পরিসংখ্যান
মানুষ যাবে না কেন মানুষের কাছে? দেখা হলে
চায়ের আসরে, পথে, পার্কে কিংবা বিমান বন্দরে
কেন পরস্পর মেলাবে না হাত? মানুষ তো নদী,
গাছপালা, পাখি আর যন্ত্রের নিকট যায় আর
সূর্যাস্তের ছোপলাগা টিলায় দাঁড়ায় মাঝে-মাঝে।
তা’হলে মানুষ কেন ফিরিয়ে রাখবে মুখ শুধু
মানুষের থেকে? কিছু মানবিক ঘ্রাণের জন্যেই
পরস্পর করে মেলামেশা সব বিচ্ছিন্ন মানুষ।
প্রত্যহ ক’জন মানুষের কাছে প্রকৃত পৌঁছুতে
পারি, বলা মুশকিল। তিনজন চোরাকারবারি
সুস্নিগ্ধ ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে হাত কী নিপুণ
বাড়ায় আমার দিকে, চারজন কালোবাজারির
আংটির চমক চোখে দ্যায় জ্বেলে অলীক দেয়ালি,
আমার টেবিলে আনে তড়িঘড়ি চা করে এক খুনি।
প্রতিদ্বন্দ্বী
কী একটা জেগে ওঠে অন্তর্গত গুহায় এবং
বেখেয়াল সবাইকে দিব্যি দারুণ চ্যালেঞ্জ দিয়ে
বসে আছি। গাছ, নদী ফুল, পাখি এবং পাহাড়
সবাইকে হারিয়ে দেয়ার পণ করেছি বস্তুত।
গাছের উদ্দেশে বলি,-কেন তুমি এমন উদ্ধত?
আমিও আমার বুকে রাখি পাতাদের ঝিলিমিলি,
অনেকেরে দিই ছায়া ভালোবেসে, এমন কি ক্রুর,
প্রতিহিংসাপরায়ণ শক্রকেই কখনও সখনও।
নদীর সম্মুখে করি উচ্চারণ নদীর মতোই
কণ্ঠস্বরে- আমিও তো যাচ্ছি বয়ে, আমারও হৃদয়
সরাক্ষণ যায় ভেসে জলে, কখনও প্রশান্ত আমি,
কখনও-বা ফুঁসে উঠে, আমিও সহিষ্ণু অতিশয়।
তাকিয়ে ফুলের দিকে উঠি মেতে স্বগত ভাষণে
কেন তুমি গর্বে ওঠো দুলে ক্ষণে ক্ষণে? দ্যাখো
আমার ভেতর কত গোলাপ, করবী, গন্ধরাজ
ছন্দিত, সতেজ; ওরা ঝরে পড়বে না অবেলায়।
পাখিকে শুনিয়ে বলি,-কেন তুমি গর্বে থরো থরো?
আমার কি নেই গান, ভাবো? আমার সত্তার
অত্যন্ত গভীর থেকে জাগে সুর, প্রাণপ্লাবী সুর।
প্রত্যহ আহত আমি নিজে, তবুও বানাই গান।
অনেক উঁচুতে গিয়ে পাহাড়কে করি শ্রোতা, বলি-
এই দ্যাখো, আমাকেও দ্যাখো তুমি, আমি মাথা নত
করি না কারুর সম্মুখেই। চক্রান্ত কি হামলার
অন্ত নেই, তবু সংশয়ের বাঁকে রয়েছি অটল।
একজন যাকে আমি কখনও দেখিনি, কিন্তু যার
সঙ্গে হতে পারে দেখা যেকোনো মুহূর্তে, সেই
পুশিদা মানুষটিকে মনে মনে বলিনি কিছুই।
তার কাছে, শুধু তার কাছে আমি হেরে যেতে পারি।
ফিরে আয় উত্তরাধিকারী
অমন তাকাতে নেই, তোর এই দৃষ্টির সম্মুখে প্রতিবার
অসহায়, বড়ো অসহায় মনে হয়। কেন প্রহরে প্রহরে
আমাকেই লক্ষ্য করে ছুড়ে দিস একরাশ ভীষণ হিংস্রতা
আদিম ব্যাধের মতো? খোকা তুই বাড়াসনে অতিশয় নোংরা
তীক্ষ্ণ নখ বারবার আমার গলার দিকে, চোখে লাল ছিটে
দিসনে লাগতে ওরে। ঘাতকেরই এমন ধরন, এ ঘাতক দ্রুত
কর্কশ রয়ঙ্ক হচ্ছে তোর অভ্যন্তরে, সরে দাঁড়া, এ বিশদ
ছায়া থেকে ওরে সরে দাঁড়া তুই, চলে যা আড়ালে।
শত বর্ষা, মনে হয়, পারবে না ধুয়ে নিতে অমন হিংস্রতা,
এমন কি তোর জননীও হস্তাবলেপে কি চুম্বনে চুম্বনে
মুখের কঠিন রেখাবলী তোর পারবে না করতে কোমল
কিছুতেই। ফিরে আয়, আমার মিনতি শোন, ওরে ফিরে আয়
পৈশাচী বলয় থেকে পিতৃবক্ষে, মাতৃক্রোড়ে, পড়ার টেবিলে।
প্রত্যহ কিছু না কিছু ভাঙছিস তুই, গ্লাস, প্লেট, চায়ের পেয়ালা,
আলমারির কাচ খুঁটিনাটি কত কিছু, মাঝে-মাঝে
মনে হয়, বুঝি তুই সূর্যোদয় সুর্যাস্তকে ফেলবি গুঁড়িয়ে
কী বিরোধভাসে মজে। হায়, তোর সমান বয়সী
আমার গোপন স্বপ্নটিকে করছিস খান খান। এ কেমন
ভাঙার খেলায় তুই মেতেছিস হে উদাস, হে ক্রুদ্ধ কিশোর?
যখন চিৎকার করে তোর এই আধোয়া শরীর, জীর্ণ ঘর
আমাদের নিমেষেই ভয়ার্ত হরিণ হয়ে যায়, উপদ্রুত,
উল্মুক কৈশোর তোর একা ভাসমান লাভা স্রোতে। আমি চোখ
কেবলি ফিরিয়ে নিই; কোত্থেকে পেলিরে তুই এমন চিৎকার?
একটি খঞ্জর হয়ে, একটি কৃপাণ হয়ে, বর্শা হয়ে আর
ভয়ংকর শর হয়ে কাঁপছিস তুই। ভাবি, যদি তোকে ঐ
গোলাপের অভ্যন্তরে, হরিণীর পেটের ভিতর কিংবা সুস্থ
দূরগামী মেঘে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মন্ত্র জানতাম,
যদি তোকে বাস্তবিক আমার চোখের মণি, আমার হৃৎপিণ্ড
বানিয়ে ফেলতে পারতাম। আমার সকল বেলা কালবেলা হয়ে যায়।
তুই কি পিতৃঘ্ন হবি শেষে? তোর মুখের ভূভাগ থেকে ক্রুর
ছায়া সরে গেলে শূন্যতা ছড়িয়ে থাকে, চোখ থেকে
দজ্জাল লালিমা মুছে গেলে, বুকের ভিতর আমি পুনরায়
কী মধুর প্রত্যাবর্তনের ধ্বনি শুনি, ফিরে আসে ঝাঁক ঝাঁক শাদা হাঁস,
বিরূপ বাগানে জ্বলে ফুলের উল্লাস, সুকোমল শুশ্রূষায়
সতেজ পালক পায়, পায় স্নিগ্ধ রঙ আমার আহত গুপ্ত পাখি।
এত্ত তো ক্ষণিক দৃশ্য। পর মুহূর্তেই তোর দৃষ্টি জ্বলন্ত তীর দেখে
তোর অন্তর্গত ঘাতকের প্রবল দুর্বার জাগরণ দেখে
কেমন বিহ্বল হয়ে যাই। তপ্ত কুয়াশার ঘোরে মনে পড়ে-
একদা আমিও ক্রুর তাকাতাম আমার পিতার
দিকে কখনও সখনও।
হত্যা উঠতো কি নেচে মগজে আমার? বহু দূরে
হয়তো আমার পিতা অবচেতনার ঘনারণ্যে অস্ত্র হাতে
হঠাৎ দিতেন ঝাঁপ তাঁর স্নেহময় জন্মদাতার ওপর।
তাহলে তোর কী অপরাধ? কেন তোকে মিছেমিছি সর্বক্ষণ
ভীষণ অসুস্থ ভাবি? তুই তো বিপজ্জনক এক উত্তরাধিকারী শুধু।
বন্ধুকে বললাম
বন্ধুকে বললাম, তুমি, আমি, তোমরা, ওরা
অথবা সে, বাস্তবিক এসব শব্দের মানে নেই।
তোমাকে যে-নামে ডাকি সে কি তোমার আসল নাম?
ভুলে যাই, বড়ো বেশি ভুলে যাই তোমার কি নাম,
এমন কি কী-যে এই আমার নিজের নাম, কখনও-সখনও
তা-ও ভুলে যাই, দ্যাখো কী অদ্ভুত জগতে আমরা
এত্যহ নিশ্বাস নিচ্ছি সারাক্ষণ। জংধরা তার
আর কেরোসিন কাঠে তৈরি ওরা, মানুষ বটেই,
হাঁটে ফুটপাতে, বসে চায়ের টেবিলে, তাস খেলে,
প্রত্যহ স্যুইচ টেপে এটা-সেটা, মেশিন চালায়
এবং কাগজে লেখে, ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকে ফের
গণক-যন্ত্রের দিকে। দেখছো না দেবতার স্বর্গীয় শরীরও
পুরনো সংবাদপত্রে কেমন বানানো, যেন এক ফুঁয়ে উড়ে
যাবে দূরে, বহু দূরে অলিম্পিক খেলায় কোথাও!
দেখছো না
রাস্তায় রাস্তায় পার্কে, মাঠে-কলোনিতে
দপ্তরে দপ্তরে
আর কারখানায় উন্মাদেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এখন?
হরিণ, সতেজ ঘোড়া, খরগোশ, একরত্তি চড়াই, সবাই
চকিতে ফিরিয়ে নেয় চোখ, এমন কি গাছপালা
বেজায় বিমুখ।
ক্ষুধার্ত অসুস্থ
শিশুর কান্নার মতো কোথাও গিটার বেজে চলে একটানা।
মুখহীন মুখ দেখে পথ চলি, ডানে বাঁয়ে মুখহীন মুখ।
চতুর্দিকে বোতলের জাগছে পাহাড় শাদা, নীল-
সবুজ বোতল,
হলুদ বোতল,
বেগুনি বোতল,
বাদামি বোতল,
কাছে দূরে রাত্রিদিন কোকিলও ডাকছে কোকা-কোলা,
কোকা-কোলা!