কে তোমরা
কে তোমরা অভ্যন্তরে তাড়াতাড়ি সাজাচ্ছো চেয়ার
সারি সারি, দেখছো পর্দার রঙ ঠিক আছে কি না?
খানিক সাজিয়ে ফের এলোমেলো করে দিচ্ছো সব-
রঙিন সিল্কের পর্দা ছিঁড়ে,
চেয়ারের পাহাড় বানিয়ে খুব গল্পমগ্ন তোমরা এখন।
নাকি নৈঃশব্দই ভালবাসো?
কে তোমরা বাস্তবক মাথার বদলে ঘাড়ে শুধু
বন্ধ ঘড়ি নিয়ে বসে আছো মুখোমুখি অবেলায়?
আমার মগজে হো হো হেসে ওঠো তোমরা, কখনও
অত্যন্ত ফুঁপিয়ে কাঁদো বুকের ভেতর, সারাক্ষণ
রয়েছো অধীর প্রতীক্ষায়, যেন কোনো সুসংবাদ
আসবে এক্ষুণি।
সর্বদা চঞ্চল দৃষ্টি, কেউ আসে কি না, মানে কোনো
পিওনের ব্যাগ ভেসে ওঠে কি না, তারই দিকে লক্ষ্য
তোমাদের। এখনও আসেনি কেউ, কস্মিনকালেও
চকিতে তেমন কারো মৃদু
পদশব্দ বেজে উঠবে কি না, কে পারে বলতে?
কিন্তু আমি তোমাদের পরিচয় চাই, চাই জেনে নিতে কোন্
ডাকবাক্সে ফেলো চিঠি, কাদের সংসর্গে লাগে ভালো?
কেন বারবার
মেঘের ডানায় ঝুলে থাকো? গহন নদীতে কেন
উড়ন্ত টেবিল পেতে বসো অথবা মরুর বুকে
মধ্যরাতে জনহীনতায়
বের করো জ্যোৎস্নারাঙা হ্যাণ্ডনোট? কেমন বাজার
জমে ওঠে অকস্মাৎ, বালিয়াড়ি উম্মে কুলসুমি সুরে সুরে
বিশদ রঞ্জিত হয়, বালি ফুঁড়ে জাগো রাশি রাশি
কাচের গুঁড়োর মতো জলের ফোয়ারা, পুণ্যময়।
আমার ভেতর কে তোমরা ফিসফিস কথা বলো,
গোপনে ছড়িয়ে দাও বীজ, জল ঢালো? পাঁজরের
জমি ছিঁড়ে অগণিত চারা তোলে মাথা, যেন ওরা
অজস্র নিশান।
সতেজ রত্তিরে
লতাগুল্ম উন্মীলিত শরীরের দেয়ালে দেয়ালে।
কখনও আবার বুনোষাঁড়
ছেড়ে দাও আমার বুকের চৌরাস্তায়, করে সে চুরমার
সব কিছু; খেয়ে ফেলে তোমাদেরই দেওয়া কত ফুল।
কে তোমরা অভ্যন্তরে হার্ডবোর্ডে আঁকছো যেশাশ
আমারই আদলে আর বলছো কেবলি,-চলে যাও
চলে যাও তুমি?
অথচ আমি তো অন্তর্গত চারায় লাগিয়ে গাল,
আঙুলে ঘুরিয়ে দ্রুত কাচের প্লেটের মতো চাঁদ
এবং পায়ের নখ দিয়ে
নহর খুঁচিয়ে তুলে দ্বন্দ্বের দুন্দুভি শুনে আর
মীমাংসার অস্পষ্ট ট্রাফিক আইল্যাণ্ডে চোখ রেখে
প্রত্যহ আবৃত্তি করে আলোকের স্বর্গমালা চাই
থাকতে চাই।
কেউ না ডাকলেও
কেউ না ডাকলেও কেন এমন নিঃসাড় থাকি ইদানীং কেন
ডাকের কম্পনে
তক্ষুণি কী করে টোল নিয়ে আপন সত্তায়
দোল খেতে হয় প্রতিবার ভুলে গেছি? নাকি তার কোনো মানে
অধুনা পাই না খুঁজো! কেউ ডাকলেও কেন আমার হৃদয় ঢিল-খাওয়া
ঝিলের মতন হয়ে ওঠে না তক্ষুণি?
রাত্রি কত গাঢ় হলে দুঃখী তার কণ্ঠে আনে গান, জানি আমি;
একাকীত্বে তার কত সূর্যোদয়, কত সূর্যাস্ত জমেছে-
সেও তো অজানা নয়। বেদনার তীর্থে যে-জন আঁজলা ভরে
করে জল পান,
আস্তে-সুস্থে ধোয়া
পায়ের শতেক ক্ষত, আমার ভেতরে তার জন্মপরিচয়
জ্বলে সারাক্ষণ আর ঋতুতে ঋতুতে কত আর্তি অস্ত যায়।
তোমাদের মনে রাখা দরকার, এই তো এই আমিও একদা
ডাক আর আহ্বানের সূক্ষ্ম সব বিবাদ মিটিয়ে
চায়ের আসরে খুব উড়িয়েছি কথার রঙিন ঘুড়ি, তুড়ি
মেরে নৈরাশ্যের মুখে ঘোড়ার আড়াই ঘর লাফ কিংবা গজের দুলুনি
কখনও দেখেছি আড়চোখে। চমৎকার চমৎকার বলে চায়ে
দিয়েছি চুমুক বারবার।
কখনও ডাকলে কেউ আমার সত্তায় আগে নামতো আকাশ,
হতো সূর্যোদয়।
আমার দুয়ারপ্রান্ত থেকে বিফল যায়নি ফিরে কেউ, কেউ
‘বন্ধ’ শব্দ কখনও করেনি পাঠ আমার কপাটে, মনে রেখো।
চতুরতা বিনা
সবাইকে প্রায়শই ফুল দিয়ে বলেছি, দেখুন
আমার আঙুলে এই অশেষ আনন্দ ফুটে আছে নিশিদিন।
টেবিলে অনেক চিঠি জমে, অগণিত টেলিগ্রাম
অবসন্ন ছেঁড়াখোঁড়া পাখির ডানার মতো ঝোলে
পুরনো দেয়ালময়, কড়া
নেড়ে নেড়ে ক্লান্ত চলে যায় কত আগন্তুক, কেউবা সুদূর
পথপ্রান্তে প্রতীক্ষায় একাকি দাঁড়িয়ে
গোধূলি আবৃত্তি করে খুব,
তবুও দিই না সাড়া, বসে থাকি ছায়াচ্ছন্ন বিদায়ের ঘরে।
অকস্মাৎ কী-যে হয়, কখনও কেউ না ডাকলেও ছুটে যাই
শূন্যতায়, গলা ছেড়ে ডাকি
অন্তপুরে, প্রান্তরের মধ্যযামিনীতে, ডেকে যাই ক্রমাগত,
অনেক পেছনে থাকি পড়ে নির্বাসনের গৈরিক আলখাল্লা, নিরিবিলি।
কেমন করে হঠাৎ তুমি
কেমন করে তুমি হঠাৎ তুমি আমার মধ্যে করলে বসত,
সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে,
এখনো তো প্রশ্ন আছে।
যখন তুমি তোমার চোখে ঋতুরাজের প্রসাদ নিয়ে
দাঁড়িয়েছিলো একদা এক সান্দ্র মধুর বেলাশেষে,
আমার আপন আট কুঠুরি
সকালবেলার মতো হেসে
সম্ভাষণের কিরণ-ঢেউয়ে প্রবল তোমায় দুলিয়ে দিলো।
তোমার আমার মধ্যে কখন ভ্রূকুটিহীন একটি দৃষ্টি
জন্ম নিলো, হৃদ ভুবনে
উঠলো দুলে
ফুলের ডালি পাখির গানের সম্মোহনে,
কেউ জানে না, কেউ জানে না।
তোমায় দেখে স্বপ্ন আমার চোখ খুলেছে,
মুখ তুলেছে আশার শ্যামা।
কেমন করে হঠাৎ তুমি আমার দিলে
অন্তরঙ্গ তোমার দিনের
তোমার রাতের স্বত্বাধিকার?
যখন তুমি ছড়াও হাসি ঠোঁট-জমিনে
দুঃখটাকে আড়াল করো চুলের আড়ে,
আমার মনের ঝুল অথবা
এই শরীরের ভাঁজে ভাঁজে
জমে থাকা কালের ধুলো কিংবা বালি
যায় তো ঝরে অগোচরে,
যায় তো ঝরে।
কিন্তু যখন তোমার চোখের দু’তীর ব্যেপে
হঠাৎ আবার মেঘ জমে যায়, জলজ কাঁটা
ধরায় জ্বালা চোখের কোণে,
আমার বুকের ভেতর বহু গাছগাছালি
এক নিমেষে ধুলোয় গড়ায়,
পক্ষী কত শরীরজোড়া জখম নিয়ে কেঁদে বেড়ায়।
কান্না তোমার ক্ষয় করে দেয় আমার আয়ু,
ভীষণভাবে ক্ষয় করে দেয়।