তোমার কথাই ঠিক
তোমার কথাই ঠিক আব্বা, তোমার কথাই ঠিক-
আমার সকল বেলা বিফলে গিয়েছে নিশিদিন।
দাঁড়িয়ে রয়েছি একা নিরুপায়, অশ্বেতর আর
গাধার ব্যাপক খুরে হচ্ছে পিষ্ট, হায়, ধ্রুবপদ।
যখন বলতে তুমি, ‘কেন যে ফুজুল দিনরাত
কী ব্যগ্র টেবিলে ঝুঁকে সারি সারি অক্ষর সাজিয়ে
থাকিস বিভোর হয়ে? এই আসমানি সওদায়
কী হাসিল করবিরে পাগলা, ভাবিস? পারবি কি
দুনিয়াকে বদলাতে এতটুকু ?’- আমি ভাবতাম
এ বিশ্বের নব্য প্রতিমার কথা, ভাবতাম কত
উজ্জ্বল তোরণ, স্তম্ভ হবে তৈরি নতুন শৈলীর
এবং সে কারুকর্মে আমিও অভীক শিল্পী এক।
আড়াই দশক আমি কবিতার হাত ধরে হেঁটে
জেনেছি রৌদ্রের দিন, সংখ্যাহীন, বৃষ্টি, দীর্ঘপথ।
আব্বা তুমি নেই, আমি আছি, আছে সেই পৃথিবীটা,
যাকে আমি কোনো দিন বদলাতে পারবো না বলে
তুমি হামেশাই স্পষ্ট করতে উল্লেখ উঠোনের
কৃশ চারাগাছটার ঈষৎ কম্পনে চোখ রেখে।
তোমার কথাই ঠিক আব্বা, তোমার কথাই ঠিক-
আমার সকল বেলা বিফলে গিয়েছে নিশিদিন।
পর্দা ওঠে যথারীতি বার বার, কখনও তুমুল
করতালি যায় শোনা, কখনও বা পড়ে পচা ডিম;
আমি শুধু এক কোণে থাকি পড়ে ভূমিকাবিহীন,
ঘোরলাগা ঘণ্টাধ্বনি শুনি। হাহাকার আমার এ
জীবন-যাত্রার মূল গায়েন বস্তুত; বলবো কি
শেষটায় অখুশি আমি, বলা মুশকিল, কিছু হোক
আর না-ই হোক, কথা বলে অজস্র শব্দের সঙ্গে
নিজস্ব আঁধারে আমি অতিশয় বদলে গিয়েছি।
তোমার সঙ্গে
তোমার সঙ্গে আমি তোমার সঙ্গে আমি আছি কোন্ তন্তুবায় একগাছি
সূতো দিয়ে গেঁথেছেন আমাদের তোমার সঙ্গে আমি আছি কখনও
দূরে কাছাকাছি
কখনও-বা তোমার সঙ্গে আছি উদাহরণত জন্মবধি একটি চোখ অন্য
চোখের সঙ্গে যেমত আছে আমার মুখমণ্ডলে তেমনি তোমার সঙ্গে আছি
তোমার সঙ্গে বরাবর ছুরির ফলা থেকে ধার জ্বলন্ত বাল্ব থেকে আলো
একশিশি আতরের থেকে সুবাস কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো থেকে মার্কস
এঙ্গেলস-এর মেধা চিন্তা মিছিল থেকে স্লোগান বাজারের
অমল ফর্দ থেকে তাবৎ
প্রয়োজনীয়তা জীবন্ত হৃৎপিণ্ড থেকে স্পন্দন যেমন অবিচ্ছেদ্য তেমনি
বিচ্ছিন্ন করা যায় না আমাদের তোমার সঙ্গে তোমার সঙ্গে আছি তোমার
সঙ্গে আছি আমার সঙ্গে তুমি টিয়ে যেমন সবুজ রঙের সঙ্গে মাছ চকচকে
রূপালি আঁশের সঙ্গে যখন তুমি গোলাপের বুক থেকে শিশির তুলে নাও
ফোঁটা ফোঁটা তর্জনীতে তখন যেমন সেই জলজ কণা তোমার আঙুল থেকে
আলাদা করা যায় না তেমনি আমরা দু’জন পরস্পর অবিচ্ছিন্ন
অস্ত্র দিয়ে কাটতে পারো পোড়াতে পারো আগুনে
যা তোমাদের ইচ্ছে খেয়াল-খুশি
তবু
আমরা সঙ্গে আছি সঙ্গে থাকবো সর্বদাই কোনারকের সেই
মূর্তির মতো চুম্বন হয়ে সর্বদায় কালপটে অনন্তকাল
আমাদের এভাবে দেখে লোমচর্ম তর্কবাগীশ
নিমিষে হয়ে যায় রুদ্ধবাক মুর্দাফরাশ
হকচকিয়ে কর্মিষ্ঠ কোদাল দ্যায় ছেড়ে
আমি তোমার সঙ্গে তুমি আমার সঙ্গে পরস্পর আছি যৌবনাবধি
আছি থাকবো নাক্ষত্রিক অন্ধকারে জাগর অন্ধকারে
কোনো মেট্রন কোনো প্রিন্সিপাল কোনো সমাজ খুড়ো
কোনো ডিক্টেটর অথবা পিত্রালয়ের
কোনো ষড়যন্ত্র ছাড়াই
আমরা আবার বিধ্বস্ত সেতুর দুই অংশের মতো হয়ে যাই
আ লা দা
আ লা দা
আ লা দা
আ লা দা
সু দূ র আ র
আ
লা
দা
সু দূ র
আ লা দা
বি ষ ম
আ লা দা
দুঃখ পেতে থাকি
আমি দুঃখ পেলে নক্ষত্রের কিছু এসে যায় না এবং
শালিক চড়ই আর যাবতীয় গাছপালা উদাসীন থাকে।
শহুরে নদীতে পা ডুবিয়ে দেখি তার জলে দুঃখ
ধুয়ে মুছে যায় কি না। অনেক রাত্তিরে ঘরে ফিরি, দুঃখ সঙ্গী
হয়ে বসে থাকে।
ঘরের বেড়ালটার দিকে উৎসুক তাকাই, দেখি তার কটা চোখে
আমার দুঃখের ছায়া পড়ে কি না। আদুরে আওয়াজে নৈঃশব্দকে
দুলিয়ে খানিক
আমার লেখার টেবিলের নিচে নির্বিকার সে ঘুমায় একা
স্বপ্নচ্ছন্ন কবিতার মতো।
ভুলে থাকি বারান্দার অকপট সূর্যাস্তের রঙ,
ভুলে থাকি ওষুধের গন্ধভরা ঘরের দরজা,
ভুলে থাকি পুলিশের বাঁশি আর বন্ধুর ধিক্কার,
ভুলে থাকি সাংস্কৃতিক সভার করুণ কর্মসূচি
ভুলে থাকি মগজের কোষে কবিতার ফিসফাস,
ভুলে থাকি প্রেমিকার আদরিণী বেড়ালের নাম,
ভুলে থাকি ক্যাথলিক চার্চের চূড়ার আর্ত চিল,
ভুলে থাকি নগ্ন পাগলীর হাতে নিষ্প্রাণ মোরগ।
মনে রাখি ফুটপাতে নিঃসঙ্গ বৃষ্টিতে একা ভেজা,
মনে রাখি নৈঃশব্দের সঙ্গে বাতাসের কথা বলা।
হঠাৎ একটি ঘরে ঢুকে দেখি ধোঁয়া আর ত্র্যালকোহলের
ঘ্রাণ ভাসে ঘরময়। ক’জন খেলছে তাস, কেউ কেউ হাতে
গ্লাস নিয়ে আসে কাছে টলতে টলতে, যেন সদ্য
শিখেছে হাঁটতে।
একজন একরাশ ধোঁয়া দ্যায় ছুড়ে আমার বিস্মিত মুখে,
হাসাহাসি চলে কিছুক্ষণ, কেউ কেউ আমার হাতের ত্বকে
সিগ্রেটের ছ্যাঁকা দিতে চায়, চেয়ে থাকি দরজার দিকে, ভাবি-
ক’জন বামন
দেখাচ্ছে কয়েক হাত বেশ।
পারি না বলতে কিছু, যেন ভুলে গেছি মাতৃভাষা। নেরুদার
সেই জলকন্যার মতন
অকস্মাৎ ফিরে আসি স্বকীয় নৈঃসঙ্গে, এলোমেলো পদক্ষেপে
আমার মৃত্যুর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাই, সকলেই যায়।
মধ্যরাতে অন্ধকারে জেগে উঠে ভয় পাই, দুঃখ পেতে থাকি।
ধুলায় ধুলায়, ঘাসে ঘাসে
বাজারে বাজারে ঘুরে বলতাম কথা, নানা কথা।
শুনতো অনেকে, অনেকে আবার অমনোযোগী।
‘সংসারে দেবে কি মন, না কি আজীবন শব্দের পায়রা
উড়িয়ে শুধু ঘুরবে পথেঘাটে?’
আমার মনের গুপ্ত পথে রাখেননি পদযুগ
বেয়াড়া গৃহিণী। কী লাভ কেবল তাকে দোষী করে?
সমাজের হর্তাকর্তা কিংবা শিরোমণি, তারাও সত্যের শাঁস
পায়নি খুঁজে আমার কথায়-তাই তো ওরা
আমার হাতে দিয়েছে বিষপাত্র আর
বলেছে আকণ্ঠ তুমি সত্য শুষে নাও!
ছুতোর হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আমার ভিতরে
অন্যজন দিনরাত্রি নগ্ন পায়ে হাঁটে।
রক্তপিপাসু পাথরে কাঁটায়
বুক পেতে দেয়, বয় ক্রূশকাঠ, সয় পাঁচমিশেলি গঞ্জনা
শহরে ও গ্রামে-গঞ্জে। আমার নিজস্ব বিশ্বাসের
পুরুষ্ট বীজ দারুণ খরায় ক্ষেতে-প্রান্তরে ছড়াতে গিয়ে
হলাম বিরাগভাজন ওদের,
আমাকে করল ক্রুশবিদ্ধ ওরা, আমার রক্তের
স্রোত, দেখলাম, যাচ্ছে বয়ে শতাব্দী শতাব্দী ধরে।
তখনও আমার বাঁচতে পারাটা কঠিন ছিলো না।
আমার ধারণা পাল্টে ফেললেই অথবা চুপচাপ থাকলেই
সহজ হতো বেঁচে-বর্তে থাকা আর প্রমোদে ঢেলে মন
সকল উজ্জ্বল পুঁথি পুড়িয়ে আমিও দীর্ঘজীবী
হতে পারতাম। আমার জ্ঞানের জন্যে আমাকে
ডাইনীর মতো ওরা পুড়িয়ে মেরেছে কী প্রবল ঘৃণায়, আক্রোশে।
মুক্তি শব্দটিকে আমি প্রেমিকের মতো উচ্চারণ
করতাম আর মুক্তি আমার শিরায় শিরায়
বোদলেয়ারের কবিতার মতো উঠতো নেচে মুহূর্তে মুহূর্তে।
কত চোরা পথে বনে জঙ্গলে ছুটেছি আমি
মানুষের মুক্তির জন্যেই।
যখন আম বিশ্ব জুড়ে ফেলেছি মহাছায়া,
তখনই জঙ্গলে আমি নিহত হলাম।
আমার বুকে বুলেট প্রিয় মুক্তি এই শব্দটিকে
লিখে দিলো আরো গাঢ় আরো উজ্জ্বল অক্ষরে।
আমি আর হাতে
নেবো না তুলে বিষপাত্র,
কস্মিনকালেও আর কোনো গলগোথায় যাবো না।
চতুর্দিকে জ্বলুক শত অগ্নিকুণ্ড,
আমি পুড়ে মরবো না।
আমাকে কখনও কেউ আর কোনো কুটিল জঙ্গলে
পারবে না বুলেটের ইস্পাতী বৃষ্টিতে,
ছিন্নভিন্ন করতে।
আমার মুক্তি ধূলায় ধূলায়, ঘাসে ঘাসে।