একজন ভ্রমণকারী
সেখানে কী পাবে তুমি? তবু কেন এমন প্রহরে
যাচ্ছো একা? যাচ্ছো কিছু এলেবেলে স্বপ্নের আশায়?
কোথাও না কোথাও কখনও
যেতে হয় বলে যাচ্ছো? কী শিরশিরে পথ, আলোহীন,
জনশূন্যতায় স্তব্ধ। খড়ঠাসা পাখির ডানার মতো কিছু
জানালা হাওয়ায় নড়ে, ফুটপাতে নিশ্চুপ দাঁড়ানো একা, কে সে?
হেলে-পড়া, নিরক্ষর, বিবর্ণ, ধোঁয়াটে
সাইনবোর্ডের ধুলো ঝরে তার গায়ে, মুখ তার
বেবাক ব্যাণ্ডেজে মোড়া, মর্গের টেবিল থেকে যেন
এক্ষুণি এসেছে ওঠে স্মৃতিশূন্য, ভালোবাসাহীন।
অপ্রেমে মানুষ
হয়তো এমনই হয়। ভুলেও ছুঁয়ো না তাকে, সে তো স্বরহীন,
পার্সেলের বিস্তব্ধতা তার অবয়বে। সম্মুখে হাঁ খোলা পথ,
অকূল জ্যোৎস্নায় ভাসে নিষ্ঠাবান পুলিশের ক্রস।
একটি কুকুর মুখে নতুন কাফন নিয়ে ছোটে দিগ্ধিদিক,
অনেক অনেক দূর শতাব্দীর স্মৃতিভারাতুর তাম্রঘণ্টা
কী মধুর কোলাহল করে।
নিশ্চিহ্ন প্রতিটি সাঁকো, বন্ধ সব পথ, শুধু একটি বাগান
জেগে থাকে অন্তরালে-সেখানে তরুণী এক ছায়ার আদর
কুড়ায়, কখনও গায় গান,
গান শুনে মৃত্যু ভোলে তার শীতল হিংস্রতা আর
বাগানের সব গাছ নিমেষেই হয়ে যায় কেমন মায়াবী।
অকস্মাৎ সে তরুণী জরার ব্লিজার্ডে দিশেহারা, মিশে থাকে
ঘরের ছায়ায় সারাক্ষণ, শীর্ণ হাতে তাস খেলে
ঘণ্টা নিজের সাথেই।
ঝুঁকেছিলে ঝটপট, নিমেষে অসুখ ধুয়ে ফেলবে বলেই
বেশ ঝুঁকেছিলে।
জলাশয়ে মুখচ্ছবি বড়ো টলমলে, ঢিল ছুড়ে
চকিতে জাগালে তুমি ঊর্মিল সংসার- কতো কিশোর-কিশোরী
কলরব করে ওঠে, সাজিতে কুড়ায় ফুল কেউ, কেউ ফল
তুলে নেয় ঝোপঝাড় থেকে।
উত্তরচল্লিশ তুমি, তাহাদের বয়স বাড়ে না।
শুনলে কিসের ডাক? জীর্ণ কাকতাড় য়া তোমাকে
বললো কার কথা? তুমি তার পদপ্রান্তে লুটোপুটি
খেয়ে কিছুক্ষণ শিস দিতে দিতে চলে গেলে খুব
উঁচু উঁচু ঘাসের ভিতরে।
পাশ ফিরে শোবে? শুলে কিছুটা আরাম বোধ হবে।
জলের সংসার ভেঙে ফেলে পুনরায় হলে ভীষণ একাকী।
আবার ঘুমের ঘাস চতুর্দিকে দুলে ওঠে বুঝি-
এই তো তিনটি কাক, হ্যাটপরা, শস্যক্ষেতে উড়ছে প্রখর,
সিগারেট-গড়া স্যুট ওড়ে, পথচারী, অন্ধ, টলে পড়ে যায়।
গ্যারি কুপারের বুট নেচে নেচে অতিশয় তেজি
ঘোড়ার গ্রীবায় দোলে, গাঢ় সূর্যাস্তের অত্যন্ত ভিতর থেকে
বেরিয়ে হিরোর মতো মাথা তোলে একটি বিরাট ঘড়ি, তার
দুটি কাঁটা যেন
নর্তকী নর্তকী, শূন্য রেল-লাইনের ধারে প্রজাপতি এক ঝাঁক, কতো
ওয়াগন, ঘোড়া
তরঙ্গিত পাহাড়ের ঢালুতে গড়িয়ে পড়ে, দিগন্তে আগুন।
স্যুটের ভিতর ক্লান্ত ক্ষীয়ামান তোমার জনক, উঁচু উঁচু
ঘাসে ডুবে যাচ্ছে ভিন্ন শতাব্দীর দিকে হাত রেখে।
একটি কান্না
এমন তো মাঝে-মধ্যেই হঠাৎ হয়েই থাকে। রাত্রির খাবার
খেয়ে আর বেতারের নৈশ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে
শুতে যাই; কী-যে হয়, আমার ঘুমের বনে চকিতে আবার
জ্বলে ওঠে দাবানল- পালায় হরিণ, ভীত পাখি। মেষ গুনে
গুনে ক্লান্ত, কিছুতেই বোজে না চোখের পাতা, বিফল ঘুম-বড়ি।
অথচ সহজ ঘুমে অচেতন জায়া পুত্রকন্যা, আমি শুধু
করি পায়চারি ঘরে, বারান্দায়, ত্রস্ত কখনও দেয়াল পড়ি;
জানালায় ঝিল্লিস্বর স্বপ্ন রেখেও রাখে না, অবিরত ধু-ধু
করে স্মৃতি-এভেনিউ। পড়ে থাকে বই বিছানায় কি টেবিলে,
অতিশয় মৃত; ধৃতরাষ্ট্রের মতন চেয়ে থাকি, নিষ্পলক,
অন্ধকারে, চতুষ্পার্শ্বে দেখি না কিছুই কিংবা ছন্দও মিলে
বয় না বুকের রক্তে পুষ্পঝড়। ভাসমান লাল নীল স্বপ্নিল ফলক।
সহসা রাত্রির অন্ধ স্তব্ধতাকে খান খান করে আসে ভেসে
একটি কান্নার শব্দ, যেন শুনি রাতেরই ফোঁপানি অবিরাম
এ কান্না বয়স্ক নয়, কচিকণ্ঠ উৎস তার। বুঝি দেশে দেশে
এশিয়া কি আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায় শহর ও গ্রাম
এমন কান্নায় থরো থরো বারবার। মধ্যরাতে কাঁদে শিশু
হয়তো-বা মাঝপথে, ক্ষুধায় কাতর সেকি? কী যে তার নাম
বলা মুশকিল, থাকে কার সঙ্গে? নাম তার কালু না কি বিশু
অথবা সালেহা, শীলা? জননী কি অন্ধকারে নিতেছে বিশ্রাম
দূরে? পিতা অপমৃত? কান্নারত এই শিশু পরিত্যক্ত, একা?
এ কান্নায় মিশে যায় আমার সে কবেকার হারানো বোনের
হু হু কান্না-স্রোত, বুকে ওঠে দুলে পলাতক সাল, পথরেখা।
এ-কান্নায় ছায়া আছে, আছে নিশি-পাওয়া আর হৃদয়-কোণের
ঝোড়ো হাওয়া। এ কান্নার কম্পনে চকিতে কী প্রবল নড়ে ওঠে
অস্তিত্বের খাঁচা, অন্তর্গত বুলবুল ভোলে গান। ‘কই শব?’
‘এক্ষুণি কবরে দেবো, এনে দে এনে দে’-বলে এ ক্রন্দন লোটে
ঘরে, পথে-ঘাটে, গোঠে-বুঝিবা কাঁদছে একা আমারই শৈশব।
একটি বিনষ্ট নগরের দিকে
অচেনা জ্যোৎস্নায় বুঝি এসে গেছি। চতুর্দিকে ঘোড়ার কঙ্কাল
ঝুলে আছে, দরজায় দরজায় ঊর্ণাজাল; এখানে-সেখানে
বিষণ্ন কাদার মূর্তি এলোমেলো, অসংখ্য বাতিল ট্রাকে, বাসে
এলাহি বল্মীক আর রাশি রাশি উজাড় বোতল সবখানে।
হে পুরুষ, হে মহিলা আপনারা কোথায় এখন, কোন্ দূরে?
দশকে চার দিয়ে গুণ করে আমার বয়স আরো কিছু দূর
হেঁটে যায়, কী একাকী পদচিহ্ন পড়ে শহরের পথে পথে
প্রচ্ছন্ন গলিতে।
শহরের সব দুঃখ আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে
গাঁথা; আমি দুঃখের বাইরে চলে যেতে চেয়ে আরো
বেশি গাঢ় দুঃখের ভিতর চলে যাই, যেন কোনো
একা আদি মানবের বেলাশেষে নিজের গুহায়
নিঃশব্দ প্রস্থান।
বারুদমণ্ডিত কাঠিগুলি একে একে পড়ে গেলে দেশলাই
খুব শূন্য থেকে যায়, অনুরূপ শূন্যতায় ভোগে
এ মূক শহর সারাবেলা, ট্রম্বোন দূরের কথা, এমনকি
দিকপ্রিয় পুলিশের বাঁশিও যায় না শোনা কোথাও এখন।
একটি বিনষ্ট নগরের দিকে চেয়ে থাকা কী যে
শিরাবিদারক মুহূর্তের চাপ সয় যাওয়া রুক্ষ
জনশূন্যতায় পথ ফেলে দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন
ঘূর্ণমান পুরনো কাগজ
ল্যাম্পেস্টের নিচে খুব শীতকাতুরে পাখির মতো
পড়ে আছে, গাছগুলি বিধ্বস্ত পাথুরে মূর্তি যেন।
নৈঃশব্দের দীর্ঘ জিভ কেবলি চাটছে বাড়িঘর,
সারি সারি থাম,
যেমন কামুক
তন্ময় লেহন করে মেয়েমানুষের ঊরু। যে-জীবন করিনি যাপন
তারই ছায়া দুলে ওঠে, দুলে ওঠে মহা ব্যালে। কেন মুছে যায়?
নৈঃসঙ্গে বিলুপ্তিবোধ তীব্র হয়, বড়ো তীব্র হয়।
বেসিনে বেসিনে ধুলো পুরু হয়ে জমে নিশিদিন,
রক্তিম আরশোলা ঘোরে মেঝেতে দেয়ালে, ঝাঁক ঝাঁক।
মুরগী রান্না হয়ে পড়ে আছে ঠাণ্ডা রন্ধনশালায়,
খাবার টেবিলে নিঃসঙ্গতা, মেঘের মেরুতে ভাসমান স্মিত
চার্বাকের খুলি!
শুধু একজন কী খেয়ালে দেয়ালের দিকে মুখ রেখে তার
গোসলখানার চৌবাচ্চায় ছিপ ফেলে প্রহরের পর
প্রহর দাঁড়ানো।
বিদঘুটে মরুচারী পাখি দেখি ছাদে ও কার্নিশে, শত শত;
ওদের ক্ষুধার্ত চোখে সিমুমের স্মৃতি আর দীপ্র মরীচিকা।
‘ফুটপাতে কতকাল পড়ে না মানুষী পদচ্ছাপ’ বলে ওরা
শহরের শীর্ষে ওড়ে পাখায় বাজিয়ে অট্রহাসি বারবার।
হঠাৎ অসুস্থ লাগে খুব; তাহলে কি ওরা সব, এলেবেলে
এই শহরের নাগরিকবৃন্দ, মৃত অনুরূপ অসুখেই?