এখন আমার শব্দাবলি
ছিলো তো সোনালি সমঝোতা, তবু কেন বেঁকে বসে
আমার নিজস্ব শব্দাবলি?
কখনও তোয়াজে রাখি, কখনও-বা ওদের সম্মুখে
প্রেমিকের মতো সানুরাগ নতজানু আমি। আর
গন্গনে দুপুরে ওদের যত্নআত্যি করি চামর দুলিয়ে ঘন ঘন,
যখন প্রবল নামে শীত,
ব্যাকুল বাঁচিয়ে রাখি আপাদমস্তক
শীতবস্ত্রে ঢেকে।
কখনও খাওয়াই দুধকলা, অসুখের আন্দেশায়, পার্কে কিংবা
নদীতীরে খানিক বেড়িয়ে নিয়ে আসি,
চাবুক চালাই খুব সপাং সপাং মাঝে মাঝে,
যেন সার্কাসের শ্বাপদের ট্রেইনার।
এখন আমার শব্দাবলি নিরিবিলি স্মিত ঝিলে পা ডুবিয়ে
হরিণের মতো চোখ তুলে তাকায় না, দাঁড়ায় না
খড়ের গাদার পাশে চকচকে ঘোড়ার মতন
বাঁকিয়ে তরুণ গ্রীবা, দোলে না কেশররাজি হাওয়ায় স্পন্দিত
শস্যের ধরনে আর। এখন আমার শব্দাবলি অগাধ জ্যোৎস্নায়-পাওয়া
পরীদের মতো নয় নৃত্যপরা। টাইপরাইটরের বিশদ কীবোর্ড
ছিটোয় না উচ্ছসিত গোলাপ এখন। বাণিজ্যিক এলাকায়,
ফুটপাতে, বনেদি পাড়ায়, ফ্লাটে ফ্লাটে
কিংবা কোনো বিবর্ণ বস্তিতে
আমার নিজস্ব শব্দাবলি
রক্তচক্ষু কোকিলের মতো গেয়ে ওঠে না এখন।
সকল পাখির কণ্ঠে জমাট বেঁধেছে চাপ চাপ
তুষার, তাদের ছিন্নভিন্ন
পালক এখানে ওড়ে ইতস্তত এবং অস্বস্তিকর মৌন
ঝুলে রয় চতুর্দিকে বিরতিবিহীন, এ প্রান্তর অতিশয়
ক্লিষ্ট, গমগিন, এমনকি মাতমেরও ধ্বনি নেই।
রজনীগন্ধার বন ফুঁড়ে বেরোয় কেবলি শীর্ণ, প্রসারিত
হাত, অগণিত বিক্ত, মূক ও বধির।
হঠাৎ দুপুরে সন্ধ্যা, মানুষের ত্রাতা তাঁর পেরেক-চিহ্নিত
রক্তাপ্লুত হাতে খুঁজছেন খাদ্যকণা বার বার
কুকুর-শাসিত ডাস্টবিনে, তিনটি মলিন হ্রস্ব
নোটের বদলে মেরি-মাতা নির্দ্বিধায়
রাত্তিরে হচ্ছেন ম্লান, হাতে উল্কি আঁকা, একচক্ষু
নাবিকের আস্তানায় এবং রবীন্দ্রনাথ কালোবাজারির
দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল
ভিক্ষা চাইছেন ত্রঁটো-কাঁটা মাথা নত করে আর
তিন দিন তিন রাত্রি উপোসের পরে ফুটপাতে
এক ভিড় লাশের পাশেই ভাঙা উজাড় থালায়
দেখছেন অলৌকিক ভোজ নজরুল ইসলাম।
কী করে আমার শব্দাবলি একরাশ
পাতার আড়াল থেকে রক্তচক্ষু কোকিলের মতো
গান গেয়ে ওঠবে এখন?
কথোপকথন
এই দ্যাখো আজ জ্যোৎস্নারাতে
বাগানের সবচে সুন্দর গোলাপটি দিলাম তোমার হাতে।
‘যতই আনো না কেন’ বললে তুমি, ‘গোলাপ বকুল
অথবা রজনীগন্ধা, বৃথা সবই, আমি তো চাইনে কোনো ফুল।
তাপর বহুপথ চড়াই উতরাই
পেরিয়ে তোমাকে জানালাম, শোনো, করি না বড়াই,
তবু বলি, এই যে এনেছি চন্দ্রহার, এর সমতুল্য
নেই কিছু। বললে তুমি, ‘অন্তত আমার কাছে
এ হারের নেই কোনো মূল্য।
তা হলে কী চাও তুমি? বলো তো কী ছাই-
পাশ পেলে হও খুশি? বললে মৃদু স্বরে,
‘শুধু তোমাকেই চাই’।
কবিকে দিও না দুঃখ
কবিকে দিও না দুঃখ, দুঃখ দিলে সে-ও জলে স্থলে
হাওয়ায় হাওয়ায়
নীলিমায় গেঁথে দেবে দুঃখের অক্ষর। কবি তার নিঃসঙ্গতা
কাফনের মতো মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে
ফুটপাতে একা,
দালানের চূড়ায় চূড়ায়, দিগন্তের অন্তরালে
কেমন বেড়ায় ভেসে, চাঁদের নিকট যায়, নক্ষত্র ছিটোয় যত্রতত্র
খোলামকুচির মতো। তাকে দুঃখ দিও না, চৌকাঠ থেকে দূরে
দিও না ফিরিয়ে।
ফেরালে নক্ষত্র, চাঁদ করবে ভীষণ হরতাল, ছায়াপথ তেজস্ত্রিয়
শপথে পড়বে ঝরে, নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ।
প্রায়শ পথের ধারে ল্যাম্পোটে হেলাল দিয়ে খুব
প্রচ্ছন্ন দাঁড়িয়ে থাকে, কখনও-বা সীমাহীন রিক্ততায়
রেস্তরাঁয় বসে
বান্ধববিহীন বিষাদের মুখোমুখি
নিজেই বিষাদ হয়ে। মাঝে মাঝে মধ্যে চৌরাস্তায় খুঁড়ে তোলে এক
গোপন ফোয়ারা পিপাসার্ত পথিকেরা আঁজলা ভরবে বলে।
আবার কখনও তার মগজের উপবনে লুকোচুরি খেলে
খুনি ও পুলিশ!
মধ্যরাতে শহরের প্রতিটি বাড়ির দরজায় কিছু ফুল
রেখে আসে নিরিবিলি কাউকে কিছু না বলে! কবি সম্মেলনে
রাজধানী আর মফস্বলে স্টেজে কয়েক ডজন
পংক্তির জ্যোৎস্নায় রৌদ্র পুনরায় স্নান সেরে স্বকীয় গোপন
ঘুলঘুলিটার
দিকে চোখ রেখে নীলিমার সঙ্গে বাণিজ্যের কথা ভাবে, ভাবে
সুদূর অনন্ত তাকে চোখ টিপে বেঘোরে ঘোরাবে কতো আর?
কবি সম্মেলনে তেজি যুবরাজ, প্রেমের নিকট বাস্তবিক
বড়ো নগ্ন, বড়ো অসহায়!
কবিকে দিও না দুঃখ, স্বপ্নের আড়ালে তাকে তীব্র
আবৃত্তি করতে দাও পাথর বুক, গাছ,
রমণীয় চোখ,
ত্বক, হেঁটে যেতে দাও ভিড়ে নিজের ভেতরে। রোজ
হোক সে রূপান্তরিত বার বার। নিজস্ব জীবন রেখেছে সে
গচ্ছিত সবার কাছে নানান ধরনে অকপট।
কবিকে দিও না দুঃখ, একান্ত আপন দুঃখ তাকে
খুঁজে নিতে দাও।
কবিতা এখানে এসো
কবিতা এখানে এসো, বসো, এই আমার নিভৃত
বাম পাশে; কী খেয়ালে এই তো সেদিন গেলে, তবু
মনে হয় কতদিন দেখি না তোমাকে কতদিন
আমার ছায়ায় ছিলে, আমার রোদ্দুরে লুটোপুটি
খেয়েছো আনন্দে বহুবার, রহস্যের পাকে পাকে
খেলেছো অনেক খেলা! কখনও দিয়েছো তরতাজা
একটি গোলাপ, অকস্মাৎ রেগেমেগে কখনও-বা
প্রচণ্ড দিয়েছো ছুড়ে মুখে কালোজিরার মতন
রাশি রাশি মরা মাছি। তোমার জানুতে মাথা রেখে
মরবো বলেই আজও নানা রোগ শোক নিয়ে আছি।
নির্জনতা ভালোবাসো বলে আমি নিঃসঙ্গ গুহায়
প্রবেশ করেছি বারবার, ঊর্ণাজালে মুখ রেখে
আদিম ভাষার সুর তুলেছি গলায়, তর্জনীতে
স্বপ্নের মন্দির কত ঘুরিয়েছি যখন-তখন।
ফিরে এসো, বসো তুমি আমার নির্ভৃত বাম পাশে।
এখনও আমার কণ্ঠস্বর তোমাকেই ছুঁতে চায়
এবং আজলা ভরে নিতে চাই তোমার সঙ্গীত।
কেন যে আমাকে ছেড়ে চলে যাও বারবার? আমি
ছন্নছাড়া ঘুরি একা একা রুক্ষ তুমিহীনতায়।
আমার বয়স দ্রুত বাড়ছে বলে কি তুমি দূরে
সরে যাবে? নিরুপায় আমি পড়ে থাকবো এখানে
জঞ্জালের স্তূপে একা জংধরা অসির মতন?