- বইয়ের নামঃ ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই
যখন তোমাকে দেখি তোমার নিবাসে, দেখি তুমি
বিষাদের ছায়া নিয়ে খেলা করো; আছো কিংবা নেই
বোঝা দায়। কখনো কখনো
মনে হয় যেন তুমি ছায়ার মতন জালে আটকা পড়েছো
অসহায়, চারদিক থেকে
ছুটে আসে ঝাঁক ঝাঁক ছায়ার হাঙর।
তখন আমার
বুকের ভেতরে শত শত নক্ষত্রের মৃত্যু হয়,
দাবানলে পোড়া যূথবদ্ধ ঘোড়া আর্তনাদ করে,
তুষারের কামড়ে বাগান
অন্ধ হয়ে যায় এক লহমায় আর
পুরোনো কবর খোলে মুখ ব্যাপক ক্ষতের মতো।
যখন তাকাও হেসে, হঠাৎ তোমার
বালিকা বয়স, যা’ দেখিনি আমি কখনো, আমার
ভাবনায় ভেসে ওঠে। অবচেতনায় কতিপয়
ছবি জেগে ওঠে, যেন গির্জের রঙিন কাচে গূঢ় আভাসিত
চিত্রাবলী! চাঁদ খুলে ফেলে তার নাইটি যখন,
মনে পড়ে শুয়ে আছো স্বপ্নের ডিভানে।
সংশয়ের ঘুণ
এখনো তোমাকে কুরে কুরে খায়, তুমি
তাই বিষাদের ছায়া নিয়ে খেলা করো, নাকি এই
বিষাদের নেই কোনো শেকড় বাকড়।
যখন শুনবে তুমি জানালার বাতাসের টোকা,
বুঝে নিও আমার নিঃসঙ্গ ভালবাসা ডেকে যায়
তোমাকেই তোমার মধুর নাম ধ’রে;
যখন দেখবে তুমি কোনো পাখি ছোঁয়
গাছের যৌবন, জেনো আমার সতেজ ভালবাসা
তোমাকেই ছুঁতে চায় সকল সময়;
যখন তোমার চোখে পড়বে নৌকোর
তীর-ছেড়ে-যাওয়া, বুঝে নিও
আমার জাগর ভালবাসা যাত্রা করে
তোমার দিকেই।
আমার ঘরের
প্রতিটি জানালা গ’লে রোদ আসে, হাওয়া
বয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে, চড়ুই যুগল ঘর বাঁধে
আমার এ ঘরে শীতে। বস্তুত এখানে
অনেকেরই আনাগোনা সকল ঋতুতে,
অথচ আমার ঘরে কোনোদিন পড়ে না তোমার পদচ্ছাপ।
ইচ্ছে হয় একটু দাড়াই
আজো ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটায়
চিরুনীতে কাঁচা পাকা কিছু চুল উঠে এলো আজো,
ধুমায়িত চায়ের কাপের সঙ্গে এলো
খবর কাগজ।
ইচ্ছে হয় বিছানায় জলচর প্রাণীর মতন সুনসান
আরো কিছু সময় কাটা।
প্ল্যাস্টিকের বালতিতে নামে
ট্যাপের পানির কৃশ ধারা, ঘরে ভাসে
পান্নালাল ঘোষের ভৈরবী; অকস্মাৎ
দুপুরে চিলের ডাকে আমার শৈশব ফিরে আসে
শ্লেট, চকখড়ি আর বাদামি রঙের
ব্যাগ হাতে। গলিতে আবছা কণ্ঠস্বর। আরো কিছু
প্রিয় স্মৃতি-আলোড়ণকারী শব্দ শোনার আশায়
ইচ্ছে হয় কান পেতে থাকি।
কেউ এসে ছোঁবে ব’লে
গোলাপ প্রতীক্ষা করে টবে, ফুলদানি
ডাকে তাকে সামাজিক আঙ্গিকে অথচ
সে কেবলি দারুণ অসামাজিক কারো
হাতে যেতে চায়,
মেঘের হৃদয় ফুঁড়ে কনে-দেখা-আলোয় চকিতে
উদ্ভাসিত কারো মুখ। কবে
দেখা হয়েছিলো তার সঙ্গে? মনে আছে
দুপুরকে ম্লান ক’রে তার ব’সে-থাকা বিকেলের বারান্দায়
দাঁড়ানো নিভৃত ছন্দে, সেই মুখ দেখছি এখন
স্মৃতি নাকি মেঘের কৃপায়!
ইচ্ছে হয়, সেদিকে তাকিয়ে থাকি বেশ কিছুকাল।
ছোটছুটি চলছেই, এক বিন্দু থেকে
আরেক বিন্দুতে নিত্য চরকির মতো
ঘোরা ফেরা। এরই মধ্যে দ্রুত
আকাশে তাকানো, বকুলের ঘ্রাণ নেয়া আর কাউকে সী-অফ
করতে এসে ইস্টিশানে কেমন অস্থির
পায়চারি করা। ট্রেন ইস্টিশান ছেড়ে
যাবার পরেও
কোলাহল-কমে-আসা প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছে হয় একটু দাঁড়াই।
এই যে আমি এলাম
এই যে আমি এলাম, এর কোনো তাৎপর্য কি
হীরের মতো
জ্বল জ্বল করবে আজকের অমাবস্যায়?
ক্রোশ ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে,
সত্তায় নিয়ে অনেক গ্রীষ্ম আর শীতের নখচিহ্ন
এসেছি তোমার ঘরে এবং
আমার প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই সারা ঘরে
ধুলো আর লতাগুল্মের গন্ধ,
নদীর তোলপাড়,
অজস্র পাখির ডানার ঝাপ্ট
আর অপরাহ্নের নিস্তেজ আলোর ঝিকিমিকি।
ভালো করে তাকাও আমার দিকে।
তোমার চোখ আমার অস্তিত্বে চুমো খেলে
আমার যৌবনের দিনগুলি
গুণীর তানের মতো বেজে উঠবে নিমেষে
আমার বুকের ভেতর,
দুলে উঠবে এক হাজার এক রাত্রির
অতুলনীয় ঝাড়লন্ঠন।
এখন আমি বসবো নাকি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো-
মনস্থির করতে পারছিনা।
মুহূর্তগুলি আমার হৃৎপন্ডকে খুঁচিয়ে
রক্তাক্ত করছে, যেমন
একজন কাঁকড়ার মুখিয়ে-থাকা দাঁড়া ক্রমাগত
খোঁচায় আমার কবিতাকে।
এবং আমার মাথায় এখন শৈশবের
হংসযুগলের মৃত্যু, একজন উন্মাদের বাদামি দাড়ি,
অবনীন্দ্রনাথের কাটুম কুটুম,
হরিণের চিত্রল যৌবন, বাৎসায়নের কামসূত্র,
বুদ্ধের উপবাসী মুর্তি, আমার
মরহুম পিতার ফটোগ্রাফ, রসেটির সনেট,
মদেলিয়ানীর শায়িত মহিলা,
রাশিয়ার নাছোড় তুষারে আটকে-পড়া
নাৎসী বাহিনী আর অ্যানি ফ্রাঙ্কের ডায়েরি
কেবল তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
আমরা দুউ’জন দু’টি শরীরের ভিন্নতা
অতিক্রম করতে চাইছি
চুম্বনে, আলিঙ্গনে, উথালপাতাল সঙ্গমে।
অথচ কিছুতেই আমি
তোমার প্রকৃত নাগাল পাচ্ছি না।
তাহলে কি ব্যর্থ আমার এই আসা?
আমার প্রশ্নকে স্তব্ধতায় মুড়ে রেখে তুমি
হাই তুললে, সুইচ অন করে দিলে ক্যাসেট প্লেয়ারের।
ভরাট গলার গায়কের কণ্ঠস্বরকে
ধারণ করল তোমার ঘর, সিগারেটের ধোঁয়া
পেঁচিয়ে উঠলো স্মৃতির মতো, জটিল চিন্তার মতো।
দু’পা এগিয়ে গেলাম ঘরের বাইরে,
বিদায়ের প্রতি উদাসীন তুমি আরো বেশী
স্তব্ধতার সরোবরে ডুবসাঁতার কাটলে-
অথচ তুমিই আমাকে ডেকেছিলে।
একটি গল্প
একটি তরুণ
একটি তরুণী
একটি শ্যামল পার্ক
একটি পুরুষ
একটি নারী
একটি নিভৃত ঘর
একটি পুরুষ
একজন নারী
একটি দোলনা
দোলনায় তুলোর মতন
তুলতুলে শিশু
একটি পুরুষ
একজন নারী
যুগল কবর
একটি বালক
একটি বালিকা
একটা সবুজ মাঠ মাঠে লাল বল
একটি তরুণ
একটি তরুণী
একটি শামল পার্ক।
একটি গোলাপ যখন
একটি গোলাপ যখন তার ডাগরতা নিয়ে
বাঙময় হয়ে ওঠে,
আমার চোখে তখন আলিঙ্গনাভিলাষী
বাহুর মতো পথ, গোধূলিরঞ্জিত দিগন্ত,
কয়েকটি অলৌকিক কলরবহীন বছর,
একটি মুখের অলকাতিলক,
কাংক্ষিত টেলিফোন নম্বর, আমার জন্মদিনের
পোশাক, সিগারেটের ধোঁয়া আর
আধুনিক কবির বই আর
অস্পষ্ট কতিপয় ঘোড়া, স্বপ্নে-দেখা সোনার ঘড়া।
একটি সিল্ক-কোমল গোলাপ যখন তার ডাগরতা নিয়ে
বাঙময় হয়ে ওঠে,
আমার মনে পড়ে রিলকের মৃত্যুর কথা, মনে পড়ে
বহু দূরের আজ পাড়াগাঁয়ে
আমার আব্বার কবরের কালো মাটিতে
হল্দে পাখির রঙের মতো এক বিকেলে
একটা গোলাপ অর্পণ করেছিলাম।
আমার চোখে পানি ছিল না এক ফোঁটা, অথচ
ফুলের কান্নায়
ভিজে গিয়েছিল আমার অস্তিত্ব
আজো সেই কান্নার স্মৃতি আমার ভেতর
হাহাকার।
আমার টেবিলের গোলাপটিকে
ক্রমশ শুকিয়ে যেতে দেখলে হঠাৎ মনে পড়ে যায়,
আমার সময় বেশী নেই। প্রায়শ
একটা স্বপ্ন দেখি আমি-
আমার গলা ফুঁড়ে রক্ত বেরুচ্ছে ঝলক ঝলক,
আমি সেই রক্ত এবং ডাগর গোলাপের
তুলনায় মেতে পরখ করছি
কার রঙ কতটা গাঢ়। এবং সেই স্বপ্ন গ্লাশের মতো
ভেঙে গেলে বেশী করে মনে পড়ে
আমার সময় কত কম।
স্বপ্ন যত ভয়ঙ্করই হোক, শেষ অব্দি স্বপ্নেই বাজে
পরিত্রাণের সুর;
আমার প্রতিটি স্বপ্ন ক্ষোদিত অদৃশ্য পোড়ামাটিতে।
আমার টেবিলের গোলাপটি
যখন পাপড়ি ঝরাতে থাকে, তখন আমি
চৌচির মাঠে উবু-হয়ে-বসে-থাকা কৃষক,
বেতফলের স্বাদে ভরপুর কিশোরী,
নতুন চরে পড়ে-থাকা লাঠিয়ালের ভেজা শরীর,
পালকির পর্দা সরিয়ে-তাকানো নতুন বউ,
অন্ধকারে জেলে ডিঙির ছিপছিপে গতি দেখতে পাই
এবং দেখি
চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে ফুটে থাকে একটি রক্তগোলাপ।
কষ্ট
রাত্রিবেলা শুনি আর্ত গলার আওয়াজ-
‘আমার কষ্টে তোমার কীগো?’
ঘোর নিশীথে রুগীর কষ্ট বাড়ার মতো
রাত বেড়ে যায়,
রাত বেড়ে যায় ক্রমাগত, বুকের ভেতর
কষ্ট বাড়ে। কিন্তু তুমি ব্যথাজাগর কণ্ঠ থেকে
ঝরিয়ে দেবে শব্দ কিছু-
‘আমার কষ্টে তোমার কীগো?’
কাঙাল আমি, হাত বাড়িয়ে থাকি সদাই;
তোমায় দেখার আশায় আজো
সকলসময় চক্ষু দুটি মেলে রাখি
রৌদ্র ছায়ায়, জ্যোৎস্নাপুরে।
কোথাও আমি হাত দেখি না, মানে তোমার
হাত দেখি না।
কাঙাল আমি হাত, বাড়িয়ে থাকি সদাই।
হস্তমাথা নেই কি তোমার? তবে বলো
কেমন ক’রে অমন সুরে কথা ছাড়াও
রাতের বুকে?
অন্ধকারে শুনেছিলাম, ‘আমার খোঁজে বৃথাই ঘোরো
একটুখানি সবুর করো, সময় হলে
নিজেই আমি নেবো খুঁজে। একলা থাকা
ভালো আমার,
তাইতো এমন একলা থাকি।
যখন বলি, ‘এমন একা একা থাকা কষ্ট ভীষণ’,
তখন আর্ত কণ্ঠ বাজে মাঝনিশীথে-
‘আমার কষ্টে তোমার কীগো?’
খাটো মোমবাতি
জীবন ফুরিয়ে যায়,
জীবন ফুরিয়ে যায় সাত তাড়াতাড়ি।
এই তো সেদিন মা আমার পাঠাতেন
আমাকে পোগোজ স্কুলে সযত্নে মাথায় সিঁথি কেটে,
দিতেন ঝুলিয়ে ব্যাগ কাঁধে,
রোজানা বরান্দ ছিল দু’পয়সা টিফিনের আর
এখন আমার ছেলে
দশটা পাঁচটা করে আপিশে, দুপুরে
রেস্তোঁরায় খায়,
প্রত্যহ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে ক্লান্ত পায়।
জীবন ফুরিয়ে যায়,
জীবন ফুরিয়ে যায় সাত তাড়াতাড়ি।
এই তো সেদিন আমি দিয়েছি তোমার কানে ঢেলে
কত ব্যাকুলতা, তন্বী ত্বক
নিমেষেই হতো রক্তজবা। আজ কেমন ধূসর
মলিন হয়েছো তুমি, তোমার প্রাক্তন অস্তিত্বের
শাড়ি-পরা প্রেত তুমি, হায়!
জীবন ফুরিয়ে যায়,
জীবন ফুরিয়ে যায় সাত তাড়াতাড়ি।
এইতো সেদিন আমি হাফ প্যান্ট প’রে
জনকের হাত ধ’রে ঘুরেছি বিকেলে
শৈশবের মাঠে।
জনক গতায়ু সেই কবে,
আমার দৌহিত্র আজ, তিন বছরের
শিশু,
কত যে বায়না ধরে, গেরিলার মতো
স্টেন গান নিয়ে করে আনাগোনা
বালিশের জঙ্গলে এবং
আধো আধো বোলে পপ গান গায়।
কখনও সে দাঁড় বায় সাধের ময়ূরপঙ্খী নায়, দেয়
পাড়ি সাত সমুদ্দুর,
তের নদী, যখন তখন
রাঙা পাল সোৎসাহে খাটায়।
জীবন ফুরিয়ে যায়,
জীবন ফুরিয়ে যায় সাত তাড়াতাড়ি।
দেবেদ্রবাবুর
ভীষণ অঙ্কের ক্লাশে, মনে পড়ে, বড় কাবু আমি,
দিয়েছি প্রচুর ফাঁকি; বুঝি
তাই জীবনের গলিঘুঁজি নিত্যদিন দিচ্ছে ফাঁকি
এখন আমাকে আর হিসেবের গরমিল দেখি
কিংবা ভয়ঙ্কর ভুল
জীবন খাতার প্রায় প্রতিটি পাতায়।
জীবন ফুরিয়ে যায়,
জীবন ফুরিয়ে যায় সাত তাড়াতাড়ি।
চাঁদমারি
আমার মিত্রের সংখ্যা কমছে ক্রমশ,
অথচ কী দ্রুত যাচ্ছে বেড়ে বিচিত্র শক্রুর ব্যুহ
আজকাল। কেউ দীর্ঘকায়, কেউ বেঁটে;
কেউ বোকা, কেউবা চতুর
অতিশয়; কেউ কেউ শিশেনাদরপরায়ণ খুব,
বেহেড মাতাল,
ধর্মের ইজারাদার কেউ,
কারো ধর্মে নেই মতি। বাস্তবের বরপুত্র কেউ,
বাগ্মিতায় দড়;
কেউবা নীলিমাজোড়া পরাবাস্তবের মৃণভোজী
পক্ষীরাজে উদাস সওয়ার,
গুলরুখপ্রিয় অতি, মসলিন-মিহি।
কেউ ছৈল ছবিলা রাজনীতিতে মশগুল, কেউ
বিবর্ণ বসন্তমুগ্ধ স্বঘোষিত অরাজনৈতিক।
এমন বেয়াড়া দিনকাল,
গাছপালাগুলো নিজ নিজ জায়গা ছেড়ে
বীর ম্যাকবেথের শক্রুর মতো ঘোর রণসাজে
ভীষণ আসছে ধেয়ে আমার উদ্দেশে। নদীনালা
ফুঁসে ওঠে যখন তখন,
শহরের যাবতীয় পোস্টার আমাকে
আপাদমস্তক মুড়ে ফেলে
নিমেষে বানাতে চায় মমি;
মিউজিয়ামের
প্রতিটি জন্তুর মূর্তি জেগে ওঠে আজ,
আইজেনস্টাইনের ফিম্লে পাথরের পশুরাজ
সহসা যেমন।
যতদূর জানে লোকে ক’বছর আগেও এখানে
চোতে কি বোশেখে,
অঘ্রাণে, ফাল্গুনে
আমাদের প্রিয়তম রঙবেরঙের পাখি ছিল
অগণিত, আজ এ তল্লাটে
একটি পাখিও আর পড়ে না সহজে চোখে কারো।
একদা এখানে বনে অনেক হরিণ ছিল, বনের কিনারে এসে ওরা
পানিতে ডোবাতো মুখ, দিতো লাগ দুলিয়ে শিং-এর
মোহন স্থাপত্য পূর্ণিমায়,
এখন হরিণরিক্ত অরণ্যানী ব্যাধের ব্যাপক স্বেচ্ছাচারে।
পাখি আর হরিণের সংখ্যা কমে গেছে অতি দ্রুত,
উত্তরে দক্ষিণে
বেড়েছে ব্যাধের সংখ্যা ক্রমাগত ঋতুতে ঋতুতে।
সেই কবে থেকে
বারুদের গন্ধে দিশেহারা
খরগোশ এবং জলপিপি কোথায় যে
দিয়েছে গা ঢাকা।
এমন কি কাঠবিড়ালিরা কোনোক্রমে
বেরোয়না গাছের কোটর থেকে আর,
মরে যায় খাদ্যাভাবে; হয়তো হতে চায়
মাটির নিচের কীট অথবা পতঙ্গ নিরিবিলি।
এখন আমার দিকে ভোজালি উদ্যত,
এখন আমার
মাথার ওপর ঝোলে শত শত রগচটা খাঁড়া
এখন আমাকে হল্ট ব’লে
ভীষণ ধমকে দেয় গর্জনপ্রবণ
বনেদী রিভলবার,
এখন আমার বুক লক্ষ্য করে শ্বাপদের মতো
নিবিষ্ট তাকিয়ে আছে বন্দুকের চোখ,
এখন আমার ঘরে বাড়িয়ে দিয়েছে খুব চকচকে গ্রীবা
সমর্থ কামান।
আর কতকাল আমি
সপ্তরথী শক্রুতার ছারখার চাঁদমারি হবে?
তোমাকে বিশ্বাস ক’রে
তোমাকে বিশ্বাস করে আমি এ শহরে ইচ্ছেমতো
আশাস্পৃষ্ট, হতাশা দংশিত
মানুষের ভিড়ে
হেঁটে যেতে চাই,
বাসার স্টপেজ ছেড়ে নিঃসঙ্গতা বয়ে
বাসের পিঞ্জরে বসে চাঁদ আর বিবাগী মেঘের
কানামাছি খেলা দেখে
মাইল মাইল দুরে চলে যেতে চাই।
যখন নিভৃতে টেলিফোনের মুখের মতো ফুল
শূন্যতাকে মোহন সাজায়,
তোমার মুখের দ্রিকে চেয়ে
আমার বিশ্বাস ফোটে সহজ মোটিফে।
যখন পাখির কণ্ঠে সুরের পরাগ ঝরে যায়,
তোমার উদ্দেশে
আমার বিশ্বাস
আলাপ এবং জোড়ে দীপ্যমান। যখন নদীতে
রূপালী মুকুট প’রে নাচে ঢেউগুলি
আমার বিশ্বাস রাজর্ষির মতো পথ হাঁটে একা।
অথচ আমার বিশ্বাসের কণাগুলি
তোমার ধারালো
ঝকঝকে দাঁতের দেয়ালে,
লালিম মাড়িতে, দশ আঙুলের নখে
পায়ের পাতায় লেগে আছে বিয়েবাড়ির ছড়ানো
বাসি খাবারের মতো।
একদা যে-হাত বিশ্বাসের পদ্ম দিয়েছিলো তুলে
আমার এ-হাতে,
যে-কোনো মুহূর্তে তার ক্যামোফ্লেজ-করা
ফণা ঝাঁঝাঁ উল্লসিত হতে পারে জেনেও তাকেই ছুঁতে চাই।
তোমার উলের কাজ
তোমার উলের কাজ দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়
কমবেশি। কী সহজে নতুন বিন্যাস
ফুটে ওঠে তোমার আঙুল আর কাঁটার মোহন ছন্দোময়
সঞ্চালনে ক্ষণে ক্ষণে। কখনো রঙিন পুষ্পোছ্বাস,
কখনো বা লতাপাতা অথবা বিমূর্ত নক্শা জাগে। কেউ কেউ
কণ্ঠে এনে বিস্ময়ের ঢেউ
বলে, কী’যে জাদু আছে তোমার আঙুলে।
তোমার নিজেরই কাছে সে এক রহস্য, গ্রন্থি যার
পারো না খুলতে তুমি। উলে
তোমার আনন্দ ফলে, জাতশত্র, শূন্যতার।
আর এমনও তো হয় কোনো কোনোদিন-
শুধু ভুল হতে থাকে ঘরে,
নর্তকীর মতো কাঁটা নুলো হয়; অত্যন্ত মলিন
হ’য়ে যায় তোমার মুখের রেখা, কিসের নিগড়ে
ভীষণ আটকে পড়ে তোমার বয়নকলা এবং তখন
তোমাকে যায় না চেনা। যাকে চিনতাম, তাকে ঢেকে
ফেলেছে শিল্পঘম মেঘ, বড় নিশ্চেতন;
যাবে না তো ফেরানো সহজে তাকে ডেকে।
তোমার মুখশ্রী আজ
তোমার মুখশ্রী আজ লুটেরা মেঘের অন্তরালে
চলে গেছে, মনে হয়; কণ্ঠস্বর সুদূর হাওয়ায়
মিশে আছে। আগন্তুক পরিব্রাজকের মতো ঘুরি
এ শহরে ফুটপাতে, বাসস্টপে, অলিতে গলিতে,
যদি দেখা হয়ে যায় কোনো ক্রমে, যদি এসে বলো,
‘কী ব্যাপার এতকাল দেখা নেই কেন?’ স্বরচিত
কবিতা তোমাকে যদি আনতে পারতো ডেকে, তবে
অনেক আগেই চলে আসা ছিল নাকি সমীচীন?
জেনেছি তোমার কাছে গেলে দুঃখের সহিত
অনিবার্যভাবে মালা বদলের প্রয়োজন হয়, তবু
হাওয়ায় উঠলে দুলে পর্দা, রূপালি তবক-মোড়া
এলাচ দানার মতো নক্ষত্র জাগলে নীলিমায়,
আকাশ সাঁওতাল যুবতীর মতো মেঘনম্র খোঁপা
বাঁধলে তোমাকে খবু কাছে পেতে ভারি সাধ হয়।
ত্র্যাকিলিসের গোড়ালি
এইতো চুয়ান্ন হলো, স্বাস্থ্য মোটামুটি
ভালো, ছুটোছুটি
এখনো করতে পারি খুব বেশি না হাঁপিয়ে, সিঁড়ি
বেয়ে উঠি নামি রোজ। তেমন বিচ্ছিরি
কোনো রোগ নেই, বলা যায়, শরীরে আমার। মানে,
বস্তুত চলেছি আমি জোয়ারের টানে।
ভাবি না ভাটার কথা আপাতত। এখনো তো কেউ
কেউ, ওরা সতেজ তরুণ, বলে, ‘তারুণ্যের ঢেউ
খেলিয়ে সত্তায় আজো দিব্যি আছেন হে কবি; সত্যি
আপনাকে দেখে চোখে কেমন সবুজ রঙ ফোটে। এক রত্তি
তোষামুদে চতুর অত্যুক্তি নেই ওদের কথায়
ভেবে আমি তৃপ্তির রোদ্দুরে বসি সুস্মিত মুদ্রায়।
যুকৃৎ তুখোড় আজো, যা কিছু পাঠাই নিত্য জঠরে হজম
হয় সবই রীতিমতো; যম
অসৌজন্যমূলক দ্রূকুটি হেনে ঈশ্বরের স্তব্ধতার মতো
প্রাচীনতা নিয়ে হাসে, করে পায়চারি ইতস্তত,
ঈগলদৃষ্টিতে খোঁজে খালি
আমার ধ্বস্ত এ অস্তিত্বের ত্র্যাকিলিসের গোড়ালি।
দগ্ধ মাটিতে
শরতের কিছু লিবিডোতাড়িত উচাটন মেঘ
দূরে ভেসে যায়, ময়ূর আমার প্রাণ।
হঠাৎ কী ক’রে মগজে আমার ক্রীড়াপরায়ণ
সেই কবেকার জবাকুসুমের ঘ্রাণ।
তোমার বাহুতে লীলায়িত জানি বসন্ত রাগ,
তোমার দুচোখে সূর্যোদয়ের গুঁড়া।
তোমার শরীরে মেঘনার খর তরঙ্গঁ নাচে,
জাগে চন্দ্রিল গারো পাহাড়ের চূড়া।
মনে পড়ে সেই পলায়নপর বৈশাখী রোদে
আমরা ছিলাম ধূসর পাথরে ব’সে।
ঢেউগুলি তটে খাচ্ছিল চুমো, জলজ কণারা
সহজ যাত্রী মগজের কোষে কোষে
হঠাৎ তোমার ত্বকে ফোটে আঁশ রূপালী মাছের
গোধূলিবেলায় তোমাকে যায় না চেনা।
আমিও নিমেষে পাখি হয়ে উড়ি, নেচে আসি ঢেউয়ে,
ব্যাকুল আমার চঞ্চুতে লাগে ফেনা।
তোমাকে আমার চষ্ণতে গেঁথে যাব নীলিমায়-
হাওয়ায় ডানার উষ্ণতা যাবে মিশে।
মেঘ মেঘালির নিঃসীম ক্ষেতে ডানার ছোঁয়ায়
জাগবে শিহর স্বপ্নের ঘন শীষে।
এই শতকের করুণ গোধূলি আমাদের চোখে
আনে বিভ্রম, দেখি প্রেতায়িত তরী;
সেই জলযানে আশ্রয় নিয়ে কখনো এগোই,
কখনো প্রখর ভাটায় পিছিয়ে পড়ি।
কিন্তু আমরা গোধূলিমাতাল পাথরেই ব’সে
প্রবল প্যাশনে পুষ্পিত দেহমনে।
কখনো আপন আর্তির ধ্বনি শুনি অবিরল
অতল জলের কাঁকড়ার ক্রন্দনে।
তোমার নিবিড় অঞ্জলি থেকে আনন্দ-বেলী
আমার জীবনে ঝরেছিল অকৃপণ।
কখনো কখনো বেদনার মেঘ এনেছিলে ডেকে,
মরুভু আমার বেদনাবিদ্ধ মন।
দদ্ধ মাটিতে খর পূর্ণিমা এনেছিলে ব’লে
অকুণ্ঠ আজো জানাই কৃতজ্ঞতা।
তোমার নিকট চিরঋণী আমি, কেননা জ্বেলেছ
অমাবস্যায় গহন উজ্জ্বলতা।
দরজা কখন খুলে যাবে
অবশেষে অপরাহ্নে দাঁড়ালাম এসে কায়ক্লেশে
কারুকাজখচিত বিশাল
দরজার কাছে আর নিমেষেই সৌন্দর্যের ছায়া
নক্শা হয় মনের ভেতরে। স্তরে স্তরে
গুপ্তধন থেকে ঠিকরে-পড়া বিভা কল্যাণের মতো
জেগে থাকে, মনে হয়। দরজার জ্যোতি,
সত্তাময় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি একা।
রঙিন মেঘের বুকে সন্ধ্যা ঝুঁকে আছে
লাজুক আঙ্গিকে;
এখনো দাঁড়িয়ে আছি, দরজা খোলে না।
নিশীথের বনে সুখে হরিণ হরিণী
ঘুমিয়ে পড়েছে। পর্যটক বাতাসের
স্পর্শে পাতাদের গীতস্পৃহা মঞ্জরিত হয় আর
আমি চেয়ে থাকি কারুকাজময় দরজার দিকে,
অর্গল নিঃসাড় তবু।
আমার চোখের পাতা সীসে হতে থাকে ক্রমাগত,
তবে কি এখানে আমি দরজার কাছে
নিজস্ব মাদুর পেতে শুয়ে থাকবো একাকী কিংবা
নিঃশব্দে থাকবো ব’সে বেগানা ধূলায়?
দরজা দাঁড়িয়ে আছে ঠায়
সীমাহীন উদাসীনতায়। অনেকেই ফিরে গেছে,
কেউ কেউ কৃপাপ্রার্থী মানুষের মতো
ভঙ্গিমায় বসে থাকে কিছুকাল ডানে আর বামে,
তারপর চ’লে যায় হতাশার কালো
পেরেকে আমূল বিদ্ধ। বন্ধ দরজায়
করাঘাত করে করে অবসন্ন আমি-
অথচ যাইনি ফিরে, অকস্মাৎ দরজা কখন
অনিবার্যভাবে
খুলে যাবে, কেউ তা জানে না।
ধ্যানের প্রহর
(মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
অবশ্য আজো আকাশের প্রচ্ছদে
অযুত তারার নক্শা দীপ্যমান,
এমনকি শত অবহেলা-লাঞ্ছিত
বাগানেও জাগে অতিথি পাখির গান।
পথের কিনারে রাজছত্রের মতো
ছায়া মেলে দেয় জটাধারী বুড়ো বট;
নানা সন্দেহ নিভৃতে ফিরিয়ে দিয়ে
গেরস্ত ঘরে আছে মঙ্গলঘট।
মধ্যরাতের মসজিদে মেলে গাঢ়
স্তব্ধতামেশা এবাদতী মহাক্ষণ।
কিন্তু জিকিরে, নিখাদ কবুল করি,
মজেনা আমার চিরসংশয়ী মন।
খানকায় জানি অমূল গোলাপ জ্বলে,
বাউলতত্ত্ব অজানা, এমন নয়;
রুমির ঐশী প্রেমের কিরণ-ঢেউ
কখনো আমারও মন-পিদ্দিমে বয়।
অসম সাধ্যে উত্তর দক্ষিণ
দুটি বিপরীত মেরুতে বিবদমান;
সমরনায়ক পারমাণবিক ক্লাবে
গলা খুলে গায় প্রলয়ের জয়গান।
এই ডামাডোলে, বাজখাঁই রলরোলে
ধ্যানের প্রহর আমিও নিত্য খুঁজি।
কিন্তু ভুতের বেগার খেটের মরি
এবং কী দ্রুত ফুরায় আয়ুর পুঁজি।
নীরোগ তরুণ
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চমকে ওঠে, যেন অচেনা কারুকে দেখছে
অনেকদিন পর। জুলফি শাদা, চুল দ্রুত পলায়নপর, গলার ত্বক
ভীষণ কুঁচকে-যাওয়া। বেশীদেরি নে আর, এখন থেকে থেকে এক অদৃশ্য
এসিড তাকে ক্ষইয়ে দিতে থাকবে তারই প্রখর সংকেত ভোরের আয়নায়।
এখন থেকে দাঁত নড়বে ঘন ঘন, কমতে শুরু করবে চোখের জ্যোতি।
অসুখ বিসুখ বিশ্বস্ত কুকুরের মতো নিত্যসঙ্গী হবে তার। এখন থেকে
প’ড়ে প’ড়ে মার খেতে হবে সময়ের। এখন থেকে কেউ আর তাকে
ঈর্ষা করবে না তার কান্তির জন্যে, এ-কথা ভেবে প্রবল গ্রীষ্মেও দুঃসহ
শীত অনুভব করে সে।
‘হায়, লোকটা রাতারাতি বুড়ো হয়ে গেল’ ব’লে কেউ কেউ
করুণা প্রকাশ করতে চাইবে এবং এটাই হলো সবচেয়ে মারাত্মক।
মুখ ফুটে কিছু না বললেও হাবে ভাবে বিলক্ষণ বুঝিয়ে দেবে,-
যত বারফট্রাই করনা কেন, আসলে এখন তুমি বার্ধক্যের মুখে
ইদুঁর। ভাবে, এক্ষুনি ঘুরে দাঁড়াবে আয়নার দিএক পিঠ দিয়ে,
আমল দেবেনা কাল-ভারাক্রান্ত কোনো চিন্তাকে, ভেসে বেড়াবে
হালকা হাওয়ায়। প্রকৃত ঈগল কখনো বয়সের ভার স্বীকার
করেনা, তাকে মানায়না অসুস্থ গেরস্ত আচরণ; বায়ুস্তরে
তরঙগ তাকে তুলতেই হবে পাখার ঝলসানিতে বারংবার। তাই,
সে আজো পাখি দ্যাখে, জ্যোৎস্নার ভিতরে হাত বাড়িয়ে দেয়
আর কোনো কোনো রাতে তার শিরায় তীব্র হুইস্কির মতো কী যেন
সঞ্চারিত হয় অলক্ষে। তখন সে আলোয় ঘেরা টেবিলে ঝুঁকে মেতে ওঠে
সময়ের সঙ্গে অলৌকিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, হয়ে ওঠে নীরোগ তরুণ।
বুড়োটে নাবিক
বুড়োটে নাবিক বেলাশেযে চাখানায় গল্প করে
সমুদ্রের। চায়ের কাপের তাপে ক্রমে ভাটা পড়ে।
একে একে উঠে যায় অনেকেই কাঠের চেয়ার
আর টুল ছেড়ে, কেউ ভুল ক’রে ফেলে যায় তার
দেশলাই, হাই তোলে পথের কুকুর। অকস্মাৎ
নাবিকের রক্তে জাগে প্রবল কল্লোল, শীর্ণ হাত
তলোয়ার মাছ হয়ে স্মৃতির তরঙ্গে নাচে, বুক
স্পন্দিত দ্বীপের গানে, নীল জামা তার স্বপ্নভূক।
রাত বাড়ে, বুড়োটে নাবিক আস্তে সুস্থে গল্পে ছেদ
টেনে আর ঝেড়ে ফেলে কবেকার মিলন-বিচ্ছেদ
সমুদ্রের ফেনার মতন পথে নামে, অন্ধকারে
চোখ মেলে স্বপ্নময়তায় তীব্র খোঁজে বারে বারে
কখনো ধোঁয়াটে বন্দুরের তন্বীটিকে, কখনোবা
পদ্মাসনে একা ক্ষুধাশীর্ণ বুদ্ধের মুর্তির শোভা।
বড়ে গোলাম আলির মাহাড়ি শুনে
পাকদন্ডী মহেঞ্জোদারোর গূঢ় স্তব্ধতার মতো
স্তব্ধতায় স্নান করে, লাজনম্র হয়
ছায়ার চুমোয়। কিয়দ্দূরে
দেখা যায় একটি বাদামি ঘোড়া, বয়েসী সওয়ার,
চোখে যার সূর্যের গহন
আবীর এবং গৃহদাহ, কবরখানার স্মৃতি।
চকিতে প্রচ্ছন্ন ঝরণা প্রকাশিত হলে
জলপানে মগ্ন হয় ঘোড়া,
আরোহী ভীষণ খরাপোড়া আঁজলায়
তুলে নিয়ে জল
ভাবে তৃষ্ণা তার মর্মমূলে জ্বলে ধু ধু
চিতাগ্নির মতো দিনরাত।
আরোহী ঘোড়ার ঘামাপ্লুত
ধনুক-গ্রীবায় রাখে হাত; বুকের ভেতরে তার
কবেকার ভোরবেলা, কুয়োতলা, পুষ্পিত ডালের
শোভা প্রস্ফুটিত অকস্মাৎ। এবং একটি নাম
লতাগুল্মে, কাঁটা ঝোপে ঝরণার নুড়িতে
স্বপ্নাদ্য হীরের আংটি। দেখা দিয়ে বনদেবী চকিতে মিলায়।
কিছু কি পরিকল্পনা ছিল পর্যটনে? এ কেমন পথচলা
ক্রমাগত? যত সে এগোয়,
ততই দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে। পৌঁছবে আখেরে
কোনখানে ভরসন্ধেবেলা? পৌঁছবে কি?
হয়তো ফিরে যেতে হবে। আহার না ক’রে কিংবা মাদুরে না শুয়ে
শুধু কবিরাই পারে ফিরে যেতে প্রত্যাশাবিহীন।
ভুল
তাহ’লে কি গোড়াতেই হয়েছিল সুনসান ভুল?
সরল বিশ্বাসের তুমি যাকে
পথ ভেবে করেছিলে যাত্রা তা ছিল গোলকধাঁধা এক,
একদা যে-হাত ছুঁয়ে স্বর্গের প্রবালসিঁড়ি বেয়ে
উঠে গেছ ব’লে
মনে হয়েছিল বার বার,
ছিল না তা’হাত কোনোকালে, ছায়ার প্রসুন নিয়ে
ছিলে মেতে, ওষ্ঠ ভেবে যাতে
করেছো অর্পণ চুমো শতবার, সেসব চুম্বন
হাওয়ায় হারিয়ে গেছে, যেন
অশরীরি কেউ
চেপে ধরেছিল ঠোঁট তোমার সংরক্ত ওষ্ঠতটে।
ব্যর্থ বাসরের রঙ লেগে
থাকে কি আত্মায় চিরকাল? জন্মান্ধ নিঃশব্দ ঝড়
আঁচড় কাটতে থাকে সত্তার দেয়ালে,
স্বৈরিনীর হাসির মতন
আলোর ঝিলিক
আঁধারকে আরো বেশি অনাত্মীয় করে,
কী যেন নিমেষে ভেঙে যায় অকস্মাৎ
হৃদয়ের আবরণ ছিঁড়ে।
ভুল ভেঙে যাবার পরেই
একটু থমকে তুমি দাঁড়ালে যদিও, তবু তুমি
নাওনি বিদায়,-
যেমন মঞ্চের আলো নিভে যাবার পরেও নট
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য স্টেজে বিষন্ন খেয়ালে।
পারোনি ফিরিয়ে নিতে চোখ
চেনা দৃশ্যাবলি থেকে। অন্ধকার সিঁড়ি
আর স্মৃতিখচিত দরজা,
তক্তাপোশ, কার্পেট, মাদুর,
এমনকি সে-ও
ছিল না তোমার, তুমি নিজের ভিতর থেকে একা
বাইরে বেরিয়ে এসে পরাবাস্তবের
সৌহার্দ্যে আপ্লুত হ’লে এবং রাখলে শাদা হাত
সংহারপ্রবণ সেই মরীচিকাশোভন হাতের ছায়াঘুমে।
প্রেমের কাঙাল তুমি, তাই আজো সবচে; সুন্দর
পাঞ্জাবি চাপিয়ে গায়ে, পারফিউমের অন্তরালে
অতিশয় পোড়া
কাঠের মতন অস্তিত্বের গন্ধ চেপে
তার কাছে যাও আর অর্থহীন জেনেও নিবিড়
কথপোকথনে মেতে, কফি খেয়ে, এর ওর দিকে
তাকিয়ে গল্পের রেশ খোঁজো ঘুমপাওয়া মুর্খ বালকের মতো।
প্রেমের কাঙাল তুমি, কখন তুমুল
স্বেচ্ছাচারিতায় উঠে গেছো ভুলে অপ্রেমের শীতল চিতায়।
মধ্যরাতের ভাবনা
প্রাচীন প্রেমের কাব্য আমি পড়ছিলাম নির্জনে
মধ্যরাতে টেবিল-ল্যাম্পের ফুল্ল আলো সুষমায়।
পংক্তির সংশৃদ্ধ সখ্যে অকস্মাৎ মৃতির পীড়নে
মন হলো ভারাতুর। ভুলতে পারি না তাকে হায়।
অথচ ভুলতে চাই তাকে, যে আমার রক্তমজ্জা
শুষে নেয় ক্রমাগত অন্তরাল থেকে। বুঝি তাই
শাদা কফিনের মতো মনে হয় আমার এ শয্যা;
ভীষণ উঁচিয়ে থাকে তীক্ষ্ম ছুরি নেপথ্যে কসাই।
অবশ্য সে নয় স্মৃতিসঙ্গী সকল সময়, যদি
সত্যের খাতিরে বলি। দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কাজে,
ককটেল পাটিতে আড্ডায় মধ্যনিশীথ অবধ
কাটে আর সময় করুণ বেহালার মতো বাজে!
এরই মধ্যে কখনো সখনো তার স্মৃতির ফোয়ারা
প্রবল উচ্ছ্রিত হয়। সে আমাকে আজো, হে হৃদয়,
স্মরণে রেখেছে কিনা, সে-কথা বিবেচ্য নয়। যারা
হিসেব নিকেশে দড়, এই বিবেচনা তাদেরই বিষয়।
হয়তো সে আমাকে গিয়েছে ভুলে, অথবা নবীন
কারো দেহমনের উত্তাপে সেঁকে মাতাল যৌবন
কাটে তার রাত্রিদিন। তাতে মুখ হবে ন মলিন-
কেননা একাগ্র নয় আর আমারও অতিজ্ঞ মন।
যায়
সূর্য নিবাসিত রাজার মতন দিয়েছে গা ঢাকা,
সন্ধ্যা ঝুঁকে আছে বারান্দায়,
টেলিফোন বেজে ওঠে আরো একবার।
হ্যালো, হ্যালো জ্বীহাঁ,
ম্যাসিভ ত্র্যাটাক।
সিঁড়িতে প্রবীণ ফিসফিসে গলা, কাশি,
মেঝেতে জুতোর শব্দ। টেলিফোন বাজে,
এই তো দু’ঘন্টা আগে বিকেলে ক্লিনিকে।
এলভিস প্রিসলী দেয়ালে
নিঃশব্দ সঙ্গীতে কী রঙিন,
চির তারুণ্যের
আভা স্তব্ধ মুখে।
ধোঁয়াচ্ছে তিনটি সিগারেট,
টেলিফোন বেজে ওঠে আর্ত
পাখির চিৎকারের মতো।
হ্যালো, হ্যালো কিছু শোনা যাচ্ছে না, বলুন-
হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি, দুই ছেলে এক মেয়ে।
টেবিলে ছড়ানো বই, ম্যাগাজিন, শূন্য প্লেট, দূর থেকে ভেসে
আসে লালনের গান ‘খাঁচায় ভিতর’…
গাড়ি বারান্দায়
প্রচ্ছন্ন আলাপ- কী যে হলো ইদানীং
কী বেয়াড়া দিনকাল,
এই বয়সেই।
আঁধারে অচিন পাখি ক্যমনে আসে আয়…
টেলিফোন বাজে, হ্যাল, হ্যালো,
জ্বী, কাল দুপুর দেড়টায় বায়তুল মোকাররমে।
কয়েকটি শরীর এখন ঢেউ, তটে আছড়ানো;
বাড়িটা গুমরে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে বেদনার্ত দেবতার মতো,
একটা বেড়াল অন্ধকার মুড়ি দিয়ে
শুয়ে আছে নিস্তব্ধ টিভির কাছে। টেলিফোন বাজে,
বেজে যায়,
যায়…
শব্দের মৃগতৃষা
‘মেয়েরা উঠলে ছাদে অতি দ্রুত সূর্য ডুবে যায়,
চাঁদ ওঠে
ওদের স্তনের মতো সাবলীলভাবে’-
এটুকু লিখেই থামলেই তিনি। বাক্যটি লেখা হয়ে
যাবার পর শব্দ সমুদয় থেকে অনেকদিন
তোরঙ্গে রাখা কাপড় চোপড়ের
ভাঁজ খোলাকালীন যে গন্ধ বিস্ফারিত হয়,
সেরকম গন্ধ নাকে লাগল তাঁর।
প্রতিটি শব্দ শুঁকলেন তিনি
অপরাধী অনুসন্ধানকারী
কুকুরের মতো, শুঁকলেন বারংবার; বিরক্তি
বোলতা হয়ে ঘুরতে থাকে
নাকের ডগায়, ঘন ভুরুতে। তিন-পংক্তি-সম্বলিত
কাগজটা দলা পাকিয়ে,
কাঁচাপাকা চুলঅলা মাথাটা ঝাঁকিয়ে, প্রৌঢ় কবি
ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে, যেমন
ভোরবেলা নাশতা খাবার সময়
মাঝে মধ্যে পাউরুটির শক্ত অংশগুলি
ছুঁড়ে দেন চড়ুই কিংবা কবুতরের প্রতি।
কবুতরের চোখের রঙের মতো দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে
কবি খুঁজতে শুরু করলেন
সে সব শব্দের পাছা আর দ্রোহী স্তন,
যারা দপ্ দপ করবে তাঁর কপালের রগে,
ঠোঁটে। শব্দের মৃগতৃষা তাঁকে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করলো; কলমের খাপ
একহাতে আর অন্যহাতে কলম নিয়ে
বসে থাকতে হলো তাঁকে
ঘন্টার পর ঘন্টা। তাঁর অধিকারে এলো না
সেই কাঙ্ক্ষিত জমি,
যার ওপর দিয়ে রাজেন্দ্রানীর মতো হেঁটে যাবে সৌন্দর্য।
গায়ে পাঞ্জাবি চাপিয়ে
তিনি বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়, বিন্দুমাত্র
আমলে আনলেন না গ্রীষ্মের চড়া রোদ,
ঘুরলেন অলিতে গলিতে,
ঘামে ভিজে উঠলো পাঞ্জাবি, গেঞ্জি আর
আন্ডারওয়ার; অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর।
দুপুরে চাইনীজ রেস্তোরাঁয় কাটল কিছুক্ষণ,
নিকেলে বন্ধুর ডেরায় আর
প্রচুর মদ খেয়ে যখন বাসায় ফিরে কড়া নাড়লেন
তখন মধ্যরাত নিজেই টঙ হয়ে আছে
গাঁজা-খাওয়া সন্ন্যাসীর মতো।
বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন কবি,
চপ্পল খসে পড়ল পা থেকে এবং তিনি
দেখতে পেলেন
টেবিলে-রাখা গোলাপটিকে, যার রঙ এখন
খাসির কলজের মতো।
ঢুলু ঢুলু চোখে তিনি দেখলেন একটা বুনো ঘোড়া ওর তরঙ্গিত
কেশর দিয়ে আদর করছে পূর্ণিমা চাঁদকে,
সে যেন চাঁদ আর আকাশের
ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বড় যত্নপরায়ণ। পবর্তপ্রমাণ
তুষারস্তূপে রবীন্দ্রনাথের মুখ
আবিষ্কার ক’রে গুনগুনিয়ে
ওঠেন তিনি, তারপর ঘুম ওকে মুকুট পরিয়ে
নিয়ে যায় নক্ষত্র সভায়।
ভোর জাগিয়ে তোলে কবিকে, যেন
এক্ষুনি ঘটবে কবিতার উন্মোচন; ধড়ফড়িয়ে উঠে
তিনি বসলেন লেখার টেবিলে,
কিন্তু চতুর্দিকে ব্যেপে এলো এমন এক স্তব্ধতা
যার পবিত্রতা হরণ করার জন্যে সেই মুহূর্তে
কোনো আগ্রহের দীপ আর জ্বলে উঠল না তার হৃদয়ে।
শোভাযাত্রা
হেমন্ত বিকেলে আমি বেশ্যাদের শোভাযাত্রা দেখে
আরো বেশি কৌতূহলী হই জীবনের রূপায়ণে।
নিশীথে কন্যারা এই পড়ন্ত বেলায় হেঁটে যায়,
ওদের শরীরে নগ্ন হাওয়া বিষণ্ন লেখে।
খুব কাছ থেকে দেখি গণিকার নগর ভ্রমণ;
স্বেদচিহ্ন দেখি না কোথাও আপাতত, কী কৌশলে
লুকিয়ে রেখেছে ওরা পৃথিবীতে জীবন-যাপন
করার দির্বেদ আর পাতালের জন্মান্ধ পীড়ন।
সমাজপতিরা দ্রুত ব্যাঙ্কনোট গুণে স্নানাহার
সেরে চুলে সুদূর আলালীটেরি কেটে ফুরফুরে
পাঞ্জাবির অন্তরালে সীল মাছের মতন দেহ
ঢেকে দূর থেকে করে ব্যবহার বাইনাকুলার।
বেশ্যাদের শোভাযাত্রা আস্তে সুস্থে একটি সফেদ
ঘোড়ার নেতৃত্বে চলে, ক্রমশ এগোতে থাকে। দূরে
অমৃতের ভান্ডে মাছি ওড়ে, ক’জন ধাঙড় ঢোল
বাজায় সূর্যাস্ত পান ক’রে, সমস্ত শরীরে জমে স্বেদ।
সুন্দর সুন্দর ব’লে ওরা সেই শোভাযাত্রাটিকে
মদালো রঙিন চোখে জানায় স্বাগত। দেয় পেতে
আসন উঠোনে, তাম্বুলের রঙ আনে আচরণে,
অবৈধ সৌন্দর্য চর্চা করে ক্ষণস্থায়ী অলৌকিকে।
অকস্মাৎ কারো মনে পড়ে ওপ্টেনের ঘ্রাণ আর
কেউ বনশিউলীর গন্ধ মনে ক’রে দীর্ঘশ্বাস
ফেলে, এরা কেউ সাড়ে তিন হাত সোঁদা নির্জনতা
পাবে না, পাবে না বুঝি চন্দর কাঠের সত্তাসার।
নিবিড় গোধূলিপায়ী বেশ্যাদের শোভাযাত্রা গাছে,
ফুটপাতে, দোকানের উল্লোল শো-কেসে রেখে যায়
নোনা মায়া, শোভাযাত্রা শবদাহ-স্মৃতিসম্বলিত
কাপাস তুলোর মতো উড়ে যায় কবিতার কাছে।
শ্রমিকের মতো
কখনো চাইনি হতে দরবেশ, তাই
জঙ্গলে বাঁধিনি ডেরা, শুইনি গুহায় কোনোদিন;
সেতারের ঝালার মতন রোদে আনন্দ খুঁজিনি।
কী মোহন আকর্ষণে অদ্যাবধি লোকালয়ে আছি, থেকে যাই।
এখনো এখানকার পথঘাট, জনমানুষের
কলরব ভাল লাগে, জূড়ায় দু’চোখ
লতাগুল্ম, ঝোপঝাড়, বেদেনীর কোমরের মতো
নদীর গহন বাঁক দেখে,
দেখে শিশুদের খেলা মাঠে
অথবা সূর্যাস্তমাখা দিঘির কিনারে।
নিসর্গের অভিভাবকতা
না বুঝেই ওরা খুব উপভোগ করে।
এখনো আমার
শরীর বাঁশির মতো বেজে ওঠে তন্বীর আয়ত চোখ দেখে।
লোকালয় এখনো আমাকে বড় আকর্ষণ করে।
কখনো লুন্ঠিত হই, কখনো সতেজ
পেশীগুলি ছিঁড়ে যায় লোলুপ কামড়ে, চক্ষুদ্বয়
অন্ধ হয়ে আসে কী ব্যাপক ধূলিঝড়ে,
দাঁতে দাঁত চেপে
তবু লোকালয়ে আছি, থেকে যাবো যতদিন থাকা
সম্ভব এখানে
মানুষের প্রকৃত আঙ্গিকে।
যতদিন আছি,
ভিখারীর মতো নয়, শ্রমিকের মতো তেজী, আন্দোলনলিপ্স,
পদক্ষেপে জীবনের কাঁধে হাত রেখে
পর্যটন করে যাবো তেজস্ক্রিয় আবর্জনাময়
আমাদের এই পৃথিবীতে, যেখানে দেবতা দ্রুত
নিবিড় ছাগল হয়ে যায় আর ছাগল দেবতা!
সপ্তম রাউন্ড
আরেকবার টাল সামলে নিতেই শুনি
দশদিক কাঁপিয়ে
চিৎকার করছে সবাই, হাজার-হাজার
ঝাড়লণ্ঠন যাচ্ছে গুঁড়িয়ে। মনে-মনে গুনি
ক’ রাউন্ড হলো। ইতিমধ্যেই কয়েকবার
হাঁসের মতো গোত্তা মেরে উঠেছি হাঁপিয়ে।
আমার চোয়ালে মারাত্মক
আপারকাটের চিহ্ন, নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে
ক্রমাগত। প্রতিপক্ষের প্রতিটি লড়াকু
জ্যাব ক্ষত তৈরি করছে
নিমেষে এবং বলছে, ‘তুমি যাও। হৈ-হল্লা, তীক্ষা সিটি
ভীষণ বিঁধছে আমাকে, ছিঁড়ে যেতে চাইছে মুখমন্ডলের ত্বক।
সান্ত্বনার কথা, এখনো মুখ
থুবড়ে পড়িনি অথবা
ছিটকে চলে যাইনি রিং-এর বাইরে। ভুলচুক
হচ্ছে মাঝে-মধ্যে, চোখজোড়া রক্তজবা
এবং আপাতত
আহত চিতাবাঘের মতো
মহুর লাফাচ্ছি দড়িঘেরা জায়গাটায়;
রাউন্ড-অন্তে বিরতি আমাকে বাঁচায়।
চারদিকে লোকের ভিড় আর তুমুল
জনগর্জন, তবু কেমন নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে।
আমি কি ভুল
করে বেছে নিয়েছি এমন খেলা-থেকে-থেকে
এই প্রশ্ন কাঠঠোকরা হয়ে ব্যবহার
করে আমাকে। এমন চারদিকের মুখগুলি
ঢেউয়ের চূড়ায় ফুল, আমার দু’চোখ অন্ধকার,
কানের ঘুলঘুলি
অজস্র ঝিঁ ঝিঁ পোকার দখলে।
বেল্টের নিচে আঘাত পেয়েও টিকে থাকতে হবে
এই রাউন্ডে কব্জির জোরে, অভিজ্ঞ কৌশলে।
বস্তুত আবার ওস্তাদের বৈভবে
আমার লড়াই শুরু করবার পালা।
সপ্তম রাউন্ডে আমি রিং-এর ভেতরে
কোনোমতে পা দুটো খাড়া রেখে, সাহস সঞ্চয় করে,
টাল সামলে, ঘোর অন্তর্জ্বালা
নিয়ে জয়ের সূর্যোদয়ের কাছাকাছি
আরেক রাউন্ডের প্রতীক্ষায় আছি!
সেই উপত্যকায়
করতলে ভয়ার্ত এক পাখি নিয়ে
পড়ি-মরি ক’রে আমি পালিয়ে এসেছিলাম
বিশাল সেই উপত্যকা থেকে।
একদা আমার পর্যটনের কোনো এক পর্যায়ে
হঠাৎ পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই উপত্যকায়,
যেখানে বসবাস করে একই মাপের
হাজার হাজার মানুষ।
সেখানে পৌঁছেই মনে হয়েছিল
কী চমৎকার নিসর্গশোভা। এমন নতুন সবুজ
আমি কখনো দেখিনি,
শুনিনি পাখির এমন মধুর গান। আগে
এখানে কেন আসিনি, এই আক্ষেপ
আমাকে ভয়ানক কাতর করেছিল, বলা যায়।
সেখানকার বাসিন্দাদের গায়ের রঙ
আরশোলার রঙের মতো, শালিখের চোখ যেন
বসিয়ে দেয়া হয়েছে ওদের চোখে।
ওদের সবার পরনে একই ধরনের পোশাক
ওরা সবাই কথা বলে অভিন্ন কায়দায়,
ওদের তাকানোর ভঙ্গি হুবহু এক এবং
একজনের হাসি থেকে অন্যজনের হাসি
আলাদা কিছু নয়।
এক এলাহি ঘন্টা ওদের শাসন করে
প্রহরে প্রহরে। দল বেঁধে ওরা
নির্ধারিত সময়ে এক সঙ্গে খায় দায়, একই রকম
বিছানায় শুতে যায়,
ভোরবেলা সবাই বিছানা ছাড়ে ঠিক একই সময়ে। সেখানে
পান থেকে চুন খসে না কখনো।
অতিকায় সেই ঘন্টার শাসন
আমাকে বেঁধে ফেলতে চাইতো
আষ্টেপৃষ্ঠে।
ঢং ঢং ঘন্টা বাজলেই খাবার টেবিলে
সবার সঙ্গে এক কাতারে বসা
আমার ধাতে নেই।
গাছগাছালি আর নক্ষত্রপুঞ্জকে উপেক্ষা ক’রে
একটা মস্ত হলঘরে সবার সঙ্গে গাদাগাদি ক’রে
নির্ধারিত সময়ে
চোখের পাতা বন্ধ করা আমার পক্ষে মুশকিল।
সেখানে দিন কাটতে চায় না, রাত চায় না পোহাতে।
বরাবর খুব বেলা করে ওঠা আমার অভ্যাসঃ কোনো নির্দেশে
সেই অভ্যাস আমি ছাড়তে পারিনি, আর
আমার নিজস্ব পোশাক আশাকও আমি পাল্টাইনি।
ওরা সবাই যখন একই সময়ে একই ধরনে হাসতো,
তখন বিষণ্নতা দখল করতো আমাকে।
যখন ওরা অদ্ভুত ব্যায়ামের ভঙ্গিতে
একই জায়গায় কদম চালাতো
আমি তখন শুয়ে শুয়ে পাখির ওড়াউড়ি
দেখতে চেষ্টা করতাম, ভাবতাম-
কী করে একচক্ষু নিয়মের ঊর্ণাজাল থেকে
মুক্তি পাবে আমার বন্দী সত্তা?
সত্যি বলতে কি, ওরা আমাকে নিয়ে
বেশ ফাঁপরে পড়েছিল।
নিয়ম-না-মানা লোকটাকে নিয়ে কী করবে, ওরা
দীর্ঘদিন সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেনি।
গোল টেবিল বৈঠক হলো বারবার,
অবিশ্যি তর্কের তুফান ওঠেনি কোনো;
কেননা, সেখানে সবাই সকল বিষয়ে নিখাদ একমত।
বিশেষ্ণগণ দামি মাথা নেড়ে নেড়ে
বললেন, ‘লোকটার মগজের কোষে আছে এক
খাপছাড়া তন্তুজাল এবং সেটাই
সকল এলেবেলে ব্যাপারের উৎস।
অস্ত্রোপচার ক’রে সেটি উপড়ে ফেললেই
অন্ধতাকে সে আর বলবে না দৃষ্টিহীনতা,
শস্যহীনতাকে বলবে না দুর্ভিক্ষ,
আকাশের তারা কিংবা জোনাকির স্ফুরণ
দেখার জন্যে সে রাত জাগবে না কখনো,
রহস্য বনদেবীর মতো ওর কাছ ঘেঁষে হেঁটে যাবে,
অথচ সে এতটুকু শিহরিত হবে না;
আমাদের মতের উজানে কস্মিনকালেও কাটবে না সাঁতার।
দৈবদয়ায়
সেই অস্ত্রোপচারের নির্ধারিত দিনের আগেই
করতলে ভয়ার্ত এক পাখি নিয়ে
পড়ি-মরি ক’রে পালিয়ে আসতে পেরেছিলাম
সেই উপত্যকা থেকে।
ঠিক কীভাবে সম্ভব হয়েছিল
আমার এই পলায়ন, বলতে পারবো না।
তবে এতকাল পরেও মাঝে-মাঝে
সেই উপত্যকা আমার স্মৃতিতে
নড়ে ওঠে জল-আলোড়নকারী হাঙরের মতো।