বিবাদ
তুমি সরে যাচ্ছো শেষ দেয়ালের দিকে। চেয়ে দ্যাখো
আর কোনো জায়গা নেই সরে দাঁড়াবার, দ্বিধাহীন
দাঁড়াও আয়নার সামনে- এ ন্যাংটো সত্যকে করো ফেস্।
স্থির হও, খোলো চোখ; এখানে কোথায় আমি বলে
চেঁচিয়ে উঠো না বারবার, আমার অগাধ তৃষ্ণা আর
আমার নিরালা স্বপ্ন কারুকেই দেখছি না বলে
আয়নাকে করো না দোষী, তার সঙ্গে করো না বিবাদ।
এভাবে মানুষ ক্রমে হয়ে যায় নিজেরই অচেনা।
একি তুমি ভেঙে ফেললে বিশ্বস্ত দর্পণ! ঘরময়
দিয়েছো ছিটিয়ে পারদের মতো কবির বিষাদ।
এ বিষাদ পারবে না টাঙাতে কোথাও কোনোদিন,
কোথায় এমন যন্ত্র যার সুরে এ বিষাদ ঠিক
দেবে ধরা? চিরদিন তোমাকেই বয়ে যেতে হবে।
দর্পণের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করার মানে নেই।
ব্যথিত পুরুষ
বড়ো দুঃখে থাকি আমি বড়ো দুঃখে রাত্রিদিন; বিষাদ আমাকে
মুখস্থ করায় বিষণ্নতা বেলা-অবেলায়, সারাক্ষণ পাঠে
কবরের ঘাস নড়ে, কাঁপে গুহার আঁধার, কখনও-বা
সমুদ্রের তল জেগে ওঠে কিংবা দীর্ঘ পথরেখা, জনহীন।
মুহূর্তে মুহূর্তে মরে বুনোহাঁস মগজে আমার, শক্ত হয়;
বড়ো দুঃখে থাকি আমি বড়ো দুঃখে রাত্রিদিন, ভীষণ একাকী।
একজন শীর্ণকায় ব্যথিত পুরুষ তার বুকের ভেতর থেকে পচা
মাখনের মতো জ্যোৎস্না বের করে সাবলীল আমার টেবিলে
সহসা রাখেন জমা। এই উপহার কী কাজে লাগবে ভেবে
আমি তো অন্যমনস্কার ঊর্ণাজালে রইলাম ঝুলে শুধু।
এই উপহারে দুর্বলতা ছিলো, ভালোবাসা ছিলো হয়তোবা,
অথচ হেলায় আমি ফিরিয়ে দিয়েছি তাকে, অকম্পিত তিনি
ব্যর্থ কবিতার মতো মুখ নিচু করে একটি রুমাল ফেলে
কোথায় গেলেন চলে। আমি সেই রুমালের প্রতি কী প্রবল
আকর্ষণ বোধ করি। কেন করি? বুঝি-বা প্রকৃত বস্তু ছেড়ে
শুধু তার চিহ্নের জন্যই বড় বেশি কাতরতা আমাদের।
মনে হয়, নিজেকেই জব্দ করে দিয়েছি ফিরিয়ে উদাসীন,
আমার ভেতরে দেখি অভিমানে পা ঝুলিয়ে রয়েছেন একা
ব্যথিত পুরুষ আর প্রত্যঙ্গসমূহ তার ভেঙে ভেঙে পড়ছে কেবলি।
বড়ো দুঃখে থাকি আমি বড়ো দুঃখে রাত্রিদিন। দুঃখবোধ প্রায়ই
রাখে উপবাসে, পিপাসায় ছুঁই না শীতল জল; তবে কি আমিও
কমলালেবুর মতো শুকিয়ে মরে যাবো অগোচরে?
জরায়ুর অভ্যন্তরে পুরুষের বীজরাশি গ্রহণ করেও
যে-নারী অত্যন্ত বন্ধ্যা, তারই অনুরূপ থাকি আমি
অপেক্ষায় সর্বক্ষণ। কিসের অপেক্ষা তা-ও বুঝি না কখনও।
অস্থিরতা অস্তিত্বের সূত্র টানে, মৃত হাঁসের ওপর থেকে
ছায়া সরে এসে যেন আমাকে জড়াতে চায়, জড়ায় খানিক।
আমার বুকের পাশে ঘুমিয়ে থাকেন গাঢ় ব্যথিত পুরুষ,
চতুর্দিকে আস্তে-সুস্থে বাড়ে উদ্ভিদ, কোমল প্রাণী
কতিপয়; আকালেও তার কানে সুর ঢালে অবাধ্য কোকিল!
ভালো থেকো
ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।
ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা।
ভালো থেকো।
ভালো থেকো চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।
ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।
ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।
ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।
ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।
ভালো থেকো কাক, কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।
ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।
ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।
ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।
ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।
ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,
ভালো থেকো বক, আড়িয়ল বিল,
ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।
ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।
ভয়
সেদিন খুব ভোরে হঠাৎ জেগে দেখি-
বইছে অবিরাম বাইরে তেজি ঝড়।
সংখ্যাহীন প্রেত মেতেছে কান্নায়,
বুঝি-বা যাবে উড়ে আমার কৃশ ঘর।
হুনের মতো হাওয়া বেজায় কর্কশ।
আহত সৈনিক গাছের কত শাখা
মৃত্তিকায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে;
এখন সমীচীন কেবল চুপ থাকা।
আমার নড়বড়ে বন্ধ জানালায়
কে যেন খুব জোরে হঠাৎ দিলো টোকা।
একাকী সত্তায় জাগলো বিস্ময়-
সত্য এলো কেউ? নাকি মনেরই ধোঁকা?
অনেক কাছে শুনি শব্দ কা কা,
তবে কি জানালায় একটি ভীত কাক
ভীষণ ঠোকে তার চঞ্চু বারবার?
বন্য ঝড়ে ডোবে আর্ত কালো ডাক।
এখন ঝড়ে-পড়া নগ্ন কাক একা
দিগ্ধিদিক খোঁজে একটু আশ্রয়।
দরজা দিই খুলে, বাইরে রাখি চোখ;
আসে না তবু ঘরে। আমাকে পায় ভয়?
মৃত্যুর বাড়িতে
মৃত্যুর বাড়িতে ছিলো লোকজন, ছিলে তুমি-
ফিসফাস, আয়াতের সুর লোবানের ঘ্রাণময়
ধোঁয়ার মতন উড়ছিলো খুব পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে,
চাটাই অপেক্ষমান বারান্দায়, নিশ্চুপ বরফ।
দেখি, দরজায় তুমি। তোমার হৃদয় শোকভূমি,
যেন জনহীন দ্বীপ, থেকে গেছে এখানে সময়,
হঠাৎ পাশের ঘরে শিশু ওঠে বিষম চেঁচিয়ে,
দেয়ালে দেয়ালে মৃত্যু লেখে কত অদ্ভত হরফ।
মৃত্যুর বাড়িতে মৃত্যু শুয়েছিলো খাটে কি একাকী।
তোমার চুড়ির শব্দ বাজে, তার খুলি ফুঁড়ে জাগে
রজনীগন্ধার গুচ্ছ, তোমার দৃষ্টির ঝরনা তার
নিঃস্পন্দ শরীরে আনে চাঞ্চল্য বিস্মৃত নগরীর।
মৃত্যুর বাড়িতে আমি তোমার দিকেই চেয়ে থাকি,
শোকের আড়ালে মন কী রহস্যময় অনুরাগে।
প্রেমিকের প্রেতাত্মার মতো একা ঘোরে বারবার
তোমাকেই ঘিরে, গায় গান, মৃত্যু পাথর-বধির।