মধ্যরাতের ভাবনা
প্রাচীন প্রেমের কাব্য আমি পড়ছিলাম নির্জনে
মধ্যরাতে টেবিল-ল্যাম্পের ফুল্ল আলো সুষমায়।
পংক্তির সংশৃদ্ধ সখ্যে অকস্মাৎ মৃতির পীড়নে
মন হলো ভারাতুর। ভুলতে পারি না তাকে হায়।
অথচ ভুলতে চাই তাকে, যে আমার রক্তমজ্জা
শুষে নেয় ক্রমাগত অন্তরাল থেকে। বুঝি তাই
শাদা কফিনের মতো মনে হয় আমার এ শয্যা;
ভীষণ উঁচিয়ে থাকে তীক্ষ্ম ছুরি নেপথ্যে কসাই।
অবশ্য সে নয় স্মৃতিসঙ্গী সকল সময়, যদি
সত্যের খাতিরে বলি। দৈনন্দিন খুঁটিনাটি কাজে,
ককটেল পাটিতে আড্ডায় মধ্যনিশীথ অবধ
কাটে আর সময় করুণ বেহালার মতো বাজে!
এরই মধ্যে কখনো সখনো তার স্মৃতির ফোয়ারা
প্রবল উচ্ছ্রিত হয়। সে আমাকে আজো, হে হৃদয়,
স্মরণে রেখেছে কিনা, সে-কথা বিবেচ্য নয়। যারা
হিসেব নিকেশে দড়, এই বিবেচনা তাদেরই বিষয়।
হয়তো সে আমাকে গিয়েছে ভুলে, অথবা নবীন
কারো দেহমনের উত্তাপে সেঁকে মাতাল যৌবন
কাটে তার রাত্রিদিন। তাতে মুখ হবে ন মলিন-
কেননা একাগ্র নয় আর আমারও অতিজ্ঞ মন।
যায়
সূর্য নিবাসিত রাজার মতন দিয়েছে গা ঢাকা,
সন্ধ্যা ঝুঁকে আছে বারান্দায়,
টেলিফোন বেজে ওঠে আরো একবার।
হ্যালো, হ্যালো জ্বীহাঁ,
ম্যাসিভ ত্র্যাটাক।
সিঁড়িতে প্রবীণ ফিসফিসে গলা, কাশি,
মেঝেতে জুতোর শব্দ। টেলিফোন বাজে,
এই তো দু’ঘন্টা আগে বিকেলে ক্লিনিকে।
এলভিস প্রিসলী দেয়ালে
নিঃশব্দ সঙ্গীতে কী রঙিন,
চির তারুণ্যের
আভা স্তব্ধ মুখে।
ধোঁয়াচ্ছে তিনটি সিগারেট,
টেলিফোন বেজে ওঠে আর্ত
পাখির চিৎকারের মতো।
হ্যালো, হ্যালো কিছু শোনা যাচ্ছে না, বলুন-
হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি, দুই ছেলে এক মেয়ে।
টেবিলে ছড়ানো বই, ম্যাগাজিন, শূন্য প্লেট, দূর থেকে ভেসে
আসে লালনের গান ‘খাঁচায় ভিতর’…
গাড়ি বারান্দায়
প্রচ্ছন্ন আলাপ- কী যে হলো ইদানীং
কী বেয়াড়া দিনকাল,
এই বয়সেই।
আঁধারে অচিন পাখি ক্যমনে আসে আয়…
টেলিফোন বাজে, হ্যাল, হ্যালো,
জ্বী, কাল দুপুর দেড়টায় বায়তুল মোকাররমে।
কয়েকটি শরীর এখন ঢেউ, তটে আছড়ানো;
বাড়িটা গুমরে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে বেদনার্ত দেবতার মতো,
একটা বেড়াল অন্ধকার মুড়ি দিয়ে
শুয়ে আছে নিস্তব্ধ টিভির কাছে। টেলিফোন বাজে,
বেজে যায়,
যায়…
শব্দের মৃগতৃষা
‘মেয়েরা উঠলে ছাদে অতি দ্রুত সূর্য ডুবে যায়,
চাঁদ ওঠে
ওদের স্তনের মতো সাবলীলভাবে’-
এটুকু লিখেই থামলেই তিনি। বাক্যটি লেখা হয়ে
যাবার পর শব্দ সমুদয় থেকে অনেকদিন
তোরঙ্গে রাখা কাপড় চোপড়ের
ভাঁজ খোলাকালীন যে গন্ধ বিস্ফারিত হয়,
সেরকম গন্ধ নাকে লাগল তাঁর।
প্রতিটি শব্দ শুঁকলেন তিনি
অপরাধী অনুসন্ধানকারী
কুকুরের মতো, শুঁকলেন বারংবার; বিরক্তি
বোলতা হয়ে ঘুরতে থাকে
নাকের ডগায়, ঘন ভুরুতে। তিন-পংক্তি-সম্বলিত
কাগজটা দলা পাকিয়ে,
কাঁচাপাকা চুলঅলা মাথাটা ঝাঁকিয়ে, প্রৌঢ় কবি
ফেলে দিলেন বাজে কাগজের ঝুড়িতে, যেমন
ভোরবেলা নাশতা খাবার সময়
মাঝে মধ্যে পাউরুটির শক্ত অংশগুলি
ছুঁড়ে দেন চড়ুই কিংবা কবুতরের প্রতি।
কবুতরের চোখের রঙের মতো দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে
কবি খুঁজতে শুরু করলেন
সে সব শব্দের পাছা আর দ্রোহী স্তন,
যারা দপ্ দপ করবে তাঁর কপালের রগে,
ঠোঁটে। শব্দের মৃগতৃষা তাঁকে
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্লান্ত করলো; কলমের খাপ
একহাতে আর অন্যহাতে কলম নিয়ে
বসে থাকতে হলো তাঁকে
ঘন্টার পর ঘন্টা। তাঁর অধিকারে এলো না
সেই কাঙ্ক্ষিত জমি,
যার ওপর দিয়ে রাজেন্দ্রানীর মতো হেঁটে যাবে সৌন্দর্য।
গায়ে পাঞ্জাবি চাপিয়ে
তিনি বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়, বিন্দুমাত্র
আমলে আনলেন না গ্রীষ্মের চড়া রোদ,
ঘুরলেন অলিতে গলিতে,
ঘামে ভিজে উঠলো পাঞ্জাবি, গেঞ্জি আর
আন্ডারওয়ার; অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর।
দুপুরে চাইনীজ রেস্তোরাঁয় কাটল কিছুক্ষণ,
নিকেলে বন্ধুর ডেরায় আর
প্রচুর মদ খেয়ে যখন বাসায় ফিরে কড়া নাড়লেন
তখন মধ্যরাত নিজেই টঙ হয়ে আছে
গাঁজা-খাওয়া সন্ন্যাসীর মতো।
বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন কবি,
চপ্পল খসে পড়ল পা থেকে এবং তিনি
দেখতে পেলেন
টেবিলে-রাখা গোলাপটিকে, যার রঙ এখন
খাসির কলজের মতো।
ঢুলু ঢুলু চোখে তিনি দেখলেন একটা বুনো ঘোড়া ওর তরঙ্গিত
কেশর দিয়ে আদর করছে পূর্ণিমা চাঁদকে,
সে যেন চাঁদ আর আকাশের
ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বড় যত্নপরায়ণ। পবর্তপ্রমাণ
তুষারস্তূপে রবীন্দ্রনাথের মুখ
আবিষ্কার ক’রে গুনগুনিয়ে
ওঠেন তিনি, তারপর ঘুম ওকে মুকুট পরিয়ে
নিয়ে যায় নক্ষত্র সভায়।
ভোর জাগিয়ে তোলে কবিকে, যেন
এক্ষুনি ঘটবে কবিতার উন্মোচন; ধড়ফড়িয়ে উঠে
তিনি বসলেন লেখার টেবিলে,
কিন্তু চতুর্দিকে ব্যেপে এলো এমন এক স্তব্ধতা
যার পবিত্রতা হরণ করার জন্যে সেই মুহূর্তে
কোনো আগ্রহের দীপ আর জ্বলে উঠল না তার হৃদয়ে।
শোভাযাত্রা
হেমন্ত বিকেলে আমি বেশ্যাদের শোভাযাত্রা দেখে
আরো বেশি কৌতূহলী হই জীবনের রূপায়ণে।
নিশীথে কন্যারা এই পড়ন্ত বেলায় হেঁটে যায়,
ওদের শরীরে নগ্ন হাওয়া বিষণ্ন লেখে।
খুব কাছ থেকে দেখি গণিকার নগর ভ্রমণ;
স্বেদচিহ্ন দেখি না কোথাও আপাতত, কী কৌশলে
লুকিয়ে রেখেছে ওরা পৃথিবীতে জীবন-যাপন
করার দির্বেদ আর পাতালের জন্মান্ধ পীড়ন।
সমাজপতিরা দ্রুত ব্যাঙ্কনোট গুণে স্নানাহার
সেরে চুলে সুদূর আলালীটেরি কেটে ফুরফুরে
পাঞ্জাবির অন্তরালে সীল মাছের মতন দেহ
ঢেকে দূর থেকে করে ব্যবহার বাইনাকুলার।
বেশ্যাদের শোভাযাত্রা আস্তে সুস্থে একটি সফেদ
ঘোড়ার নেতৃত্বে চলে, ক্রমশ এগোতে থাকে। দূরে
অমৃতের ভান্ডে মাছি ওড়ে, ক’জন ধাঙড় ঢোল
বাজায় সূর্যাস্ত পান ক’রে, সমস্ত শরীরে জমে স্বেদ।
সুন্দর সুন্দর ব’লে ওরা সেই শোভাযাত্রাটিকে
মদালো রঙিন চোখে জানায় স্বাগত। দেয় পেতে
আসন উঠোনে, তাম্বুলের রঙ আনে আচরণে,
অবৈধ সৌন্দর্য চর্চা করে ক্ষণস্থায়ী অলৌকিকে।
অকস্মাৎ কারো মনে পড়ে ওপ্টেনের ঘ্রাণ আর
কেউ বনশিউলীর গন্ধ মনে ক’রে দীর্ঘশ্বাস
ফেলে, এরা কেউ সাড়ে তিন হাত সোঁদা নির্জনতা
পাবে না, পাবে না বুঝি চন্দর কাঠের সত্তাসার।
নিবিড় গোধূলিপায়ী বেশ্যাদের শোভাযাত্রা গাছে,
ফুটপাতে, দোকানের উল্লোল শো-কেসে রেখে যায়
নোনা মায়া, শোভাযাত্রা শবদাহ-স্মৃতিসম্বলিত
কাপাস তুলোর মতো উড়ে যায় কবিতার কাছে।