যমজ আলো
অমন যমজ আলো মিলে যাবে তারাস্রোতে? নাকি
নাছোড় থাকবে লেগে দেয়ালে, ল্যাম্পোস্টে সারাক্ষণ
অথবা সাইনবোর্ডে নেবে খুঁজে অর্থের স্পন্দন
কোনো শুকনো অন্ধকারে? এই অবেলায় চেয়ে থাকি
যমজ আলোর দিকে বুকে নিয়ে বিপুল বৈশাখী।
পথ চলি পুনরায়; তলোয়ার মাছের মতন
একটি শরীর চোখে ভাসে, আমাকে অনুসরণ
করছে দু’টি চোখ ধুলো-সমুদ্রের, আমি দৃষ্টি ঢাকি।
আমার প্রস্থানরত পিঠ ফুঁড়ে সেই চক্ষুদ্বয়
ছিটকে পড়লো দূরে মার্বেলের মতো। শাদা ভয়
জুড়ে রয় সত্তাময়। মাড়িয়ে যাবো কি যুগ্ম আলো?
যখন চিলেকোঠায় ফিরে রতিমগ্ন, মনে হয়-
শয্যাসঙ্গিনীর দু’টি চোখে কামনার কী ধারালো
পূর্ণিমা; চকিতে তারই চোখে ভিন্ন চোখ, মৃত্যু-কালো।
রুক্ষ বুভুক্ষায়
এখানে কবিতা ঝরে ভোরবেলাকার মৃদু কামিনীর মতো,
‘আমি তো বকুল’ বলে কোনো কোনো কবিতা আবার
শিউলির কাছে চলে যায়। এখানে কবিতা লেখালেখি
চলে অবিরত। কবিত্বের চূড়ায় চূড়ায় ঘোরে বাস্তবতা,
পরাবাস্তবতা; কেউ কেউ উদার অক্ষরবৃত্তে গোলাপের
আকৃতির শোভা ধরে রাখে, কেউবা নির্ভৃত চন্দ্রকলা
দ্যায় পুরে মাত্রামৃত্তে। এবং আমারও পাণ্ডুলিপি স্ফীত হয়,
যেমন জনসভায় ক্রমে জমে লোক। আওড়াই কত শ্লোক।
বিষাদ উৎপন্ন হয় স্তবকে স্তবকে, প্রায় প্রতি প্যারাগ্রাফে
ম্লান টেডিবালকের মতো হাঁটে নিঃসঙ্গ নৈরাশ। কী-যে হয়,
লিখতে গেলেই আজ শব্দে শব্দে লাগে শুধু জান্তব বিশ্বাস,
বাজে কঙ্কালের শুকনো হাড়, ঘন ঘন ত্রঁকেবেঁকে যায় পংক্তি,
অক্ষর বেঢপ হয় বড়ো। শাদা কাগজে স্প্রিংয়ের মতো ক্ষিপ্র
কেবলি লাফিয়ে ওঠে বিষাক্ত উদ্ভিদ। মাঝে মাঝে ভালোবেসে
সুস্নিগ্ধ লোলাপজল দিই কবিতার চোখে, তবু তার চোখে
রক্তজবা লেগে থাকে সারাক্ষণ। কখনও বিলাপ শুনি শুধু।
হঠাৎ শহরে ভাসে জন্তুগন্ধ, তামসিক গুহা থেকে রুক্ষ
বুভুক্ষায় জেগে ওঠে একটি হাভাতে পশু। খাচ্ছে ছিঁড়ে ছিঁড়ে
রবীন্দ্ররচনাবলি, গীতবিতানের সেট, তার অতিশয়
ক্রুর মূঢ় মুখের গহ্বরে পড়ে ক্রমাগত রমণী, পুরুষ,
অত্যন্ত নিষ্পাপ শিশু শত শত। হেলে-দুলে চলে একা,
যেন সে সামন্তরাজ, মগ্ন স্বৈরাচার। তার ক্রুদ্ধ পদধ্বনি,
ক্ষুধিত গর্জন ক্রমান্বয়ে ব্যাপ্ত হয়, গ্রাম ও শহরে জন্মে
হাহাকার। এখন যাবে কি রোখা তাকে, হায় কাব্যের কৃপাণে?
ভয়ে চোখ বুজে থাকে সমস্ত শহর; কখন যে কার পালা,
কে বলবে? লেখার টেবিল ছেড়ে যাই, ফিরে আসি পুনরায়,
কখনও-বা ব্যক্তিগত মশারির ভিতরে লুকাই। যত্রতত্র
ওড়ে হল্কা পশুটার নিশ্বাসের, নিমেষে ঝলসে যায় চোখ
মুখ আর পাঁজর বেরিয়ে পড়ে সবাকার। সব একাকার
বেঢপ পায়ের নিচে তার; পশু অন্য কোনো দিকে চলে যাবে
ভেবে ইতস্তত রাখি চোখ, বস্তুত আশ্বাস খুঁজি চেনা রৌদ্রে,
বিপন্ন প্রতিবেশীর অস্থির দৃষ্টিতে জব্দ, নষ্ট লোকালয়ে।
আমিও মাথার ঘাম মুছে
আতপ চালের মতো রাশি রাশি নক্ষত্রের দিকে ছুটে যাই।
সঞ্জয় কেথায়?
বসে থাকি বন্ধ ঘরে অন্ধের মতন, অস্থিরতা
এলে ব্যেপে করি পায়চারি কখনও-বা, প্রৌঢ় প্রেম
তক্তপোশে তন্দ্রাচ্ছন্ন। কোথায় যে ঘণ্টা স্মৃতিবৎ
কী সোনালি বাজে, শুনি। যাবো আমি? এখন কোথায়?
বাইরে জীবন তীক্ষ্ণ স্বরে হেঁকে যায় ক্রমাগত
অভ্যাসবশত আমি আমার ঘরেই থাকি একা,
বইয়ের পাতায় চোখ, মাঝে-মাঝে রুক্ষ শীর্ণকায়
সন্তের মতন হয়ে যাই অন্তর্গত বনবাসে।
কখনও হঠাৎ তাপ বেড়ে যায় শরীরে আমার-
বুঝিবা১০৩, ঘরের দেয়াল দেখি
কোথায় গিয়েছে উড়ে, ঘর আর ঘর নয়। আমি
নির্জন প্রান্তরে নতজানু, সূর্য নিচে, বহু নিচে
জ্বলন্ত এসেছে নেমে, চতুর্দিক ধোঁয়াময়, মেঘ
নেই একরত্তি, অকস্মাৎ চোখ ফেরাতেই ফের
ফুলের ডালের মতো কিছু তন্বী হাত ভাসমান,
আমার শরীর ফুঁড়ে কত রাঙা পাখি উড়ে যায়!
জানি না প্রত্যহ কী-যে ঘটে রাত্রিদিন আজকাল
আমার এ চার দেয়ালের বাইরে, হঠাৎ কোনো
শব্দ এসে আমাকে ঠোকর মারে, আজ কে আমাকে
বলে দেবে কোথায় কী হচ্ছে, কারা অস্ত্রে দিচ্ছে শান,
কারা মিত্র সেজে শক্রতায় মাতে, বকুলতলায়
শোওয়ায় কবন্ধ লাশ? কে আমাকে বলে দেবে দূরে
অত কোলাহল কেন? সঞ্জয় সে-ও তো নেই কাছে,
হয়তো মিলে গেছে ঐ ভিড়ে, তারও গলা সেখানেই।
স্পর্শ
বাড়িয়ে দু’বাহু বারে বারে তোমার দিকেই যাই
স্বপ্নচালিতের মতো, সম্মুখে দাঁড়াই,
দেখি আশ্চর্যের অক্ষরেই স্মিত লেখা
তোমার শরীর প্রতিবার, যদিও প্রত্যহ এই দেখা।
যেন ঐ হাত, গাল, ঠোঁট, জানু, সুহাস চিবুক,
সুগোল স্পন্দিত বুক
ছুঁলেই তোমাকে পাবো, তুমি
হৃদয়ের ভূমি
সৌরভে ভরিয়ে দেবে, ফলাবে ফসল থরে থরে।
স্বপ্নের রঙের মতো মুহূর্তের অভ্যন্তরে এই জীর্ণ ঘরে
শবে-বরাতের আলো দেখবো এবং স্বয়ম্বরা ফুলে ফুলে
যাবে ছেয়ে ব্যর্থ প্রেমিকার মতো রিক্ত মেঝে, তোমাকেই ছুঁলে।
একজন উন্মাদকে যে-হাতের ভেতর লালন করি আর
যে-ঠোটে সংযত রাখি একজন মাতালকে, সকল চিৎকার
অন্তরালে পুষি শিরাপুঞ্জে যে-বুকের, তারা ঠিক
পাল্টে যায় নিমেষেই তোমার সান্নিধ্যে, কী বেল্লিক!
লিখেছি তোমার হাতে স্পর্শাক্ষর, বুকে মাথা,
তোমার পায়ের দু’টি পাতা
হেসে কুটি কুটি এই আমার পদাঙ্গুলের ছোঁয়ায়, তোমাকে
শেকড়-বাকড়ে বাঁধি অস্তিত্বের, আলিঙ্গনে বুভুক্ষু সত্তাকে
মিশিয়ে তোমার দিকে চাই,
তবু বুকে মরু, গলে যাও তুমি, মিলে যাও-
কোথায় উধাও,
এ খর শরীরব্যাপী স্পর্শে কী তোমার পাই?
এ জন্যেই সবখানে যে-নেই কেমন ভাসে, তারই শূন্য অন্তহীন
পেছনে পেছনে করি ধাওয়া
যোগাযোগহীন রাত্রিদিন
বুকে নিয়ে আর্তি- প্রাণপ্লাবী হাওয়া বয়, শুধু হাওয়া।