তোমাকে বিশ্বাস ক’রে
তোমাকে বিশ্বাস করে আমি এ শহরে ইচ্ছেমতো
আশাস্পৃষ্ট, হতাশা দংশিত
মানুষের ভিড়ে
হেঁটে যেতে চাই,
বাসার স্টপেজ ছেড়ে নিঃসঙ্গতা বয়ে
বাসের পিঞ্জরে বসে চাঁদ আর বিবাগী মেঘের
কানামাছি খেলা দেখে
মাইল মাইল দুরে চলে যেতে চাই।
যখন নিভৃতে টেলিফোনের মুখের মতো ফুল
শূন্যতাকে মোহন সাজায়,
তোমার মুখের দ্রিকে চেয়ে
আমার বিশ্বাস ফোটে সহজ মোটিফে।
যখন পাখির কণ্ঠে সুরের পরাগ ঝরে যায়,
তোমার উদ্দেশে
আমার বিশ্বাস
আলাপ এবং জোড়ে দীপ্যমান। যখন নদীতে
রূপালী মুকুট প’রে নাচে ঢেউগুলি
আমার বিশ্বাস রাজর্ষির মতো পথ হাঁটে একা।
অথচ আমার বিশ্বাসের কণাগুলি
তোমার ধারালো
ঝকঝকে দাঁতের দেয়ালে,
লালিম মাড়িতে, দশ আঙুলের নখে
পায়ের পাতায় লেগে আছে বিয়েবাড়ির ছড়ানো
বাসি খাবারের মতো।
একদা যে-হাত বিশ্বাসের পদ্ম দিয়েছিলো তুলে
আমার এ-হাতে,
যে-কোনো মুহূর্তে তার ক্যামোফ্লেজ-করা
ফণা ঝাঁঝাঁ উল্লসিত হতে পারে জেনেও তাকেই ছুঁতে চাই।
তোমার উলের কাজ
তোমার উলের কাজ দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়
কমবেশি। কী সহজে নতুন বিন্যাস
ফুটে ওঠে তোমার আঙুল আর কাঁটার মোহন ছন্দোময়
সঞ্চালনে ক্ষণে ক্ষণে। কখনো রঙিন পুষ্পোছ্বাস,
কখনো বা লতাপাতা অথবা বিমূর্ত নক্শা জাগে। কেউ কেউ
কণ্ঠে এনে বিস্ময়ের ঢেউ
বলে, কী’যে জাদু আছে তোমার আঙুলে।
তোমার নিজেরই কাছে সে এক রহস্য, গ্রন্থি যার
পারো না খুলতে তুমি। উলে
তোমার আনন্দ ফলে, জাতশত্র, শূন্যতার।
আর এমনও তো হয় কোনো কোনোদিন-
শুধু ভুল হতে থাকে ঘরে,
নর্তকীর মতো কাঁটা নুলো হয়; অত্যন্ত মলিন
হ’য়ে যায় তোমার মুখের রেখা, কিসের নিগড়ে
ভীষণ আটকে পড়ে তোমার বয়নকলা এবং তখন
তোমাকে যায় না চেনা। যাকে চিনতাম, তাকে ঢেকে
ফেলেছে শিল্পঘম মেঘ, বড় নিশ্চেতন;
যাবে না তো ফেরানো সহজে তাকে ডেকে।
তোমার মুখশ্রী আজ
তোমার মুখশ্রী আজ লুটেরা মেঘের অন্তরালে
চলে গেছে, মনে হয়; কণ্ঠস্বর সুদূর হাওয়ায়
মিশে আছে। আগন্তুক পরিব্রাজকের মতো ঘুরি
এ শহরে ফুটপাতে, বাসস্টপে, অলিতে গলিতে,
যদি দেখা হয়ে যায় কোনো ক্রমে, যদি এসে বলো,
‘কী ব্যাপার এতকাল দেখা নেই কেন?’ স্বরচিত
কবিতা তোমাকে যদি আনতে পারতো ডেকে, তবে
অনেক আগেই চলে আসা ছিল নাকি সমীচীন?
জেনেছি তোমার কাছে গেলে দুঃখের সহিত
অনিবার্যভাবে মালা বদলের প্রয়োজন হয়, তবু
হাওয়ায় উঠলে দুলে পর্দা, রূপালি তবক-মোড়া
এলাচ দানার মতো নক্ষত্র জাগলে নীলিমায়,
আকাশ সাঁওতাল যুবতীর মতো মেঘনম্র খোঁপা
বাঁধলে তোমাকে খবু কাছে পেতে ভারি সাধ হয়।
ত্র্যাকিলিসের গোড়ালি
এইতো চুয়ান্ন হলো, স্বাস্থ্য মোটামুটি
ভালো, ছুটোছুটি
এখনো করতে পারি খুব বেশি না হাঁপিয়ে, সিঁড়ি
বেয়ে উঠি নামি রোজ। তেমন বিচ্ছিরি
কোনো রোগ নেই, বলা যায়, শরীরে আমার। মানে,
বস্তুত চলেছি আমি জোয়ারের টানে।
ভাবি না ভাটার কথা আপাতত। এখনো তো কেউ
কেউ, ওরা সতেজ তরুণ, বলে, ‘তারুণ্যের ঢেউ
খেলিয়ে সত্তায় আজো দিব্যি আছেন হে কবি; সত্যি
আপনাকে দেখে চোখে কেমন সবুজ রঙ ফোটে। এক রত্তি
তোষামুদে চতুর অত্যুক্তি নেই ওদের কথায়
ভেবে আমি তৃপ্তির রোদ্দুরে বসি সুস্মিত মুদ্রায়।
যুকৃৎ তুখোড় আজো, যা কিছু পাঠাই নিত্য জঠরে হজম
হয় সবই রীতিমতো; যম
অসৌজন্যমূলক দ্রূকুটি হেনে ঈশ্বরের স্তব্ধতার মতো
প্রাচীনতা নিয়ে হাসে, করে পায়চারি ইতস্তত,
ঈগলদৃষ্টিতে খোঁজে খালি
আমার ধ্বস্ত এ অস্তিত্বের ত্র্যাকিলিসের গোড়ালি।
দগ্ধ মাটিতে
শরতের কিছু লিবিডোতাড়িত উচাটন মেঘ
দূরে ভেসে যায়, ময়ূর আমার প্রাণ।
হঠাৎ কী ক’রে মগজে আমার ক্রীড়াপরায়ণ
সেই কবেকার জবাকুসুমের ঘ্রাণ।
তোমার বাহুতে লীলায়িত জানি বসন্ত রাগ,
তোমার দুচোখে সূর্যোদয়ের গুঁড়া।
তোমার শরীরে মেঘনার খর তরঙ্গঁ নাচে,
জাগে চন্দ্রিল গারো পাহাড়ের চূড়া।
মনে পড়ে সেই পলায়নপর বৈশাখী রোদে
আমরা ছিলাম ধূসর পাথরে ব’সে।
ঢেউগুলি তটে খাচ্ছিল চুমো, জলজ কণারা
সহজ যাত্রী মগজের কোষে কোষে
হঠাৎ তোমার ত্বকে ফোটে আঁশ রূপালী মাছের
গোধূলিবেলায় তোমাকে যায় না চেনা।
আমিও নিমেষে পাখি হয়ে উড়ি, নেচে আসি ঢেউয়ে,
ব্যাকুল আমার চঞ্চুতে লাগে ফেনা।
তোমাকে আমার চষ্ণতে গেঁথে যাব নীলিমায়-
হাওয়ায় ডানার উষ্ণতা যাবে মিশে।
মেঘ মেঘালির নিঃসীম ক্ষেতে ডানার ছোঁয়ায়
জাগবে শিহর স্বপ্নের ঘন শীষে।
এই শতকের করুণ গোধূলি আমাদের চোখে
আনে বিভ্রম, দেখি প্রেতায়িত তরী;
সেই জলযানে আশ্রয় নিয়ে কখনো এগোই,
কখনো প্রখর ভাটায় পিছিয়ে পড়ি।
কিন্তু আমরা গোধূলিমাতাল পাথরেই ব’সে
প্রবল প্যাশনে পুষ্পিত দেহমনে।
কখনো আপন আর্তির ধ্বনি শুনি অবিরল
অতল জলের কাঁকড়ার ক্রন্দনে।
তোমার নিবিড় অঞ্জলি থেকে আনন্দ-বেলী
আমার জীবনে ঝরেছিল অকৃপণ।
কখনো কখনো বেদনার মেঘ এনেছিলে ডেকে,
মরুভু আমার বেদনাবিদ্ধ মন।
দদ্ধ মাটিতে খর পূর্ণিমা এনেছিলে ব’লে
অকুণ্ঠ আজো জানাই কৃতজ্ঞতা।
তোমার নিকট চিরঋণী আমি, কেননা জ্বেলেছ
অমাবস্যায় গহন উজ্জ্বলতা।
দরজা কখন খুলে যাবে
অবশেষে অপরাহ্নে দাঁড়ালাম এসে কায়ক্লেশে
কারুকাজখচিত বিশাল
দরজার কাছে আর নিমেষেই সৌন্দর্যের ছায়া
নক্শা হয় মনের ভেতরে। স্তরে স্তরে
গুপ্তধন থেকে ঠিকরে-পড়া বিভা কল্যাণের মতো
জেগে থাকে, মনে হয়। দরজার জ্যোতি,
সত্তাময় ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি একা।
রঙিন মেঘের বুকে সন্ধ্যা ঝুঁকে আছে
লাজুক আঙ্গিকে;
এখনো দাঁড়িয়ে আছি, দরজা খোলে না।
নিশীথের বনে সুখে হরিণ হরিণী
ঘুমিয়ে পড়েছে। পর্যটক বাতাসের
স্পর্শে পাতাদের গীতস্পৃহা মঞ্জরিত হয় আর
আমি চেয়ে থাকি কারুকাজময় দরজার দিকে,
অর্গল নিঃসাড় তবু।
আমার চোখের পাতা সীসে হতে থাকে ক্রমাগত,
তবে কি এখানে আমি দরজার কাছে
নিজস্ব মাদুর পেতে শুয়ে থাকবো একাকী কিংবা
নিঃশব্দে থাকবো ব’সে বেগানা ধূলায়?
দরজা দাঁড়িয়ে আছে ঠায়
সীমাহীন উদাসীনতায়। অনেকেই ফিরে গেছে,
কেউ কেউ কৃপাপ্রার্থী মানুষের মতো
ভঙ্গিমায় বসে থাকে কিছুকাল ডানে আর বামে,
তারপর চ’লে যায় হতাশার কালো
পেরেকে আমূল বিদ্ধ। বন্ধ দরজায়
করাঘাত করে করে অবসন্ন আমি-
অথচ যাইনি ফিরে, অকস্মাৎ দরজা কখন
অনিবার্যভাবে
খুলে যাবে, কেউ তা জানে না।