উদ্ভিদ
নিসর্গের সঙ্গে কোনো ঢলাঢলি নেই ইদানীং।
পেতল তামার সঙ্গে, ইট-কাঠ ইত্যাদির সঙ্গে
খুব বেশি মেলামেশা হয়। কর্কশ শিরিষ দিয়ে
প্রত্যহ মসৃণ করি একটি কাঠের বাড়ি, তার
দেয়ালে দেয়ালে চিত্র, নরুনে খুঁচিয়ে তোলা; তবু
আমার ভেতরে এক কেমন উদ্ভিদ বেড়ে যায়
প্রতিদিন চুপিসারে, জিভ নেড়ে নেড়ে অতিশয়
নম্র ভঙ্গিমায় ডাকে। তার কিছু স্বাদ আছে ভেবে
সামাজিক কীটপতঙ্গের দ্রুত চঞ্চলতা বাড়ে।
যেও না তোমরা কেউ উদ্ভিদের কাছে, যত বলি-
তত ভিড় আশেপাশে, কণ্ঠে তুলে নিতে চায়
তীব্র অন্তর্স্রাবী রস। বিবেচনা নেই, কী গরল
সেখানে প্রচ্ছন্ন বয়, ভেবেও দ্যাখে না একবার।
আমি নীল হচ্ছি ক্রমে, দেখছে না তাও; ওরা শুধু
বিশদ কুহকে মজে রসমগ্ন হয়। উদ্ভিদের
আনাচে-কানাচে বহু শতাব্দীর চূর্ণ শোভা আর
কালিঝুল লেগে থাকে, আমি তার ক্ষুধিত ছায়ায়
ক্লান্তি আর উদ্যমের মাঝামাঝি করি বসবাস।
উপসর্গ
এখন শরীরে প্রায়শই অতিরিক্ত তাপ থাকে।
থার্মোমিটারের পাঠ ছাড়াই সহজে বলা যায়,
তাপের এমন মাত্রা আদপেই নয় স্বাভাবিক ।
কেমন অস্বস্তিকর তপ্ত অনুভূতি ত্বকময়
জেগে রয়, স্বপ্নকামী ঘোরে কাটে সারাদিন, চোখে
জ্বালা নিয়ে ঘুরি দিগ্ধিদিক্, কখনও-বা ঝাঁক ঝাঁক
শূন্যচারী হাঁস এই উঠোনে নামবে ভেবে খুব
ব্যগ্র হই, চেয়ে থাকি, অপলক বালকের মতো।
ভুল চিকিৎসায় কাটে কিছুকাল, কখনও-সখনও
অবসন্ন চেতনায় সুস্থতার ক্ষণিক বিভ্রম
ভ্রমরের মতো তোলে গুঞ্জরণ, অথচ আমার
সারা গায়ে অতিরিক্ত তাপ থাকে সারাক্ষণ।
লোকে বলে, রৌদ্রজ্যোৎস্নাময় বাক্য রচনার হেতু
এই তাপ জন্মে আর জিহ্বায় ছড়ায় তিক্ত স্বাদ।
এই নবান্নে
মাছের কাঁটার মতো নক্ষত্র কি খুঁচিয়ে তুলবে ক্ষত আর
কোকিল রটাবে কোনো দুঃসংবাদ? এখন তো সংবাদ মানেই
দুঃসংবাদ প্রতিদিন। শুধু টেলিপ্রিন্টারের রিবনের নিচে
নয়, কবিতার স্তবকেও দুঃসংবাদ ফুটে রয় বাস্তবিক।
হে আমার গিল্টিকরা নকল সোনার বাংলা তুমি ক্ষেতে ক্ষেতে
বুনে যাচ্ছো ড্রাগনের দাঁত, ওষ্ঠে নিচ্ছো তুলে বিষাক্ত শিশির।
হয়ে গ্যাছো অতিশয় দরিদ্র দোকান। বড়ো বেশি দেরি করে
ফেলছো, বস্তুত দ্যাখো প্রকৃত পুরুষ্ট বীজ হচ্ছে পরিণামহীন।
কতো কিছু দেখি চতুষ্পার্শ্বে, দেখি কবরের মাটি ফুঁড়ে হাত,
শত শত, উঠে আসে, দ্যায় ছুড়ে স্বর্ণ থালা; দেখি রাজপথে
এখন একটি রাজহাঁস তার চঞ্চুতে নাচাচ্ছে কী হলুদ
নবান্নের দিন। রাশি রাশি ধান উড়ন্ত গালিচা হয়ে দ্রুত
কুয়াশায় মিশে যায়; প্রতিধ্বনিকে চুম্বন করে ঝাঁক ঝাঁক
পরিযায়ী পাখি, শহরের আনাচে-কানাচে ফেরেশ্তার ভাঙা
ডানা পড়ে থাকে; কত বিষণ্ন করোটি ফুটপাতে, ঝোপেঝাড়
কালোবাজারির বন্ধ গুদামের আশেপাশে লুটায় কেবলি।
যখন ঘুমায় শিশু দোলনায়, আমার হৃদয় নিরিবিলি
পাখির ছায়ার মতো শান্তি নামে; প্রিয়তমা ঘুমায় যখন
স্বপ্নের মেঘের মতো বিছানায় ছড়িয়ে চুলের শস্যরাশি,
আমি সে ঘুমের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বিটোফেনি সঙ্গীতের
মতো ভাসি, অথচ যখন অগণিত অনাহারী নানা রুক্ষ
টানা-হ্যাঁচড়ায় নবান্নের দিনে ক্লান্ত শুয়ে থাকে সংবিধানে
নিঃসাড়, যখন সংখ্যাহীন মৃত শিশু খাদ্যবাহী জাহাজের
দিকে মুখ করে পড়ে থাকে, আমার মগজে জ্বলে মরুভূমি।
একজন কবিঃ তার মৃত্যু
সে নয় ঘরের কেউ, তবু ঘরেই ঘুমন্ত। অতিশয় শীর্ণ
অবয়ব, এলোমেলো দীর্ঘ চুল, গালে দু’দিনের
না-কামানো দাড়ি
এবং শরীর তার নিঃস্পন্দ নিঃসাড়, যেন তারহীন বীণা,
বাজবে না কোনোদিন আর!
দেয়ালের গোয়েন্দা খানিক দেখে তাকে সুদর্শনা
পতঙ্গের দিকে
ধীরে-সুস্থে অগ্রসর হয়। অকস্মাৎ জানালায় ছায়াচ্ছন্ন
বকুলতলার এক সঙ্গীতপ্রবণ পাখি এসে বলে গেলো-
নেই, নেই, নেই।
পুড়ছে আগরবাতি, বিবাগী লোবান। ঘরে নড়ে নানা লোক,
প্রবীণ, নবীন ছায়া পাঁশুটে দেয়ালে।
অনুরাগী কেউ আসে কেউ যায়, দ্যাখে তার সমস্ত শরীরে
উচ্চারিত মৃত্যুর অব্যয় মাতৃভাষা।
আসেন সমালোচক, পেশাদার; বন্ধু কেউ কেউ, জুটে যায়
বেজায় ফেরেববাজ প্রকাশক। অনুরক্ত পাঠক নোয়ায় মাথা আর
বারান্দায় ভিড়ে
বলপয়েন্টে ক্ষিপ্র নিচ্ছে টুকে জীবনীর ভগ্নাংশ নিপুণ
নৈর্ব্যক্তিক স্টাফ রিপোর্টার।
কোন্ সালে জন্ম তার, কী কী গ্রন্থের প্রণেতা, ক’জনই-বা
পুষ্যি রইলো
পড়ে ঘোর অবেলায়, নাকি সে অকৃতদার ইত্যাদি সংবাদ
দ্রুত প্যাডে জমা হয়, তবু
উন্মোচিত জীবনের আড়ালে জীবন খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে যায়।
এইদিন তার নয়, এই রাত্রিও তো নয়, এখন সে শোকাশ্রুর
কেউ নয়, লোবানের নয়, বকুলতলার সেই মুখ্য
সুরেলা পাখিও কেউ নয়। স্বপ্নময় সোনালি রূপালি মাছ
ফিরে যাবে না পেয়ে সংকেত; এখন তো ভাঙাচোরা
তৈজসপত্রের মতো ইতস্তত রয়েছে ছড়ানো তার সাধ, বিফলতা।
প্রজাপতি কোথায় কোথায় বলে বারবার উড়ে যায় দূরে।
ক’জন রমণী আসে উদ্বেলিত বুক আর কান্না নিয়ে চোখে,
কেউ কেউ গোপন প্রেমিকা
হয়তো বা; কারো হাতে ফুল তরতাজা, রাখবে কি দ্বিধাহীন
নিরালা শিয়রে?
কার বুকে শূন্যতার স্বেচ্ছাচারিতা প্রবল হয়, কার ভীরু
সত্তাময় জেগে রয় একটি অব্যক্ত ধ্বনিঃ হে মেধা, হে কাল
পাইনি, পাইনি।
কেউ আসে কেউ যায়, যথারীতি দ্যাখে ঝুঁকে, কী যেন বিহ্বল
খোঁজে তার চোখে-মুখে, নিথর আঙুলে, টেনে নেয় কী উদাস
ধূপের সুগন্ধ বুকে। শূন্যে ঝলসিত পাখসাট,
কখন হঠাৎ এক ঝাঁক হাঁস নামে ঘরে, পুশিদা, সফেদ;
মায়াকাননের শোভা প্রস্ফুটিত চারদিকে, যে আছে ঘুমিয়ে
তাকে ক্রমাগত স্নেহে করাচ্ছে কোমল স্নান সমুদ্রের নীল জল,
পায়ের পাতার কাছে একটি প্রবালদ্বীপ, শালবন, দীর্ঘ
তরুময় পথরেখা, ঝোপঝাড় সমেত খরগোস জেগে ওঠে-
কেউ দেখলো না।
হাতে ফোটে পদ্মকলি, রাশি রাশি, বুকে ঝরে পাপড়ি গোলাপের;
চকিতে হরিণ আনে ডেকে দূরস্মৃতি দিগন্তের, ঠোকে খুর
ঘরের মেঝেতে, নাচে; ঝিরিঝিরি, ঝরনা তার কানে বন্দনামুখর-
কেউ দেখলো না।
পদাবলী উজাড় পথের মতো ঠোঁটে একে একে দ্যায় এঁকে
বিদায়ী চুন্বন।
দৃষ্টির প্রখর দীপ্তি, আনন্দ বিষাদ কিংবা উচ্ছল কৌতুক,
ঈর্ষা, ক্রোধ, অথবা বস্তুর জন্যে কাতরতা, কলহ, বিলাপ
এবং দুর্মর ইচ্ছা আমৃত্যু কবিতা রচনার, রৌদ্র আর
জ্যোৎস্নার ঈষৎ কম্পনের সঙ্গে কথোপকথনে মাঝে মাঝে
অত্যন্ত গভীর মেতে থাকার অভ্যাস নিরিবিলি হৃৎস্পন্দন-সবই তো
ছেড়ে গেছে তাকে একযোগে। শুধু আত্মা তার একটি অদৃশ্য
মালা হয়ে দোলে ঘরে অগোচরে; বকুলতলার পাখি
আবার বসলো এসে জানালায় একা, গানে গানে বলে গেলো-
নেই, নেই, নেই।
ভিড় কৃশ হলে, থেমে গেলে পাঁচমিশালি গুঞ্জন, সুনসান
নীলিমার থেকে এলো নারী কেমন আলাদা।
অলক্ষ্যে সবার
একান্ত নিভৃত
দাঁড়ালো শয্যার পাশে কী সঙ্গীতময় অস্তিত্বের তেজে ঋজু,
একাকিনী; অদৃশ্য সে মালা তার গলায় এখন। কিছুক্ষণ
রাখে চোখ শেষ দৃশ্যে, অনন্তর নিলো সে বিদায়; শব্দহীন
পদধ্বনি কোথায় মিলায়।
একটি অনাবশ্যক, স্মৃতিহীন স্বপ্নহীন নিঃসঙ্গ শরীর
পড়ে থাকে
অনেক চোখের নিচে। মনোভূমিপ্লাবী অলৌকিক
জ্যোৎস্না বলে, যাই।