কোনো এক শীত সন্ধ্যায়
শীত রাজধানীকে জাপটে
ধরেছে। সন্ধেবেলা শার্ট,
গাঢ় নীল রঙের ব্লেজার ধূসর
ট্রাউজার পরে
বেরিয়েছি বন্ধুর মোটর কারে।
শীতের কামড়
টের পাচ্ছি না তেমন। বাইরে
হাড়-কাঁপানো শীত। পথের
ধারে একটি প্রায়-নগ্ন
বালিকা তার অসুস্থ, উলঙ্গ
ভাইকে কোলে নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে শহুরে মেকী
বৈভবকে
বিদ্রুপ ক’রে। শীতের দাঁত
ওদের শরীরকে
দংশন করছে ক্রমাগত।
বালিকার এক হাত
সামনের দিকে বাড়ানো করুণ
প্রত্যাশায়।
আমার শার্ট, গাঢ় নীল রঙের
ব্লেজার,
ধূসর ট্রাউজার আর পশমি
মোজা
বিছে হ’য়ে কামড়াতে থাকে
আমাকে ইচ্ছে হলো,
এক ঝটকায় গা থেকে সব
পোশাক
খুলে ফেলে সম্পূর্ন উলঙ্গ
হ’য়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে
দৌড় শুরু ক’রে দিই। অথচ
সুরক্ষিত
মোটর কারের ঈষৎ উষ্ণতায়
বসে থাকি। নিজের ব্যর্থতায়
মনের হাত কামড়াই।
ঘরের নামকরণ
তুমি কি জানো, আমার এই
ঘর শূন্যতার প্রহারে
হাঁপানি রোগীর মতো খুব
শ্বাসকষ্টে আছে? তুমি কি
বুঝতে পারো আমার ঘরে
চেয়ার টেবিল খাট আর প্রচুর
বইপত্র সমেত কেমন খাঁ খাঁ
ধোঁয়াটে শ্মশানের মতো?
আমার ঘর তুমি দেখে গ্যাছো,
চোখ বুলিয়েছো
এর দেয়ালে, জানালা দিয়ে
তাকিয়েছো বাইরে,
বারান্দার রেলিঙে রেখেছিলে
হাত?
গাছের সতেজ পাতাগুলো কি
ছুঁয়ে দেখেছিলে? তোমার স্পর্শ
পেয়েছিলো
এই শয্যার চাদর, তোমার
আঁচল
লুটিয়ে পড়েছিল বালিশে।
তোমার হাতে কবিতার বই
সাইবেরিয়ার হাঁস হ’য়ে
খাচ্ছিল আদর।
তুমি কি জানো তোমার-দেখা
সেই ঘর আর
আগেকার আকৃতি ধারণ
করে না? কেমন বিদঘুটে
হতচ্ছাড়া হ’য়ে গেছে, ভীষণ
এক শৈত্যপ্রবাহে
উবে গেছে সবটুকু সজীবতা।
দরজা-জানালা, টেবিল-চেয়ার
খাট আর বুক শেল্ফ্ আজ
প্রলম্বিত হাহাকার।
তোমার দৃষ্টির দাক্ষিণ্যহীন
আমার এই ঘর।
সাপের খোলসের মতো অথবা
তোমার
পরিত্যক্ত শাড়ির মতো প’ড়ে
আছে। এ ঘরের নাম
কা’রো ইচ্ছে হ’লে
দিব্যি রাখতে পারে নিঃসঙ্গতা
কিংবা দীর্ঘশ্বাশ, যা খুশি।
চুল
বইমেলায় ঘুরছিলাম তরুণ
কবির সঙ্গে। ধুলো
লাগছিল জুতো-মোড়া পায়ে
এবং গায়ে
গা ঠেকে যাচ্ছিল দারুণ
ভিড়ে। বড় একা আমি;
কে যেন, মনে পড়ছে না,
বলল, ‘আপনাকে চিনতে
ভারি কষ্ট হচ্ছে। চুল ছাঁটালেন
কবে?’
কোনো উত্তর না দিয়ে ঈষৎ
হাসি, অজান্তে নিজের
হাত চলে যায় মাথায়। খুব
ছোট হয়ে গেছে আমার
স্যামসনী চুল কাচির দাপটে।
সেলুন থেকে ফেরার পর
আমার নিজের কাছেই
নিজেকে কেমন উটকো
লাগছে।
আমি যেন আমি নই আর,
অন্য কোনো মানুষ
প্রবেশ করেছে আমার ভেতর।
এখন আমি গাছের সঙ্গে,
নদীর সঙ্গে, ঝোপঝাড়ের
জোনাকি, বাঁশ বাগান এবং
নক্ষত্রের সঙ্গে
কথা বলতে ভুলে গেছি।
কীভাবে
দেবদূতের সঙ্গে আলাপ করতে
হয়, তা-ও যেন
মনে নেই আমার। যখন
আমার চুল অনেক
দীর্ঘ ছিল, ঘাড়ে ছিল
ক্রীড়াপরায়ণ
উত্তর মেরুর শাদা চালুকের
শাবকের ধরনে,
তখন কবিতার নানা শব্দ
আসতো অবলীলায়
আমার কাছে, যেমন জলের
উপরিতলে আসে মাছ। এখন
আমি আগেকার
ব্যক্তিত্ব-রহিত,
কবিতা-বঞ্চিত।
মাথা ভরা খাটো চুল নিয়ে
বিব্রত আমি
অধুনা শয্যায় ছটফট
করতে-করতে ক্লান্ত। হঠাৎ
কে এক আদিম পুরুষ আমার
চুল ধ’রে
টানতে থাকে রাতভর। আমি
তার উৎপীড়নের কাছে
নতজানু; ছায়াপথ,
সপ্তর্ষিমন্ডল, দিগন্তজোড়া
স্তব্ধতা আমাকে এক নতুন
খেলার আমন্ত্রণ জানায়।
১.৩.৯৪
তোমরা আমাকে আর
আমার কাছের এবং দূরের
বন্ধুগণ,
মিনতি জানাই করজোড়ে,-
তোমরা আমাকে আর কখনো
আমার নিজের লেখা কবিতা
পড়তে বলো না।
গা ঘুলিয়ে ওঠে, ভয়ানক বমি
আসে, ওয়াক্ ওয়াক্ ক’রে
তলপেট চেপে ধরি অসহ্য
যন্ত্রণায়, কী যেন
দলা দলা বেরিয়ে আসতে চায়
কণ্ঠনালী ফুঁড়ে।
কীভাবে করব কবিতা পাঠ?
তোমরা আমাকে আর কখনো
আমার নিজের লেখা কবিতা
পড়তে বলো না।
চাঁদকে পনির ভেবে অগণিত
ধেড়ে ইঁদুর
কুট কুট খেয়ে ফেলছে
অবিরত,
আমাদের স্বপ্নগুলোকে দাঁতাল
শুয়োরের পাল
ঢেকে ফেলছে ওদের মলে,
আমাদের মুক্ত চিন্তার গলা
টিপে ধরছে কিছু ভৌতিক
হাত,
আমি ওদের তাড়াতে পারছি
না।
বাগানকে দ্রুত ভাগাড়
বানাচ্ছে যারা,
হায়, ওদের বারণ করতে
গিয়ে হিমসিম খাচ্ছি বেজায়।
কবিতার বইয়ের শব্দগুলো
উপেক্ষার
ত্র্যাসিডে ভীষণ ক্ষয়ে গেছে,
একটি পংক্তির ভগ্নাংশ থেকে
অন্য পংক্তির ভগ্নাংশ
কোন্ মুদ্রায় আলাদা, আমি
ঠাহর করতে অক্ষম!
যখন কবিতা পড়ার জন্য
কাব্যগ্রন্থ হাতে তুলে নিই,
তখন অনেক লোক প্রাণ
হারাচ্ছে
ধর্মান্ধ ঘাতকের অস্ত্রাঘাতে;
যখন কবিতার অপরূপ
ডৌলের কথা ভাবি,
তখন বহু ঘরবাড়ি পুড়ে যাচ্ছে
দুর্বৃত্ত, সাম্প্রদায়িক আগুনের
লালসায়।
যখন কবিতা পাঠের
সুশোভিত মঞ্চের কথা ভাবি,
তখন লকলকে পিশাচেরা বহু
নারীকে
মারাত্মক অগোছালো করছে
ধর্ষণে;
যখন কবিতার দ্যুতিময়
উপমার অপরিহার্যতা
এবং চিন্তার গভীরতা
বিবেচনায় রাখি,
তখন হাজার হাজার অভুক্ত
শিশু কাতরায়
ক্ষুধার নেকড়ে-দাঁতের
কামড়ে।
আমি আমার কবিতাবলীতে
স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের অবিন্যস্ত
পদচারণা শুনতে পাই;
আমাকে তোমরা আমার
নিজের লেখা কবিতা
পড়তে বলো না কখনো,
পড়তে বলো না।
যাদের হিংস্র উত্থানে বিজয়
দিবসের উৎসবেও
বিষণ্ন, বড় বিপন্ন হয়ে যায়
স্বাধীন মানুষ,
যাদের হাতে এখনো আমার
শিক্ষকের,
আমার ভায়ের রক্তের ছোপ
আর্তনাদ করছে,
যাদের ফতোয়ার তুলট
কাগজে
বহু নারীর লাঞ্ছনা, বিপর্যয়,
হাহাকার, বুকফাটা চিৎকার
মুদ্রিত স্পষ্টাক্ষরে, যারা
অহর্নিশ
আমাকে বধ্যভূমিতে টেনে
নেয়ার ভাবনায় মশগুল
ধিক্ ধিক্ আমাকে, আজো
ওদের শাস্তি বিধান করতে
পারিনি।
আমার নিজের লেখা কবিতা
পাঠের
অধিকার আমি অনেক
আগেই হারিয়ে ফেলেছি।
১১.১২.৯৩