কবিতা, দ্বিরূপিণী
কবিতাকে নিয়ে আমি বাস্তবিকই মুশকিলে পড়েছি।
দ’দণ্ড দেয় না শান্তি, কেবল অশান্ত করে রাখে।
স্নানাহার শেষে মাথাভরা পরিপাটি চুল নিয়ে
নিভৃত শয্যায় শুয়ে শুয়ে
বই পড়ি কিংবা ফুঁকি সিগারেট, হঠাৎ কোত্থেকে এসে বড়ো
এলোমেলো করে দ্যায় চুল
কোনো কোনো দিন।
মধ্যরাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, ঘরময় শুনি নিশিডাক,
বলা-কওয়া নেই
কখনও কলজেটাকে এমন নাড়িয়ে দ্যায়, হায়,
বেড়ে যায় বুকের স্পন্দন।
কবিতাকে নিয়ে আমি বাস্তবিকই মুশকিলে পড়েছি।
গ্রীষ্মের রাত্তিরে ঘুমহীন, প্রেমহীন জানালার কাছে যাই,
বাতাসের সাথে
আচমকা সে-ও ঢুকে পড়ে ঘরে। কখনও শরীর হয় জ্যোৎস্নাময় বন
কখনও-বা রৌদ্র উচ্ছসিত
উদাস প্রান্তর,
আদিম অরণ্যঘ্রাণ কখনও সত্তায় তোলে আলোড়ন। সে তো
বুকের ভিতরে দ্যায় ছেড়ে সোনালি রূপালি মাছ কতো,
আমাকে জাগিয়ে রাখে প্রহরে, প্রহরে ক্লান্ত করি নিশিদিন।
চোখে হানে জ্বালা,
মাথার ভিতরে জ্বলে দ্বীপের উৎসব, ফের চকিতে নেভায় এক ফুঁয়ে।
প্রত্যহ দু’দিক থেকে আসে দু’জন আলাদা নারী।
একজন, তার লক্ষ্মী লক্ষ্মী ধরন চিনতে
কখনও হয় না ভুল, বলে-
চলো যাই হ্রদের নিকারে বসি, রাখি
চোখ ঐ গোলাগের গোলাপি হিল্লোলে,
এসো, এসো প্রাচীন গুহায়
দেখাবো পরীর নাভিমূল,
তোমাকে দেখাবো রাজা আর ক্রীতদাসীর সঙ্গম;
একা হও তুমি,
তারার অলীক তলোয়ারে বিদ্ধ হও, বিদ্ধ হও।
অন্যজন ছিন্নমস্তা, লংকার ঝালের মতো ঝাঁঝ কণ্ঠস্বরে
মেখে বলে-
চলো যাই শ্মশানে অথবা গোরস্তানের বসি কিছুক্ষণ, দেখি
কঙ্কাল-মিছিল।
তুমিও আপনার শরীরে পেরেক ঠুকে দ্যাখো
যীশুর যন্ত্রণা
সইতে পারো কি না,
ক্রমাগত ক’দিন উপোস করে দ্যাখো অনাহার কায়ক্লেশ
কত যে সহনযোগ্য আর ক্ষুধার্ত শিশুর গালে গাল রেখে
জেনে নাও মুত্যৃর শৈশর।
মুমূর্ষ বৃদ্ধের কানে প্রজাপতি আবৃত্তি করলো
কোন পদাবলি
জানবে না তুমি? পদকর্তা মৃতের চোখের কোণে জেগে থেকে,
কাঁটার মুকুট পরে লেখো দ্বিধাহীন-
আমরা সবাই আজ দুর্ভিক্ষের বিকৃত সন্তান।
দু’জন দু’দিক থেকে টানে আমাকে নিয়ত, আমি
কখনও এদিকে
কখনও ওদিকে ঝাঁকে পড়ি,
যত বলি ছাড়ো পথ, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও হে
নারী, দ্বিরূপিণী,
ততই তাদের খেলা ভীষণ হিংসুক হয়ে ওঠে।
কখন যে দু’জন চকিতে একজন হয়ে যায়, বোঝা দায়-
একই আলোবৃত্তে
হ্লাদিনী নর্তকী নাচে, ফোটে নানা মুদ্রা ক্ষণে ক্ষণে।
কানামাছি ভোঁ ভোঁ
‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছোঁ’-বলেই ওরা
যে যার ধরনে ঘোরে চারদিকে, কখনও রঙিন বল নিয়ে
দে-দৌড় খেলার মাঠে হই হই।
দু’দিকে দাঁড়ায় দু’টি দল;
পায়ে পায়ে ছোটে বল, শূন্যে ওঠে কখনও বা, কেউ
চকিতে ফাউল করে, বাধে খিটিমিটি। ফের ক্ষিপ্র খেলোয়াড়
থর থর হাত রেখে প্রতিপক্ষের গলায় সহজেই
মেটায় বিবাদ ক্ষণিকের। কখনও বা বালকেরা
ওড়ায় বলুন ঝাঁক ঝাঁক, গলা ছেঁড়ে দেয় ডাক
হরেক রকম।
এখন বাগানে গেলে কোনো দৈত্য, ক্ষ্যাপা, স্বার্থপর, করবে না
পথরোধ। কেউ চকোলেট খায়, খোঁজে কেউ পরীর সমাজ
আশেপাশে, চোখ মেলে দেখে নিতে চায় দু’চারটে দেবদূত
খেলাচ্ছলে দোলে কিনা টেলিগ্রাফ-তারে বারবার।
গোধূলি রঞ্জিত চোখে দেখি দূরে থাকে ভোরবেলার মতন
বয়স ওদের, খুঁজি কচি ঠোঁটে আমার নিজের ডাক নাম।
এই দৃশ্য নিভে গেলে চোখ বুজে টাইরেসিয়াসি
চৈতন্যে সুস্পষ্ট দেখি, যেন-বা টেলিভিশনে ফিল্ম
প্রাচীন, ধ্রুপদী, দেখি এইসব প্রফুল্ল বালক-কেউ বেঁটে,
কেউ দীর্ঘকায়,-ঘোরে বয়স্ক রোদ্দুরে ক্লান্ত পায়,
খরায় পোহাতে চায় ছায়া, ছায়া শুধু দ্রুত দূরে সরে যায়।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
একজন ভূলুণ্ঠিত পথপ্রান্তে, ভগ্ন ঊরু, তার দীপ্র মোটর বাইক
আহত পশুর মতো পড়ে আছে পাশে।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
অন্যজন মুখে ক্রুর রেখাবলি নিয়ে জুয়ার টেবিলে বসে
সৌভাগ্যের আনুগত্য চায় প্রতিবার দান ফেলে, কেউ
কাটায় সকল বেলা পাগলা গারদে, আঁকে দুঃস্বপ্ন নিয়ত
আতঙ্কিত মগজের দেয়ালে দেয়ালে। একজন প্রেমিকাকে
গোলাপের তোড়া দিয়ে বনে যায় রাতারাতি সুদক্ষ ঘাতক।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
কেউ হন্তদন্ত হয়ে অলিতে-গলিতে খোঁজে বেবি-ফুড, যেমন সুদূর
মধ্যযুগে অশ্বরূঢ় নাইট খুঁজতো হোলি গ্রেল কী দুর্গম
পাথুরে প্রান্তরে, বনে উপবনে, পাহাড়ে পাহাড়ে।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
ভেসে ওঠে একজন যুবা, ক্ষয়রোগীর মতন সমাজের
স্বাস্থ্যেদ্ধারে নিবেদিত, সর্বদা ভূতলবাসী।
ব্যক্তিগত টানেলে কেউ-বা
অতিশয় স্বপ্নলিপ্সু, পলায়নই অর্থ তার সোল্লাসে রটায়
শক্রপক্ষ। একজন নিজ ঘরে দ্যাখে চোরাবালি সর্বক্ষণ,
দ্যাখে বাগানের পথে বীভৎস কঙ্কালময় রুক্ষ মরুভূমি।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
অন্যজন, ছন্নছাড়া, রাত্রির শহরে অন্ধকার পথে হাঁটে,
তার চুল থেকে এক অলৌকিক পথরেখা ছায়াপথে মেশে,
বুকে জোনাকির মতো শব্দ জ্বলে নেভে, বুকে ব্যস্ত
জটিল বীজাণু।
(কানামাছি ভোঁ ভোঁ…)
কিছুই পারি না
কিছুই পারি না আমি। প্রত্যহ পাথর কেটে কেটে
কান্তিমান মূর্তি কিংবা দুধশাদা নহর বানানো
হয় না আমাকে দিয়ে। মধ্যযুগী নাইটের মতো
ড্রাগনের আতশী নিশ্বাস থেকে কোনো তরুণীকে
করিনি উদ্ধার; সবদেজ ঘোড়া ছুটিয়ে কান্তারে,
মরুপথে, সুনসান মায়াবী উদ্যানে কোনোকালে
যাইনি, ছিঁড়িনি সর্বরোগহর ফল, মুক্তিজন
ছিটিয়ে পারিনি দিতে প্রাণ অগণিত প্রস্তরিত
প্রজাদের অভিশপ্ত রাজ্যের অথবা ভাসাইনি
ভেলা দূর সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে, বাঁধিনি তো ডেরা
বিপুল রহস্যঘেরা জনশূন্য দ্বীপে, প্রাণপণ
লড়িনি, জংলির সঙ্গে, অজচর্মে ঢাকিনি শরীর।
একা-একা আজীবন বয়ে চলি ব্যর্থতার ক্রশ!
পিঠের উপর নিয়ে রৌদ্রজল লাঙল চালিয়ে
পারি না মাটির বুক চিরে চিরে ফসল ফলাতে;
সরু ডিঙি বেয়ে নিশিদিন পারি না ফেলতে জাল
গহন নদীতে, চিরকাল খনিও অগম্য আর
পশুপাখি নিরাপদে করে চলাফেরা সর্বক্ষণ
আমার চৌদিকে- আমি শুধু কিছু অক্ষর সাজিয়ে
কবিতা রচনা ছাড়া এ যাবত পারিনি কিছুই।
আজো কবিতার মতো সত্য কবিতা ফুটলো কি না
খাতার পাতায় বাস্তবিক, হায়, তা-ও তো জানি না।