শওকত ওসমানের জন্যে
এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি,
আপনি আহত
শার্দুলের মতো বসে আছেন
আপনার নিজস্ব বিবরে।
বাইরে এখন অন্ধকার গাঢ়
হচ্ছে ক্রমাগত, রক্তখেকো
নেকড়েগুলোর তৎপরতা
ভীতি সঞ্চার করছে
অনেকের মনে। আপনি
আহত, অথচ অন্তর্গত
রক্তক্ষরণ আপনাকে
অবসন্ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আপনি, অনুমান করি,
তাকিয়ে আছেন ঘরের
দেয়ালের দিকে,
যেখানে আপনার না-লেখা
পংক্তিগুলো মাঝে-মধ্যে
ঝিকিয়ে উঠছে, চক্ষুষ্মান
আপনি সহজে
দেখতে পাচ্ছেন কালান্তরের
অপরূপ অভিষেক।
আপনার জীবন এক অবিরাম
সংগ্রাম বাঁচবার
ক্লান্তি আর হতাশা যাদের
কুঁজো করে ফেলেছে তাদের
বাঁচিয়ে তুলবার। আপনি ইচ্ছে
করলেই
গোলাপের সুঘ্রাণে বুঁদ হয়ে
নক্ষত্রের গুঁড়ো সারা শরীরে
মেখে
কাটিয়ে দিতে পারতেন
অবলীলাক্রমে, কিন্তু যে
আপনি জীবনকে
দেখেছেন নানা মাত্রায়, বিভিন্ন
স্তরে,
তাঁর পক্ষে কী ক’রে সম্ভব
পদ্মভুক হ’য়ে থাকা? ক্ষুরধার
আপনার লেখনী, তার
আঘাতে
অন্ধকার কাতরাতে থাকে
পশুর মতো। আপনার
অক্ষরমালার দ্যুতিতে চোখ
ধাঁধিয়ে যায়
মধ্যযুগচারী লোকদের, ওরা
বুঝতেই পারে না
আপনার সীমাহীন অভীপ্সা,
আপনার স্বপ্নের বলয়ে
কী ঐশ্বর্য জ্বলজ্বল করছে!
এ দেশের প্রতিটি বিবেকী
মানুষ আপনার
রচনা সমূহের পক্ষে, হে
প্রেরণাসঞ্চারী অগ্রজ,
এ দেশের প্রতিটি সাহসী,
অগ্রসর মানুষ
আপনার সুদীর্ঘ জীবনের
পক্ষে, আপনার কাঁটার মুকুটে
ঝরুক পুষ্প বিকাশের সুর,
আমাদের কৃতজ্ঞ চিত্তের
আনন্দধারা।
২৮.১২.৯৪
শাস্তি দাবি করে
কখনো এমন সময় আসে,
কিছুই
ভাবা যায় না। সাতটি ময়ূর
পেখম মেলে
নাচে, তিনটি ঘোড়া ছুটতে
থাকে
সবুজ ঘাসের শিশির ঝরিয়ে,
পাঁচটি দোয়েল শিস বাজিয়ে
নিসর্গকে
সঙ্গীতময় ক’রে তোলে,
অথচ আমি
বন্ধ্যা সময়ের মুখোমুখি
ব’সে থাকি ভাবনাহীন।
একখণ্ড পাথরের মতো
আমার অবস্থান। কে আমাকে
নীরেট পাথরের স্তব্ধতায় ঢেকে
রাখে?
হঠাৎ কখন যে পাথর ফুঁড়ে
জাগে ফোয়ারা
আমি আমার চতুর্দিকে দেখি
জ্যোতির্ময় এক বলয়,
যেখানে
মুনীর চৌধুরীর হস্তধৃত তীক্ষ্ণ
কলম,
শহীদুল্লাহ কায়সারের স্মিত
ঠোঁট,
আলীম চৌধুরীর একজোড়া
চোখ,
ফজলে রাব্বির হৃৎপিণ্ড,
গোবিন্দ দেবের নির্মোহ উদার
বাহু,
জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার
বুদ্ধিদীপ্ত ললাট
আনোয়ার পাশার নাক
আলতাফ মাহমুদের সুরাশ্রয়ী
কণ্ঠ
এক বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে
বিজয়োৎসব হ’য়ে যায়।
আমরা এই উৎসবে আনন্দিত
হ’তে হ’তে
বেদনার্ত হ’য়ে যাই আর
কিছু লোক
উৎকট ভঙ্গিতে হাসতে থাকে
শ্লেষের তুবড়ি ছুটিয়ে
ওদের মুখ থেকে গলগলিয়ে
বেরিয়ে আসে
বহু বছরের রক্ত। আকাশের
নক্ষত্র, ঝোপের
জোনাকি, নদীর ঢেউ,
ক্ষেতের ফসল
পায়ে-চলা পথ, কৃষকের
কুটির, জেলের ডিঙি
গণকবরের ঘাস একযোগে
ওদের বিচার দাবি করে
বিচার দাবি করে,
শাস্তি দাবি করে;
চরম শাস্তি দাবি করে।
যারা উদাসীন, নীরব তাদের
উদ্দেশে
নিসর্গ এবং জনবসতির
ধিক্কার ছাড়া কিছু নেই,
কিছু নেই,
কিছু নেই।
১৫.১২.৯৩
সহমর্মী
বিকেল পুরোনো বেনারসীর
মতো মৃদু জ্বলজ্বলে।
এরকম সময়, যখন অবসাদ
দিনের আঁচলে জড়িয়ে থাকে,
আমার চায়ের তৃষ্ণা
বেড়ে যায়। তখন আমি
সচরাচর পর পর
দু’কাপ চা খাই; আজ
দ্বিতীয় কাপের চা টুকু শেষ
করার
সময় লক্ষ্য করি, বিলীয়মান
দিনের আভায়
পিরিচে রাখা বিস্কুটগুলো যেন
বাদশাহী আমলের আশরফি
আর আকাশে দুলছে ঢেউয়ের
পিদিমের মতো পাখির ঝাঁক।
দূরগামী পাখির বুক আমাকে
জীবনের বিশেষ কোনো
রহস্যের প্রতি উৎসুক করে
তোলে। আমার
জৈবিক তৃষ্ণা হয়ে যায়
মননের ক্ষুধা। গতকাল
কুরিয়ার সার্ভিসে আসা চিঠির
অনুপম এক শব্দগুচ্ছ আমার
বুকের ভেতর কখনো
ফুল ফোটায়, কখনো তারা,
কখনো-বা গ্রীষ্ম দুপুরে এক
ঝলক
ঠান্ডা হাওয়ার মতো বয়ে যায়
আমার সত্তায়।
শব্দগুলো আমাকে অনেক্ষণ
বন্দী করে রাখে
এক অলৌকিক পুষ্পিত
কারাগারে। সেই বন্দীদশা
ঘোচাতে
অনিচ্ছুক আমি চোখের সমুখে
শব্দগুচ্ছের প্রতিমা ছাড়া
কিছুই দেখি না।
দেকার্তের ‘আমি চিন্তা করি,
তা-ই আমি আছি’
বাক্যটির
অনিবার্যতা মান্য করে আমার
চিন্তায় যিনি সর্বেশ্বরী,
তাকে উপমার, অলঙ্কারের
আড়ম্বরের
ওপারে রেখে হৃদয়ের
কিংবদন্তী রচনা করি। চোখ
বুজলে দেখি
সঙ্ঘবদ্ধ কাদাখোঁচাদের
পীড়নে
কোকিলের কণ্ঠরোধ হয়ে
আসে, গলা চিরে বেরোয়
রক্তধারা। আমি আহত
কোকিলটিকে কাদাটে ঝোপ
থেকে
কুড়িয়ে নিয়ে তার শুশ্রূষার
ভার দিই
গাছের সতেজ পাতা, ফুলের
পাপড়ি, সরোবরের জল,
জোনাকি আর নক্ষত্রের
উপর। কোকিল
আমার দিকে তাকায় সুহৃদের
দৃষ্টিতে। তাকে আমি কেন
জানি
নিজের ভেতর ধারণ করি
প্রাতঃস্মরণীয় শ্লোকের মতো।
২২.৩.৯৪
সে এক ধোঁয়াশায়
কতিপয় কুঁদুলে লোক সে
এক ধোঁয়াশায় ঘোঁট পাকায়
বনগ্রামে, হাঁকায় বেঢপ গাড়ি,
যার জঠর থেকে বেরোয়া
গাদা গাদা ছাই, কাদা এবং
নিষ্ঠীবন, কখনো
পুরোনো বিষ্ঠা। ঘন ঘন ওরা
বুক চাপড়ায় হিংস্রতায়।
আকাশে চাঁদ দেখলে,
গোলাপের উন্মীলন দেখলে
মুখ বেঁকে যায় ওদের।
হাওয়ার ফোয়ারায়
করছে স্নান, নিজের খুব কাছে
ডেকে আনছে
নক্ষত্র, পাখি, অচিন পাথর,
সুস্নিগ্ধ জলধারা,
তার তিন কুড়ি চার বছরকে
ফুঁয়ের তোড়ে উড়িয়ে দিতে
ওরা
কানাঘুষো করে, চেঁচায়,
কটমট তাকায়, দাঁত ঘষতে
থাকে।
এতগুলো বছর শুভঙ্করের
ফাঁকি নয়,
নয় শূন্যের গুণক কিংবা
পাতলা ছেঁড়া কাগজ, শুষ্ক
অঙ্কের
আড়ালে আছে পায়ে চলা
পথের ধুলো, বহু সূর্যোদয়,
বহু সূর্যাআস্ত,
অসংখ্যা রাত্রির জাগরণ,
শিশুর আলিঙ্গন, নারীর চুম্বন,
নিসর্গের শুশ্রূষা, খোলা পথের
ধারে
কবিতার আসা-যাওয়া, গ্রন্থের
সাহচর্য, খন্ড খন্ড লড়াইয়ের
স্বাক্ষর, নানা পল্লীর মানুষের
ভালোবাসা,
বিশ্বাসের নিশ্বাস, ধ্যান আর
নান্দনিক আরাধনার দীর্ঘ
ইতিহাস।
এসব নিমেষে নিশ্চিহ্ন করা
যায় এক ফুঁয়ে,
সঙ্ঘের ঝাপ্টায় কিংবা
জটলার মাটি-কাঁপানো
হুঙ্কারে?
সেই লোকটা-যার দিকে
ধাবমান ছাইয়ের গাদা
ডাঁই ডাঁই কাদা, পুরনো বিষ্ঠা
আর নিষ্ঠীবন,-
সন্ত্রাসের উন্মত্ত থাবা থেকে
হাড় পাঁজরাগুলো বাঁচিয়ে
এখনো খাড়া আছে
পাগলা ঘন্টির চিৎকারে
অন্তর্গত উদাসীনতাকে দর্লভ
প্রতিমা বানিয়ে।
৪.৩.৯৪