রুটিন
তাঁকে চেনে না এমন কেউ নেই এ শহরে
তিনি থাকেন
সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় হাঁটেন মোজাইক করা মেঝেতে
বসেন ময়ূর সিঙ্ঘাসনসুলভ পদিমোড়া চেয়ারে
খ্যাতি তাঁর পায়ের কাছে কুকুরের মত
কুঁই কুঁই শব্দে লেজ নাচায়
হলফ করে বলতে পারি আমাদের আগামী
বংশধররা বাধ্যতামূলকভাবে পড়বে তাঁর সচিত্র জীবনী
স্কুল কলেজে সমাজ রাষ্ট্র জগৎসংসার বিষয়ক তাঁর হ্যাণ্ডবুক
সুকান্ত লাইনো টাইপে
প্রকাশিত হবে বছরের পর বছর
আর এওতো অবধারিত যে তাঁর জন্মবার্ষিকী এবং
মৃত্যুবার্ষিকীতে আপামর জনসাধারণ
ভোগ করবেন সরকারি ছুটি
আমাদের এই পঙ্গু দেশ যাতে তিন লাফে এলাহি
পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারে
সেজন্যে রাত জেগে তিনি দেখেন বন্যায় ভেসে যাওয়া
ছাগলের পেটের মত ঢোসকা নিবন্ধ
ফজরে দশ মিনিট নামাজ পড়ার পর তিনি
পনেরো মিনিট তেলাওয়াত করেন কোরান পাক
খুরপি আর ঝারি হাতে
আধঘণ্টা বাগান করেন
দুর্লভ জাতের গোলাপ ফোটানোই তার লক্ষ্য
এক ঘন্টা কাটে তাঁর
ব্রেকফাস্টা করে খবরের কাগজ পড়ে
আর ডেটারজেন্ট সুবাসিত সাফসুতরো বাথরুমে
তিনি দশটা পাঁচটা অফিস করেন নিয়মিত
ক্লাবের টেনিসকোর্টে কাটান ঘণ্টা দেড়েক
ছেলেমেয়েদের আদর করেন পনেরো মিনিট
ঘড়ি ধরে ঘরের বউকে সোহাগ করেন ত্রিশ মিনিট
পরের বউকে নব্বই মিনিট
মাশাল্লা মজবুত তাঁর গাঁথুনি
ইস্পাতি গড়ন অথচ
মাখনের মত নরম তাঁর মন
প্রত্যহ তিনি পরিবগুর্বোদের জন্যে দুঃখ করেন
পাক্বা তিন মিনিট।
লেয়ার্টেস
এই ছিল তবে আমার ভাগ্যে মধ্যদুপুরে
বিনা মেঘে এই বিপুল বজ্রপাত?
পিতা হত আর পিতৃশোকেই ভগ্নী আমার
উন্মাদিনী সে হয়েছে আকস্মৎ।
কত ঝঞ্ঝায় কত যে প্লাবনে কেটেছে আমার
মাতৃস্নেহের ছায়াহীন শৈশব।
বিকৃত শত মুখোশের ঢঙে নাচে অবিরত
অধিবাস্তব নাট্যের কুশীলব।
নাছোড় অশেষ দাবানল জ্বলে শিরায় শিরায়,
হৃদয়ের শত ফুল্কি দুচোখে ওড়ে।
তীক্ষ্ণ অসির সূচিমুখ আমি করছি পরখ,
শক্র কোথায় কোন্ প্রান্তরে ঘোরে?
আমার নিরাহ বয়েসী পিতার লাশ ওরা খুব
তাড়াহুড়ো করে মাটিতে রেখেছে ঢেকে।
রক্তের ঋণ শোধার জন্যে মনে হয় তিনি
আর্ত কণ্ঠে আমাকেই যান ডেকে।
আজীবন শুধু রাজসেবা করে জনক আমার
বার্ধক্যেই হলেন অসির বলি।
জঘন্য এই হত্যা আমাকে দেয় ধিক্কায়,
আমি নিজস্ব ধোঁয়াটে নরকে জ্বলি।
ভগ্নী আমার কালের বৃন্তে স্বর্গ কুসুম,
মেলেছিল তার প্রতিটি পাপড়ি সুখে।
রাজার কুমার কী জানি কেমন বাজালো বেহাগ,
দুঃখ-ফলানো ঢেউ ওঠে তার বুকে।
চৈতি রাতের স্বপ্নে মগ্ন যুবরাজ তাকে
শোনালো ব্যাকুল মদির গুজ্ঞরণ।
সোনালী নদীর মত সেই স্বর শুনে হয়ে গেল
একটি মেলডি তরুণীর তনুমন।
দর্শনঘেঁষা বাক্যবিলালসী বুদ্ধিজীবী সে,
দিশাহারা যেন মননের সংকটে।
ভগ্নী শোনেনি বারণা আমার, রাখেনি মিনতি-
পড়ল জড়িয়ে ঊর্ণার ক্রুর জটে।
কোন্ ইঙ্গিতে অপাপবিদ্ধ তরুণীর প্রতি
কুমার করেছে নিষ্ঠুর আচরণ?
নিশ্বাসে তার পুষ্পপোড়ানো গ্রীষ্মের দাহ,
ভাষায় প্রাকৃত বৃশ্চিক-দংশন।
সারল্য তার পায়নিকো ক্ষমা, মগজের কোষে
অপ্রকৃতি গায় বড় এলোমেলো গান।
তন্বী শরীরে জলচুম্বন, নিখাদ পূররী,
ভুঁইচাপা আর জলবিছুটির ঘ্রাণ!
রাজার বাগানে সাপ তোলে তার চক্কর-আঁকা
ফুটন্ত মাথা; ঘাতক, গুপ্তচর
আশপাশে ঘোরে, করে কানাঘুষো। মারি ও মড়কে
কংকাল হয় কত লোক লস্কর।
দশকে দশকে বাটপাড় আর ঘোড়ল দালাল,
লুটেরার পাল আসে পালটিয়ে রূপ।
ইতরজনের বহ্বারম্ভ সাধু সজ্জন
ভ্যাবাচ্যকা খেয়ে আজ বড় নিশ্চুপ।
কানকখা শুনে মিত্রকা আমি শক্র ভেবেছি,
সত্তা আমার হীন দ্বৈরথে মাতে।
যে-জাল নিজেই বিছিয়েছি ষড়যন্ত্রে ব্যাপক,
অসহায় আমি আটকা পড়েছি তাতে।
জোর যার তার মুলুক সত্য, দুর্ভোগ বাড়ে
গণমানুষের, খরাকবলিত দেশ।
ঘুচাবো দীনতা, এমন সাধ্য নেই একতিল,
আমি নগণ্য ব্যর্থ লেয়ার্টেস।
রাজার কুমার হয়তো পারতো দুর্গ প্রাকারে
জ্বালাতে সূর্য অমাবস্যার রাতে,
কিন্তু এখানে কেবলি শবের ছড়াছড়ি আর
বীর যুবরাজ নিহত আমারই হাতে।
শ্লোগান
হৃদয়ে আমার সাগর দোলার ছন্দ চাই
অশুভের সাথে আপোসবিহীন দ্বন্দ্ব চাই।
এখনো জীবনে মোহন মহান স্বপ্ন চাই
দয়িতাকে ভালোবাসার মতোন লগ্ন চাই।
কবিতায় আমি তারার মতোন শব্দ চাই,
শান্তি এবং কল্যাণময় অব্দ চাই।
মল্লিকা আর শেফালির সাথে চুক্তি চাই,
সর্বপ্রকার কারাগার থেকে মুক্তি চাই।
মুক্তি চাই,
মুক্তি চাই।
হে আমার বাল্যবন্ধুগণ
শোনো তোমরা হে আমার বাল্যবন্ধুগণ-
শোনো আফজাল, তাহের, ফরহাদ, সূর্যকিশোর।
আজ পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
ভাবছি তোমাদের কথা।
আফজাল, আমি জানতাম
সেলুলয়েডে একটা নির্মল কাহিনী রচনার সাধ ছিলো তোমার।
তাহের, তুমি একটা বিরাট সেতু নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে।
ফরহাদ, গ্রাম-থেকে-আনা তোমার গোলাপী রঙের টিনের
স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলো
যাবতীয় চিরকুট, সবুজ শাল আর একটা রাজহাঁস।
সূর্যকিশোর,
প্রতিদিন সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যাওয়াতেই ছিলো তোমার আনন্দ।
আফজাল, তোমার সেই সেলুলয়েডী সাধ, যদ্দূর জানি,
পূর্ণ হয়নি। এইতো সেদিন আমরা কতিপয় শোকার্ত মানুষ
গোলাপজল আর লোবানের ঘ্রাণময় হাতে
তোমাকে শুইয়ে দিলাম মাটির নিচে, যেখানে
কাঁকড়াবিছে আর পোকামাকড়ের ঘনিষ্ঠ গেরস্থালি।
প্রতিবাদহীন তুমি ছিলে অসম্ভব নিশ্চুপ, অথবা শার্টের কলারে
কিং জ্যাকেটের আস্তিনে একটা পিঁপড়ে
অথবা, কাঁচপোকা আনাগোনা করলে তুমি
মাথাখারাপ-করা অস্বস্তিতে ভুগতে, টোকা মেরে উড়িয়ে দিতে
তৎক্ষণাৎ। মনে পড়ে, আফজাল তোমার সঙ্গে দেখেছিলাম
জীবনের প্রথম জোনাকি আর তোমার স্মৃতি এখন জোনাকি।
তাহের তুমি সেতু তৈরির স্বপ্ন খারিজ করে
বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে একদিন পাড়ি জমালে সুদূর বিদেশে।
তুমি আজ ফেঁসে গিয়েছো ভিনদেশী এক শহরে, ডিপার্টমেন্টাল
স্টোরের ঝলমলে করিডোরে, ব্যাংক ত্র্যাকাউন্টের ঝকমকিতে,
চকচকে এস্কেলেটারে।
ফরহাদ, তোমার সেই ‘এলাহি ভরসা’ খচিত
গোলাপী রঙের টিনের স্যুটকেস থেকে বেরিয়ে-পড়া রাজহাঁস
গ্রামীণ তেজারতির অন্ধকার গুদামে দম আটকে
মারা গ্যাছে। তুমি চটজলদি
তাকে দাফন করেছো জামতলায় হল্দে পাতার নিচে।
সূর্যকিশোর; সেই যে তুমি হাঙ্গামায় বেচারামের
দেউড়ির বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে গেলে
সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে, তারপর তোমার কোনো খোঁজখবর
আমি পাইনি। তুমি কি পশ্চমবঙ্গের রাইটার্স বিল্ডিং এ
কলম পিষছো? নিত্যদিন মিশছো চৌরঙ্গীর ভিড়ে ? নাকি
ডেলি প্যাসেজ্ঞারি করছো মফস্বলী ট্রেনে?
সূর্যকিশোর, তুমি কি আজ খুচরো যন্ত্রাংশের কারবারি?
তুমি কি ধিকিয়ে-ধিকিয়ে-চলা খবর কাগজের
সংবাদ-শিকারি? তুমি কি ফাটকা বাজারে ঘোরো নিত্যদিন?
সূর্যকিশোর, হে বন্ধু আমার, তুমি এখনো
সূর্যাস্তের দিকে হেঁটে যেতে ভালোবাসো প্রত্যহ?
ইতিহাসের চেল্লাচিল্লি আর রাজনীতির হৈ-হল্লায়
তুমি বেঁচে আছো কিনা, আমি তা জানি না সূর্যকিশোর।
শোনো তোমরা শোনো, হে আমার বাল্যবন্ধুগণ,
পঞ্চাশের ডান দিকে বসে
আমি ভাবছি তোমাদের
এবং ভাবছি আমার নিজের কথা।
একদা সুকান্তের মতো গালে হাত দিয়ে
পুরোদস্তুর কবির কায়দায়
একটা ফটো তুলেছিলাম,
উই-খাওয়া সেই ফটো আজ
কোথায় হারিয়ে গ্যাছে। তোমাদের অলক্ষ্যে
কী রহস্যময় সখ্যে
অক্ষরের পরী ভর করেছিলো আমার ওপর। এখনো
গায়ে-কাটা-দেওয়া প্রহরে প্রহরে
আমার নিভৃত ঘরে, পথে-বিপথে তার
অনির্দিষ্ট আনাগোনা।
শোনো তোমরা শোনো, হে বাল্যবন্ধুরা আমার, শোনো
আমার ঘরে নিমেষে বস্তুময়তার উপরিতলে পিছলে
অনেক রঙিন মাছ এসে যায়, সাঁতার কাটে, এসে যায়
জলাভূমির ধারে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের
হাড়গোড়ের সারে মজ্ঞরিত লক্ষ লক্ষ টাটকা গোলাপ।