নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের সৈকতে
আমার ভেতর থেকে আশ্চর্য এক যুবক
সামুরাই তরবারির ঝলসানির আঙ্গিকে
বেরিয়ে সরাসরি হেঁটে যায়
তোমার নিবাসে রাস্তার ভিড় আর
কোলাহলের চারদিকে পর্দা টেনে দিয়ে।
তুমি তাকে না দেখে
তাকাও এক স্তূপ ধূসরতার দিকে;
তোমার ভুরুর মাঝখানে দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলক।
এই হাত দুটো আমার, দেখ এই
এক জোড়া চোখ, এই ওষ্ঠ আমার;
শোনো, বুকের এই ধুকপুকুনি আমার-এক স্তূপ ধূসরতা
ব্যাকুল কণ্ঠস্বর।
সেই কণ্ঠস্বর তোমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে,
মনে হয় না। তুমি জানালার
বাইরে তাকিয়ে আছো, যেন একটি একটি করে গুনছ
পাখির পালক, জেনে নিতে চাইছ গাছের পাতার
রহস্য। তোমার উদাসীনতায় প্রতিহত
কণ্ঠস্বর আত্মসমর্পণ করে স্তব্ধতার হাতে।
কিছুতেই তোমাকে বুঝতে পারি না আমি,
যেমন একট বাই চার পাঁচবার পড়বার পরেও
তার মাথামুণ্ড কিছুই
বোধগম্য হয় না নিবিষ্ট পড়ুয়ার।
বলেই ফেলি তোমাকে ঘিরে অষ্ট প্রহরের
ছটফটানি আমার ছুটির দরখাস্ত
দাখিল করেছে দিনের আলোকরশ্মি আর নক্ষত্রের কাছে
এবং আমার ভালোবাসা
গ্রীষ্মমণ্ডল ছেড়ে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের
সৈকতের চিকচিকে বালিতে শুয়ে রোদ পোহায়।
নাবিক
শাদা পোশাকের লোক, মাথায় সফেদ টুটি, ছিল
বন্দরে বন্দরে, আমাদের
পরিচিত, তাসের আড্ডার একজন। মাঝে-মাঝে
কী-যে হতো তার, তাস ফেলে
জমাট টেবিল ছেড়ে ছুড়ে যেতো চলে,
যেন সে শুনেছে গান জলকন্যাদের। নাম তার কখনো হয় নি জানা।
কোথায় যে গেল
এ নিয়ে আমরা কেউ ঘামাই নি মাথা কোনোদিন।
চাঁদের বন্দি সে, শোনা গেল, জ্যোৎস্নার মায়ায় মজে
হঠাৎ হারিয়ে গেছে ঘোর সামুদ্রিক কুয়াশায়।
অনেক বছর কেটে যায়, বার্ধক্য ছুঁয়েছে আমাদের
তাসের আড্ডার সঙ্গীদের, আমাকেও;
কেউ আত্মভোলা, কেউ স্মৃতি সচেতন, কেউবা স্তিমিত খুব।
একদিন যথারীতি তাসের টেবিলে বসে দেখি
এসেছে সে ফিরে, শাদা পোশাকের যুবা, কী আশ্চর্য, চোখ তার
মুক্তো এক জোড়া, ওষ্ঠে অপার্থিব নীরবতা আর
সমস্ত শরীর থেকে ঝরে
অবিরল সমুদ্রের ফোঁটা ফোঁটা সবুজাভ জল।
নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই
আমাকে কেউ ইশ্বরের প্রতিদ্বন্দী বলে
সম্বোধন করল কি করল না তাতে আমার
কিছু যায় আসে না। আমার স্তুতি কিংবা নিন্দায়
পাড়াপাড়শিরা হুল্লোড়ের হাট বসিয়ে লাঠালাঠি,
মাথা ফাটাফাটি করলেও সেদিকে আমার
লেশামাত্র নজর নেই।
তোমরা কি দ্যাখো নি কী করে নিমেষে
বিকল্প সৌরলোক, ভিন্ন চাঁদ, স্বতন্ত্র
তারাভরা নিশীথের আকাশ আমি তৈরি করি?
তোমাদের চোখে কি পড়ে নি আমার বানানো
সেই বাগিচা যা’ আদম ও হাওয়ার উদ্যানের চেয়েও সুন্দর,
অথচ সেখানে নেই সবুজ সাপের হিস্হিসে পরামর্শ?
নিশ্চয়ই সেই বাগানে তোমরা দেখেছ
বেহেশ্তের হুরীদের অধিক রূপবতী তরুণীদের, যারা
তারায়-গড়া ময়ূরপঙ্খী নাও কুমারী জলে ভাসিয়ে
রওয়ানা হয় প্রেমোপাখ্যানময়
দ্বীপের উদ্দেশে। ঢেউয়ের তালে তালে দোলে তাদের স্তন,
তাদের উল্লসিত কেশে জলকণা চিক চিক করে। সমুদ্রতলে
সুলেমানী রত্ন ভাণ্ডারের চেয়েও ঐশ্বর্যময় খাজাঞ্চিখানা
নির্মাণ করেছি, এ-ও তোমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি, আমার বিশ্বাস।
তোমরা কি অগ্রাহ্য করো আমার দাবি? আমাকে আজ
গোধূলি বেলায় প্রতারক অপবাদ দিয়ে
এই তমসাচ্ছন্ন, অবক্ষয়-স্পৃষ্ট নগরী থেকে
তাড়িয়ে দিতে চাও? এই তো আমি মেঘের
শাদা ঘোড়ায় সওয়ার, ঘোরাচ্ছি আঙুল
আর চতুর্দিকে অন্ধকারকে লজ্জা দিয়ে
শিশুর হাসির মতো ফুটে উঠছে আলো,
খরাপীড়িত নরনারীর পায়ের তলায় বয়ে যাচ্ছে
জলধারা গ্রামীণ কন্যাদের গীত ধ্বনির মতো-
তোমরা দেখতে পাচ্ছ না? দ্যাখো, আমারই ইচ্ছায়
কীরকম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অজস্র গোলাপ
আবর্জনার স্তূপে, দুঃস্থ কবিয়াল
যুবরাজের ভঙ্গিতে তার সারিন্দায়
লাগাচ্ছে দিক-জাগানো নতুন সুর, জমির আল
মিশে যাচ্ছে স্বর্গগঙ্গায় এবং আততায়ীদের
ধারালো অস্ত্রগুলো মিলনমালা হয়ে দুলছে।
এখন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে আমার অস্তিত্ব
তরঙ্গিত নদীর মতো এক নাচ, ঘূর্ণমান
দরবেশের মতো আত্মহারা আর টাল সামলে
নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই আমি কেমন পাথুরে স্তব্ধতা।
নিঝুম বৃষ্টির সুর
সাঁওতাল রমণীর মতো যে অন্ধকার
দিগন্তে স্তব্ধ,
তা’ এখন শহরের ওপর খুব নীচু হ’য়ে
ঝুঁকে পড়েছে; ওর নিঃশ্বাস
অনুভব করি ত্বকে। থমথমে গুমোট-ছেঁড়া
হাওয়ায় ঈষৎ শৈত্য; শহরের চোখের পলক
না পড়তেই বাতাসের
প্রচণ্ড মাতলামি, নিমেষে হাজার হাজার
দরজা জানালা বন্ধ। আকাশ ফুটো করে
বৃষ্টি এল অগণিত ঘোড়সওয়ারের মতো আওয়াজে।
মেঘের বুকে বিদ্যুৎ-তরবারির
ঝলসানি, কানফাটানো বাজের শব্দ!
একটানা বৃষ্টির সুর ঝরে শিশুপল্লীর ছাদে,
গোশালার টিনে, রাধাচূড়া গাছের পাতায়,
নিঝুম বৃষ্টির সুর ঝরে
হতশ্রী বস্তির খোলার ঘরে আর
শহরের উঁচকপালে এলাকায়,
ঘুমের ভেতরে, অবচেতন মনের খনিতে।
বৃষ্টির সুর ঝরে আমাদের ভালোবাসার ওপর,
আমাদের মিলন এবং হু হু বিচ্ছেদের ওপর।
আমাদের স্বপ্নেরা বৃষ্টির জালে আট্কা পড়ে
ছটফট করে চকচকে রূপালি মাছের মতো।
আমি আমার ছোট ঘরে বসে আছি
একা এবং নিশ্চুপ-
আমার মাথায় বৃষ্টির শব্দময় শব্দহীনতা আর
একটি হয়ে-উঠতে-চাওয়া কবিতার
অস্পষ্ট মেঘমল্লার এবং
তোমার স্মৃতির মোহন কম্পন।
তুমি অন্ধকার বারান্দায় একাকিনী বসে দেখছো
বৃষ্টি কোমল চুমো খাচ্ছে আম গাছের পাতার ঠোঁটে।
তোমার নিঃসঙ্গতাকে স্পর্শ করে
নিঝুম বৃষ্টির সুর। আমার শূন্য বিছানা
ভেলার মতো ভাসমান অথৈ বেদনায়।
তোমার এবং আমার
হাতে মাঝখানে জলজ দেয়াল। কে যেন
বাইরে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত পান করে চলেছে শ্রাবণের আরক।
যখন বৃষ্টি দেখি, তোমার প্রগাঢ় চোখের অশ্রুজল
মনে পড়ে আর তোমার চোখের জলে শ্রাবণধারা খুঁজে পাই।