ডেডেলাস
না, আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, যে আমার
নিজের একান্ত অংশ, স্বপ্ন, ভবিশ্যত; যাকে আমি
দেখেছি উঠোনে হাঁটি-হাঁটি পা-পা হেঁটে যেতে
আনন্দের মতো বহুবার। যখন প্রথম তার
মুখে ফুটেছিলো বুলি, কি যে আনন্দিত
হয়েছি সেদিন আমি; যখন জননী তার ওকে
বুকে নিয়ে চাঁদের কপালে চাঁদ আয় টিপ দিয়ে
যা ব’লে পাড়াতো ঘুম, আমি
স্বর্গসুখ পেয়েছি তখন।
কতদিন ওকে
নিজেই দিয়েছি গ’ড়ে পুতুল এবং
বসেছে সে আমার আপনকার পিঠে, ক্ষুদে অশ্বারোহী।
আমার স্নেহের ঘরে সে উঠেছে বেড়ে
ক্রমান্বয়ে,
আজ সে শুধুই স্মৃতি, বেদনার মতো বয়ে যায়
আমার শিরায়।
কোন কোনদিন স্থাপত্যের গূঢ় সুত্র-বিষয়ক চিন্তার সময়
অকস্মাৎ দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে আমার শয্যার পাশে
সুকান্ত তরুণ;
ইকারুস ইকারুস ব’লে ডাকলেই উজ্জ্বীবিত
দেবে সাড়া। কখনো বা মনে হয় আমার নিজের
হাতে গড়া ডানা নিয়ে দেবে সে উড়াল
দূর নীলিমায়
অসম্ভব উঁচুতে আবার।
না, আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, স্মৃতি যার
মোমের মতন গলে আমার সত্তায়, চেতনায়।
সর্বদা সতর্ক আমি, বিপদের গন্ধ সিদ্ধ, তাই
বুঝিয়েছিলাম তাকে সাবধানী হ’তে,
যেন সে না যায় উড়ে পেরিয়ে বিপদসীমা কখনো আকাশে।
কিন্তু সে তরুণ, চটপটে, ঝকঝকে, ব্যগ্র অস্থির, উজ্জ্বল,
যখন মেললো পাখা আমার শিল্পের ভরসায়,
গেলো উড়ে ঊর্ধে, আরো ঊর্ধে, বহুদূরে,
সূর্যের অনেক কাছে প্রকৃত শিল্পীর মতো সব
বাধা, সতর্কতা
নিমেষে পেছনে ফেলে, আমি
শংকিত অথচ মুগ্ধ রইলাম চেয়ে
তার দিকে, দেখলাম তাকে
পরিণাম বিষয়ে কেমন
উদাসীন, ক্রর রোদ্রঝলসিত, সাহসী, স্বাধীন।
না আমি বিলাপ করবো না তার জন্যে, স্মৃতি যার
মোমের মতন গলে আমার সত্তায়, চেতনায়।
যেন আমি এখন উঠেছি জেগে অন্তহীন নির্জন সমুদ্রতীরে একা
আদিম বিস্ময় নিয়ে চোখে। আস্তে আস্তে মনে পড়ে
নানা কথা, মনে পড়ে বাসগৃহ, বহুদূরে ফেলে-আসা কত
স্থাপত্যের কথা আর নারীর প্রণয়। মনে পড়ে,
আমার সন্তান যেতো পাখির বাসার খোঁজে, কখনো কখনো
দেখতো উৎসুক চেয়ে আমার নিজের
বাটালি ছেনির চঞ্চলতা। মনে পড়ে
দেবতার মতো স্তব্ধ আলোচ্ছ্বাস, তরুণের ওড়া
ভয়ংকর অপরূপ দীপ্তিময়তায়। তার পতন নিশ্চিত
বলেই হয়তো আমি তাকে আরো বেশি ভালোবেসেছি তখন।
পিতা আমি, তাই সন্তানের আসন্ন বিলয় জেনে
শোকবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ পাখির মতন দিশাহারা;
শিল্পী আমি, তাই তরুণের সাহসের ভষ্ম আজ
মৃত্যুঞ্জয় নান্দনিক সঞ্চয় আমার।
নিজের কবিতা বিষয়ে কবিতা
আমার কবিতা নিয়ে রটনাকারীরা আশেপাশে
নানা গালগল্প করে। কেউ বলে আমার কাব্যের
গোপনাঙ্গে কতিপয় বেঢপ জড়ুল জাগরুক,
ওঠেনি আক্কেল দাঁত আজো তার, বলে কেউ কেউ।
আমার কবিতা নাকি বাউন্ডুলে বড়ো, ফুটপাথে
ঘোরে একা একা কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে ব’সে থাকে,
ইন্দ্রিয়বিলাসে মজে বন্ধ কুঠুরিতে, মাঝে-মাঝে
শিস দেয়; আমার কবিতা খুব বেহুদা শহুরে!
একরত্তি কান্ডজ্ঞান নেই তার, সবার অমতে
সোৎসাহে চাপিয়ে গায়ে আজব জ্যাকেট, কেয়াবাং,
সুনীল লন্ঠন হাতে দিনদুপুরেই পর্যটক
এবং অভ্যাসবশে ঢোকে সান্ধ্য মদের আড্ডায়।
মদের বোতল রুক্ষ গালে চেপে অথবা সরোদে
চুমু খেয়ে অস্তিত্বহীনতা বিষয়ক গান গায়,
এবং মগজে তার নিষিদ্ধ কথার ঝাঁক ওড়ে
মধুমক্ষিকার মতো সকালে কি রাত বারোটায়।
আমার কবিতা অকস্মাৎ হাজার মশাল জ্বেলে
নিজেই নিজের ঘর ভীষণ পুড়িয়ে দেখে নেয়
অগ্নুৎসব; কপোতীর চোখে শোক; এদিকে নিমেষে
উদ্বাস্তু গৃহ দেবতা, কোথাও করবে যাত্রা ফের।
বিদ্যের জাহাজ দ্রুত চৌদিকে রটিয়ে দেয়, ‘ওর
পদ্যটদ্য এমনকি ইকেবানা নয়, এইসব
আত্মছলনার অতি ঠুনকো পুতুল-টিঁকবে না,
ভীষণ গুঁড়িয়ে যাবে কালের কুড়ুলে শেষমেষ।
যখন পাড়ায় লাগে হঠাৎ আগুন ভয়াবহ,
আমার কবিতা নাকি ঘুমোয় তখনও অবিকল
গাছের গুঁড়িয়ে মতো ভাবলেশহীন। আর ঘুম
ভাঙলেও আত্মমগ্ন বেহালায় দ্রুত টানে ছড়!
আমার কবিতা করে বসবাস বস্তিও শ্মশানে,
চাঁড়ালের পাতে খায় সূর্যাস্তের রঙলাগা ভাত,
কখনো পাপিষ্ঠ কোনো মুমূর্ষ রোগীকে কাঁধে বয়ে
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় আরোগ্যশালায়।
আমার কবিতা পথপ্রান্তে দুঃখীর চোখের মতো
চোখ মেলে চেয়ে থাকে কার পায়ের ছাপের দিকে,
গা ধোয় ঝরনার জলে। স্বপ্ন দ্যাখে, বনদেবী তার
ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে হু হু জ্বলছেন সঙ্গম-লিপ্সায়!
বসতিতে, মনীষায়
আজকাল বিছানায় বড় বেশি শুয়ে থাকে একা,
বালিশে অনেকক্ষণ মুখ গুঁজে সময় যাপন
করে, কড়িকাঠ গোনে। বাড়িটা পুরনো, নড়বড়ে;
বুড়ো কাকাতুয়ার বিবর্ণ
পালকের মতো রঙ দেয়ালে অস্পষ্ট। পলেস্তরা
খসে পড়ে মাঝে-মধ্যে; প্রাচীন পদ্যের ঋদ্ধ পংক্তির মতন
কি যেন গুমরে ওঠে ক্ষয়ে-যাওয়া বাঘছালে ইঁদুরের দৌড়
কাঠের চেয়ারে শাদা বেড়ালের স্বপ্নাশ্রিত মাথা,
খবর কাগজ ঘোর উন্মাদের স্মৃতির মতন
লুটোয় মেঝেতে আর দিন যায়, দীর্ঘ বেলা যায়।
রোদের জঙ্গলে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে
এখন সে গা-গতর এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়
রৌদ্রদগ্ধ শ্রমিকের মতো।
সে কি একবুক অভিমান নিয়ে শুয়ে থাকে, নাকি
সত্তাময় অপমান নিয়ে হতে চায় আত্মঘাতী?
নানান ফলের প্রতি তার দুর্বলতা আছে ব’লে
শিয়রে সাজিয়ে রাখে সযত্নে অলীক ফলমূল। আলস্যের
ভায়োলেট মখমলে গুটিসুটি পড়ে থাকে; চোখের পাতায়
ঘুম নয়, কিছু তন্দ্রা লেগে থাকে মোহের মতন।
স্বপ্নের টানেলে ঘোরে নিরুদ্দেশে, নিজেকে সংশয়মুক্ত রেখে
তারই করতলে রাখে মাথা খুব নিটোল আস্থায়
যে তার অকুন্ঠ পিঠে আমূল বসিয়ে দেবে ছোরা সুনিশ্চিত।
কখনো হঠাৎ তার তন্দ্রার ঝালর কাঁপে, অলিতে-গলিতে
রাত্রিদিন নানা কলরব, ছদ্মবেশী শজারুর ভিড় বাড়ে
ক্রমাগত আশেপাশে। প্রকৃত ধর্মের চেয়ে ধর্ম-কোলাহলে
অত্যন্ত মুখর আজ শহর ও গ্রাম। বিশ্বযুদ্ধে নেই কারো সায় আর,
তবু অতিকায় কালো রাজহাঁসের মতন ছায়া ফেলছে সমর
বসতিতে, মনীষায়, সভ্যতার মিনারে-মিনারে।