- বইয়ের নামঃ ইকারুসের আকাশ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অত্যন্ত অস্পষ্ট থেকে যায়
অক্ষর সাজিয়ে আমি অক্ষরের রূপে মজে আছি
সারা দিনমান আজো, কত নিদ্রাহীন রাত কাটে
প্রতিমা বানিয়ে অক্ষরের। ক্যালেন্ডারময় শাদা
দেয়ালের মুখোমুখি বসে থাকি প্রহরে প্রহরে।
কখনো হঠাৎ, যেন বিদ্যুতের স্পর্শে বিচলিত,
দাঁড়াই সটান ঘুরে। দেখেছি কি হরিণের লাফ,
অথবা চিতার দৌড় নাকি বলেভিয়ার জঙ্গলে
যে গুয়েভারার কাদামাখা হাত, অস্ত্রহীন, একা,
চির অস্তাচলে! বুঝি তাই বহু দেশে এখনো তো
হয়নি প্রকৃত সুর্যোদয়; স্বাধীনতা ফাঁসিকাঠে
ঝোলে দিকে দিএক, পিঠে চাবুকের কালশিটে
দাগ নিয়ে কুঁজো হয়ে পথ হাঁটে আহত বিবেক।
অক্ষর সাজিয়ে আমি, মনে হয়, রৌদেজ্যোৎস্নাময়
স্বাস্থ্যনিবাসের মতো কি একটা স্থাপন করেছি
আমার নিজের বাম পাশে। যে যাই বলুক আজ
এমন কন্টকময় পথে সোজা শিরদাঁড়া আর
যিশুর চোখের মতো গৌরবের আভাই সম্বল
আমার এবং দ্রুত শ্মশানের আগুন নেভাই।
অনেক সুন্দর নৌকো গহীন নদীর চোরা টানে
দূর নিরুদ্দেশে ভেসে যায়, দেখেছি কি দেয়ালের
শূন্য বুকে? মাঝে-মধ্যে নাগলতা আমাকে জড়িয়ে
ধরে আর অন্ধকারে স্বপ্নের মতই নিরিবিলি
আলখাল্লা কম্পমান। ‘আয় তুই আমার হৃদয়ে’
ব’লে গাঢ় কণ্ঠস্বর আমাকে স্বপ্নের শুভ্রতায়
ডাকেন মৌলানা রুমি নাকি হো চি মিন, বোঝা দায়;
স্বপ্নে কিছু স্পষ্ট কিছু অত্যন্ত অস্পষ্ট থেকে যায়।
আবাসিক
কোনো ঘুমন্ত রূপসীর স্মিত হাসির মতো
এই বিকেল। হাওয়া এক পাল
হরিণের চাঞ্চল্য। সুসজ্জিত মঞ্চে
শোভা পাচ্ছে সেমিনারের সুলেখা শিরোনাম।
নগরের আবাসিক সমস্যা’। সভাকক্ষ
আস্তে-আস্তে ভ’রে উঠলো শ্রোতায়,
যেমন উৎসবের দিন কোনো কোনো বিরাট ঘর
ছেয়ে যায় ফুলের স্তবকে। মঞ্চ
সভাপতি, প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি
এবং বক্তাবৃন্দ; কেউ-কেউ প্রৌঢ়, কেউবা যুবা।
মঞ্চস্থিত টেবিলে যুগল সৌখিন ফুলদানি আর এক গ্লাশ
টলটলে পানি। মঞ্চে উপবিষ্ট যাঁরা,
তাঁদের অধিকাংশের নিজস্ব ঘরবাড়ি আছে,
কারো-কারো একাধিক; একজন কি দু’জনের কোনো
বাড়ি আছে, অধিকাংশই ভাড়াটে বাড়ির বাশিন্দা;
কেউ কেউ থাকেন মেসবাড়িতে।
নগরের আবাসিক সমস্যা বিষয়ে
বক্তারা একে-একে বক্তৃতা দিলেন সকলেই। বক্তব্য তাঁদের
শাঁসালো, যুক্তিশাণিত। মঞ্চে ক্ষনে ক্ষণে
টিভি ক্যামেরার চমক আর ঠমক। ক্যামেরাম্যান আর
স্টাফ ফটোগ্রাফারদের
হঠাৎ আলোর ঝলকানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সভাকক্ষ বারংবার
ঝলমলিয়ে উঠলো অজস্র কথার ফুলকিতে। কেউ কেউ
পাঠ করলেন দীর্ঘ প্রবন্ধ, তত্ত্বে তথ্যে ভুরভুরে।
প্রবন্ধ-পাঠকালীন কোনো-কোনো মুহূর্তে কেউ আড়চোখে
দেখে নিলেন শ্রোতাদের মুখমন্ডলে
ভাষণের প্রতিক্রিয়া; কেউবা হাততালির স্থায়িত্বের মাপকাঠিতে
নিজের জনপ্রিয়তা করলেন পরখ। তাদের
সুভাষিবলীর মুখে পড়লো ফুলচন্দন।
প্রধান অতিথি যখন ভাষণ দেয়ার উদ্দেশ্যে
আসন ছেড়ে দাঁড়ালেন,
এগিয়ে গেলেন মাইক্রোফোনের দিকে, তখনই
বলা-কওয়া নেই, হঠাৎ একজন বালক
সবার অলক্ষ্যে শূন্য একটি চেয়ারে এসে
ব’সে পড়লো আনাহূত বিশেষ অতিথির মতো।
তার পরনে ছেঁড়া শার্ট, জন্মের পর যতোগুলো বছর
সে পাড়ি দিয়ে এসেছে, ততো বিচিত্র তালি তার
ময়লা হাফপ্যান্টে চুল উসকো-খুসকো। রাস্তার ধারে
ধুলোবালির ঘর বানাচ্ছিলো। সে রাস্তাই
নিবাস তার; দিনে ঘুরে বেড়ায় এক রাস্তা থেকে
অন্য রাস্তায় নির্বাসিত নাবালক রাজার মতো,
কুড়ায় বাতিল কাগজ। কারো
বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে তোলে না গোলাপ
বাজখাঁই গলার ভয়ে। রাতে ঘুমায়
ফুটপাথে, দোকানের বন্ধ দরজার কাছে, কিংবা
টিনশেডের আশেপাশে। কখনো-কখনো স্বপ্নে
সে প্রবেশ করে অভ্রের তৈরি গীতময় এক অট্রলিকায়।
এখন সে আচমকা ঢুকে পড়েছে কৌতূহল বশে
এই সভাকক্ষে, প্রবেশাধিকারের
প্রশ্নটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। নাকি সে
নগরের আবাসিক সমস্যা বিষয়ক সেমিনারে
যাচাই করতে এসেছে, এই যে সাত বছর আগে
ঘুঁটেকুড়ানী এক নারীর অন্তর্গত লতাগুল্ম ছিঁড়ে
সভ্যতার উগরে-দেয়া উচ্ছিষ্ট হিশেবে
সে চলে এসেছে পৃথিবীতে, এ-ঘটনা কতোটা যুক্তিসঙ্গত
এবং সমীচীন!
আরাগঁ তোমার কাছে
আরাগঁ তোমার কাছে কোনোদিন পরিণামহীন
এই পংক্তিমালা
জানিনা পৌঁছবে কিনা, তবু
তোমারই উদ্দেশে এই শব্দাবলী উড়ে যাক পেরিয়ে পাহাড়
অনেক পুরনো হ্রদ বনরাজি এবং প্রান্তর।
আমার এলসা আজ যৌবনের মধ্যদিনে একা
জীবনকে ফুলের একটি তোড়া ভেবে টেবে আর
গানের গুঞ্জনে ভরে কোথায় আয়নার সামনে চুল আঁচড়ায়,
দীর্ঘ কালো চুল, পা দোলায় কোন সে চত্বরে ব’সে অপরাহ্নে
কিংবা পড়ে ম্লান মলাটের কবিতার বই কিংবা কোনো
পাখির বাসার দিকে চোখ রেখে কী-যে দ্যাখে, ভাবে
আমি তা’ জানিনা, শুধু তার স্বপ্নের ফোঁটার মতো
গাঢ় দু’টি আর সুরাইয়ের গ্রীবার মতন
গ্রীবা মনে পড়ে।
আরাগঁ আমার চোখে ইদানীং চালশে
এবং আমার নৌকো নোঙরবিহীন, তবু দেখি কম্পমান
একটি মাস্তুল দূরে, কেমন সোনালি।
অস্থিচর্মসার মাল্লা কবে ভুলে গেছে গান, কারো কারো
মাথায় অসুখ, ওরা বিড় বিড় ক’রে আওড়ায়
একটি অদ্ভুত ভাষা, মাঝে-মধ্যে দূর হ দূর ব’লে ঘুমের ভেতরে
কাদের তাড়ায় যেন, আমি শুধু দেখি
একটি মাস্তুল দূরে, কেমন সোনালি।
তরমুজ ক্ষেতের রৌদ্রে নগ্ন পদ সে থাকে দাঁড়িয়ে-
আমার কবিতা।
কখনো আমাকে ডেকে নিয়ে যায় বনবাদাড়ে যেখানে
সাপের সংগম দ্যাখে স্তম্ভিত হুতোম প্যাঁচা, যেখানে অজস্র
স্বপ্নের রঙের মতো ঘোড়া খুরে খুরে ছিন্ন ভিন্ন করে ঘাস ফুল
কখনো আমাকে ডাকে শহরতলীর বর্ষাগাঢ় বাসস্টপে
কখনো বা সিনেমার জনময়তায়,
আমার স্তিমিত জন্মস্থানে
এবং আমার ঘরে খেলাচ্ছলে আঙুলে ঘোরায়
একটি রুপালি চাবি, বাদামি টেবিল ক্লথ খোঁটে
চকচকে নখ দিয়ে-আমার কবিতা।
আবার কখনো তার সুপ্রাচীন তরবারির মতন বাহু
অত্যন্ত বিষণ্ন মেঘ, তার দুটি চোখ
ভয়ংকর অগ্নিদগ্ধ তৃণভূমি হয়।
যে-বাড়ি আমার নয়, অথচ যেখানে আমি থাকি
তার দরোজায়
কে যেন লিখেছে নাম কৃষ্ণাক্ষরে-অসুস্থ ঈগল।
পাড়াপড়শিরা বলে, মাঝে-মধ্যে মধ্যরাতে জীর্ণ
বাড়িটার ছাদ আর প্রাচীন দেয়াল থেকে তীব্র ভেসে আসে
নিদ্রাছুট রোগা ঈগলের গান, কী বিষণ্ণ-গর্বিত গান।
আরাগঁ তোমার মতো আমিও একদা
শক্রুপরিবৃত শহরের হৃদয়ে স্পন্দিত হ’য়ে
লিখেছি কবিতা রুদ্ধশ্বাস ঘরে মৃত্যুর ছায়ায়
আর স্বাধীনতার রক্তাক্ত পথে দিয়েছি বিছিয়ে কত রক্তিম গোলাপ।
আরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে, যেখানে সুর্যের
চুম্বনে ফসল পাকে, রাঙা হয় গুচ্ছ গুচ্ছ ফল,
সজীব মুখের ত্বক রুটির মতোই ঝলসে যায়,
যেখানে বিশদ খরা, কখনো বা ভীষণ নির্দয় বানভাসি,
যেখানে শহুরে লোক, গ্রাম্যজন অনেকেই শাদাসিধে,
প্রায় বেচারাই, বলা যায়; আমাদের হালচাল
সাধারণ, চাল-চুলো অনেকের নেই।
আমাদের মাস ফুরোবার অনেক আগেই হাঁড়ি
মড়ার খুলির মতো ফাঁকা হ’য়ে যায়, দীর্ঘ দূরন্ত বর্ষায়
গর্তময় জুতো পায়ে পথ চলি, অনেকের জুতো নেই।
ধুতামি জানিনা, মোটামুটি
শাদাসিধে লোকজন আশেপাশে চরকি ঘোরে
এবং দু’মুঠো মোটা চালের ডালের জন্যে ক্ষুধার্ত আমরা।
ক্ষুধার্ত সত্তার পূর্ণ সূর্যোদয়, ভালোবাসা নান্মী লাল
গোলাপের জন্যে
আরাগঁ তোমার কাছে লিখছি সে দেশ থেকে আজ,
যেখানে দানেশমন্দ ব’সে থাকে অন্ধকার গৃহকোণে বুরবক সেজে
জরাগ্রস্ত মনে, অবসাদ-কবলিত কখনো তাড়ায় আস্তে
অস্তিত্বের পচা মাংসে উপবিষ্ট মাছি।
আরাগঁ তবুও জ্বলে গ্রীষ্মে কি শীতে
আমাদের স্বপ্ন জ্বলে খনি-শ্রমিকের ল্যাম্পের মতো