- বইয়ের নামঃ উজাড় বাগানে
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অত উঁচুতে তুলে দিয়েছ
আমি তো ছিলাম খুব নিচে
সামান্য
নিজস্ব নিয়ে। গুবরে পোকার
নিঃশব্দ চলা, কাছের
কলা গাছের পাতায় রোদের
চিকন পিছলে-যাওয়া,
হাওয়ায় পাতার নড়া দেখে,
বন্ধুর হাতে হাত রেখে,
কাগজের নৌকো বানিয়ে,
তা’ নিয়ে শিশুকে
আনন্দমেলায়
এনে চৌকো ছায়ায় কাটত
আমার বেলা। আমি তো
এমনই ছিলাম।
তোমরা আমাকে হঠাৎ করে
খুব উঁচুতে তুলে দিয়েছ।
এখন আমাকে মেঘ আদর
বুলোয় ক্ষণে ক্ষণে,
নক্ষত্রেরা প্রদক্ষিণ করে
আমাকে,
কালপুরুষ হাত রাখে আমার
মাথায়।
বড় বিব্রত আমি; তোমরা
আমাকে খুব উঁচুতে
তুলে দিয়েছ, ঈগলেরও সাধ্য
নেই আমাকে ছোঁয়,
বিমান আমার পায়ের অনেক
অনেক নিচে উড়ে যায় এবং
ছায়াপথে আমার নিত্যদিনের
হাঁটা।
নিচে তাকাতে পারি না, মাথা
বোঁ বোঁ লাটিম, ভয় হয় কখন
নক্ষত্রগুলো
ঠোকরাতে শুরু করে,
কালপুরুষ যায় ক্ষেপে। হয়ত
ছায়াপথ হবে ভাঙা সাঁকো,
পা হড়কে যাব প’ড়ে।
অত উঁচু থেকে ধুলোয় মুখ
থুবড়ে পড়ার আশঙ্কায়
সর্বক্ষণ কাঁপি তুষার-ঝড়ে
আটকে-থাকা
মানুষের মতো। আমার
নিদারুণ পতনে উল্লসিত
লোকজনের
হাঃ! হাঃ! হাসির কামড়ের
কথা ভেবে আমি দুঃস্বপ্নগ্রস্ত।
১২.৪.৯৪
অন্য কোনো সাক্ষী নেই
সত্তায় নিঝুম গোধূলির প্রলেপ
নিয়ে
নিঃশব্দে পা রাখলাম ঘরে।
তুমি একলা বসেছিলে খাটের
উপর
দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে।
নীরবতা কোনো
কোমল প্রাণীর মতো লেহন
করছিলো
তোমার হাত, মুখ, বুক,
নাভিমূল, নিতম্ব আর
পায়ের রাঙা পাতা। মনে
হলো, তুমি
নীরবতার লাল-ঝরানো আদর
বেশ
উপভোগ করছিলে আচার
খাওয়ার ধরনে। আমি
নিস্তব্ধতার জল কেটে এগিয়ে
গেলাম তোমার দিকে।
স্পর্শ করলাম তোমাকে,
যেমন কোনো
সুরসাধক গভীর অনুরাগে
তার বাদ্যযন্ত্রের তার
স্পর্শ করেন অভীষ্ট সুর বাঁধার
জন্যে।
যখন তোমাকে ছুঁই, মনে হয়
এবারই
আমার প্রথম ছোঁয়া। আমার
কেলিপরায়ণ হাত
তোমার হাতের কানে কানে
কী এক গানের নিভৃত কলি
গুন্গুনিয়ে যাত্রা করে স্তনের
দিকে।
আমার মুঠোর ভেতর তোমার
স্তন
পায়রার মতো ছটফট করে
নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যে।
তোমার ঠোঁটে আমার ঠোঁট,
কখনো আমার জিভ
তোমার মুখের ভেতরে মাছ
হয়, কখনো
তোমার জিভ আমার মুখের
গহ্বরে
অন্ধ পাখির মতো ডানা
ঝাপটায় এবং
আমার ভালোবাসা
সন্তের মতো প্রজ্বলনের বলয়
ভেদ করে
তোমার অস্তিত্বের গভীরতম
প্রদেশে নবীন অতিথি।
সেই মুহূর্তে তোমার শরীরে
ফোটে
প্রথম কদম ফুল, জ্বলজ্বল
করে হাজার তারা;
সেই মুহূর্তে তোমার শরীরে
জ্যোৎস্নাধোয়া আরণ্যক
শোভা। তোমার
শরীর তখন বরফ-গলা নদী।
কী ক’রে দেখাবো
অন্য কাউকে এই অনুপম
দৃশ্য? কাকে বিশ্বাস করাবো
এ-কথা?
দূরের আকাশ, চার দেয়াল,
শয্যার বিস্রস্ত চাদর বুক
শেল্ফ্ এবং
টিভি সেট ছাড়া অন্য কোনো
সাক্ষী নিএ এই গহন
সৌন্দর্যের।
আমার আঁজলা
সারা ঘরে মিশ্র গুঞ্জন, তুমি
এক কোণে বসেছিলে
সৌন্দর্যের তরঙ্গ তুলে।
টেবিলে তোমার হাত, হাতে
ডিম্বাকৃতি হ’য়ে পড়ছে
টেবিল ল্যাম্পের আলো,
তোমার খোঁপায় বেলফুলের
মালা
ঘোষণা করছে সজীবতা।
আলো, তোমার চুল,
গ্রীবা আর টেবিলে ব’য়ে
যাচ্ছে
ওস্তাদের ছায়ানট এবং তুমি
রূপান্তরিত হচ্ছো গীতধারায়,
যেখানে ভরে উঠল আমার
আঁজলা।
আমার জীবন আমি
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
আনন্দ নিবাসে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বিষাদের ঘরে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
পথের ধুলায় হেঁটে আর
ঘাসে শুয়ে থেকে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
নালনের আখড়ায়, হাসন
রাজার
উৎসবের ফুল্ল কলরবে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বদ্ধ ঘরে বড়ো একা-একা।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
গ্রীষ্মে পুড়ে-পুড়ে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
উন্মুক্ত মাথায় নিয়ে বুনো
বর্ষাকাল।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
ভীষণ নৈঃশব্দ্যে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
গানের ঝর্নাতলায় অস্তিত্ব
ভিজিয়ে
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বিপুল রবীন্দ্রবিশ্ব পর্যটন
ক’রে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
আধুনিকদের, সুন্দরের আর
সত্যের সন্ধানে।
আমার জীবন কাটিয়ে দিয়েছি
শক্রতার সঙ্গে দাবা খেলে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
বন্ধুত্বের প্রসন্ন ছায়ায়।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
স্বপ্নের সোপান গ’ড়ে প্রহরে
প্রহরে
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
দুঃস্বপ্নের বহু চোরাবালিতে
তলিয়ে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
গদ্যময় এবড়োখেবড়ো দীর্ঘ
পথে,
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
কবিতা নামের কামিনীর সঙ্গে
রূপ-সরোবরে
কখনো সাঁতার কেটে, কখনো
গহীন
জঙ্গলে, পাহাড়ে ঘুরে, কখনো
নৌকায় মুখোমুখি
অচিন নদীর খরস্রোতে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
জীবনের বাঁশি শুনে শুনে।
আমার জীবন আমি কাটিয়ে
দিয়েছি
মরণের সঙ্গে প্রায় কানামাছি
খেলে।
২১.৩.৯৪
আমার মুঠোয়
ক’দিন ধ’রে আমার কবিতা
তোমাকে অবিরত
ডেকে-ডেকে গলা ক্ষতার্ত
ক’রে ফেলেছে, প্রিয়তমা।
তোমার জন্যে কেঁদে-কেঁদে
আমার হৃদয়ের চোখ
এখন ভয়ানক লাল আর
ফোলা।
তুমি কি জানো ক’দিন
ধ’রে
তোমার জন্যে আমার ঘরের
চার দেয়াল, জানালা,
বাতি আর বুকশেল্ফের মন
ভালো নেই?
এখনো কি আমি আবেগের
দাস হ’য়ে থাকবো?
কই, আজো তো তোমার
কোন সাড়া নেই। কতদিন
হ’য়ে গেলো, তোমার কোনো
তাড়া নেই
আমার উদ্দেশে অক্ষরের ফুল
ফোটাবার।
আমাকে সামান্য কিছু অক্ষর
উপহার
দেওয়ার ইচ্ছেটাই হয়তো
ম’রে গেছে তোমার।
এরই মধ্যে আমাকে দেখতে
হলো,
হায়, এরই মধ্যে আমাকে
দেখতে হ’লো আমার মুঠোয়
পুষ্পসারের বদলে চিতাভষ্ম!