একটি গাধাকে দেখি
একটি গাধাকে আমি প্রতিদিন দেখি আশে পাশে,
শহরে নিঃসঙ্গ ভিড়ে,
আমার সান্নিধ্যে দেখি রোজ
আওলাদ হোসেন লেনের মোড়ে, বাবুর বাজারে,
ইসলামপুরে, বঙ্গবন্ধু অ্যাভেন্যুর ফুটপাথে, সিদ্ধেশ্বরী,
পলাশী বেইলী রোডে, বুড়িগঙ্গা নদীটির তীরে
মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে, ধানমন্ডি লেকের ওপারে।
হঠাৎ কখনো রমনা পার্কে তার দেখা পাওয়া যায়,
একটি গাধার সঙ্গে ঘুরে ফিরে দেখা হয় প্রত্যহ আমার।
তাকে দেখে মনে হয়, যেন দার্শনিক, অস্তিত্ব কি অনস্তিত্ব
নিয়ে চিন্তাবিষ্ট খুব চলেছেন একা, তাবৎ বস্তুর প্রতি
বড়ো উদাসীন;
এবং কর্তব্যাক্লান্ত ট্রাফিক পুলিশ, ক্রুশচিহ্ন আইল্যান্ডে,
বেলা অবেলায় তাকে ঈষৎ মুচকি হেসে পথ ছেড়ে দ্যায় বার বার।
গাধাটির কথা বলিহারি, কিছুই দেখে না যেন
চোখ মেলে, পথ হাঁটে একা-একা, বিস্তর ধূলায়
আরবী রেখার মতো নক্শা
তৈরী ক’রে অচেতনভাবে। কাকে বলে আয়কর ফাঁকি দেয়া,
সুরক্ষিত বাক্সের ভেতর থেকে ব্যালট পেপার চুরি আর
টিকিটবিহীন রেল ভ্রমণের সাধ মেটানো, বস্তুত জানে না সে।
কখনো ঘেসেড়া ডাকে, খচ্চরের ভিড় লুব্ধতায়
তার খুব অন্তরঙ্গ হ’তে চায়। মনে পড়ে রজকের পৃষ্ঠপোষকতা
ছিলো বহুদিন, আজ রজকের ঘাট থেকে দূরে,
বহুদূরে চলে এসেছে সে, স্মৃতি ছেঁড়া দূববার মতন ওড়ে,
মাঝে মাঝে অপরাহ্নে ঘাসের সৌন্দর্য দেখে ভালো লাগে তার।
কৃপাপ্রার্থী নয় কারো, তবু বিশ্বাসঘাতকতার চুমো নিয়ে
গালে গূঢ় ডুমুর ফুলের কাছে কামগন্ধহীন রজকিনী প্রেম চায়।
তাঁর চক্ষুদ্বয়ে দ্বিপ্রহরে চিলডাকা আকাশের
প্রতিধ্বনি, কবিতার লাইনের মতো অনুকরণকাতর
অবরুদ্ধ নগরীর শব্দাবলী, দূর অনার্য রাত্রির জ্যোৎস্না-বিহ্বলতা,
মায়া কাননের ফুল, পরীর দেশের
রহস্যময়তা আর নিগৃহীত কোবিদের মেধার রোদ্দুর
মাথার ভেতরে তার এজমালী তত্ত্বের তথ্যের দীপাবলী,
আত্তারের সহজিয়া গল্প ছলে সুসমাচারের স্নিগ্ধ কোমল গান্ধার।
আসিসির সন্ত ফ্রান্সিসের মতো নিজেকে অভুক্ত রেখে কৃশ
হয়, হাঁটে চরাচরব্যাপী ঝড়ে, বৃষ্টিপাতে আর
তুষামৌলির দিকে দৃষ্টি রেখে পর্বতারোহণে মাতে, সঙ্গীহীনতায়
নিজের সঙ্গেই কথা বলে বারংবার। মুখমন্ডলের
রুক্ষতা ক্রমশ বাড়ে, দাঁতে ক্ষয়, পায়ে মস্ত ক্ষত,
শুধু চক্ষুদ্বয় তার সন্তের চোখের মতো বড়ো জ্বলজ্বলে-
যা উপোসে, কায়ক্লেশে, ক্রমাগত উর্ধ্বারোহণে এমন হয়।
কুষ্ঠরোগীদের ক্ষতে হাত রাখে, চুমো খায় গলিত ললাটে
দ্বিধাহীন বারংবার, যাত্রা করে দুর্ভিক্ষের প্রতি,
মড়কের প্রতি, নানাদেশী শীর্ণ উদ্বাস্তুর প্রতি,
বিকলাঙ্গ শিশুদের প্রতি, অন্ধের শিবিরে আর
মৃত্যুপথযাত্রী জীর্ণ পতিতার প্রতি,
যোজন যোজনব্যাপী কাঁটাতর, নিযাতিত রাজবন্দীদের প্রতি,
যাত্রা করে বধ্যভূমি আর ফাঁসির মঞ্চের প্রতি।
এবং প্রকৃত পরী তার পদ্মপাতা-কানে চুমো খায়,
কোজাগরী পূর্ণিমায়, ব্যাকুল সে খোঁজে সেই চুম্বনের মানে।
কথার জেরুজালেম
এখন বলার কিছু নেই আর তাই থাকি আপাতত
চুপচাপ, প্রায় বোবা, বলা যায়। তুমিও আগের
মতো কথা পুষ্পসারে দাওনা ভরিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
আমার প্রহর আজ। যদিও কখক নই নিপুণ, তুখোড়,
তবু ছিলো দীর্ঘস্থায়ী কথোপকথন
আমাদের; ছিলো, মনে পড়ে, প্রহরে প্রহরে।
এখন আমার চোখ কথা বলে, প্রতিটি আঙুলে
সযত্বে সাজায় শূন্যে কথামালা, আমার বুকের
রোমারাজি কথা হয়ে ফোটে থরে থরে
পাঁজরে পাঁজরে সর্বক্ষণ
কথার পিদিম জ্বলে,
হৃদয়ের গাঢ় অন্ধকার
অন্য মানে পায়, তাই সহজে খুলি না মুখ আর।
এখনো বাসিন্দা আমি স্বপ্নময় জেরুজালেমের।
সেখানে নিঃশব্দে পথ চলি, কত যে গলির মোড়
ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকে, দীঘল চুলের
ছায়া নামে মুখের ওপর
জোয়্যরি জ্যোৎস্নায়।
রাস্তায় কি ঘরে কেউ বলে না কখনো কথা, শুধু
সুরে সুরে জেগে থাকে আদিগন্ত বাখের উৎসব।
স্বপ্ন-নগরীতে, বলো, কথার কি দরকার? বরং
যুগ যুগ চেয়ে থাকা যায়
কারো চোখে চোখ রেখে কথার চেয়েও খুব গভীর ভাষায়,
হৃদয় জেরুজালেম জেনে
হাঁটা যায় নানান শতকে,
কারো হাত ধ’রে স্বপ্নময়
জেরুজালেমের পথে। শত ভুল শুধরে নেয়া যায়
একটি চুম্বনে,
মে চুম্বনে পড়বে ছায়া দীর্ঘ মিনারের জলপাই পল্লবের।
এখন তো মেঘমালা, গাছের সতেজ পাতা, বৈশাখী রোন্দুর,
শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, পাখির অমর্ত্য গান আমাদের হয়ে
প্রহরে প্রহরে
আমাদের দুজনের হয়ে
করবে রচনা নয়া কথার জেরুজালেম। কে বলেছে?
একজন কেউ, আছে যার খুব স্বপ্নবিলাসী উদাত্ত পাখা।
কবির অশ্রুর চেয়ে দামী
আমি কি অজ্ঞাতবাসে আছি? এ-রকম থেকে যাবো
গোপনীয় মনোকষ্টে ডুবে বহুদিন দলছাড়া?
কীট-পতঙ্গের সঙ্গে উচ্চারণহীন মেলামেশা,
বিষণ্ণ বিকেলে হ্রদে ভাসমান প্রেমিকের জামা,
আর ঊর্ণাজালের মতই ঝোপঝাড়ে তেজী আলো,
মাথার ওপর উড্ডয়নপরায়ণ একা দীর্ঘপদী পাখি-
ভাবি আজো নিসর্গের পৃষ্ঠপোষকতা
রয়েছে অটুট। গোধুলিতে খোলামেলা
ঢিবির ওপরে ব’সে দেখি জীবনের ঢ্যাঙা ছিরি!
জীবন আমার হাতে কোন সে ঠিকানা গুঁজে দিয়ে
দেখিয়েছে খোলা পথ; পথে
তৃণ ছিলো, কাঁটাঝোপ ছিলো, ছিলো সাঁকো,
হরিণের লাফ ছিলো, উজ্জ্বল সাপের
হিস্হিস্ ছিলো, কিছু কাটাকুটি, কিছু ভুল ছিলো-
ভাবতে-ভাবতে হাঁটি, কায়ক্লেশে হাঁটি,
কখনো নিঝুম ব’সে থাকি পথপ্রান্তে, ক্ষয়ে-যাওয়া
দাঁতে ছায়া চিবোতে-চিবোতে দিন যায়।
দিন যায়,
কখনো-কখনো খুব সহজে যায় না।
কোনো-কোনো ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই কষ্ট পাই,
বিষণ্ণতা ব্যেপে আসে শ্রাবণের মেঘের ধরনে,
উদ্যানের পাশে
কী এক সৌন্দর্য ফৌত হয়ে প’ড়ে থাকে, মনে হয়
পুরোনো কবর থেকে কোনো পূর্বপুরুষ আমার
বেরিয়ে এলেন পৌরপথে, প্রতিকার চেয়ে-চেয়ে
পুনরায় ত্বক-মাংস তাঁর খ’সে যায়, খ’সে যায়,
বুঁজে আসে কবরের চোখ। দিন খুব
দীর্ঘ লাগে, দীর্ঘশ্বাসে-দীর্ঘশ্বাসে প্রহর উদাস।
মাঝরাতে যখন ভীষণ একা আমি,
যখন আমার চোখে ঘুম নেই একরত্তি, আমি
বিপর্যস্ত বিছানায় প’ড়ে আছি ক্রশের ধরেন,
তখন অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে
কে এক নৃমুন্ডধারী অশ্ব এসে বলেঃ
শোনো হে তোমার
নিজের শহরে আজ আমাদের রাজ
পাকাপোক্ত হলো;
দ্যাখো চেয়ে আমাদের সংকেতবহুল
পোস্টারে-পোস্টারে
ছেয়ে গ্যাছে শহরের প্রতিটি দেয়াল আর ছায়া-কেবিনেটে
জ্যোতিশ্চক্রগুলি নৃত্যপর, কবিসংঘ এই অশ্ব সমাজের,
মানে আমাদের সমর্থনে দিনরাত্রি
বেহাল কাটায় দীর্ঘ স্তোত্র রচনায়।
তোমার শহরে, শোনো, একটিও ভিক্ষুক নেই আর।
হাসপাতালের সব বেড খালি, কেননা এখন
আর রোগী নেই কেউ। পাগলাগারদও আজ বাশিন্দাবিহীন,
অতিশয় পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোকগুলো কুচকাওয়াজের ঢঙে
দিব্যে হেঁটে যায়
নতুন মুদ্রার মতো চকচকে রাস্তায়-রাস্তায়!
বাছা-বাছা যুক্তিবাদী রাজনীতিবিদ
পরিবর্তনের গূঢ় পতাকা পকেটে পুরে নব্য খোয়ারিতে
ছায়াস্নিগ্ধ বনভোজনের চমৎকার
মানুসরুটি খেয়ে
দাঁত খুঁটছেন ঘন-ঘন আর মাঝে-মাঝে
দরাজ গলায় গান ধরেন পার্টিতে ফের অকস্মাৎ ঘুমিয়ে পড়েন
প্রতারক জ্যোৎস্নার কার্পেটে।
ফলস্ ত্র্যালার্ম শুনে ভয় পেও না বেহুদা, ছুটে
যেও না বাইরে, চোখ-কান বুঁজে প’ড়ে থেকো নিজস্ব শয্যায়
বিপদকে গ্রেপ্তার করেছি আমরা, বিপুল ধ্বংসকে
পাঠিয়েছি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, তোমার নিজের
শহরকে খলখলে রক্ষিতার মতো সাজিয়ে দিয়েছি
আপাদমস্তক অহংকারী অলংকারে।
আমার ব্যর্থতা
কবরখানার হল্দে ঘাসে নাঙা সন্ন্যাসীর মতো
শুয়ে থাকে সাবলীল,
আমার ব্যর্থতা ফণিমনসার মতো তীক্ষ্ম অহংকারে
রৌদ্রজ্যোৎস্না পোহার নিয়ত,
আমার ব্যর্থতা টাওয়ারের প্রতি বাড়িয়ে দু’হাত
ধুলোয় গড়াতে থাকে কখনো-বা শিস দিতে-দিতে
চলে যায় নিরুদ্দেশে, বেকার যুবার মতো ছেঁড়া জুতো পায়ে
পথে-পথে ঘোরে,
সর্বস্বান্ত নবাবের মতো চেয়ে থাকে সূর্যাস্তের দিকে বড়ো
উদাসীন, গলির দোকান থেকে সিগারেট কেনে ধারে আর
আমার ব্যর্থতা ব্যর্থ কবির ধরনে
খুব হিজিবিজি কাটাকুটির অরণ্যময় কালো খাতা খুলে
ব’সে থাকে, সিগারেট ঠোঁটে, ছাই ঝ’রে যায়, শুধু
ছাই ঝ’রে যায়।
এইসব কথা লিখে অধিক রাত্তিরে কবি ধূসর বালিশে
মুখ চেপে কাঁদে, রক্তে মাংসে হাড়ে ও মজ্জায় ঝরে
কান্না ঝরে অবিরল।
কবির অশ্রুর চেয়ে দামী মায়াময় অন্য কিছু আছে কি জগতে?