নিজের নিকট থেকে
চোখের অসুখ তাই কিছু ঠিক
দেখতে পারি না।
এ কীসের গন্ধ লাগে নাকে?
এ কাদের
পদশব্দ স্তব্ধতাকে ভীষণ
আঘাত করে? কাকে
আমার অত্যন্ত কাছে বসিয়ে
জিগ্যেস করি আজ?
কার ঘরে হৈ-হুলোড় করে
কেরোসিন ঢেলে ছুঁড়ে
দিচ্ছ প্রজাপতি মার্কা কাঠি?
হায়, একি
আমারই শরীরে লাগে তাপ;
যেন আমি
চিতায় রয়েছি শুয়ে, জীবন্ত
পুড়িয়ে দেবে বুঝি!
কলহ বিবাদ নেই কারুন
সাথেই, তবু কেন গায়ে পড়া
কাইজার হিংস্র কোলাহল
চতুর্দিকে?
শুধু বেঁচে থাকবার সাধ ধুক
ধুক
বুকে নিয়ে দিনযাপনের
শরশয্যা বেছে নিই।
চক্ষুঃপীড়া হেতু ঠিক দেখি না
কিছুই। অন্ধকারে
মিত্রকে সরিয়ে দূরে শক্রকে
নিবিড় বুকে টানে,
কারো বাড়া ভাতে ছাই দিইনি
কখনো,
অথচ আমার থালা ভেঙে
ফেলে দুর্জনেরা, বুক হয়
ছাই।
আবছা নিজের হাত, নিমগাছ
নিঝুম নিশীথ,
আছে না কি নেই, বোঝা
দায়, যদুবংশ-যুবকেরা
মদমত্ত,
নারী হরণের পালা শুরু করে।
আমি অসহায়
অশক্ত শরীরে আজ নিজের
নিকট থেকে পালিয়ে বেড়াই।
১৭.৩.৯৩
পাথরগুলো হবে ফুল
তুমি এসেছ, বড় ভুল সময়ে
এসে গ্যাছো তুমি।
বলব না, এই অসময়ে আসা
উচিত হয়নি তোমার;
ঘোর অবেলায় বিষ্ঠার স্তূপ
আর মান্ধাতার
পচা আবর্জনায় আবীর ছড়ায়
ঝলমলে রোদ, তবে কি তাকে
বারণ করার
কোনো অর্থ দাঁড়ায়?
তোমার দিকে অজস্র তীর
ছুঁড়ছে চৌদিক থেকে
কবন্ধ তীরন্দাজের দল,
তোমাকে ওরা তীর-জর্জরিত
দুলদুল বানিয়ে
হিংস্র উৎসবে মেতে উঠতে
চায়, রপ্তানি করতে চায়
ওদের উলঙ্গ জয়োল্লাস
বর্বরতার চূড়ায়। তোমার
অন্তর্লোকে
ওরা ছড়িয়ে দিয়েছে বিষাদের
মিশমিশে মেঘ।
যদি পারতাম এই নিষ্ঠুউরতম
দহনে
আমি তোমার জন্যে নিভৃতে
রচনা করতাম ছায়া,
যদি পারতাম তোমার
বুক-পিঠে বর্ম
এবং মাথায় শিরস্ত্রাণ হয়ে
ঝলসে উঠতাম, যদি
পারতাম।
আমার বড় সাধ হয়, তোমার
হৃদয়ের, মননের বিকাশমান,
সৃজনশীল ডালপালাকে মূঢ়
ক্রুর আগুন থেকে বাঁচিয়ে
রাখি।
না সরযু নদীর জল, না
ফোরাতের পানি-
কিছুই পারবে না তোমার
অন্তর্গত ক্ষতগুলো ধুয়ে দিতে।
আমি তোমার যাবতীয়
ক্ষতকে লাল গোলাপ বানিয়ে
দিতাম,
যদি পারতাম। আজ তুমি বড়
একা, যেদিকে তাকাও
সেদিকেই মুদ্রিত প্রগাঢ়
বেদনা। তোমার চোখ থেকে
অশ্রুজল ঝরলে পুড়ে যায়
করতল, দুব্বো ঘাস।
চৈত্রের রৌদ্রের মতো তোমার
গান ছড়িয়ে পড়ছে
নদীমুখে, খোলা রাস্তায়,
প্রান্তরে, দিগন্তে থেকে দিগন্তে।
কোনো নির্দিষ্ট জাত কিংবা
ধর্মের উদ্দেশে নয় তোমার
গান;
যে-গানে ধ্বনিত ভালোবাসার
মহিমা,
বিশ্বমানবের নিলনোৎসব।
তুমি জীবনের স্তব
রচনা করো বলেই ওরা
তোমার দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে
মরণ-ফাঁস।
ভয় পেও না মূঢ়তার
প্রেতনৃত্য দেখে-
দ্যাখো, তোমার খুব কাছেই
সাদা আলখাল্লা পরে দাঁড়ানো
সোক্রাতেস,
তোমার বিষাদ তিনি সস্নেহে
মুছে দেবেন সত্যসন্ধ হাতে।
জানি, কষ্ট তোমার মর্মমূলে,
অথচ শিরদাঁড়া খাড়া সর্বক্ষণ;
তুমি ছাড়া কে লিখতে পারত
‘আয় কষ্ট ঝেঁপে জীবন
দেবো মেপে?
ঘাতকের দল ব্যানারে লিখছে
তোমার নাম
হিংসার হরফে,
তোমার কণ্ঠস্বরকে ওরা
লোমশ পা দিয়ে মাড়িয়ে
থেঁতলে দিতে চায়, অথচ
যে-পথ তাদের পদশব্দে
আজ সন্ত্রস্ত খরগোশের মতো
কম্পমান,
সে-পথ একদিন তোমার
কণ্ঠস্বরের জন্যে
উৎকর্ণ হয়ে থাকবে সর্বক্ষণ,
বুকে ধারণ করবে
তোমার জন্যে ভালোবাসার
গোলাপ। সূর্যমুখী হবে
ভবিষ্যৎ।
ভেব না একা তুমি। দূরের
আকাশ নেমে এসে
সঙ্গ দেবে তোমাকে, গাছপালা
আর নক্ষত্র
তোমার নির্জন, শূন্য
মুহূর্তগুলোকে কানায় কানায়
ভরিয়ে তুলবে
বিলাপ-তড়ানো সংলাপে।
তোমার দিকে
ছুটে আসবে তোমার হাজার
হাজার ভাইবোন
তোমার উদ্দেশে কাসিদা
গাইতে-গাইতে, নিক্ষিপ্ত
পাথরগুলো হবে ফুল।
প্রকৃত মানব
গহন কুয়াশা ফুঁড়ে ক’জন
মানুষ স্পষ্টালোকে
এসে যায়, তাকায় এ ওর
দিকে, হাসি
ফোটে সকলের ঠোঁটে। ওরা
দেখেছে অনেক গৃহদাহ,
দেখেছে মানুষ কত
সহজে চালায় ছুরি মানুষের
বিপন্ন গলায়,
নারী লুণ্ঠনের কৃষ্ণ উৎসবও
তাদের
দেখতে হয়েছে বার বার
অসহায়
প্রহরে বলির পাঠা হ’য়ে।
এখন সহজে তারা একই
পাত্রে ভাগ ক’রে খেতে
পারে একই খাবার প্রত্যহ,
কুণ্ঠাহীন
নামের পদবী বদলের
বেলায়; ফলত সাহা রাহমান
আর খান গুণ
হ’য়ে যায়। অথচ ওদের
চোখগুলো
চোখই থাকে, নাক মুখ
অবিকল আগের মতোই
রয়ে যায়; নিশ্বাস প্রশ্বাসে নেই
কোনো হেরফের, যে-প্রেম
ওদের
প্রবল উদ্বেল করে, তার
কোনো গোত্র নেই, নেই
কোনো
আলাদা পদবী। অগ্নিশুদ্ধ
হ’য়ে, দীর্ঘকাল ঘন
কুয়াশায় হেঁটে হেঁটে ওরা
আজ প্রকৃত মানব।
১৭.২.৯৪
প্রত্যুত্তর
একজন চিত্রকর সাতদিন
ঘরের ভেতর খুব একা
কাটিয়ে বিকেলবেলা সারসের
মতো ধবধবে
পোশাক চাপিয়ে গায়ে
বেরুলেন শহুরে রাস্তায়।
হঠাৎ কোত্থেকে এক অসিত
কুকুর এসে ইস্ত্রি
করা পাজামাটা ক্ষিপ্র ভিজিয়ে
পালায় দৌড়ে আর
একজন বদখৎ লোক কাদার
কলঙ্ক লেপে
দিয়ে শিল্পীটির পাঞ্জাবিতে
হেসে ওঠে, মজা লোটে
ইয়ার বক্সির সঙ্গে। উদাসীন
চিত্রকর একা
ধীর স্থির হেঁটে যান। কেউ
কেউ তার দিকে চেয়ে
সহানুভূতির আভা ছড়িয়ে
দিলেন। কেউ কেউ
তাকে বেশ উত্তেজিত ক’রে
তোলার মশলা কিছু
জোগান দেয়ায় চেষ্টাশীল।
কাউকে কিছু না ব’লে
তিনি ঘরে ফিরে দোরে খিল
এঁটে চৈত্র পূর্ণিমার
মতো নগ্নতায় জ্ব’লে
ক্যানভাসে সৌন্দর্য আঁকেন।
১৮.৩.৯৩