নৌকা কাহিনী
কিছুক্ষণের জন্যে, এই ধরো চব্বিশ-ঘণ্টাব্যাপী, একটা জোয়ার
এসেছিল। লোকগুলো আনন্দ। টগবগে ছন্দোমায় কোনো কবিতা
যেমন মাতিয়ে রাখে সবাইকে, তেমনি। একটি নৌকা,
ছিপছিপে, ঔদার্যে অলংকৃত, জলে ভাসতে ভাসতে ওদে,
যারা তীরে দাঁড়িয়ে দূরে থেকে দেখছিল খেলাচ্ছলে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে নৌকায় দোলা, বলে, “অনুপম সূর্যোদয়
দেখাব তোমাদের। তোমরা ভরাট গলায় জয়ধ্বনি দাও”।
নদীতীরে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকগুলোর মনের গহনে তখনো
সূর্যোদয় দেখার সাধ আড়মোরা ভাঙেনি। নৌকা
মানুষের নিঃস্পৃহতার ধূসর ধাক্কায় অনেকক্ষণ ঘুরপাক
খেলো মাঝ-নদীতে। তারপর জলকন্যার মতো দিলো ডুব।
প্রতিশ্রুতি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তে মুক্তোর দ্যুতি ছড়ায়।
প্রতিটি নিঃশ্বাসে
বারান্দায় আহত লোকটা। তার অর্ধেক শরীর
বোদ্দুরে, অর্ধেক ন্যস্ত ছায়ায়; ঘুরে কোমলতা
প্রশ্রয় দিয়েছে তাকে। খোয়াবের অর্ধস্ফুট ভিড়
ঘিরে ধরে, সুপ্রাচীন কংকালেরা হিজিবিজি কথা
কেবলি বলতে থাকে স্বপ্নের ভেতর। অকস্মাৎ
জেগে ওঠে, এদিক ওদিক দেখে নেয় ভালো করে;
বেখাপ্পা দুপুর ছোরাহত মানুষের মতো কাত
হ’য়ে বিকেলের কাঁধে ঢলে পড়ে গৃহস্থের দোরে।
এ কেমন রাত আসে? ধূসর পথের ক্লান্ত ঠোঁটে
শিশির রক্তের রঙ ধরে; ঘরবাড়ি শীতে নয়
আতঙ্কে কম্পিত যেন। নিদ্রাছুট মানুষেরা ভয়
পেতে পেতে নিথর নিঃস্পন্দ হ’য়ে গেছে। অবিশ্বাসে
আচ্ছন্ন পাথুরে চোখ। কখন যে ফের জেগে ওঠে
মানবিক বোধ, এই প্রশ্ন কাঁপে প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
প্রতিদান
অমাবস্যা আমাকে নিত্যদিন গিলে খেতে চায়,
আমি তার গলায় চাঁদ ঝুলিয়ে দিই তড়িঘড়ি।
পোকামাকড় হরহামেশা আমরা শরীরে উৎপাত চালায়,
আমি ওদের জন্যে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকি।
মধ্যরাতে আমার ঘুমের নরম মাংসে
তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে দেয় দুঃস্বপ্ন, আমি জাঁহাবাজ, কুৎসিত
স্বপ্নগুলোকে সুন্দর করে গড়ি।
কালবৈশাখী এক ঝটকায় উপড়ে ফেলে আমার ভালোবাসার
নিভৃত তাঁবু আমি দূরন্ত ঝড়ের উদ্দেশে
স্তোত্র রচনার প্রয়াসে কলম ধরি।
যারা মৈত্রীর মুখোশ এঁটে মুখে
আমাকে কাদায় ফেলে পা ছোড়ে জোরেশোরে,
আমি তাদের অপ্রস্তুত কপালে
চন্দনের ফুল এঁকে দিতে পছন্দ করি।
বন্দনীয়
আমার নিকটে এসে পুনরায় দূরে চলে গেলে।
যাবার সময় তুমি আমার কথার প্রতি কান
দাওনি, অথচ আমি আলো-আঁধারির কণ্ঠস্বরে
হৃদয়ের কিছু কথা তোমাকেই বলতে চেয়েছি।
আমার দু’হাতে কারা হাতকড়া দিয়েছে পরিয়ে,
আমি হাঁটলেই ঝন্ঝনিয়ে ওঠে লোহার শেকল
বার বার-এই অজুহাতে তুমি পরিহার করো
আমাকে এখন, জানি কারাগারে জমে না প্রণয়।
তবুও তোমাকে নিত্য গোলাপ পাঠাই, ভিলানেল
লিখে যাই তোমার উদ্দেশ্যে তাজা হৃদরক্ত দিয়ে।
প্রতিষ্ঠালোলুপ সব সমাজসেবক স্তব করে
শাসকের; আমি আজও তোমাকেই বন্দনীয় মানি।
বন্ধুবরেষু
বেশ কিছু দিন থেকে তোমার শরীর ভালো নেই,
বলা যায়, মনও ভালো নেই। শীতের রোদ্দুরে একা
বসে থাকো চুপচাপ বিষণ্ন ধ্যানীর মতো, চোখে
ভেসে ওঠে কবেকার শূন্য মাঠ, চারু পদছাপ।
ঈষৎ অক্ষম বটে, অসহায় পদচারণায়;
খাতার সকল পাতা থেকে যায় অক্ষরবিহীন।
তোমার মননে পক্ষাঘাতের কামড় নেই, টান
আছে ঠিক আগেকার মতো রবীন্দ্রনাথের গানে।
কখনো ছিলে না সঙেঘ, একলা সর্বদা নির্বাচিত
বান্ধবমণ্ডলে, গাম্ভীর্যের অন্তরালে হাস্যরস
বুঝি বা লুকানো থাকে, ঝর্ণা হয়ে ঝরে মাঝে-মাঝে;
দেখলে তোমার মুখ হৃদয়ে রোদ্দুর কথা বলে।
আজ প্রাতঃভ্রমণে বেরুনো দায়, ঠায় বসে থাকা,
নিজের সঙ্গেই চলে বিভিন্ন আলাপ, কখনো বা
শব্দাবলী খুনসুটি করে অসাড় হাতে সাথে,
তোমার মনোজ হংস উড়ে যায় কোন সে মানস সরোবরে।
বাঁচো, তুমি বাঁচো
বাঁচো, তুমি বাঁচো ধীরে স্থির অনাবিল বেঁচে থাকো।
এক বুক রৌদ্রছায়া নিয়ে বাঁচো; কাকে
বলে বাঁচা, এনিয়ে খামোকা যুক্তিতর্ক
করো না কখনো, বাঁচো, তুমি শুধু বাঁচো।
এইতো তোমাকে ছুঁয়ে যায় হাওয়া, পাখি
শোনায় কত যে গান, জ্যোৎস্না তোমার পায়ের কাছে
কোমল লুটিয়ে পড়ে, গাছের নিবিড় পাতাগুলি
খোলাখুলি তোমাকে জপায় রোজ, ‘বাঁচো, তুমি বাঁচো’।
ম্লান, ছেঁড়া বাচাল পোস্টার পথে পড়ে আছে, শিশু
বখিল উঠানে খিলখিল হাসে খেলনাবিহীন;
বারান্দায় একজন তরুণী শ্রাবণ-কালো চুলে
চালায় চিরুনি চিরায়ত ডৌলে-চোখ ভরে দ্যাখো।
জ্বর ছেড়ে গেছে, মুখ নেই তেতো স্বাদ, ফল খাও, কাশিটাও
তেমন নাছোড় নয়। রোগ শোক সত্ত্বেও গভীর তুমি বাঁচো।
মেঘের ওপারে নয়, এখানেই কোথাও তোমার জন্যে কেউ
প্রতীক্ষায় আছে, তার আর কবিতার জন্যে বাঁচো, তুমি বেঁচে থাকো।
বাগান
সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে
কয়েকটি চারাগাছের দিকে তাকিয়ে তার
স্বপ্নের কথা বলছিল, ‘যদি কোনো দিন
আমার নিজের বাড়ি হয়, তাহ’লে আমার
শোবার ঘরের জানালার
কিছু দূরে থাকবে হাস্নাহেনার গাছ,
ড্রইং রুমের দেয়াল ঘেঁষে
বেড়ে উঠতে দেবো বেলি ফুলের ঝাড়
আর গেটের সামনে
ফুল ফোটাবে একটি বকুল গাছ’।
অথচ ঘুণাক্ষরে তার মনেই হয় নি যে,
সে নিজেই একটি বাগান। দেখি,
ওর স্বপ্নের ওপর শুধু
চিক চিক করছে দুপুরের রোদ।
বিতর্ক
থাকুক না; থাকলে দোষ কী? আজ ওদের হটাতে
করা সভা ডেকে
করবে ঘোষণা লাগাতার হরতাল? বলো, কারা
মানববন্ধনে মেতে চাঁদ আর চন্দ্রমল্লিকাকে
কবিতার খাস জমিনের চতুঃসীমা
থেকে দেবেনির্বাসন? না, ওরা থাকবে নিজ নিজ
জায়গায় অটুট। কারো কোনো ক্ষতি নেই;
কবিতার বুকে নিত্য ফুটবে গোলাপ আর দুলবে দোয়েল।
কবিতা কি ধুলোবালি থেকে ইস্ত্রি করা
কাপড় বাঁচিয়ে খুব সন্তর্পণে দূরে দূরে
অশোক ফুটিয়ে হেঁটে যাবে অথবা রুমালে নাক ঢেকে
এঁদো বস্তি পার হবে মখমলী চটি পায়ে? যদি
মানুষের বসতিতে হঠাৎ আগুন আগে, তবে কবিতা কি
মাউথ অর্গানে সুর তুলে আর্তনাদ মুছে দেবে?
যদি কোনো চিত্রকল্পে বেজে ওঠে কংকালের হাড়,
উপমায় ভীষণ শীতার্ত, খাদ্যহীন, তাপহীন
নারী আর শিশুদের নীল মুখ ভেসে ওঠে, তবে
ঘোর নান্দনিক কম্বুকণ্ঠে উচ্চারিত
হবে কি ধিক্কার? এ প্রশ্ন তুলে যারা
পথে হাঁটে, মিছিলে দুর্বার ছোটে, তারা
উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকবে না। রোদ্দুরে মন্দিরা বাজে,
নতুন আঙ্গিকে ওরা হয়ে ওঠে দীপ্ত মানবিক।