তোমার নাম এক বিপ্লব
আগুনে-পোড়া তরঙ্গের মতো আমার স্বপ্নগুলোকে
গোছানোর ব্যগ্রতায় অধিক
এলোমেলো করে ফেলি। আমার স্বপ্নগুলোকে
যারা পুড়িয়ে দিয়েছে, তাদের আস্তানায়
আজ মোচ্ছব। আমি আমার আর্তনাদকে
মেঘের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে
আগুন রঙের গুচ্ছ গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার মধ্যে
মুখ লুকাই।
এক সম্পাহ ধরে লেখা কয়েকটি কবিতার
পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফিপ্সি
হাওয়ায় উড়িয়ে দিই; আমার মুখমণ্ডলে
লেগে-থাকা কৃষ্ণচূড়ার ভগ্নাংশসমূহ
আমাকে কোনো আদিবাসীর
আদল দেয়। ক্রোধ
আমার হৃদয়কে ক্রমাগত পোড়াতে থাকে আর
আমি দিগন্তে দেখি তোমার মুখের উদ্ভাসন।
আজ জানালার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি
সূর্যোদয়ের চুম্বনের প্রত্যাশায়।
আকাশের চাঁদ মাঝে-মধ্যে
ঢাকা পড়ে মেঘের বোরখায়
আবার পর মুহূর্তেই প্রস্ফুটিত
মুক্ত চিন্তার মতো।
কোনো কোনো গ্রন্থের হরফের অপ্রতিরোধ্য মিছিল
বদলে দিতে পারে সমাজকে।
সেরকম বহু বইয়ের সারাৎসার তুমি
নিজের অজ্ঞাতেই ধারণ করেছিলে।
আমার মনে পড়ে যায়, তোমার মৃতদেহ
১৯৭৫টি বুলেটে বিদ্ধ,
তোমার তর্জনী উদ্যত সূর্যোদয়ের দিকে।
কেউ দ্যাখেনি সেই মৃতদেহ থেকে
বেরিয়ে এসেছেন এক অগ্নিপুরুষ,
যিনি ছাপ্পান হাজার বর্গমাইলের
প্রতিটি পথে হেঁটে যান
পাখি, জলধারা, রৌদ্র-জ্যোৎস্না এবং
মেঘমালাকে দীক্ষিত করতে
কৃষ্ণচূড়া আর স্বর্ণচাঁপা ছড়াতে ছড়াতে।
কৃষকের কুটির, বস্তির খোলার ঘর
মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট, আত্মমগ্ন কবির দৃষ্টি,
ঝাঁঝালো দুপুরে মিছিলের শত শত মুখ
শনাক্ত করছে তোমাকে।
তোমার নাম নতুন সূর্যোদয়ের মতোই
এক বিপ্লব, যার অন্ধকার-তাড়ানো
রুদ্র সৌন্দর্য দেখার প্রত্যাশায়
আমি দাঁড়িয়ে আছি জানালার খুব কাছে।
দোদুল্যমান
সে বসেছিল তার প্রশস্ত বারান্দায়
শরীরে যৌবনের গোধূলি নিয়ে। আমি,
বার্ধক্যের দোরগোড়া-পেরুনো, তার মুখোমুখি
অন্ধকারের ডানার রেশমি ছায়ায়।
একটি ক্লান্ত পাখির ডানা ঝাড়ার শব্দে
চিড় ধরে নিস্তব্ধতায়, হঠাৎ এক সময়
মনে হলো, সে নেই এই সন্ধ্যাময় বারান্দায়,
তার জায়গায় স্থাপিত
প্রসিদ্ধ কোনো ভাস্করের শিল্পিত পাথর।
সেই ভাস্কর্য এবং আমার মাঝখানে
দুলতে থাকে, ক্রমাগত দুলতে থাকে
আমার একটি না-লেখা কবিতা।
দ্বিতীয় পাখি
আজ থেকে দেখব সকালসন্ধ্যা আমি মেঘেদের,
পাখিদের ভেসে-যাওয়া। আবার দেখব ভালো করে
কী করে গাছের পাতা, ভোরের শিশির পাতা থেকে
ঝরে যায়। বাগানের মৃত্তিকার পোকা মাকড়েরা
কী ভাবে খুশিতে ঘোরাঘুরি করে চেনা এলাকায়,
দেখে নেব। বহুকাল জঙ্গলের মাথায় চাঁদের
মুকুট দেখি নি; ঝিলে মুখ ডুবিয়ে চিত্রল কোনো
হরিণের জলপান অদেখা রয়েছে কতকাল।
বড় বেশি হৈ চৈ ছিল চতুর্দিকে, ছিল জামা ধরে
টানাটানি আর গলা ফুলিয়ে বাক্যের ফুলঝুরি
তাৎপর্যহীনভাবে ছোটানো, বাজানো, ডুগডুগি
মেলায়; এখন সঙঘ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে
নদীতীরে কিংবা শাল তাল তমালের বনে ঘোরা,
কবর, কোকিল, ঝর্ণা, পাকদণ্ডি দেখা, শুধু দেখা।
ধোঁয়াশায়
এইমাত্র কবিতার মনোহর বাড়ি থেকে একলা, উদাস
বেরিয়ে এলেন তিনি। কিয়দ্দুরে আড়ালে দাঁড়িয়ে
ঘন ঘন ফুঁকছেন সিগারেট; ধোঁয়া
ঘিরে ধরে তাকে, কাছে ধারে
তরুণ কবিরা নেই, কেউ নেই, কোথাও গুঞ্জন নেই কোনো;
তিনি একা, আজ বড় একা, দুঃখের কাফনে মোড়া।
একদা ছিলেন মিছিলের প্রথম কাতারে, মুখে
ফুটতো শ্লোগান স্ফূলিঙ্গের মতো, যেন
নিজেই পতাকা, এরকম উড়তেন জনারণ্যে কী সুন্দর।
অধুনা বিবরবাসী, অন্য কাউকেই
নয়, নিজেকেই বেশি দ্যাখেন চৌদিকে। জপতপ
আছে বটে, আছে সন্ন্যাসীর মতো মন্ত্রের সাধনা।
এগিয়ে গেলাম তার দিকে। এক রাশ ধোঁয়া থেকে
কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘আরে তুমি, কী অবাক কাণ্ড,
তুমি এলে অবশেষে এ নির্জন কোণে? ভুল ছবি
দেখছি কি? আজকাল আমাকে গলিতে কুষ্ঠরোগী
ভেবে কেউ ঘেঁষে না নিকটে। হা, আমার কিবা দিন কিবা রাত্রি’।
‘আপনার কাছে আমি কবিতার ডৌল দেখে নেব’, জানালাম।
‘পদ্য রাখো, আমাকে একটু স্পর্শ করো, বহুদিন মানুষের
নিঃশ্বাস লাগে না গায়ে, ছোঁয়া না আমাকে কেউ আর।
কারো দিকে প্রীতিবশে তাকালেও তার
দৃষ্টি বড় বেশি ঠাণ্ডা মনে হয়; হায়,
এর চেয়ে তাচ্ছিল্য বরং ভালো, বলে তিনি যেন নক্ষত্রের
সঙ্গে কিছু কথা সেরে নেয়ার তাগিদে ধোঁয়াশায় মিশে যান।
নব্য মানবের স্তব
অন্ধকার ঘোর অন্ধকার উবু হয়ে বসে আছে
হতাশার কোলে, ধসে-যাওয়া ঘরবাড়ি
ভাঙাচোরা থামগুলি দুঃস্বপ্নের স্মৃতি
নিয়ে অবনত, মধ্যরাতে এমিয়ার কপোতেরা
এক সঙ্গে আর্তনাদ করে।
য়ূরোপের আত্মাহিম শীত নেমে আসে হা-হা স্বরে
এমিয়ার ঘরে ঘরে, খানিক উত্তাপ
সকলের প্রার্থনার প্রধান প্রস্তাব, মৃত্যু অন্তরালে হাসে
বাঁকা হাসি; জানে
তরুপের তাস তার হাতেই গচ্ছিত। গ্রন্থপাঠ,
সমাজের যাবতীয় রীতিনীতি বেবাক অসার। সর্বনাশ
গ্রাস করে দশদিক, সর্পাহত অক্ষর সাজায়।
ভ্রান্তি পথপ্রদর্শক জেসে খুব দ্রুত হেঁটে যায়,
অনুসারীগণ অন্ধকারে,
কেবলি হোঁচট খায় খানাখন্দে, কেউ কেউ ভীষণ আটকে
পড়ে কাঁটাবনে, যে গ্রন্থের পাতা ওরা
ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাওয়ার উড়িয়ে
দিয়েছিল, তার প্রয়োজন তীব্র বোধ করে অনুশোচনায়,
উত্তুরে হাওয়ার দিকে দগ্ধ মুখ রাখে। শক্রতায়
উন্মুক্ত আক্রোশে যে মূর্তিকে করেছে আঘাত, তাকে
সম্ভ্রমের পতাকা জড়িয়ে
আবার করাবে দাঁড় অনেক উঁচুতে, মনে হয়।
তখন নক্ষত্রপুঞ্জ মহিমার সুর হয়ে বাজবে ব্যাপক,
ধূর্ত শেয়ালেরা, নেকড়ের পাল বেদিশা পালাবে বহুদূরে,
এশিয়ার ঘরে ঘরে উঠবে জ্বলে প্রকৃত জ্ঞানের শিখা আর
কবির হরফ হবে নব্য মানবের স্তব, নিত্য সহচর।