যখন আবহাওয়া খারাপ
হাওয়ায় সে নয় আর, এখন তো বিশ্বাসঘাতক ক্ষুরধার
হাওয়া সারাক্ষণ শাঁ শাঁ বয়। তার ওড়ার দুর্বার
ইচ্ছা চোখ বুজে থাকে নিষ্ক্রিয় ডানায়; বৃষ্টি শলাকা,
ঝাঁক ঝাঁক, করেছে এমন কোণঠাসা তাকে, এখানেই ঢাকা
বস্তুত থাকতে হবে ডালে,
জবজবে পাতার আড়ালে।
নিজস্ব আকাশ মুছে যাবে? ধুন্ধুমার যুদ্ধক্ষেত্রের মতন
থাকবে সর্বদা পরিবেশ? বাসনার রঙধনু যতক্ষণ
আবার না জ্বলে ওঠে সে আর সে নয়। পারলে হাওয়ার ঝাঁটি
নিমেষেই কাটতো সেই ইস্পাতের মতো নখে কুটি কুটি।
কী ভীষণ বোকা আর উদ্যমরহিত তাকে লাগছে এখন,
যেন সে একটি চোখ, ভেজা, ড্যাবড্যাবে। প্রেতায়িত ঘন বন
ব্যাপ্ত শহরের রুক্ষ বুকে; ভাবে, যে-পানি তৃষ্ণিত প্রাণে আনে
সুস্নিগ্ধ উচ্ছাস, তারই এত হুল? দুঃখ দিতে জানে
জলধারা; অন্ধকার আসে ব্যেপে, বৃষ্টি অবিরল,
সে কি হলো দৃষ্টিহারা? দেখবে না কখনও কিছুই আর? একা, হীনবল
এখানে থাকবে পড়ে সর্বক্ষণ পরিণামহীন? আধঘন্টা হবে-
এরই মধ্যে ভুলে গেলে ওড়া? কে ছড়ালো কালি ডানার গৌরবে?
নাস্তির ডমরু শুনে এখনই এ দ্বিপ্রহরে পঙ্গু হলে ডানা,
অস্তাচলে যাবে স্বপ্ন, নীলিমার অনেক সীমানা,
কে জানে কী শোভাময়তায়, রইবে আগোচরে, স্পর্শাতীত। অন্ত
নেই অতৃপ্তির, অন্ধ গুহাতেও পুশিদা রোদ্দুর চায় সন্ত!
মনের ভেতর তার আর্তি আর ভীতির উদ্যান-
সঙ্কুচিত অস্তিত্বে অকাল শীত দিয়েছে কামড়, খুব ধ্যান
করেও দ্যাখে না কোনোখানে ফসলের কোনো শীষ,
কখনও আসে না ভেসে এ তল্লাটে উর্মিল মধুর বুনো শিস্;
তা’হলে পাখিরা মৃত সব? এখন তো ফুল শুধু
পাথরের বোন, যতদূর দৃষ্টি যায় শূন্যতায় কাঁপে, ধু ধু;
দিগন্তে দিগন্তে দ্রুত ছেয়ে যায় ছত্রাকের দল; এলো এ কেমন কাল?
চতুষ্পার্শ্বে লভ্য নয় কোনো কিছু, এমনকি স্মৃতিরও আকাল।
চকিতে আবার বয় হাওয়া ভিন্নতর, বিকশিত স্মিত রোদ
মাটিতে আকাশে ডালে ডালে, সে নির্ভার ওড়ে, কী স্বচ্ছন্দ বোধ
এখন সত্তায় তার, কী প্রত্যাবর্তন! পারবে যথেচ্ছ যেতে
এখন সে সহজেই, কুড়াবে সপ্রাণ শস্য নীলিমার ক্ষেতে।
যদি তুমি ফিরে না আসো
তুমি আমাকে ভুলে যাবে, আমি ভাবতেই পারি না।
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি
আছো এই সংসারে, হাঁটছো বারান্দায়, মুখ দেখছো
আয়নায়, আঙুলে জড়াচ্ছো চুল, দেখছো
তোমার
সিথিঁ দিয়ে বেরিয়ে গেছে অন্তহীন উদ্যানের পথ, দেখছো
তোমার হাতের তালুতে ঝলমল করছে রূপালি শহর,
আমাকে মন থেকে মুছে ফেলে
তুমি অস্তিত্বের ভূভাগে ফোটাচ্ছো ফুল,
আমি ভাবতেই পারি না।
যখনই ভাবি, হঠাৎ কোনো একদিন তুমি
আমাকে ভুলে যেতে পারো,
যেমন ভুলে গেছো অনেকদিন আগে পড়া
কোনো উপন্যাস, তখন ভয়
কালো কামিজ পরে হাজির হয় আমার সামনে,
পায়চারি করে ঘন ঘন মগজের মেঝেতে,
তখন
একটা বুনো ঘোড়া খুরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে
আর আমার আর্তনাদ ঘুরপাক খেতে খেতে
অবসন্ন হয়ে নিশ্চুপ এক সময়, যেমন
ভ্রষ্ট পথিকের চিৎকার হারিয়ে যায় বিশাল মরুভূমিতে।
বিদায় বেলার সাঁঝটাঝ আমি মানি না,
আমি চাই ফিরে এসো তুমি স্মৃতির প্রান্তর
পেরিয়ে
শাড়ির ঢেউ তুলে, সব অশ্লীল চিৎকার, সব বর্বর
বচসা স্তব্ধ করে দিয়ে ফিরে এসো তুমি,
ফিরে এসো স্বপ্নের মতো চিলেকোঠায়,
মিশে যাও আমার হৃৎস্পন্দনে।
কোথায় আমাদের সেই অনুচ্চারিত অঙ্গীকার?
কোথায় সেই অঙ্গীকার
যা রচিত হয়েছিলো চোখের বিদ্যুতের বর্ণমালায়?
আমরা কি সেই অঙ্গীকারে দিইনি ত্রঁটে
আমাদের চুম্বনের সীলমোহর?
আমি ভাবতেই পারি না সেই পবিত্র দলিল ধুলোয় লুটিয়ে
দুপায় মাড়িয়ে, পেছনে একটা চোরাবালি রেখে
তুমি চলে যাবে স্তব্ধতার গলায় দীর্ঘশ্বাস পুরে।
আমার চোখ মধ্যদিনের পাখির মতো ডেকে বলছে-তুমি এসো,
আমার হাত কাতর ভায়োলিন হয়ে ডাকছে- তুমি এসো,
আমার ঠোঁট তৃষ্ণার্ত তটরেখার মতো ডাকছে-তুমি এসো।
যদি তুমি ফিরে না আসো
গীতবিতানের শব্দমালা মরুচারী পাখির মতো
কর্কশ পাখসাটে মিলিয়ে যাবে শূন্যে,
আর্ট গ্যালারির প্রতিটি চিত্রের জায়গায় জুড়ে থাকবে
হা-হা শূন্যতা,
ভাস্করের প্রতিটি মূর্তি পুনরায় হয়ে যাবে কেবলি পাথর,
সবগুলো সেতার, সরোদ, গিটার, বেহালা
শুধু স্তূপ স্তূপ কাষ্ঠখণ্ড হয়ে পড়ে থাকবে এক কোণে।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
গরুর ওলান থেকে উধাও হবে দুধের ধারা,
প্রত্যেকটি রাজহাঁসের সবগুলো পালক ঝরে যাবে,
পদ্মায় একটি মেয়ে-ইলিশও আর ছাড়বে না ডিম।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ত্রাণ তহবিলে একটি কানাকড়িও জমা হবে না,
বেবি ফুডের প্রত্যেকটি কৌটোয় গুঁড়ো দুধ নয়
কিলবিল করবে শুধু পোকামাকড়।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
দেশের প্রত্যেক চিত্রকর বর্ণের অলৌকিক ব্যাকরণ
ভুল মেরে বসে থাকবেন, প্রত্যেক কবির খাতায়
কবিতার পংক্তির বদলে পড়ে থাকবে রাশি রাশি মরা মাছি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
এ দেশের প্রতিটি বালিকা
থুত্থুড়ে বুড়ি হয়ে যাবে এক পলকে,
এ দেশের প্রত্যেকটি যুবক মৃত্যুর মাত্রায়
ঘুমের বড়ি কিংবা গলায় দেবে দড়ি।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
ভোরের শীতার্ত হাওয়ায় কান্না-পাওয়া চোখে নজরুল ইসলাম
হন্তদন্ত হয়ে ফেরি করবেন হরবোলা সংবাদপত্র।
যদি তুমি ফিরে না আসো,
সুজলা বাংলাদেশের প্রতিটি জলাশয় যাবে শুকিয়ে,
সুফলা শস্যশ্যামলা বাংলাদেশের
প্রতিটি শস্যক্ষেত্র পরিণত হবে মরুভূমির বালিয়াড়িতে,
বাংলাদেশের প্রতিটি গাছ হয়ে যাবে পাথরের গাছ
প্রতিটি পাখি মাটির পাখি।