটে যায়,
যেতে থাকে। মৃত্যুবোধ হঠাৎ
আমাকে
ভীষণ কাতর করে। বিছানায়
লেপের বাইরে
নিজের একলা হাতটিকে
নির্বোধ, অচেনা লাগে, যেন
মৃত্যু ওকে আলগোছে
ছুঁয়ে গেছে। বড় দুঃখময় হাত
গাঢ় অবসাদে
নিমজ্জিত এক পাশে; বুকে
পাথরের ভার।
পেয়ারা গাছের ডালে-বসা
পাখিটার
মৃত্যুবোধ নেই, আকৃতিতে
ওর বেদনার কোনো
ছাপ নেই; অচিন সুরের ছায়া
আছে। ওকে প্রীতি
জানাবার সাধ জাগে;
আমাকে শুঁকতে
থাকে মৃত্যু ক্রমাগত, বুঝি বা
পচন-ধরা মাছ
এই আমি। সুদূরিকা, ঢেউময়
যৌবন তোমার
এ মুহূর্তে যদি ঘরে প্রবল
দেয়ালি
জ্বেলে দেয় ভয়ের কুয়াশা
যাবে কেটে। যদি তুমি
আমাকে বাহুতে বাঁধো এসে,
মাথায় বুলিয়ে দাও
হাত, ঠোঁট চেপে ধরো বাসি
ঠোঁটে, নিমেষে মরণ ম’রে
যাবে।
মেঘ না চাইতে
মেঘ না চাইতে জল পেয়ে
যাওয়ার মতো
আমার হাত তোমার হাতে।
এই প্রথমবারের মতো তোমার
স্পর্শ পেলাম।
কী-যে হলো আমার ভেতর,
কে ব’লে দেবে আমাকে?
আকাশে গোল চাঁদ খুব
চকচক করছিল
শাহী মুদ্রার মতো, অথচ
আমি দেখছিলাম তোমাকে
চাঁদের রূপ উপেক্ষা ক’রে।
তোমার শরীরে
জড়ানো ছিল এক টুকরো
নীল আকাশ।
আমার হাত তোমার
করতলের কানে কানে
কিছু একটা ভিন্ন মাত্রায়
বলার চেষ্টা করছিল
জ্যেৎস্নার ভাষা ধার ক’রে।
তোমার সরু, সুন্দর
আঙুলগুলো কি উদ্ধার করতে
পেরেছিল সেই সান্ধ্যভাষা?
তোমার হাতের স্পর্শ আমার
সমগ্র সত্তায়
ফুটিয়ে দিলো রঙ বেরঙের
ফুল, অনুভব করলাম
আমার হৃদয়ে অজস্র নক্ষত্রের
নাচ, আমার শরীর
নিমেষে হয়ে ওঠে স্বর্গীয়
পাখির গান।
তোমার সোনালী হাত নিঝুম
মাছ
রূপালি সরোবরে, পর মুহূর্তে
গুণীর তান।
তোমার সঙ্গীতময় হাত
আমার শিরায় শিরায়
কবিতা তৈরি করতে থাকে
আমাকে বিহব্বলতায় ডুবিয়ে।
আমি তোমার শরীরের সুঘ্রাণে
যখন বুঁদ
যখন আমি তাকিয়ে আছি
জ্যোৎস্নার চুম্বনে বিহ্বল
গাছের দিকে,
সেই গাছের মধ্যে খেলে যায়
এক প্রশ্নের বিদ্যুৎ।
হাওয়ার ঝলক সেই প্রশ্ন
পৌঁছে দেয়
আমার শ্রুতিতে-‘কবি, এত
অল্পে তুষ্ট তুমি?’
২৫.৫.৯৪
যদি সেই ঝড়কে
আমার ক্ষণকালের
নীরবতাকে ভুল বুঝে
তোমার ব্যাকুলতা সেদিন
সন্ধ্যার অন্ধকারে
আমার নিঃশব্দতাকে প্রশ্ন
করল,
‘সে কি ক্লান্ত আমাকে
ভালোবেসে?’
সেই প্রশ্নের বিদ্যুৎ-প্রবাহে
চমকে ওঠে
আমার অস্তিত্ব। আমি তোমার
ব্যাকুলতার উদ্দেশে
বলি, বোলো, তাকে বোলো,
যদিন গোলাপের সৌন্দর্য
আমাকে
ক্লান্ত করবে, যেদিন
জ্যোৎস্নারাতের বিহ্বল
ঐশ্বর্যের প্রতি নিঃসাড় থাকব,
যেদিন কোকিলের ডাক
আমার শোণিতধারাকে চঞ্চল
করবে না,
যেদিন নদীর ঢেউ দেখেও
নিস্পৃহ থাকব,
যেদিন ভোরবেলার আবীর
আমার মনকে আর
রাঙিয়ে তুলবে না,
যেদিন স্বাধীনতা আমাকে
উদ্দীপ্ত করবে না আর,
যেদিন জীবনের চুম্বন ব্যর্থ
হবে আমার ওষ্ঠে,
সেদিন, শুধু সেদিন ভালবাসা
আমাকে অবসন্ন করতে
পারবে, তার আগে কিছুতেই
নয়।
কী ক’রে থামাবো তোমার
ব্যাকুলতার ঝড়?
আমার নিরপরাধ নীরবতাকে
শত বাঙ্ঘয় ক’রেও
ব্যর্থতার বালিয়াড়িতে মুখ
থুবড়ে প’ড়ে থাকব,
যদি সেই ঝড়কে তুমি নিজে
না পাঠাও নির্বাসনে।
১০.৩.৯৪
যাচ্ছো, যাও
যাচ্ছো, যাও। পথ রোধ করে
দাঁড়াবার
নেই অধিকার
আমার। তোমার
চ’লে-যাওয়া
জানে দূর মফস্বলগামী বাস,
প্রত্যুষের হাওয়া,
লেজঝোলা পাখি, সবচেয়ে
বেশি জানে
এ কবির বিদীর্ণ হৃদয়। কোনো
মানে
এখন পাই না খুঁজে কোনো
কিছুতেই।
শুধু নেই নেই
ধ্বনি ওঠে সবখানে; রক্তমাংস
করে আর্তনাদ,
শ্যাওলার মতন বিষাদ
আমাকে দখল করে, প্রতি
রোমকূপে দীর্ঘশ্বাস,
আমার না-লেখা কবিতার
চোখে ঘাস।
চ’লে গ্যাছো। আমাকে
বিদ্রুপ করে দেয়াল,
জোনাকি,
আমি তো বিচ্ছেদ নাম্নী ভীষণ
নিষ্ঠুর রমণীকে নিয়ে থাকি।
যৌবনোত্তর বিলাপ
বনতুলসীর গন্ধ, হঠাৎ হাঁসের
চই চই শব্দ আর
ধানের সবুজ ক্ষেতে ধ্যানী
সাদা বক, দোয়েলের শিস,
ফিঙে
পাখিটির নাচ, কুটিরের
ধোঁয়া, আর মফস্বলী
স্টেশনের রাত,
চিলেকোঠা আমাকে ফিরিয়ে
দেয় আমার শৈশব।
জীর্ণ আস্তাবলে
হাড়-পাঁজর-বেরুনো শীর্ণ
ঘোড়া,
হার্নি সাহেবের কুকুরের রাগী
চোখ, বাগানের ফুলদল,
টাটকা কের্কের ঘ্রাণ, তুঁত
গাছ, মহল্লার ক্ষয়িষ্ণু পুকুর,
লাভ লেন,
ভার্সিটির করিডর, মধুর
ক্যান্টিন, আমতলা, আসমান
লাল-করা কৃষ্ণচূড়া, রমনার
সর্পিল লেক, ক্লাশ রুমে
জীবনানন্দের
বনলতা সেন আর
রবীন্দ্রনাথের
দূরে বহু দূরে স্বপ্নলোকে
উজ্জ্বয়িনীপুরে, শেষের
কবিতা,
বাংলার বিদ্রোহ, রাজপথে
পদধ্বনি,
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়া
বাঙালিনী উদ্দাম আঁচল,
কারফিউ আমাকে ফিরিয়ে
দেয় আমার যৌবন।
যৌবন কি সত্যি ফিরে আসে?
দর্পণের স্বচ্ছতায়
পরিস্ফুট যে বাস্তব প্রতিকৃতি,
তার
দিকে চোখ পড়ে যদি, যদি
সিঁড়ি বেয়ে
ওঠার সময় হাঁফ ধরে খুব,
তবে মনে হয়-
যৌবন ফেরে না আর, শুধু
যৌবনের হাহাকার
ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে
মনের গুহায়। ঝাঁক ঝাঁক
ক্ষুধার্ত ইঁদুর ছুটে আসে কী
ক্ষিপ্র যৌবনোত্তর
মানুষের দিকে মহা ভোজের
আশায়। ইঁদুরের
তীক্ষ্ণ দাঁত মাংস ছিঁড়ে নেয়,
হৃৎপিণ্ডে বিকট ফুটো করে,
সে মুহূর্তে মনে হয়-
এই যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু ঢের
ভালো।
নিঃসঙ্গতা কৃষ্ণকায় ধাঙড়
যুবার মতো সারা গায়ে সাদা
কাদা মেখে আমাকে ভীষণ
জব্দ করে। নেশা ভরে
বাংলা আর হিন্দি
মিশিয়ে কীসব কথা বলে
ব্রাত্য ছন্দে,
কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না।
সরোবরে হাত ধুই বার বার,
তবু হায়, রুক্ষতা কমে না
কিছু, যৌবন ফেরে না।
২১.৩.৯৪