একশ চার ডিগ্রী জ্বর
কে যেন আমাকে মাছে মত তেল ছাড়াই
ভাজছে ভাজছে ভাজছে হঠাৎ
কামারের হাপরের নিচে জ্বলজ্বলে পেটা লোহার কথা
মনে পড়ল আমার
এখন আমি বলা যেতে পারে টগবগে
আগ্নেয়গিরির তাপে ভয়াবহভাবে
ঝলসানো আদিম গুহামানবের মত
আমার ভেতর সেদ্ধ হচ্ছে কিছু বনমুরগী আর রাজহাঁস
আমি আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে
প্রবেশ করেছি এক তন্দুরে
অঙ্গারগুলো তুতেন খামেনের মণিরত্ন হয়ে
নাচছে আমার চতুর্দিকে
বলা নেই কওয়া নেই কোত্থেকে এক সুন্দরী
দাঁড়াল আমার সামনে
তার চুল লাল
চোখ লাল
স্তন লাল
লাল তার ঊরু আর নিতম্ব অগ্নিশিখা তার বগলের চুল
সেই লালচুল সুন্দরী আমার দুচোখে হৃদ্যতাবশত
সামনে ছুঁড়তে থাকে ত্রন্তার জ্বলন্ত রক্তজবা
দেখতে পেলাম সুন্দরীর শুধু একটিমাত্র স্তন এবং
তার সঙ্গী স্তনটি যে জায়গায় থাকার কথা সেখানে
জমাট হয়ে আছে বৃদ্ধার ফোকলা হাসি
অসহ্য উত্তাপের মধ্য থেকে
আমি বিকশিত হচ্ছি আগুন রঙের ফুলের মত
আমার মাথাটা এখন রবারের বেলুন
চিল বালিহাঁস আর ঈগলকে নিচে রেখে দিব্যি
উঠে যাচ্ছে ক্রমাগত উপরে উঠে যাচ্ছে
বেলুনের সুতাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার যোগাড়
এক ঝটকায় ঝরে গেছে আমার বয়স
যেমন খসে পড়ে পুরোনো দালানের চুনবালি
এখন আমি শিশু
বালিশের ফোকরে আটকানো আমার মাথা
ক’দিন ক’রাত্রি ধরে ক্রমাগত কখনো
এপাশ ওপাশ করছি ঝড়ে-পড়া নৌকোর মত
কখনো কতরাচ্ছি একজন রাগী ফেরেশতা
আমাকে ঘন ঘন চাবকাচ্ছে আগুনের চাবুক দিয়ে
ব্যাপক দাবানলে আমার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ছে আমার
অন্তর্গত এক পড়শী
আমার সঙ্গে পুড়ছে প্যারাডিসো হ্যামলেট গীতাজ্ঞলি
ডাস ক্যাপিটাল বনলতা সেন পদ্মনদীর মাঝি
ইয়েটস-এর পত্রাবলি গোলাপসুন্দরী আর
আবদুল করিম খাঁর যমুনাকে তীর
আমার মাথার ভেতরে আলতা বাদুড় চালতা বাদুড়
অসংখ্য বাদুড়ের ডানা ঝাপটানি ঢোসকা মাতালের
পদধ্বনি মস্তানের বিলা আওয়াজ
আমি শুনতে পাচ্ছি সুন্দরবনের চিতাবাঘের অট্রহাসি
প্রসব যন্ত্রণাবিদ্ধ এক নারীর গোলাপী হাসি
আমি শুনতে পাচ্ছি
সেপিয়া রঙের বিবর্ণ ফটোগ্রাফগুলো থেকে বেরিয়ে এসে
আমার চেনা আত্মীয়স্বজন তারস্বরে
আমাকে ডাকতে শুরু করেছে আমি শুনতে পাচ্ছি
আমার আগেকার দিনগুলোর এক দয়িতা আমাকে চটকাচ্ছে
আর আমার গৃহিণীর নির্ঘুম অসহায় হাতে
জ্বরের চার্ট বাতিল শাসনতন্ত্রের মত কম্পমান।
কবিতার প্রতি ঢ্যাম্না
এখন নখরাবাজি ছাড়। লচ্ খাওয়া হয়ে গেছে
অনেক আগেই; সেই কবে থেকে জোমে আছি আর
তোমার জন্যেই আজ আমি এমন উঠাইগিরা।
তোমার অশোক ফুল ফোটা পড়েছে আমার চোখে
বহুবার, বহুবার দেখেছি ঝুল্পি, ছাতি। জিভ
ভ্যাঙচানো; বুলিয়েছি হাত ঝাপে। জোড়-খাওয়া তা-ও
হয়েছে অনেকবার হে চামর খেপ্লু আমার।
আমিতো কপাল ফেরে ভিড়েছি তোমার মারকাটারি
অন্দরখানায়। আচমকা থেমে পড়ি, ফের গোড়া
থেকে করি শুরু আর এক পা এক পা চলি; তুমি
কাছে না থাকলে বলো কী করে হাওয়ায় গেরো বাঁধি?
কেন তুমি মাঝে-মধ্যে খামোকা বাতেলা দিতে চাও?
আন্সান্ কথা রাখ চনমনে মেয়ে যদি তুমি
আমার এ খোমা-বিলা দেখে সবকিছু গুবলিট
করে দিতে যাও, তবে কেন নিয়েছো আমার ছল্লা
ঘন-ঘন কান্কি মেরে? চুস্কি তুমি, সাতঘাটে ঘুরে
ফিরে বেড়ানোই কাজ; স্থিতু হয়ে বসতে পারো না
কোথাও সামান্যক্ষণ। এখন হঠাৎ ঠাণ্ডা পানি
হবে তুমি, তা হবে না। কেননা হেকোরবাজ নই
আমি আজো, যদিও ঢ্যাম্না বলা যায় ইদানীং।
কী জন্যে এই মধ্যরাতে
কী জন্যে এই গ্রীষ্মকাতর অন্ধকারে
মধ্যরাতে জেগে থাকা?
কি জন্যে আজ আকণ্ঠ এক তৃষ্ণা কেবল
বুকের মধ্যে জাগিয়ে রাখা?
মাঝে-মধ্যে বাইরে তাকাই, দূর আকাশে
যায় না দেখা জাগর তারা;
গাছগাছালি নিথর নিঝুম বন্য ঘ্রাণে
পাচ্ছি গতকালের সাড়া।
রাতদুপুরে পড়ছে মনে শীত দুপুরের
একলা শঙ্খচিলের ওড়া,
পড়ছে মনে অনেক আগের সাগর পারের স্বেদ ঝরানো
তেজি তরুণ সফেদ ঘোড়া।
অন্ধকারে মাঠের ভেতর আমরা দু’জন
ছিলাম প্রেমে পুলকিত-
প্রবেশ করে উষ্ণ মাংসে হীরের ছুরি, মদির চাপে
নীল ফোয়ারা উচ্ছুসিত।
রাত্রি আমার চোখে মুখে নিশাস্ ফ্যালে
রমণরত প্রাণীর মতো;
স্মৃতির ঝাঁঝে হঠাৎ আমি হয়ে পড়ি
কেমন যেন অসংযত।
কী জন্যে এই গ্রীষ্মকাতর মধ্যরাতে
আজকে আমি নিদ্রাহারা?
অস্থিরতা পোকার মতো ঘুরছে মনে,
সত্তাজোড়া কিসের তাড়া?
চমকপ্রদ কত কিছুই ঘটে আমার চিত্তপুরে,
নেইকো কোনো লেখাজোখা।
রহস্যময় শব্দবলি জ্বলে নেভে
যেন নিশুত জোনাক পোকা।
আমি কি এই মধ্যরাতে শ্মশানচারী
পদ্য লেখার আকর্ষণে?
ভবিষ্যতের কোন্ দেয়ালি মরীচিকা
দুলিয়ে দিলো দগ্ধ মনে?
কৃষ্ণচূড়া গাছের মতো জ্বলছি একা
চৈতন্যের চৌরাহাতে,
নাম-না জানা তীব্র দহন সইছি কিসের
আবছা মোহন প্রত্যাশাতে?
জাভেদ তোমার কথা
জাভেদ, তোমার কথা বেশ কিছুদিন
ধরে আমি ভাবছি প্রত্যহ। কবে কোন্ সালে কোন্ সে শ্রীহীন
পাড়ায় জন্মেছো তুমি, কী যে নাম
সে বিদ্যালয়ের, ছিমছাম
সেনার কদমছাঁট চুলের মতন ঘাসময় অনুপম
উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যার পড়েছিল তোমার প্রথম
পদচ্ছাপ, কবে বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে
কতিপয় পুস্তকের জ্ঞানগাম্যি চেখে
নিয়েছিলে সডিগ্রী বিদায়, তারপর
জুটিয়ে মাঝারি চাক্রি বে-থা করে বেঁধেছিলে ঘর-
যথারীতি পুত্র কন্যা এনে
বছর বছর, চোখ-বাঁধা বলদের মতো নিত্য ঘানি টেনে
অকালে পাকালে চুল,-এই সব কথা ইতস্তত;
বুঝেছো প্রায়শ ভাবি আজকাল। কত
ঝড়-ঝাপটা, কত যে জাহাজডুবি দেখছো জাভেদ
সচক্ষে, অথচ কোনো নিষ্কুল নির্বেদ
কখনো তোমাকে খুব ভুগিয়েছে বলে
জানা নেই; এড়িয়ে গিয়েছো ঠিক নিঁভাজ কৌশলে।
অনেক ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে
তুমি কি মাঝরিদের চেয়ে
কিছু উঁচূ হতে চেয়েছিল বাড়িয়ে নিজস্ব গলা
নিত্য জিয়াফের মতো? ঊর্ধ্বারোহণের ছলাকলা
অনেকেরই আয়ত্তে সম্প্রতি। ধিক, ধিক
জাভেদ তোমাকে ধিক, তুমি বাস্তবিক
সর্বদা মাঝারি রয়ে গেলে। সেই আপিশের সিঁড়ি
বেয়ে ওঠা ক্রমাগত সপ্তাহে ছ’দিন, আর ভীষণ বিচ্ছিরি
গলিতে প্রত্যহ ফিরে আসা,
সুপ্রাচীন কংকালের মতো অস্থায়ী, ক্ষয়িষ্ণ বাসা
নিয়ে পরিণামহীন ভাবনা এবং দূর স্মৃতি
অপ্রেমের খাটস্থিত কাঁথা মুড়ি দিয়ে যথারীতি
ঘুমানো, আবার জেগে ওঠা ভোর, ছড়া
কাটা সন্তানের সঙ্গে আর জবর খবর পড়া
চা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে, আবার আপিশ,
ঘড়ির শাসন, কালি ছিটানো খাতায় আর কিছু ফিস্ ফিস্,
নিত্যদিন নিষ্প্রভ মাইম
দেখিয়ে জাভেদ তুমি নাছোড় লোলুপ ঊর্ণাজালে
বিপন্ন আটকে পড়ে এই মতো জীবন কাটাল।
যুগপৎ গবেষণা আর তদন্তের ঘোরে
বারংবার বিশ্লেষণ করে
দেখেছি আসলে
তোমার বৈশিষ্ট্য নেই কোনো, তুমি সাধারণ মাঝারির দলে
রয়ে গেলে আজীবন। কোনো স্বপ্ন, কোনো অভিলাষ
আনেনি খ্যাতির ছটা তোমার আঁধারে। দীর্ঘশ্বাস
হয়ে আছো শুধু
অত্যন্ত নেপথ্যে আর মরুর মতন অতি ধু-ধু
জীবনে চলেছো রয়ে চায়ের কাপের স্পষ্ট ফাটলের মতো
কিছু দাগ; জাভেদ যমজ ভাই আমার, সতত
তুমি কোন্ ত্রাসে
পুরাণ পুতুল হলে নড়বড়ে বিপন্ন নিবাসে
জীবনকে ব্যাধি ভেবে নিজেকেই রূঢ় উপহাস
করছো নিয়ত আর দেখছো কেমন
নিস্পৃহ বিবশ ছন্দে লক্ষ লক্ষ জাভেদের পঙক্তিতে আরো একজন
জাভেদ চলেছে মাথা নিচু করে, যেন প্রেতচ্ছায়া,
গন্তব্যের প্রতি উদাসীন, সম্মুখে বিস্তীর্ণ ইন্দ্রধনু মায়া।