আলোকলতার মূল
বড় রুখা সুখা সেই শহর,
অথচ সেখানে যাওয়ার সাধ
আমার চুড়াস্পর্শী।
বড় রুঠা সেই শহর,
তবু জানি সেখানে কোথাও
হৃদয়-জাগানো
স্মিত জলধারা বয় অষ্টপ্রহর,
সেখানে
লাবণ্য ব’সে থাকে আমার
কবিতার ওপারে,
মাধুর্য শয্যায় শুয়ে পত্র রচনা
করে
অস্তাচলের উদ্দেশে,
সুন্দরের কণ্ঠ সজীব হয়
গানে। সেখানে প্রোথিত
অলোকসামান্য
আলোকলতার মূল।
রুখা সুখা সেই শহরে ঘুরি
একা-একা
সারা দিনমান অমৃত ধারার
উৎস সন্ধানে।
এখানে যাই কায়ক্লেশে শ্রান্ত,
সেখানে শুধাই
ব্যাকুল কণ্ঠস্বর হ’য়ে; সবাই
নিরুত্তর।
কেউ কেউ, মনে হয়,
আমাকে প্রতারিত
করে ওদের ছায়াচ্ছন্ন
নীরবতায়।
ওদের উদাসীন দৃষ্টি আর
নীরবতাকে
পরাজিত করে আকণ্ঠ শুষে
নিই অন্ধকার,
রটনা আর বিদ্রুপকে
পুষ্পসার বানিয়ে দেখি,
আমি আলোকলতার মূলে
দাঁড়ানো
বিরস ঐ দূরের শহরে, অমৃত
ধারায় আমার অবগাহন।
উজাড় বাগানে
হাওয়ার হাত আমাকে
ঠেলতে-ঠেলতে
দাঁড় করিয়ে দিলো
এক উজাড় বাগানের মুখে।
শুনতে পেলাম না
কোনো পাখির গান, ফুলের
ঘ্রাণ
আমাকে জড়িয়ে ধরেনি বসন্ত
বাহারের তানের ধরনে,
সংলাপের ফিস ফিস পৌঁছেনি
কানে।
নিস্তব্ধতার জিভ আমাকে
লেহন করছে কোমন কোনো
প্রাণীর মতো,
আমার সারা শরীর বুজে
আসে। প্রায় টলতে-টলতে
প্রবেশ করি জনমানব শূন্য
বাগানে; এ কেমন
সাঁঝ আজ নির্জন পথের
গ্রীবায়
লেপ্টে থাকে? সময়ের কাঁধে
ঝুঁকে আছে স্মৃতির
জোনাকিপুঞ্জ
কয়েকটি গাছ দুর্ভিক্ষ পীড়িত
নারীর
কংকাল যেন, ত্রাণের
প্রত্যাশায়
বিশুষ্ক, কাতর। কবেকার
ক’টি শুকনো পাতা কুড়িয়ে
আবার রেখে দিই ঘাসমাটির
চোখের কোটরে। একটি আর্ত
স্বর আমার বুকে ভীষণ
হিম ঝরিয়ে মিলিয়ে যায়
হাওয়ার অন্ধকারে।
বেরিয়ে যেতে চাই বেগানা
বাগানা থেকে,
অথচ আমার পা দুটো অনড়।
গা ঝাড়া দেবো, তার জো
নেই; আমার হাতে
নিরাশার হাতকড়া, পায়ে
মনস্তাপের শেকল। গলা ছেড়ে
গান গাইতে
চাইলাম, কার কর্কশ হাত
চেপে ধরে আমার মুখ।
বাইরে কোথাও আমার জন্যে
অপেক্ষমাণ সুপ্রিয়া কবিতা,
শিরায় অনুভব করি
তার আবছা উপস্থিতি। বেশ
কিছুদিন তার মুখ
দেখি না; প্রাণ জিভের ডগায়
এনে
তাকে ডাকি। হঠাৎ আমার
চারদিকে
কয়েকটি দোয়েল, প্রজাপতি
আর ভ্রমরের চঞ্চলতা।
২০.১১.৯৪
এ এক রহস্য আমার কাছে
চাইকোভস্কির সোয়ান লেকের
প্রধান রাজহংসীর
ভঙ্গি আত্মস্থ ক’রে এগিয়ে
এলে
আমার কাছে। বললাম বটে,
কিন্তু এই অঙ্গসঞ্চালনে
সচেতন
প্রয়াসের কোনো চিহ্নই নেই।
পদ্মের উন্মীলনের মতো
সহজ আর স্বাভাবিক তোমার
হাতের নড়া,
গ্রীবার মুদ্রা।
তোমার হাতে লৌকিকতা
দোয়েলের মতো সঙ্গীতমুখর;
ট্রের বিস্কুট, মিষ্টান্ন আর
আপেলের ফালি
সন্ধ্যার গভীরতাকে আমার
চোখে
ভিন্ন মাত্রায় স্থাপন করেছিল,
মনে পড়ে। তোমার
ঈষৎ অসুস্থতা তোমাকে
আরো বেশি
মোহনীয় করার শপথ
নিয়েছিল যেন। টেবিলে রাখা
অখণ্ড
গীতবিতান তার সকল
ঐশ্বর্যকে
উজাড় ক’রে দিতে পারে
এত সহজে তোমার কণ্ঠে,
ভাবিনি।
আমি প্রায় কিছুই না খেয়ে
চায়ের কাপের দিকে হাত
বাড়াই
একটু চলকে উঠে সোনালী
চা, চুমুক দিয়ে তরল উষ্ণতা
জিভে ধারণ ক’রে তোমাকে
দেখে নিই এক ঝলক। এই
নিবিড় ব্যাকুল
তাকানো বহু মাইলের
দূরত্বকে মুছে ফেলে
লহমায়। তুমি আমার দিকে
তাকিয়ে হাসলে, আমার
সম্মুখে
খুলে গেল সুলেমানের
রত্নভাণ্ডারের দ্বার। তোমার
পায়ের কাছে
আমার শিষ্টাচার শীয়ামিজ
বেড়াল। তোমার নাভিমূল
ছুঁয়ে
একটি প্রজাপতি আমার
অধরের কম্পনকে জানিয়ে
দেয়
অপরূপ সরোবরের রহস্যময়
কামনা। প্রজাপতির বার্তা
আমি আমার
নিঃসঙ্গতার ছায়ায় লুকিয়ে
সুজনি-ঢাকা তক্তপোশ ছেড়ে
উঠে দাঁড়াই।
আধ ঘন্টার লোকাচারস্পৃষ্ট
এই একটুখানি দেখা
আমার কাছে হ’য়ে ওঠে
মোহন সবক। তোমার
দু’চোখের
চাউনি দর্শনের জটিল সূত্রকে
বেনেকাব ক’রে দেয়,
তোমার যুগল ভুরুর
সন্ধিস্থলের রহস্যময়তা
ইতিহাসের
কোনো লুপ্ত অধ্যায়কে
জাগিয়ে তোলে এবং তোমার
হাসির
বিদ্যুচ্চমক আমাকে পথ
দেখায় বিভ্রান্তির
গোলকধাঁধায়। তোমার
আবৃত্তি আর গান কী ক’রে
যে আমাকে
স্বদেশকে ঘনিষ্ঠ চিনতে
শেখায়, এ এক রহস্য আমার
কাছে।
২৪.৩.৯৪
এ জীবন আমার নয়
এই হৈ-হল্লা, দৌড় ঝাঁপ,
নানা দিকে
ছুটে বেড়ানো,
মাইক্রোফোনের
সামনে দাঁড়ানো যখন তখন,
বক্তার সামনে ব’সে পা
দোলানো,
আমার বক্তৃতার ফাঁকে হাই
তোলা ঝিমোনো-
এ জীবন আমার নয়।
গলির মোড়ে দাঁড়ানো,
যাত্রীময় ধাবমান বাস দেখা,
রিক্স-অলার সঙ্গে
ভাড়া ঠিক করা,
হেমন্তের শিশির ভেজা ঘাস
থেকে
ঝরা ফুল কুড়ানো,
অন্ধকারে শিস দিয়ে বাড়ি
ফেরা-
এ জীবন আমার নয়।
বইয়ে ডুবে-থাকা,
রোজ সকালে আদ্যোপান্ত
খররের কাগজ পড়া,
সংসারের ব্যয় কমানোর পন্থা
নিয়ে
স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করা
মাঝে-মাঝে আড্ডা দেওয়া,
সবুরে মেওয়া ফলার স্বপ্ন দেখা
-এ জীবন আমার নয়।
দু’বছরের শিশুকে খানিক
আদর করা,
চিঠির জবাব লেখা টেবিলে
ঝুঁকে,
দুপুরে পুকুরের জলে ঢিল
ছুঁড়ে
বিলীয়মান বৃত্ত দেখা,
মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে
জেগে উঠে
আকাশের দিকে তাকানো-
আমার ভেতরকার একজন
বলে সোজাসাপটা
-এ জীবন আমার নয়।
কী তবে আমার জীবন?
কী তবে আমার জীবন?
প্রশ্ন করি নিজেকে, নির্ঘুম
কাটাই
বিছানায়। চারদেয়াল আমার
দিকে হেঁটে আসে।
যে-জীবন আমি যাপন করেছি
এতকাল, যে-জীবন যাপন
করি
এ আমার জীবন নয় ব’লে
আমি তড়িঘড়ি
কুয়াশাময় প্ল্যাটফর্মে ভুল
ট্রেনে উঠে পড়ি।
৯.১২.৯৩