পারিবারিক ত্র্যালবাম
এক মধ্যরাতে আমার পারিবারিক ত্র্যালবামের
গান শুনে জেগে উঠলাম
পুরোনো দিনের গানে নীলাম্বরী শাড়ির মন-কেমন-করা
ঝলসানি মেশকে আম্বরের ঘ্রাণ
হেমন্তের উদোম বিকেলে নববধূর চাউনি
আলবোলার ধোঁয়াটে গুড় গুড় ধ্বনি
আগদুয়ারে আতিথেয়তা খিড়কি পুকুরের
লাজনম্র সজলতা চিলেকোঠার নির্জনতা
সে গান নিয়ে যায় আমাকে ছায়াতুর এক পথে
হলদে পাতার ওপর বিছানো ডোরাকাটা
শতরজ্ঞির প্রতি টিফিন ক্যারিয়ার আর ফলমূলের প্রতি
কয়কটি কমলালেবু গড়াতে গড়াতে আসে
ডুবে যায় কবরখানার দবিজ ঘাসে
সে গান নিয়ে যায় আমাকে দূর
সমুদ্রতীরে ভেজা বালিতে পদচ্ছাপ দেখায়
দেখায় মুখচ্ছবির পেছনে সূর্যাস্ত
আমার পারিবারিক ত্র্যালবাম জলকন্যার মতো গান গায়
ঘুমায় তারা আর গুল্মময় স্বপ্নের ভেতরে কখনোবা
থমকে দাঁড়ায় প্রবাল সিঁড়ির ধাপে
সুদূর গ্রামের পোড়াবাড়িকে জানায় অভিবাদন
আমার কল্পনার গা চটে আস্তে সুস্থে
আমার অস্তিত্ব স্বপ্নের পাখির মতো
উড়ে যেতে চায় তার কাগুজ ঠোঁটে চূমো খেয়ে
বুকে জড়িয়ে ধরে।
শাদা কথায় বললে দাঁড়ায়
আমার পারিবারিক ত্র্যালবাম এক ঐন্দ্রজালিক যে
দেখাচ্ছে তার মোহসঞ্চারী বিরতিহীন খেলা
কাঠের পিঁড়িতে বসে বটিতে সবুজ কুমড়ো
কাটছেন আমার মা গ্রীনবোটে আব্বা বাবা আমার
তাঁর গায়ে ওভারকোট দূর আকাশে হংসমিথুন
আর আবছা রূপোলি মটরশুঁটির মতো
একটি কি দুটি তারা প্রধান মাঝি হাল ধরেছে উজানে
বার্থ ডে কেকে ছুরি চালাচ্ছে আমার সাত বছরের কন্যা
আমার নেই-যে পুত্র তার কপালে ব্যাণ্ডেজ ঠোঁটে হাসি
বর্ষার পানিতে সয়লাব উঠোনে সাঁতার কাটছে
যুগল হাঁস একটি গ্যাছে নেউলের পেটে
কয়কটা শাদা লাল কালো মুরগি চরে উঠোনে
এখন ওরা গরহাজির
আমার একজন সুদর্শন তরুণ স্বজন চেয়ে থাকে নিষ্পলক যে
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফেরেনি
আমি পারিবারিক ত্র্যালবামটির সঙ্গে ক্রমাগত
এমন আচরণ করি যেন সে যক্ষের ধন
কখনো তার ভেতরে বিধবার ধবধবে শাড়ির
মতো দুপুর কখনো অগাধ জ্যোৎস্না বিস্তার
কখনো তার ভেতর থেকে ভেসে আসে আকর্ণ হাসি
কখনো ডুকরে ওঠে কান্না
সেখানে কখনো ঈদের পোশাকের ঝলমলে উচ্ছ্বাস
কখনোবা কবরের বাতির ব্যথিত কম্পন।
প্রলয়ান্তে
কংক্রীট বনে ঘেমো জনস্রোতে বলো
তোমাকে কোথায় কোন্ ঠিকানায় খুঁজি?
কবন্ধ এই শহরে সন্ধ্যা হলো,
এদিকে ফুরায় বয়সের ক্ষীণ পুঁজি।
সেই কবে থেকে চলেছে অন্বেষণ।
ক্লান্তি আমার শরীরে সখ্য গড়ে,
তোমার গহন ঊর্মিল যৌবন
আনে আশ্বন এখনো বন্ধ ঘরে।
মনে পড়ে যায় শরীরে তোমার নাচে
খর বর্ষার তন্বী পাহাড়ি নদী।
তোমারই চুলের নিভৃত ছায়ার কাছে
চাই আমি চাই আশ্রয় নিরবধি।
দেয়ালের লেখা আমিও করেছি পাঠ-
জুটবে ভাগ্যে উপেক্ষা অবশেষ।
সাক্ষী এ নদী, সোনা-ওগরানো মাঠ,
খুঁজেছি স্বর্গ তোমাকেই ভালবেসে।
নশ্বরতার প্রতাপ জেনেও আমি
করি সঞ্চয় স্বপ্নফলানো স্মৃতি,
তোমারই ছায়ার আজো আমি অনুগামী,
যদিও হারানো জানি জাগতিক রীতি।
ভেবেছি ক্রমশ বিস্মরণের লেকে
তুমি ডুবে গেলে হবে না কিছুই ক্ষতি,
কিন্তু তোমার স্মৃতির পীড়ন থেকে
আমৃত্যু নেই আমার অব্যাহতি।
বিরোধী কালের জতুগৃহে করে বাস
সত্তা আমার ভস্মে গিয়েছে ঢেকে;
মেলে না কোথাও এক কণা আশ্বাস,
রজ্জুও নেই সর্পের ব্যতিরেকে।
ধ্বংস বাজায় চৌদিকে তার ঢাক,
কোথায় নিলালো তোমার পায়ের রেখা?
বিপাকে লুপ্ত আমার ব্যাকুল ডাক,
প্রলয়ান্তে ও পাবো কি তোমার দেখা?
ফাটলসর্বস্ব এক দালান
আমার চাদ্দিকে হায়েনার
হাসির মতন
অজস্র ফাটল আজ আমাকে ভীষণ
শাসন করছে, মনে হয়। মনে হয় কথাটা খামোকা বেশি
বলা হল; কবিতায় এ রকম বাড়তি কথার
ঠাঁই নেই, থাকা অনুচিত। বরং বললেই হতো
প্রকৃতই আমি ভয়ানক ফাটলসর্বস্ব এক
দালানের পুরোনো বাসিন্দা আশৈশব।
আমার নিকট থেকে একে একে অনেকেই ক্রমাগত দূরে
সরে যাচ্ছ সম্প্রতি, যেমন
ঝড়-বাদলের গন্ধ পেয়ে হুঁশিয়ার
পিঁপড়েরা গা-ঢাকা দেয় সাত তাড়াতাড়ি
বলা নেই, কওয়া নেই, এই যে হঠাৎ
সটকে পড়ল যারা, ধ্যেৎ,
সুহৃদ অথবা
আত্মীয়স্বজনদের বিষয়ে সটকে পড়া এই ক্রিয়াপদ
ব্যবহার করা আদপেই সমীচীন নয়। তাঁরা
বেহদ্দ গর্হিত কাজ করেছে, একথা
কস্মিনকালেও আমি বলব না। কেউ
ফাটলসর্বস্ব দালানের পতনের রূঢ় শব্দ
শোনার আশায়
শেষ অব্দি অপেক্ষা করে না।
অথচ সেদিনও
এক সঙ্গে গুলজার করেছি নরক,
পুরোনো সড়ক বেয়ে হেঁটে
গিয়েছি সকালে
অথবা বিকেলবেলা। সন্ধ্যায় খেলেছি দাবা, একই
টেবিলে খেয়েছি আর কখনো সখনো
দিয়েছি চুমুক গ্লাসে মস্তির ঝালরে ঝলসিত,
প্রত্যহ নিবিট হ্যাণ্ডশেক আর দু’বার দু’ঈদে
অন্তত করেছি কোলাকুলি খুব গোলাপী আহলাদে।
অজস্র ফাটলময় দেয়ালে খিলানে চেয়ে থাকি
নিষ্পলক যখন তখন,
যেন করি পাঠ অতিশয় মনোযোগে
আমার নিজস্ব ভাগ্যলিপি। মাঝে মাঝে
মধ্যেরাতে ঘুরি দালানের
আনাচে কানাচে, তারপর ভয় নিয়ে শুতে যাই,
ভয় নিয়ে জেগে উঠি প্রত্যহ আবার।
লোকটা উটকো বড় আজব ছিটেল,
বলে কেউ; কেউ বা বানায়
গল্প কিছু লতাপতাসমেত বস্তুত-
এই দালানের নিচে নাকি
আছে সুপ্রাচীন গুপ্তধন, আমি যক্ষের মতন সর্বক্ষণ
রেখেছি নজর তাতে। নইলে এইমতো
বিপদ মাথায় নিয়ে কেউ কি এখানে করে বাস?
সুদূর নীলিমা থেকে ঢ্যাঙা পোস্টম্যান অকস্মাৎ
নেমে আসে এবং আমার
হাতে গুঁজে দেয়
সুনীল নোটিশ এক, ভাষা যার অবোধ্য নিছক আর সেই
পোস্টম্যানটিকে কিছু জিজ্ঞেস করার
আগেই সে তার ব্যাগ দোলাতে দোলাতে মেঘদলে
ভাসমান, শাগালের ছবিতে যেমন।
ব্যাপারটা তবে দেখবার মতো। তাই,
নিজের সঙ্গেই আমি বোঝাপড়া করি বহুদিন
এবং নিজের অজান্তেই বারংবার
চমকে তাকাই, কাছে ধারে
সামান্য শব্দ হলেই, ভাবি এই বুঝি
হুড়মুড় করে সব দেয়াল খিলান ঘুণেধরা কড়িকাঠ
পড়ল মাথায়। সত্যিই তো
এই যে এখনো আমি অনেকের নিন্দামন্দ সয়ে
দিনরাত্রি এই ভয়তরাসের মধ্যে আছি, এর
রহস্য কোথায়? কেন আমি এই ফাটলের
সম্মেহন ছেড়ে অন্য কোথোও যাই না? কেন? প্রশ্ন
আপাতত একটাই। উত্তর আমার
জানা নেই; কেননা আমি তো এক নয়,
আমার ভেতরে আছে বহু বহুজন। তাদের কেউই
উত্তর খোঁজার জন্যে আমার মতই গা করে না।