ভালোবাসর অর্থ
সারা পথে ধুলো ছিল, কাঁটার
শাসন ছিল, কাঁকরের বিরূপতা সইতে
হয়েছে ঢের। জানতাম না পা দুটোকে রক্তাক্ত করে
কায়ক্লেশে এখানে পৌঁছে
দেখতে পাব সরোবরের উদ্ভাসন। এখানে আসার
কথা ছিল না, তবুও এলাম।
সরোবরের টলটলে জলে মুখ রেখে
তৃষ্ণা মেটাই ব্যাধের বিপদে থেকে ছুটে-আসা
বনের প্রাণীর মতো। দূরে তাকিয়ে দেখি,
তুমি দিগন্তের মহিমা থেকে বেরিয়ে আসছো;
তোমার শাড়ির রঙের বিচ্ছুরণ কলাপ মেলে আকাশে,
আমার আকাঙ্ক্ষা সুদূরপ্রসারী।
যখন নত আমি তোমার মুখের উপর,
তুমি রহস্যের ভাস্কর্য।
তোমার স্তনের নগ্নতাকে চুমো খাই যখন, তখন ধানের শীষ
ফোটে গানের গানে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পাখি
শিঁস দেয়, কৃষকের কুটির দুলে ওঠে বসন্ত বাহারের সুরে
এবং ছিপছিপে নৌকো তীর ছেড়ে এগোতে তাকে জল চিরে।
তোমার নাকে ক’ ফোঁটা ঘাম, যেন ভোরের
পাতায় জমে থাকে শিশিরবিন্দু। তোমার নিঃশ্বাসের সুগন্ধ
আমাকে বানায় মাতাল তরণী, অপ্রতিরোধ্য
কামনার হাত চেপে ধরি। কী কথা বলতে গিয়ে বোবার
অস্বস্তি রাখি ঢেকে; বিষণ্ন, রক্তচক্ষু কোকিল
নীরবতা পোহায় নগ্ন পাতার আড়ালে।
আমার হৃদয়ে প্রেম মজুরের কর্মচঞ্চল
রগের মতো দপদপ করে। জীবনের
সঙ্গে আমার গভীর দৃষ্টি বিনিময় হলো,
যখন তোমার মধ্যে দেখলাম পবিত্র অগ্নিশিখা আর
সেই মুহূর্তে তুমি আমাকে এনে দিলে একরাশ পতঙ্গের
ভস্মরাশি, যাতে ভালোবাসার অর্থ বুঝতে ভুল না হয় আমার।
মিনতি
তুমি কি এসেছ ফিরে? তুমিতো জানোই বহুদিন
ধরে আমি নীরেট বধির আর দু’চোখ আমার
জ্যোতিহীন। প্রত্যহ কে এক পাখির সুরের আড়ালে
বলে যায়, ধৈর্য ধরো, প্রতীক্ষা শিখতে হয় তাকে,
যে চায় প্রকৃত রূপ দেখে নিতে অন্তরের চোখে।
বৃশ্চিক দংশন করলে নড়বে না, বেনো জলে
বেবাক তৈজসপত্র ভেসে গেলে শান্ত থাকা চাই।
সবুরে জ্বলবে বাতি ছন্নছাড়া অন্ধকার ঘরে’।
কত আর ধৈর্য ধরি? পক্ষী-পর্যবেক্ষকের মতো
চেয়ে থাকি সর্বক্ষণ দৃষ্টিহীন। প্রতীক্ষার শেষে
আসবে তারার মতো শব্দস্রোত ভেবে কী নিশ্চুপ
বসে আছি; অজস্র বল্মীক এসে আমাকে নিশ্চিত
দেবে ঢেকে। যত শীঘ্র পারো ফিরে এসো এ নিবাসে,
আমার চোখের জ্যোতি আবার স্থাপন করো আজ।
যদি আরো কিছুকাল
যদি আরো কিছুকাল পৃথিবীর ধুলোবালি, জল
আমার সত্তায় লাগে, বাতাস রূপালি
চুলগুলি নিয়ে খেলা করে নিরিবিলি
আরো কিছুকাল, তবে এমন কী ক্ষতি হবে কার?
এইতো দেখছি ফুল তার যৌবনের আভা নিয়ে
ফুটে আছে, ডালে বসে পাখি চমৎকার
শিস দিয়ে বিকালকে বেশি বৈকালিক
ক’রে তোলে, বুঝি বা ঈষৎ ঈশ্বরিত!
মোড়ায় আছে বসে মা আমার বৈধব্যের শুভ্র
স্তব্ধতায়, স্মৃতিগুলি যেন মেঘমালা থেকে নামে
এবং সাঁতার কাটে তাঁর পায়ের কিনারে। এই
দেখা আরো কিছুকাল থাকুক না হয়।
সারা রাত অন্ধকারে বৃষ্টি পড়ে ঘুমের ওপর,
সারা রাত বৃষ্টি পড়ে স্বপ্নের ভেতর,
মায়াবি ঘুঙুর বাজে চরাচরে, শুনে ফেলি অপার বিস্ময়ে-
নামুক এমন বর্ষা বার বার হৃদয়ে আমার।
যে অদৃশ্য চাঁদ
বেলা তো অনেক হলো। এরই মধ্যে গুছিয়ে ফেলার
কথা ছিল সব কিছু। অথচ কেমন
অগোছালো পড়ে আছে সংসার এবং
কবিতার ঘর, যেন কোনো
দুষ্ট বালকের দস্যিপনায় পাখির বাসা খুব
তছনছ হয়ে আছে
বিষণ্ন ধুলোয় এক কোণে। পথচারী
উপেক্ষার কিছু ছাই ছড়িয়ে গন্তব্যে চলে যায়।
আশা ছিল, যেটুকু হায়াত আছে বাকি,
বিকেলের রোদ, জ্যোৎস্না, পাখিদের ওড়াউড়ি আর
গাছ গাছালির সবুজাভা, মেঘ দেখে
বই পড়ে, শিশুদের ছোটাছুটি, আপনজনের
কথা উপভোগ করে, কবিতার অন্তঃপুরে ব’সে
নিশ্চিন্ত কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমি আজ
হঠাৎ লুণ্ঠিত মানুষের মতো নিঃস্ব, প্রায় নগ্ন,
বাইরে প্রচণ্ড শীতে বৃষ্টিতে কাঁপছি হি হি এক
অবোধ শিশুর হাত ধরে। হায়, আমার ভুরুর মাঝখানে
যে অদৃশ্য চাঁদ আছে তা-ও কি আখেরে নিভে যাবে?
রক্ষাকবচ
মধ্যদুপুরে সতেজ যুবক দুর্ঘটনায়
রাস্তায় পড়ে বেশ বিব্রত। হাতে ছিল তার
নাদুস নুদুস বঙ্গীয় কিছু হালের থ্রিলার।
থ্রিলার সহায়, একটি আঁচড়ও লাগে নি শরীরে।
গীতবিতান কি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ তার
হতো না কি বলে যথেষ্ট এক রক্ষাকবচ?
রবীন্দ্রনাথের জন্যে
যখন অধ্যাপকের জিভের ডগায়
তোমার কবিতাবলী ভীষণ চর্চিত হ’তে থাকে,
তখন আমার কেউ নও তুমি হে রবীন্দ্রনাথ।
যখন ঘোড়েল রাজনীতিবিদ মাতে
মঞ্চ থেকে মঞ্চান্তরে
তোমার প্রবল নাম সংকীর্তনে
তোমার রচনাবলী না পড়েই, তখন তোমাকে
চিনি না এবং
যখন তোমার গান সরকারি আসরে অলঙ্কার
হয়ে বাজে উদাসীন কানে, তখনও আমার
কেউ নও তুমি।
যখন নিভৃতে দেখি তুমি পদ্মাতীরে হেঁটে যাও
আদিগন্ত সরল জ্যোৎস্নায় গীতিবিতানের স্মৃতিময়তায়,
তখন তোমার দিকে বিস্মিত তাকাই,
তখন তোমার দিকে তাকাই,
তখনই আমার তুমি, একান্ত আমার,
ভেজা মাটি, স্বর্ণ রেণু, সমস্ত আকাশ যেন তোমার হৃদয়,
আমার অন্তর জুড়ে তোমারই অমর্ত্য পদধ্বনি।
শব্দচেতনা
কোনো লুকোছাপা নয়, এর দরকার
আছে বলে মনে করি না।
শব্দ নিয়ে ছ্যাবলামি আমার
ধাতে নেই,-এই শাদা কথাটা আমাকে
সরাসরি বলতেই হচ্ছে। না বললেও চলে বটে,
যা ঘটে ঘটুক, বলে ফেলাটাই ভালো।
আত্মহত্যার বদলে খুদকুশি শব্দটি যদি
বসিয়ে দিই কিংবা বৈমাত্রেয় ভ্রাতা না বলে
বলি সওতেলা ভাই, তাহ’লে কি
আমাকে কেউ দিনদুপুরে হাতকড়া পরিয়ে দেবে?
কারগারের পরিবর্তে জিন্দানখানা
অথবা পরম বান্ধবের জায়গায় জিগরি দোস্ত
ব্যবহার করি, তবে কি
বঙ্গীয় শব্দকোষ মানহানি-মামলা করবে আমার বিরুদ্ধে?
কখনো যদি মহাফেজখানায় বসে
খোদার বদলে ঈশ্বর এবং পানির বদলে
জল উচ্চরণ করি, তাহলে কি বাজ পড়বে
কারো মাথায়? যদি মুখ থেকে আধা ডজন পুষ্পার্ঘ্য
আর এক ডজন প্রণাম অথবা নমস্কার
বেরিয়ে পড়ে তবে কি নাকে খৎ দিতে হবে সাতবার?
আপাতত কিছু শব্দ প্রজাপতির মতো
উড়ে এসে বসছে আমার নাকে, কানে,
ওষ্ঠে আর খোলা বুকের পশমে; আমার
চোখ মুদে আসছে। প্রজাপতিগুলো এক ফাঁকে
ভ্রমর হ’য়ে গুঞ্জরণে
আমার অবসরকে বানিয়ে তুলছে
এক চমৎকার খেলা এবং কনকনে হাওয়ায়
স্পন্দিত ফুল ফোটার বেলা।