তোমার এই মিথ্যা
রোগশয্যায় তুমি কখনো
শীতের শীর্ণ নদী,
কখনো অনেক দূরের
ছায়াপথ।
তুমি টিপয়ে-রাখা ওষুধের
শিশিকে বলছো-
‘আমি একা।‘
তুমি বাম পাশে ফিরে ভীষণ
আশ্রয়কাঙাল
চড়ুইয়ের চাঞ্চল্যকে বলছো-
আমি ভারী একা।‘
তুমি হাত বাড়িয়ে অখন্ড
‘গীতবিতান’
বুকের খুব কাছে নিয়ে
অজর পংক্তিময় পাতাগুলোকে
বলছো-
‘আমি একা, বড় একা
আমি।‘
তুমি শীতগোধূলিকে আর
রাত্রির কুহকছড়ানো
ঝিল্লীরবকে বলছো-
‘এই একাকিত্ব নিয়ে পারি
না আর।
এই মিথ্যাকে তুমি প্রশ্রয় দিচ্ছ
ব’লে
আমি অভিমানে ছন্দের
লালিত্যকে এক ঝটকায় খুব
ক’রে বলি,
তোমার সঙ্গে সর্বক্ষণ আছে
লোকচক্ষুর আড়ালে আমাদের
দু’জনের রচিত স্মৃতি আর
আমার ভালোবাসা,
তবু কি নিজেকে বলবে তুমি
একাকিনী?
তোমার চোখে
তোমার চোখে অনুবিশ্ব
আবিষ্কারের
নেশায় আমি বুঁদ। সেই কখন
থেকে
তোমার চোখের ভেতর
এই পর্যটক উত্তর মেরু থেকে
দক্ষিণ মেরু এবং
দক্ষিণ মেরু থেকে উত্তর মেরু
পাড়ি দিয়ে চলেছে।
পথের শেষ কোথায়?
কোথায় সেই অনুবিশ্ব, যার
সন্ধানে বার বার এই পর্যটক
হায়, হারিয়ে যাচ্ছে কুয়াশায়?
নীল এক পাহাড়ের গুহায়
হঠাৎ
প্রবেশ ক’রে দেখি অতিকায়
মাকড়সার জালে দশমীর চাঁদ
আটকা প’ড়ে হাঁসফাস
করছে।
৪.৩.৯৩
তোমার দিকেই আমার মুখ
আমি যে কাঁটাঝোপে নানা
রঙের
ফুল ফোটাতে চাই
হাত দুটো রক্তাক্ত ক’রে,
হৃৎপিণ্ড থেকে
ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরিয়ে
দিনরাত,
এ নিয়ে বিদ্রূপের হুল্লোড় ওঠে
কোনো কোনো বাঁকা মহলে।
আমি যে এই ছন্নছাড়া বয়েসে
তোমার হৃদয়ের ডালপালায়
মুখ রেখেছি
এ_ও অনেকের জিভে
চমৎকার নাচিয়ে
এই শহরে।
যেখানেই থাকি, তোমার
দিকেই আমার মুখ।
তোমার কাছে পৌঁছেনোর
আকাঙ্ঘা
রক্তগোলাপ আমার হৃদয়ে।
তোমার
ভাবনা আমাকে সর্বক্ষণ
বাজায়
বাউলের গোপীযন্ত্রের মতো।
তোমার মুহূর্তেগুলি
পাথরের নুড়ি হ’য়ে গড়ায়
প্রতীক্ষার ঝর্নাতলে।
আমার স্বপ্নভঙ্গের ছাই মেঘে
উড়িয়ে,
তোমার অনুপস্থিতির দুঃসহ
মুহূর্তগুলিকে
দূরে হটিয়ে কী এক তীব্রতায়
হন্তদন্ত ছুটলাম তোমার
নিবাসের উদ্দেশে।
যে এলাকায় তুমি থাকো
সেখানে এখন লোড
শেডিং-এর মিশমিশে
বোরখা; আমার সমস্ত শরীরে
দীর্ঘ ভ্রমণের স্বেদ, ধুলোর
গন্ধ। আমি
দোতলার অন্ধকার সিঁড়িতে
দাঁড়িয়ে দ্বিধার
অঙ্কুশে বিদ্ধ হবো আর
ম্যাক্সিপরা তুমি আলতো
আমার মুখের দিকে তুলে
ধরবে পিদ্দিম।
আমার চোখের সমুখে
তখন থরথর রহস্যের
উদ্ভাসন।
৭.৪.৯৪
তোমার দিকেই এই যাত্রা
প্রত্যুষের পাখি আমাকে দেখে
গান ভুলে
প্রশ্ন করে নিজেকে, এই সাত
একালে
কোথায় চলেছে লোকটা?
আকাশ সূর্যের মুকুট পরে
ঝলসাচ্ছে খুব,
আকাশে চক্কর দিচ্ছে যে চিল
সে ভাবে, এই ভরদুপুরে
কোন্ দিকে যাচ্ছে দিশেহারা
পুরুষ।
বিকেলের কোমল নদীর
জিজ্ঞাসা,…
কোথায় গন্তব্য এই ক্লান্ত
পথিকের?
গোধূলি বেলার গরুর গলার
ঘুন্টি
আমার উদ্দেশে উচ্চারণ
করে…
কোথায় চলেছেন কবি?
সন্ধ্যারাতের জোনাকির
সওয়াল,
কোন্ নিবাসে যাবে লোকটা?
মধ্যরাতির গোরস্তানের
আবছা বাতি
আমাকে লক্ষ্য ক’রে শুধায়,
পথের শেষ কোথায় এই
ধুলোময়
লোকটার? কোথায়?
ওরা কি জানে না প্রতি
মুহূর্তে, অন্তর্গত
ঐশ্বর্য আমার, তোমার দিকেই
এই যাত্রা?
১৭.২.৯৪
দু’হাতে জড়িয়ে ধরি
এ জীবন ক্রমাগত এলিয়ে
পড়ছে
পশ্চিমের দিকে।
দুঃখবোধ আছে, তবু এখন
আনন্দ পেতে লাগে না আমার
খুব বেশি আয়োজন।
টিকটিকি দম্পতি দেয়ালে
নীরবে বেড়াচ্ছে দেখে কিংবা
হাওয়ায় গাছের পাতাগুলি
নেচে উঠলে হঠাৎ,
শ্রাবণ-বৃষ্টির পরে রঙধনু দেখা
দিলে আর
দু’বছর নয় মাস বয়সের
শিশু
আমাকে চঞ্চল চুমু খেলে,
সহজেই আমি
আনন্দ-সাম্পানে চ’ড়ে পাড়ি
দিতে পারি
ঝড়ক্ষুব্ধ নদী।
প্রিয়তমা, বস্তুত তুমিই ওগো
আমার মনের
প্রান্তরে এনেছ সবুজিমা,
স্পর্শে যার
পথের ধূসর ধূলি হয় স্বর্ণরেণু
আমার মুঠোয় আর আমার
শরীর থেকে জরা
মুছে যায় লহমায়,
আলো-অন্ধকারে
যখন তোমার কণ্ঠস্বর বেজে
ওঠে
হৃদয়ে আমার, আমি যুবকের
মতো
দু’হাতে জড়িয়ে ধরি
তোমাকে অর্থাৎ পৃথিবীকে।
১৫.৮.৯৪
নিজেকে বলেন কবি
খুব নাক-উঁচু এক অধ্যাপক
সেদিন বাসায় এসে বলে
গেলেন কবিকে, ‘আর কত,
এবার থামিয়ে দিন
লেখনীকে।‘ একজন নিম
কবি আসর মাতিয়ে
বলেছেন, ‘লোকটাকে নিয়ে
পারা যাচ্ছে না কিছুতে,
এক্ষুণি থামানো দরকার খর্বুটে
বৃদ্ধটিকে।‘
‘থামো বাপু, ঢের জঞ্জালের
স্তূপ তুমি
কাব্য মালঞ্চের কোণে জড়ো
ক’রে লুটেছ তারিফ সুপ্রচুর
অনর্থক, ঝুলিয়েছ গলায়
মেডেল। তাড়াতাড়ি কেটে
পড়ো’ বলে তাকে
কবিসভা গুলজার-করা বুড়ো,
আধবুড়ো আর জবর জোয়ান
পদ্য লিখিয়ের দল, বহুরূপী
কাব্যবিশারদ।
থামো থামো রব বর্ষীয়ান
কবিটিকে ঘিরে
ঘোরে মৌমাছির মতো,
ফোটায় সুতীক্ষ্ণ হুল; তিনি
খাতার পাতার দিকে দৃষ্টি
রেখে নিজেকে বলেন
খুব শান্ত কণ্ঠস্বরে-যে যাই
বলুক যত তুলুক আওয়াজ,
থামব না। যতদিন পলাশ,
কোকিল,
বাবুই পাখির বাসা, লতা
পাতা, মধ্যরাত, সকাল
বেলার
আলো, বয়ে-যাওয়া জলধারা,
মাছরাঙা, সপ্তর্ষিমন্ডল
থামতে বলে থামব না
ততদিন।
এই উচ্চাবচ রুক্ষ জীবনের
অনলস শ্রমের কসম
কবিতা ঝটিতি কেড়ে না
নিলে কলম থামবে না
কিছুতেই।
১৯.৩.৯৩