ফুঁসে ওঠে ফতোয়া
তোমরা যারা পরের খেয়ে
নিজের ঘরের জৌলুস বাড়াও,
তোমরা যারা কখনো গা’
থেকে ঝরাওনি
শ্রমের স্বেদ, তোমরা যারা
নারীদের অষ্টপ্রহর
দম আটকানো চারদেয়ালের
ঘেরে
বন্দী রাখার বিধান দাও,
যাতে রৌদ্র জ্যোৎস্না চুমো
খেতে না পারে
ওদের শরীরে, তোমরা যারা
কাউকে
ভাতকাপড় দিতে পারো না,
তারাই
অন্যের রুজিতে নিষেধাজ্ঞা
সেঁটে দাও।
তোমরা যখন হেঁটে যাও,
তোমাদের পায়ের নিচে
ডুকরে ওঠে মাটি,
তোমরা যখন কথা বলো
ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে
মোড়লদের সঙ্গে, সতেজ
লতাগুল্মের মুখ শুকিয়ে যায়,
বুক কাঁপে শস্যক্ষেতের।
তোমরা যারা একটি সুন্দর
বাক্যও উচ্চারণ
করতে পারো না তুলির
আঁচড়ে
ফোটাতে পারো না প্রকৃতির
রূপ,
তোমরাই ফতোয়া দাও আলো
ঝলোমলো
কবিতার বিরুদ্ধে, চিত্রের
বিরুদ্ধে।
যারা, গলিত অন্ধ সমাজকে
বদলে ফেলার কাজে
মগজ খাটায়, হাত লাগায়,
তারা তোমাদের পথের কাঁটা,
যাদের সত্তায় শস্যরাজির
হাসি ছড়ানো,
তোমাদের ফতোয়া ফুঁসে ওঠে
তাদের বিরুদ্ধে।
পারলে তোমরা একঘরে
করতে
গোলাপ, চামেলী আর
কৃষ্ণচূড়াকে।
পারলে তোমরা পাহাড়-চূড়া,
নদীর ঢেউ
পাখির বাসা, জোনাকি আর
দু’টি হৃদয়ের মিলনের রঙিন
সাঁকোর বিরুদ্ধে
লটকে দিতে হিসহিসে
ফতোয়া।
৬.৪.৯৪
বিমান বন্দর
এপার গঙ্গা, ওপার গঙ্গা
মধ্যিখানে নয় কোনো চর।
তার চেয়ে ভিন্নতর
মফস্বলের এক বিমান বন্দর।
বিমান বন্দরটার নেই কোনো
বাহারি আদল,
নেহাতই শাদামাটা; অনুজ্জ্বল
দরজার কাছে জলকণাময়,
শোনো,
মৎস্যকন্যা নয় কোনো,
তার চেয়েও আশ্চর্যজনক
মধ্য দুপুরে নিছক
তুমি, ঐশ্বার্যশীলা, শাড়ি পরা,
চুল
কালো আগুনের শিখা, হাতে
ফুল,
ছিলে দাঁড়ানো। তোমার
শরীরে,
লক্ষ করি ঈষৎ ভিড়ে,
গুণীর তান। সেই বিমান বন্দর
বন্দনীয়
এবং চিরপ্রিয়
হয়ে ওঠে আমার শুধু তুমি
ছিলে ব’লে
আমাকে স্পর্শ করেছিলে
ব’লে কথাচ্ছলে।
মনোজ মৌচাক থেকে
আজ রাতে ঘুম আর হবে না
আমার। করোটির
ভেতর কীসের গুঞ্জরণ;
বিছানায়
নিজের শরীর নেই।
এককোণে রয়েছি দাঁড়িয়ে,
হেঁটমাথা,
একাকী, দুর্জেয় অপরাধীর
ধরনে। বেড়ালের
থাবার আঘাতে আর নিশাচর
পেঁচার চিৎকারে
ঘড়ি কাঁপে নিরন্তর, নিশীথ
গোঙায়।
কিছুক্ষণ এভাবেই কাটে,
ক্রমাগত রাতের নিশ্বাস লাগে
সত্তায় আমার, ঝর্না কলম
এবং খাতাহীন
অক্ষরের খেলা নিয়ে বসি
নিভিয়ে ঘরের বাতি।
শব্দগুলো নর্তকীর মতো,
যেমন রয়েছে মাতিসের
ক্যানভাসে,
এ ওর শরীরে ঝুঁকে থাকে
অন্তহীন বেদনার বৃত্তে।
অক্ষরেরা উঁকিঝুঁকি দিতে
থাকে, আমি
লালবাতি দেখালেও ওরা
মানে না সঙ্কেত; অপরূপ
কোলাহল
করে মগজের কোষে কোষে,
আজ ঘুমোতে দেবে না
আমাকে, করোটি যেন বিয়ে
বাড়ি, পূর্ণ চাঁদ মাতালের
চোখ;
মনোজ মৌচাক থেকে নির্ঘুম
ছড়াতে থাকি শব্দের বিভূতি।
১৪.৫.৯৪
মরমী আঙ্গিক
সৌন্দর্যকে তর্জমা করার
অভিলাষে প্রজাপতি,
খরগোশদের লাফ, দিঘির
কম্পন,
জোনাকির জ্বলে-ওঠা,
নারীমুখ নিয়ে মগ্ন হই।
অকস্মাৎ
গোধূলির পাখি এক বার্তা
পৌঁছে দেয় নিরিবিলি
আমার বোধের সীমানায়।
তড়িঘড়ি
গেলাম দেখতে মাকে অনুবাদ
অসম্পূর্ণ রেখে।
জরার আঁচড়ে কিছু, কিছু
অসুখের
পীড়নে এখন ম্লান তিনি,
জননী আমার; তার
ক্লান্ত চোখে খেলা করে নিভৃত
বিভূতি-
যেন তিনি খুঁজছেন পলাতকা
বালিকা বয়স।
পদ স্পর্শ করে বিছানার ধারে
বসতেই তিনি
মাথায় রাখেন হাত দোয়ার
মুদ্রায়। আমি সেই
অনাবিল ভঙ্গিটিকে, সকলের
অগোচরে তর্জমায় মাতি।
মা আমাকে নিজেরই অজ্ঞাতে
গোধূলিতে দেন উপহার
শিল্পের নিজস্ব মহিমায় স্নাত
মরমী আঙ্গিক।
১২.৫.৯৪
মিহিরের উদ্দেশে
মিহির, তোমার কি মনে পড়ে
জামিলের কথা?
হ্যাঁ, আমিই সেই জামিল,
যে তোমার, বলা যেতে পারে,
প্রায় অষ্ট প্রহরের
সঙ্গী ছিল। ওরা বলতো,
আমরা দু’জন মানিকজোড়।
এক সঙ্গে আমরা যেতাম
স্কুলে, খেলার মাঠে,
কখনো যেতাম বেলাবেলি
পাশের গাঁয়ের মেলায়।
গুরুজনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে
দেখতে যেতাম যাত্রা
কুয়াশাঢাকা পথে
আমরা জু’জন হাত ধরাধরি
ক’রে। যখন
যে যার বাড়িতে ফিরতাম,
তখন ঘাসের ডগায়
চিকচিক করছে ভোরের
শিশির, তোমার মনে পড়ে
মিহির?
আমি, আজকের জামিল
আখতার,
কিছুতেই ভুলতে পারি না
সেসব দিনের কথা।
রাজহাঁসের মতো
গ্রীবা উঁচিয়ে আমার দিকে
এগিয়ে আসে অনেকগুলো
বছর।
মিহির, তোমাদের বাড়ির
সমুখে ছিল
কনকচাঁপার গাছ। একবার
এক স্বর্ণলতা আমাকে
জড়িয়ে ধরেছিল অবিকল
তোমারই মতো। তুমি মৃদু
হেসে
আমাকে নিয়ে গেলে তোমার
পড়ার ঘরে। কাকিমা,
মানে তোমার মা আমার
জন্যে ঝকঝকে কাঁসার
বাটিতে
নিয়ে এলেন নারকেলের নাড়ু
আর মোয়া। কাকিমার মুখ
মনে পড়লেই দেখি আকাশের
কিনারে
কল্যাণ ছড়িয়ে রয়েছে।
আত্মভোলা কাকা বাবু
তোমার বাবা, আমার
অজান্তেই আমাকে জীবনের
গভীর সবক দিয়েছিলেন তাঁর
উদার দৃষ্টি,
নিষ্কম্প মানবিকতাবোধ এবং
জন্মভূমির প্রতি
আরাধনাপ্রতিম ভালোবাসা
দিয়ে? কী ক’রে ভুলব
তাঁর কথা? জানি না, তিনি
বেঁচে আছেন কি না,
থাকলেও
তিনি কোনোদিন জানবেন না,
আমি একলব্যের মতো
আজো দূর থেকে অনুসরণ
করে চলেছি তাঁর নীতি।
মিহির,
তোমাকে কোনোদিন বলি নি
এ-কথা।
মিহির, তুমি কী সুন্দর আবৃত্তি
করতে জীবনানন্দের কবিতা,
আমি তন্ময় হ’য়ে শুনতাম
আর চলে যেতাম
রাঙা রাজকন্যাদের দেশে। বন
জ্যোৎস্নায়, স্পষ্ট দেখতে
পেতাম,
ভেসে উঠছে মৃণালিনী
ঘোষালের শব। মিহির,
তুমি, হ্যাঁ তুমিই আমাকে
দীক্ষিত করেছিলে আধুনিক
কবিতায়।
বাংলা কবিতা যে কী মধুর
সঙ্গীতময়, তা আমি
জেনেছিলাম
তোমার আবৃত্তির গুণে,
কবিতার পংক্তিমালা আমার
চিত্তে বয়ে যেতো ঢেউয়ের পর
ঢেউয়ের মতো,
আমি শুধু অবাক হ’য়ে
শুনতাম। তোমার সুরেলা
কণ্ঠস্বর
আজো আমার স্মৃতিতে গুণীর
তান।
এর পরের ঘটনা বর্ণনা করার
মুখ নেই
আমার কলমের। ধর্মান্ধতা
মানুষকে কীভাবে অমানুষ
ক’রে তোলে,
একে অন্যের গলায় ছুরি
চালায়, সম্ভ্রম লুট করে
সস্তা পণ্যের মতো, ভাই
ভায়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে
উল্লাসে ফেটে পড়ে, এ-কথা
আমরা এই উপমহাদেশের
অসহায় মানুষ জেনেছি চড়া
দামের বিনিময়ে। দাঙ্গা
অসংখ্য মানুষের ঘর ভাঙার
কলংকিত ইতিহাসই শুধু নয়,
মানবতার কুৎসিত হন্তারকও
বটে।
তোমরা, মিহির, দেশান্তরী
হ’লে তোমার বোন শেফালী
যেদিন হ’য়ে গেল দলিত
শিউলির মতো। আমার প্রিয়
দেশ থেকে
সংখ্যালঘুদের এই নীরব
প্রস্থান কী ক’রে ঠেকাবো
কোন্ আশ্বাসের দেয়ালি
জ্বেলে? দস্যুরা কখনো সবচনে
কর্ণপাত করে না। ওদের
বর্শার ফলায়
বিদ্ধ হয় মৈত্রী এবং
সহমর্মিতার হৃৎপিণ্ড।
মিহির, সেদিন, তোমাদের
বাস্তুভিটায় গিয়ে দেখলাম,
সেখানে আমাকে গ্রীবা
বাড়িয়ে
স্বাগত জানানোর মতো
কোনো রাজহাঁস নেই।
সেখানে এখন
এক ধুরন্ধর শেয়াল তার
পরিবার নিয়ে বাস করছে।
আরেকটি খবর তোমাকে না
ব’লে পারছি না,
এখন নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের
কায়ক্লেশে ভোটকেন্দ্রে
যেতে হয় না আর, অদৃশ্য
সংকেতে
অন্যেরা তাদের ভোট দিয়ে
দেয় মহানন্দে, সগৌরবে!
কী অদ্ভুত বিবেচনা! চাঁদের
কষ্ট হবে ভেবে হয়ত একদিন
ওরা তাকে নিজেরাই ঠেলে
ঠুলে আসমানের এপার থেকে
ওপারে পাঠিয়ে দেবে।
২৯.৩.৯৪