ধ্যানের প্রহর
(মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
অবশ্য আজো আকাশের প্রচ্ছদে
অযুত তারার নক্শা দীপ্যমান,
এমনকি শত অবহেলা-লাঞ্ছিত
বাগানেও জাগে অতিথি পাখির গান।
পথের কিনারে রাজছত্রের মতো
ছায়া মেলে দেয় জটাধারী বুড়ো বট;
নানা সন্দেহ নিভৃতে ফিরিয়ে দিয়ে
গেরস্ত ঘরে আছে মঙ্গলঘট।
মধ্যরাতের মসজিদে মেলে গাঢ়
স্তব্ধতামেশা এবাদতী মহাক্ষণ।
কিন্তু জিকিরে, নিখাদ কবুল করি,
মজেনা আমার চিরসংশয়ী মন।
খানকায় জানি অমূল গোলাপ জ্বলে,
বাউলতত্ত্ব অজানা, এমন নয়;
রুমির ঐশী প্রেমের কিরণ-ঢেউ
কখনো আমারও মন-পিদ্দিমে বয়।
অসম সাধ্যে উত্তর দক্ষিণ
দুটি বিপরীত মেরুতে বিবদমান;
সমরনায়ক পারমাণবিক ক্লাবে
গলা খুলে গায় প্রলয়ের জয়গান।
এই ডামাডোলে, বাজখাঁই রলরোলে
ধ্যানের প্রহর আমিও নিত্য খুঁজি।
কিন্তু ভুতের বেগার খেটের মরি
এবং কী দ্রুত ফুরায় আয়ুর পুঁজি।
নীরোগ তরুণ
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে চমকে ওঠে, যেন অচেনা কারুকে দেখছে
অনেকদিন পর। জুলফি শাদা, চুল দ্রুত পলায়নপর, গলার ত্বক
ভীষণ কুঁচকে-যাওয়া। বেশীদেরি নে আর, এখন থেকে থেকে এক অদৃশ্য
এসিড তাকে ক্ষইয়ে দিতে থাকবে তারই প্রখর সংকেত ভোরের আয়নায়।
এখন থেকে দাঁত নড়বে ঘন ঘন, কমতে শুরু করবে চোখের জ্যোতি।
অসুখ বিসুখ বিশ্বস্ত কুকুরের মতো নিত্যসঙ্গী হবে তার। এখন থেকে
প’ড়ে প’ড়ে মার খেতে হবে সময়ের। এখন থেকে কেউ আর তাকে
ঈর্ষা করবে না তার কান্তির জন্যে, এ-কথা ভেবে প্রবল গ্রীষ্মেও দুঃসহ
শীত অনুভব করে সে।
‘হায়, লোকটা রাতারাতি বুড়ো হয়ে গেল’ ব’লে কেউ কেউ
করুণা প্রকাশ করতে চাইবে এবং এটাই হলো সবচেয়ে মারাত্মক।
মুখ ফুটে কিছু না বললেও হাবে ভাবে বিলক্ষণ বুঝিয়ে দেবে,-
যত বারফট্রাই করনা কেন, আসলে এখন তুমি বার্ধক্যের মুখে
ইদুঁর। ভাবে, এক্ষুনি ঘুরে দাঁড়াবে আয়নার দিএক পিঠ দিয়ে,
আমল দেবেনা কাল-ভারাক্রান্ত কোনো চিন্তাকে, ভেসে বেড়াবে
হালকা হাওয়ায়। প্রকৃত ঈগল কখনো বয়সের ভার স্বীকার
করেনা, তাকে মানায়না অসুস্থ গেরস্ত আচরণ; বায়ুস্তরে
তরঙগ তাকে তুলতেই হবে পাখার ঝলসানিতে বারংবার। তাই,
সে আজো পাখি দ্যাখে, জ্যোৎস্নার ভিতরে হাত বাড়িয়ে দেয়
আর কোনো কোনো রাতে তার শিরায় তীব্র হুইস্কির মতো কী যেন
সঞ্চারিত হয় অলক্ষে। তখন সে আলোয় ঘেরা টেবিলে ঝুঁকে মেতে ওঠে
সময়ের সঙ্গে অলৌকিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, হয়ে ওঠে নীরোগ তরুণ।
বুড়োটে নাবিক
বুড়োটে নাবিক বেলাশেযে চাখানায় গল্প করে
সমুদ্রের। চায়ের কাপের তাপে ক্রমে ভাটা পড়ে।
একে একে উঠে যায় অনেকেই কাঠের চেয়ার
আর টুল ছেড়ে, কেউ ভুল ক’রে ফেলে যায় তার
দেশলাই, হাই তোলে পথের কুকুর। অকস্মাৎ
নাবিকের রক্তে জাগে প্রবল কল্লোল, শীর্ণ হাত
তলোয়ার মাছ হয়ে স্মৃতির তরঙ্গে নাচে, বুক
স্পন্দিত দ্বীপের গানে, নীল জামা তার স্বপ্নভূক।
রাত বাড়ে, বুড়োটে নাবিক আস্তে সুস্থে গল্পে ছেদ
টেনে আর ঝেড়ে ফেলে কবেকার মিলন-বিচ্ছেদ
সমুদ্রের ফেনার মতন পথে নামে, অন্ধকারে
চোখ মেলে স্বপ্নময়তায় তীব্র খোঁজে বারে বারে
কখনো ধোঁয়াটে বন্দুরের তন্বীটিকে, কখনোবা
পদ্মাসনে একা ক্ষুধাশীর্ণ বুদ্ধের মুর্তির শোভা।
বড়ে গোলাম আলির মাহাড়ি শুনে
পাকদন্ডী মহেঞ্জোদারোর গূঢ় স্তব্ধতার মতো
স্তব্ধতায় স্নান করে, লাজনম্র হয়
ছায়ার চুমোয়। কিয়দ্দূরে
দেখা যায় একটি বাদামি ঘোড়া, বয়েসী সওয়ার,
চোখে যার সূর্যের গহন
আবীর এবং গৃহদাহ, কবরখানার স্মৃতি।
চকিতে প্রচ্ছন্ন ঝরণা প্রকাশিত হলে
জলপানে মগ্ন হয় ঘোড়া,
আরোহী ভীষণ খরাপোড়া আঁজলায়
তুলে নিয়ে জল
ভাবে তৃষ্ণা তার মর্মমূলে জ্বলে ধু ধু
চিতাগ্নির মতো দিনরাত।
আরোহী ঘোড়ার ঘামাপ্লুত
ধনুক-গ্রীবায় রাখে হাত; বুকের ভেতরে তার
কবেকার ভোরবেলা, কুয়োতলা, পুষ্পিত ডালের
শোভা প্রস্ফুটিত অকস্মাৎ। এবং একটি নাম
লতাগুল্মে, কাঁটা ঝোপে ঝরণার নুড়িতে
স্বপ্নাদ্য হীরের আংটি। দেখা দিয়ে বনদেবী চকিতে মিলায়।
কিছু কি পরিকল্পনা ছিল পর্যটনে? এ কেমন পথচলা
ক্রমাগত? যত সে এগোয়,
ততই দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে। পৌঁছবে আখেরে
কোনখানে ভরসন্ধেবেলা? পৌঁছবে কি?
হয়তো ফিরে যেতে হবে। আহার না ক’রে কিংবা মাদুরে না শুয়ে
শুধু কবিরাই পারে ফিরে যেতে প্রত্যাশাবিহীন।
ভুল
তাহ’লে কি গোড়াতেই হয়েছিল সুনসান ভুল?
সরল বিশ্বাসের তুমি যাকে
পথ ভেবে করেছিলে যাত্রা তা ছিল গোলকধাঁধা এক,
একদা যে-হাত ছুঁয়ে স্বর্গের প্রবালসিঁড়ি বেয়ে
উঠে গেছ ব’লে
মনে হয়েছিল বার বার,
ছিল না তা’হাত কোনোকালে, ছায়ার প্রসুন নিয়ে
ছিলে মেতে, ওষ্ঠ ভেবে যাতে
করেছো অর্পণ চুমো শতবার, সেসব চুম্বন
হাওয়ায় হারিয়ে গেছে, যেন
অশরীরি কেউ
চেপে ধরেছিল ঠোঁট তোমার সংরক্ত ওষ্ঠতটে।
ব্যর্থ বাসরের রঙ লেগে
থাকে কি আত্মায় চিরকাল? জন্মান্ধ নিঃশব্দ ঝড়
আঁচড় কাটতে থাকে সত্তার দেয়ালে,
স্বৈরিনীর হাসির মতন
আলোর ঝিলিক
আঁধারকে আরো বেশি অনাত্মীয় করে,
কী যেন নিমেষে ভেঙে যায় অকস্মাৎ
হৃদয়ের আবরণ ছিঁড়ে।
ভুল ভেঙে যাবার পরেই
একটু থমকে তুমি দাঁড়ালে যদিও, তবু তুমি
নাওনি বিদায়,-
যেমন মঞ্চের আলো নিভে যাবার পরেও নট
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে শূন্য স্টেজে বিষন্ন খেয়ালে।
পারোনি ফিরিয়ে নিতে চোখ
চেনা দৃশ্যাবলি থেকে। অন্ধকার সিঁড়ি
আর স্মৃতিখচিত দরজা,
তক্তাপোশ, কার্পেট, মাদুর,
এমনকি সে-ও
ছিল না তোমার, তুমি নিজের ভিতর থেকে একা
বাইরে বেরিয়ে এসে পরাবাস্তবের
সৌহার্দ্যে আপ্লুত হ’লে এবং রাখলে শাদা হাত
সংহারপ্রবণ সেই মরীচিকাশোভন হাতের ছায়াঘুমে।
প্রেমের কাঙাল তুমি, তাই আজো সবচে; সুন্দর
পাঞ্জাবি চাপিয়ে গায়ে, পারফিউমের অন্তরালে
অতিশয় পোড়া
কাঠের মতন অস্তিত্বের গন্ধ চেপে
তার কাছে যাও আর অর্থহীন জেনেও নিবিড়
কথপোকথনে মেতে, কফি খেয়ে, এর ওর দিকে
তাকিয়ে গল্পের রেশ খোঁজো ঘুমপাওয়া মুর্খ বালকের মতো।
প্রেমের কাঙাল তুমি, কখন তুমুল
স্বেচ্ছাচারিতায় উঠে গেছো ভুলে অপ্রেমের শীতল চিতায়।