একটি সংলাপ
‘বহু ক্রোশ হাঁটা হলো; এখন
বিশ্রাম নেওয়া যাক
এই স্নিগ্ধ গাছের ছায়ায়।
‘থামব না; কায়ক্লেশ আছে,
তবু চ’লে যেতে হবে।‘
‘পথে দেরি ভালো নয়।
চলো, আরো নদী বাকি
আছে,
দিতে হবে পাড়ি।
‘ফুটফুটে জ্যোৎস্না দেখ
চতুর্দিকে পেতেছে গালিচা
কী মধুর আমন্ত্রণে; অবহেলা
করা ঠিক নয়, এসো বসি।
‘জ্যোৎস্নার ওপারে যেতে
হবে।
‘শোনো বাউলের সুর বাজে
রঙিন টিলার ধারে,
এসো, শুনে নিই কিছুক্ষণ
শরীর এলিয়ে ঘাসে’।-
‘উঠবে অমর্ত্য সুর বেজে
পথে পথে, এখন এখানে
থামা চলবে না’।
‘তাহ’লে বলো তো, কবি,
আমাদের গন্তব্য কোথায়?’
‘এখনো জানি না; জানি,
আমাদের আছে শুধু চলা’।
৭.৩.৯৪
এখনো অনেক পথ
এখনো অনেক পথ পাড়ি
দিতে হবে। কখনো-বা
ভুল পথ নিয়ে যাবে ডেকে
দূরে, জলের অভাবে
ঝিমিয়ে পড়বে প্রাণ। কাঁটার
দেয়াল চতুর্দিকে
হঠাৎ গজিয়ে উঠে পথ রোধ
ক’রে দুঃস্বপ্নের
এলাকায় ঠেলে দেবে। রক্তাক্ত
শরীরে জেগে ওঠা,
ক্ষীণ কণ্ঠে অর্থহীন বাক্য
উচ্চারণ করা তপ্ত
ঘোরের ভেতর ভুল কবিতার
মতো-এভাবেই
কিছুকাল বুঝি বা কাটাতে
হবে বন্দীর স্বভাবে।
অকস্মাৎ বিস্ফোরণ; অনড়
দেয়াল ধসে যায়,
স্পর্শ পাই সতেজ হাওয়ার,
কণ্ঠস্বরে করে ভর
গুণীর গভীর তান প্রত্যুষের,
সত্য প্রতিমার
মতো এসে সমুখে দাঁড়ায়;
আমি নিজে খোলা পথে
দাঁড়াই প্রসন্ন মনে প্রকৃত
হদিশ পেয়ে আর
কবিতার হিরন্ময় কাল
মোবারকধ্বনি দেয়।
১৮.৩.৯৩
এখুনি আবার
এখন আমার একটু ঘুম না
হলেই নয়। অনেকদিন
ঘুর রাস্তায়, ফুটপাথে, খোলা
পথে,
মানুষের মুখর হাটে হেঁটে
হেঁটে বস্তুত
ক্লান্ত আমার হাড়-পাঁজর;
মগজের কোষে কোষে
গুঁড়ো গুঁড়ো রং আর কুয়াশা
আমাকে কিছুক্ষণ ঘুম
পাড়িয়ে রাখার গান বাঁধছে।
নির্জনতম এক জায়গায় পা
বাড়াই,
হারাই অনুশোচনা। খাড়াই
পেরিয়ে টলতে টলতে খুঁজে
নিই
ঝরা পাতার বিছানা। এখানে
নিঃশব্দতার
নিঃশ্বাস আমাকে ছোঁয়;
বনস্থলীর ডুকরে-ওঠা
বুকের মধ্যে এসে ভাবি,
হাঁটতে হাঁটতে এতদূর এসে
পড়েছি?
মাথার উপর দু’টি তারা
কাঁপছিল
প্রেমে ডগমগ কুমারীর চোখের
মতো, অথচ
সেদিকে বেশিক্ষণ তাকানোর
ধৈর্য তখন গায়েব। এখন
আমি কিছুই দেখব না,
কিছুই শুনব না, এখন আমার
শিশিরভেজা ঘাস-পাতায়
মাথা পেতে ঘুমোনো দরকার।
এখানকার নিঝুম গাছপালা
আমার পরিচয়
জানতে চায়নি, বনমর্মর
কৌতূহল প্রকাশ করেনি
আমার নাম ধাম এবং পেশার
ব্যাপারে।
শিয়রে ঝুঁকে-থাকা স্বপ্ন
জানালো না তার ঠিকানা;
আমি
আমার অকুণ্ঠ ভালোবাসাকে
বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
কতক্ষণ ঘুমের ঢেউ বয়ে
গ্যাছে আমর উপর,
বুঝতে পারিনি; কানে তৃণের
সুড়সুড়ি
আর মানবকণ্ঠের গুঞ্জন
আমাকে জাগিয়ে দেয়,
আমার চোখে তখনো
চিকচিক করছে স্বপ্নকণা।
পথরেখা
এবং চঞ্চল মানুষগুলোর দিকে
তাকাতেই
মনে হলো, এখুনি আবার
বেরিয়ে পড়তে হবে।
৬.৪.৯৪
কবি তুমি
কবি, তুমি ধুলায় ধুলায় ঘাসে
ঘাসে মিশে থাকো,
মেঘে মেঘে, নক্ষত্রেও।
সরোবরে, পাথরে, কাঁকরে
তোমার সত্তার চিহ্ন রয়ে যায়
ঈষৎ আবছা।
লোকাচার দুঃসহ ভেবেও
কবি, তুমি হ’য়ে যাও
কখনো কখনো খুব
সামাজিক। তীক্ষ্ণ কপটতা,
ভাঁড়ামি, শঠতা সহ্য করে
স্মিত মুখে। মূঢ় নর,
স্থূল নারী তোমাকে উপেক্ষা
করে দূরে সরে যায়,
কবি, তুমি সবই মেনে নাও
অনিবার্য প্রাপ্য ভেবে।
তুমি কি কখনো অপমানে
বিদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ
পরায়ণ বনে যাও? কোনো
কোনো দিন বাঘনখ
বেরিয়ে পড়ে কি মিহি
অন্তরাল ভেদ ক’রে? আর
কখনো কি ভাবো যত্রতত্র হুট
ক’রে চলে-যাওয়া
সাঙ্গ ক’রে সকলের মুখের
উপর দরজাটা
বন্ধ রেখে অপমান বিরোধী
কবিতা লিখে যাবে?
২৪.৩.৯৪
কাঁটাও ব্যথিত হয়
সূর্যাস্তের কাছে এসে অকপট
বলা যেতে পারে-
কবির জীবন ঘিরে কত শত
ভ্রম ফুটে আছে।
অবশ্য মাশুল গুনে যেতে
হবে কিছুকাল, যদি দীর্ঘ বেঁচে
থাকে।
ঈষৎ স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বাঁচতে
চেয়েছে কবি, তাই
সঙ্ঘের কলহ থেকে নিজেকে
বাঁচিয়ে
করুণ রঙিন পথে হেঁটে যায়,
দু’ধারে নিভৃতে
সপ্রেম রোপণ করে স্বপ্নময়
চারা,
যেসব হয়ত ছোঁবে নীলিমাকে
গভীর আস্থায়
কোনোদিন, বস্তুত কবির
কোনো অবিনয় নেই।
অপমানে বিদ্ধ হয় কবি বার
বার, দ্যাখে, অবলীলাক্রমে
প্রতিষ্ঠিত মিত্র শক্র হয়ে যায়
সঙ্ঘের বাচাল
পরামর্শে, ভাবনার ধোঁয়াশায়
শীতল মাথায়
কবিকে হনন করে প্রত্যহ
দু’বেলা। এইসব জেনে শুনে
প্রতারক বন্ধু তার চক্রব্যূহে
যায়, অনুরাগে
আলিঙ্গন করে নিত্যদিন কত
মুখোশধারীকে।
কোনো কোনো সুহৃদ সজীব
আর জাঁদরেল খুব,
তবু ওরা ফ্রিজে-রাখা
ছাগমাংসের মতই মৃত
কবির হৃদয়ে। সে তো কাঁটার
ওপর হেঁটে যায়
প্রায়শই, মাঝে-মাঝে পুষ্পবৃষ্টি
হয়, সকৃতজ্ঞ দৃষ্টি তার
প্রসারিত সত্যসন্ধ লোকদের
প্রতি
কীর্তিনাশা সময়ের ক্রুর তটে
একাকী দাঁড়িয়ে।
এখন কবির অপমানে
গোলাপের
কাঁটাও ব্যথিত আর নক্ষত্রেরা
হয় অশ্রুজল।
৯.৩.৯৪
কে থাকে দাঁড়িয়ে
যেতে চাইলেই কি যাওয়া
যায়? যায় না
কে থাকে দাঁড়িয়ে দরজার
ওপারে?
চিনি বটে তাকে, এগোলেই
ছুঁতে পারি, অথবা
চুম্বন আঁকতে পারি ঠোঁটে,
অথচ
পা বাড়ালেই ছায়ায় ডুবে
যায়। হাওয়ায়
তার উপস্থিতির ঈষৎ কাঁপন
জড়িয়ে থাকে।
পথে পাথর, ঝোপকাঁটা
পাজামা আঁকড়ে ধরে,
জোনাকির জ্বলে ওঠা
অন্ধকারকে
আরো বেশি অন্ধকার করে;
অন্ধের মতো
পথ চলি। মনে হয়, কে যেন
দাঁড়ায় পাশে, দেখি না
মুখ তার; পাথর পায়ের তলায়
হিংস্র বাজতে থাকে, প্রাণে
তাকে ভালোবাসার দ্যুতি।
ঘাটে নৌকো বাঁধা। এ গহন
রাত্তিরে
নদীতে নৌকো ভাসানোর
মতো কেউ নেই, দাঁড়িয়ে
আছি ঠায়, জলজ হাওয়া
বুকে ধাক্কা দেয়। গলুইয়ে
আছে যে দাঁড়িয়ে,
জল ভেঙে ছুটে গিয়ে তাকে
বুকে জড়িয়ে
ধরতেই অনেকগুলো অক্ষর
ঝর ঝর ঝরে পড়ে।
১৩.৫.৯৪