একজন বৃষ্টিভেজা লোক
সন্ধেবেলা একজন বৃষ্টিভেজা
লোক বহুদূর
থেকে তার পায়ের ঘুঙুর
বাজাতে বাজাতে এসে থামে
আমার নিবাসে। তাকে
স্বাগত জানাব নাকি
তাচ্ছিল্যের ছাঁটে
রাখব দূরত্বে,-এই দোটানার
দোলক থামিয়ে
বলি মৃদু হেসে, ‘আপনি কি
ক্লান্ত খুব হে বাউল?’
চায়ের উষ্ণতা তাকে পায়ের
ঘুঙুর তাৎক্ষণিক
বাজাতে উদ্বদ্ধ করে। বইপত্র,
দেয়ালের ছবি,
আসবাব-সব কিছু
উদাসীনতায়
নিঝুম ভাসিয়ে তিনি কথা
আর সুরের মঞ্জরী
ফোটালেন লহমায়। আমি
তার গৈরিক নৃত্যের
ঘূর্ণিত আভায় আচানক দেখে
ফেলি দাঁড়ানো লালন সাঁই।
৭.৩.৯৩
একটি বাদামি খাম
ভোরবেলা আবীরমাখা রাস্তার
মোড়ে দাঁড়িয়ে
আমি মেঘনার তীরভূমি আর
পাখি-ছাওয়া চরের কথা
ভাবছিলাম। আমার মনে
পড়ছিল বাস্কেটবল
খেলোয়াড়ের ত্বরিৎ
লাফিয়ে ওঠার মতো ঢেউ,
অনেকগুলো নৌকার
উজান যাত্রা, নানা রঙের
পাল আর
হঠাৎ তরুণ রুইয়ের
ঝলসানি। পলাশতলীর তীরে
দাঁড়ানো
যমজ দু’টি অস্পষ্ট গাছের
কথাও
আমার স্মৃতিতে ছায়া বিস্তার
করছিল।
তন্ময় আমি, ট্রাফিক তখনো
ক্রুদ্ধ জন্তুর মতো
গর্জে ওঠেনি। একটি পাখি
ঈষৎ সুর ঝরিয়ে উধাও
কোথাও; কে কখন
আমার হাতে একটি বাদামি
খাম ধরিয়ে দিয়ে গোয়েন্দার
ভঙ্গিতে হাওয়ায় মিশে গেলো
বুঝতে পারিনি। সেই খাম
আমার হাতে কবুতরের পাখার
মতো
কাঁপছে অভিমাত্রার
আকর্ষণে। বুঝলাম, নিজেরই
অজান্তে
এক হিরন্ময় বার্তা পৌঁছে
দেওয়ার গুরুভার বইছি।
কাকে বা কাদের এই
খামে-ঢাকা বার্তা আমাকে
পৌঁছে দিতে হবে, জানি না।
অন্তর্গত কুয়াশার
আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা
আলো আমাকে
জানিয়ে দেয়, ওরা অনেকজন
অনেকক্ষণ ধরে প্রতীক্ষারত
আমার হস্তধৃত বার্তার জন্যে।
আমার ভেতরকার
বার্তাবহ উদ্দাম চঞ্চল হয়ে
ওঠে আরবী ঘোড়ার পেশীর
মতো।
একটি পাখি কাঁধে বসে
আমাকে বলে, ‘এই বাদামি
খাম
আমাকে দাও, চঞ্চুতে গেঁথে
নিয়ে যাই কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়।
পাখির কথায় কর্ণপাত না
করে
আমি হাঁটতে থাকি সামনের
দিকে। ভোরবেলার হাওয়া
মিনতি জানায় বার্তাবহ
হওয়ার। আমি তার মিনতি
অগ্রাহ্য করে বাদামি খাম ধরে
রাখি শক্ত মুঠোয়।
দূরে কোথাও অনেকগুলো
ঘন্টা একসঙ্গে বাজতে থাকে,
যেন আমার
পূর্বপুরুষদের কণ্ঠস্বর।
বনজ্যোৎস্নায় বিলুপ্তপ্রায়
কৌমের বসন্তদিনের নাচ,
আমার মাথার উপর
দেবদূতের মুখমন্ডলের মতো
নিষ্কাম চাঁদ।
হেঁটে যেতে যেতে আমার পা
দু’টো ভীষণ ক্লান্ত রক্তবমনে,
আমার দু’চোখ জুড়ে নামছে
মহাস্থানগড়ের ঘুম,
খর তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুক।
হায় বিষাদসিন্ধু, তবু আমাকে
পৌঁছতে হবে
সুবর্ণ নদীর সেই মোহনায়,
যেখানে
হিরন্ময় এক বার্তার জন্যে
সেই কবে থেকে প্রতীক্ষারত
অগণিত মানুষ, যাদের পায়ের
উপর দিয়ে বয়ে চলেছে
আদিম জলধারা।
১৩.৩.৯৩
একটি ভুলের দাক্ষিণ্যে
যদি বলি, কী সুন্দর তুমি,
তবে কি
বিব্রত হবে খুব?
কোমল নত হবে তোমার
মাথা?
তুমিতো নিজেই জানো,
সৌন্দর্য তোমাকে সর্বদা
জড়িয়ে রাখে আদরে।
যখন তুমি অতি সাধারণ
কথাও বলো, নিমেষে
তুচ্ছতা স্পর্শ করে সুনীল
উচ্চতাকে। যখন তাকাও
গাছের পাতা,
সপ্তর্ষিমন্ডল অথবা আমার
দিকে, সৌন্দর্য ঝরে সবখানে।
তোমার
উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের
আড়ালে গড়ে ওঠে মধুচক্র।
তোমার বাচনভঙ্গি। কী উপমা
খুঁজব তার?
যেন ঝর্নাধারা বয়ে যায় সবুজ
উপত্যকায়,
কণিকার গায়কি হয়ে ওঠে
তোমার স্নিগ্ধ বাক্যের প্রতিটি
পর্ব আর যতি।
এই মুহূর্তে তুমি আমার কাছে
বসে নেই, কত দূরে তুমি।
তবু তোমাকে দেখছি আমি,
হাঁটছো সুরুচির
বাতাবরণে; তুমি মুদ্রিত
আমার ভেতর। মৃত্যু ছাড়া
কার এমন সাধ্য মুছে ফেলে
সেই অপরূপ প্রতিকৃতি?
আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি,
তুমি
বসে আছ একা, গুছিয়ে নিচ্ছ
শাড়ির আঁচল,
এই তো তোমার মাথা ঈষৎ
হেলে গেছে
পেছনে, জুড়োলো ভোরবেলার
কফি।
আগে কি জানতাম কী
মনোমুগ্ধকর হতে পারে
একটি বিভ্রাট?
যার কোনো অস্তিত্ব ছিল না
এক মুহূর্ত আগেও,
তা হয়ে ওঠে চিরদিনের
অবলম্বন? কবিতার খাতা
মেলে ধরে
দেখছি প্রত্যাশার চূড়ায়
মোহন আলোর লুটোপুটি।
কী আশ্চর্য, একটি সামান্য
ভুলের দাক্ষিণ্যে
পেয়ে গেলাম তোমাকে,
যেমন কোনো নিঃস্ব ভবঘুরে
দৈবক্রমে
পেয়ে যায় অসামান্য ঐশ্বর্য।
সত্যি, পেলাম কি?
এই মুহূর্তে তোমার কাছে
পাঠিয়ে দিতে চাই
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর
বুলবুল,
দোয়েল আর শ্যামা। আমার
কণ্ঠস্বরকে
কোকিলের কুহুতান করে
পাঠাতে চাই তোমার উদ্দেশে,
সে-সুর রক্ত ঝরিয়ে তোমার
নাম ধরে ডাকবে অষ্টপ্রহর,
যা তুমি ছাড়া বুঝতে পারবে
না অন্য কেউ।
দেবদূতদের নির্দেশ দেবো
তোমার চারদিকে
হিরন্ময় তরবারি হাতে পাহারা
দিতে,
যাতে শয়তানের দল উত্ত্যক্ত
করতে না পারে তোমাকে,
যাতে অমঙ্গলের ছায়া ঘেঁষতে
না পারে তোমার ত্রিসীমানায়।
আর আমার ছন্নছাড়া
কবিতাগুলোকে পাঠাব
তোমার নিঃসঙ্গতায়। এখন
থেকে আমার কবিতা তোমার
হাত
স্পর্শ করবে, হাত ঢুকিয়ে
দেবে ব্রা-র ভেতর, পালতোলা
খর আবেগে
মুখ চুম্বন করবে তোমার,
বারণ করলেও শুনবে না।
২৩.৫.৯৪