আমার কোনো তাড়া নেই
জাভেদ, তোমাকে আমি ডাকছি এই সাতসকালে,
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে,
তুমি শুনতে পাচ্ছ না?
জাভেদ তুমি টইটম্বুর বাসে
বাদুড়ের ধরনে ঝুলে যাচ্ছ।
কী দরকার ছিল এত কষ্ট করার,
পরের বাসে গেলেই তো পারতে!
তোমার কি এতই তাড়া ছিল?
আর ক’টি মিনিট
অপেক্ষা করতে পারলে না।
জাভেদ তুমি কোথায় চলেছ সবুর বিহনে?
জাভেদ, আমি তোমাকে মনে করে
অন্য কাউকে ডাক দিইনিতো? ইদানীং
এ এক দারণ মুশকিল, বুঝেছ জাভেদ,
চট্জলদি একজনের সঙ্গে
আরেকজনের তেমন তফাৎ
খুঁজে পাওয়া যায় না, যেমন ঝানু নিকেরির ঝাঁকায়
একটি মাছকে খুব আলাদা ভাবা যায় না।
আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি জাভেদ,
ঐ চোখ, ঐ কপাল আর ঢেউখেলানো চুল-
কী করে ভুল হবে আমার?
তুমি আমাকে, এই উনিশশো তেরাশির আমাকে
চিনতে পারনি হয়ত।
আমি কি খুব বেশি বদলে গিয়েছি?
নইলে কেন তুমি একটু
থমকে দাঁড়ালে না, করলে না অপেক্ষা? নাকি
চিনতে পেরেও
পড়ি মরি করে বাদুড়ের ধরনে
ঝুলে পড়েছ বাসের হাতলে। জিম্নাসটিকে
এত ভাল তুমি, আমার জানা ছিল না।
যাদের খুব তাড়া থাকে, তারা আশেপাশে
ভাল করে তাকায় না; উপরন্তু
চেনা মানুষকে ওরা অচেনা বানাতে পারে
চোখের পলকে।
জাভেদ, নিমেষের জন্যে তুমি আমাকে চিনতে পেরেছিলে,
মনে হল। তারপর কী যে হল, পাকা অভিনেতার মতো
তুমি আমাকে না চেনার ভান করলে। আমিও সাহস করে
ছুটে যাইনি তোমার দিকে,
পাছে বিব্রত হতে হয় আমাকে।
জাভেদ, আমি তোমার জন্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
অপেক্ষা করে থাকব।
তোমাকে দেখে আমি কারো পা মাড়িয়ে,
কাউকে গুঁতিয়ে অমন ঠেলেঠুলে
চলন্ত বাসে উঠে পড়ব না অথবা
চিনতে পেরেও বেমালুম না চেনার ভান করব না।
আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করার পারব।
আমি অপেক্ষা করতে পারি
একটি গোলাপ কুঁড়ির উন্মীলন দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
পক্ষীশাবকের প্রথম ওড়া দেখার জন্যে,
আমি অপেক্ষা করতে পারি
শিশুর কচি মুখের প্রথম বুলি শোনার জন্যে;
কোনো মুমূর্ষুর চোখের তারার নিভে- যাওয়া দেখার জন্যে,
কবিতার হারানো পংক্তি ফিরে পাওয়ার জন্যে
আমি অপেক্ষা করতে পারি।
আমার নিঃসঙ্গ চঞ্চু
জাভেদ এখন তুমি ভীষণ একাকী
আবেদনপত্রের মতন ঝুলে আছো মেঘের কেশর ধরে
জাভেদ তোমার গলা ফুঁড়ে
বেলফুল ঝরে রাশি রাশি
বুকে
বিশাল চোখের মতো ঘড়ি
জাভেদ কখনো তুমি সর্ষক্ষেতে একজন অশ্বারোহী হয়ে
সবুজ লাগাম হাতে ছুটছো কেবল
ঘোড়ার জ্বলন্ত চোখ রণধ্বস্ত শহরের নিরালা জানালা
পা দগ্ধ মিনার আর গ্রীবা
খয়েরি গীটার
তুমি সেই গীটার আঁকড়ে ধরে অতল পাতালে
যাচ্ছো স্বপ্নবৎ মাছের সন্ধানে নাকি
তার খোঁজে যে একদা কোনো মধ্যরাতে
জলকন্যা হতে চেয়েছিল
জাভেদ নিঃসঙ্গ বন্ধু হে আমার তুমি
ফিরে আসো মুঠো মুঠো হীরে জহরত
মাথায় নীলচে জলচর পাখি আর
শিশ্নে লতাগুল্ম নিয়ে তুমি ফিরে আসো
জলকুমারীর মাছরাঙা স্মৃতি তোমাকে নিয়ত ঠোকরায়
তোমার জামার নাম বিষাদ জাভেদ
ট্রাউজার বিচ্ছিন্নতা গেঞ্জি বিবমিষা
তোমার জুতার ফিতা কখনো কখনো ম্রিয়মাণ
লাউয়ের ডগার মতো ঝুলে থাকে
আকাশে একটি পাখি যেন
উড্ডীন পেরেক
তুমি সে পাখির তীক্ষ্ণ চঞ্চুর উদ্দেশে
অক্ষর ছিটিয়ে খুব নিরাসক্ত চেয়ে থাকো আর
পাখিটির বুকের ভেতর থেকে সজীব পাতার
মতো হাত চকিতে বেরিয়ে আসে তুমি সেই হাত
হাতে নিয়ে শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের
নিঃসঙ্গ চূড়ায়
ঈগলের মতো বসে আছো।
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা
১
লিখি আর না-ই লিখি, প্রতিদিন কবিতার খাতা
খুলে বসি পুনারায়, তাকে
টেবিলে সযত্নে রাখি মঠবাসী সন্ন্যাসীর মতো
ব্যবহারে। কবিতার খাতা, মনে হয়,
দূর অতীতের তাম্রলিপি,
কখনো প্রবাল-দ্বীপ। কবিতার খাতাটির স্মৃতি
নিয়ে একা একা পথ হাটি সারাদিনমান, বেলাশেষে
পৌছে যাই
সে-দেশে, যেখানে আজ হরিণ হরিণ নয় আর,
যেখানে পাখিরা নয় পাখি। তবু আমি
হরিণের বর্ণিল ভঙ্গিমা,
পাখির গানের ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসি, নিয়ে আসি
কবন্ধের হাত থেকে ময়ূর-ময়ূরী।
যাবতীয় অনিন্দ্য গোলাপ, বিদ্যুল্লতাময় মেঘ,
বৃষ্টিভেজা মুখ আর মায়াবৃক্ষসহ
সেসব অর্পণ করি পুণ্যার্থীর মতো
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতাটির বুকে।
২
সুদূর বৃটিশ যুগে পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
রবরবা মুসলিম লীগের আমলে কত কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
বায়ান্নোর রক্তাপ্লুত ভাষা-আন্দোলন থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
ভাসানীর সন্তোষের কুটিরের আর তাঁর পদযাত্রা থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
রাজবন্দিদের নির্যাতিত জ্বলজ্বলে চোখ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
শেখ মুজিবের স্বাধীনতা-ঝলসিত উদ্যত তর্জনী থেকে,
বজ্রমুষ্টি থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
সতত ভূতলবাসী তরুণ সিরাজ সিকদার আর তাঁর
সহযাত্রীদের কাছ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
মুক্তিযোদ্ধা, হুইল চেয়ার আর ক্রাচ থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
জীবনানন্দীয় পাতা থেকে আস্তে সুস্থে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
কমল মজুমদার পাঠ করে চণ্ডালের হাঁড়ি, শ্মশানের
তন্বী সতী, তার বানভেজা স্তন আর
গোলাপ সুন্দরী আর শ্যাম নৌকার নিকট থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
পথিকের মধ্যহ্নভোজন আর ভগ্ন পান্থ নিবাসে কাছ
থেকে কিছু
পিছুটান শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
এবং বৈচিত্র্যময় উপজাতীয় সংস্কৃতি থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
বাথরুমে-রাখা বালতির পানি আর কৈশোরের
নদীটির কাছ থেকে কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
মেয়েদের হস্টেল এবং মাতৃসদনের কাছ থেকে
কিছু শিখে নিই
আমি আর কবিতার খাতা।
স্বপ্নপ্রসূ কম্যুনিস্টো থেকে,
পরাবাস্তবের সূর্যমুখী থেকে কিছু শিখে নেয়
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।
রৌদ্রদগ্ধ শস্যক্ষেতে কৃষকের অবস্থান থেকে,
বিবাহ বাসন আর কবরের বাতি থেকে কিছু শিখে নেয়
আমৃত্যু আমার সঙ্গী কবিতার খাতা।