ছায়ায় আমেন
হেঁটে হেঁটে আমি কি এখন খুব ক্লান্ত? কায়ক্লোশ
পা দুটোকে ঘুম
পাড়িয়ে রাখার জন্যে কী একটা গান
গায় বৃক্ষতলে গোধূলিতে। এ পথের রেখা ধরে
ইতিহাস আর আমি হেঁটে যাচ্ছি। একটি পাখির
কলস্বর দিগন্তের চিবুকে বিস্ময়
জাগিয়ে কেমন উড়ে যায়,
যেন টুক্রো মেঘ; দেখ, এবার আমার
সত্যিকার লেখার সময় এল। এতকাল শুরু
গোলকধাঁধায় ঘুরে কেটেছে সময়।
প্রকৃত আলোর বীজ আবিষ্কার করি,
আবিষ্কার করি স্বপ্ন আর বাস্তবের দৃষ্টিপাত।
কলমের আঁচড়ে আবার বেঁচে উঠি।
নিজের ধরনে শূন্যতার মুখোমুখি।
নিদ্রার ঠোঁটের ফাঁকে কবিতার ফল
পুরে দিয়ে সরিয়ে রাত্রির পর্দা প্রত্যুষের খুব
টলটলে সরোবরে দিই ডুব। ভর দুপুরের
হৈ-হুল্লোড়ে আমার কবিতা
যীশুর রক্তাক্ত শরীরের মতো ঝুলে থাকে ক্রমশ। কারা যেন
অদূরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘লিখে রাখো ছায়ায় আমেন’।
ঝড়
ঝড়ঝঞ্ঝা নিয়ে আছি আমরা সবাই চিরদিন;
কত ঘর প্রায় প্রতি বছর যায় যে উড়ে আর
মাঝে-মাঝে জলোচ্ছ্বাস বসতি নিশ্চিহ্ন করে, মনে
অগণিত নরনারী, শিশু। পশুপাখি, গাছপালা
ধ্বংসের গহ্বরে যায়, এমনকি তৃণমূল মাটি
ছেড়ে শূন্যে ধায় এলোমেলো, অনন্তর মুষলের
বৃষ্টি হয়ে ঝরে অবিরত কত শত নিকেতনে।
চাই না এমন ঝড়, স্বৈরাচারের মাতন আর।
বরং আসুক সেই ঝড়, যার মত্ততায় পাকা
ফসলের ক্ষেত নয়, কলরবময় জনপদ,
প্রাণিকুল নয় আর ধ্বংস হোক মৌল দানবের
দাপট সন্ত্রস্ত দেশে দেশে; অবিচার, অনাচার,
সকল অন্যায় নিমেষেই কড়ের কুটোর মতো
ভেসে যাক, লোপ পাক অশুভ শক্তির চণ্ড নীতি।
তবে কি বৃথাই আমি
তবে কি বৃথাই আমি তোমার ইঙ্গিতে দিগ্ধিদিক
ঘুরেছি ধারালো শীতে, দুঃসহ গরমে এতকাল?
হায় কী বিভ্রমে ম’জে দিনরাত্রি এক মজা খাল
সেচে সেচে দুহাতে তুলেছি কাদা নদী ভেবে ঠিক।
চতুর্দিকে কৌতূহলী লোকজন ‘ধিক, তোকে ধিক’
বলে উৎপীড়ক চোখ রাখে আমার ওপর, গাল
দিয়ে কেউ কেউ গদ্যে করে আমাকে নাকাল।
যত পারে ওরা গাত্র ঝাল তুমুল মিটিয়ে নিক।
আমার বলার কিছু নেই, নিঃসঙ্গ থাকব বসে
অন্তরালে, ছায়ায় ভেতর থেকে যদি সুন্দরীর
আভাস চকিতে ফোটে, আলোড়নে কিছু পাতা খসে
পড়ে, তবে আমি তার উদ্দেশ্যে বলব সুনিবিড়
কণ্ঠস্বরে, তোমাকেই ঈশ্বরি মেনেছি আমি, তাই,
মনিরত্ন কিংবা ভস্ম যা-ই দাও, কোনো খেদ নাই।
তাচ্ছিল্য উজিয়ে
‘এখানে এসে কি ভুল করলাম?’ এই প্রশ্ন তাকে
চঞ্চুতে স্থাপন করে। উস্কো খুস্কো চুল, গালে দাড়ি
কামানোর কাটা দাগ, শার্টের কলারে এক টুকরো
ঘাস, যেন স্তম্ভিত টিকটিকির জিভ।
এখানে আসার আগে ছিলেন নির্জন মাঠে শুয়ে। মেঠো ঘ্রাণ
ঘিরে আছে তাকে, বুঝি উদ্ভিদের প্রাণ তার মাঝে
সঞ্চারিত; কেউ তাকে আড় চোখে দ্যাখে, কেউ কেউ
উপেক্ষার ডগায় নাচিয়ে কিছুক্ষণ ভিন্ন দিকে
নজর ফেলায়, তিনি তাচ্ছিল্য উজিয়ে বললেন,
‘এসো কোণে, একা গুঞ্জনের অন্তরালে’।
চোখে তার দূর দূরান্তের ছায়া। একে-একে ক’জন অতিথি
কণ্ঠে ভাষণের মনোহর নক্শা ফুটিয়ে প্রচুর
সুখ্যাতি পেলেন, সারা ঘর করতালিময়।
এবার বলার পালা তার। অপ্রস্তুত,থতোমতো,
গলায় কিসের দলা বাক্য-রোধক, হঠাৎ তার
দু’ ভুরুর মাঝখানে রঙধনু জেগে ওঠে, ভোরের শেভের
কাটা দাগে দোলে পুষ্পরেণু, কণ্ঠে ফোটে
অচিন পাখির ধ্বনি। সারা ঘর নিস্তব্ধ প্রান্তর।
তিনজন
জ্যোৎস্নার আদর খেয়ে চিতাবাঘ শোভার ভেতর
নিভৃতে ঘুমায়। অকস্মাৎ খসখস
শব্দে লাফাবার ভঙ্গি রচিত, দু’চোখ
ফস্ফরাসের কণা ছড়ায়, আঁধার শিহরণে নববধূ,
পেশী টান টান, জ্যোৎস্না পান করে তার
সমগ্র সততায় মদিরতা জেগে ওঠে, পরিপক্ক নিশীতের
মাংস দাঁতে গেঁথে খুঁজে নেবে
ঝোপের আড়াল, পাবে শব্দ শিকারির হরফের
মমতা এবং বাংলা কবিতার বুকে
চোখের আগুন তার রত্ন দশকের পরপারে।
দুর্ধর্ষ শিকারি কালো বন্দুক উঁচিয়ে ধরে সেই
চলমান ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের দিকে।
কবির কলম বন্দুকের নলটিকে মূক করে
দিতে চায়, গুলির আওয়াজ ফেটে পড়ে, ঘন বন
আর্তনাদ, বিষাদ ভাসতে থাকে জ্যোৎস্নার প্লাবনে,
কলম এবং কবি রক্তস্নাত, শিকারির পদতলে নিঃস্পন্দ, নিথর।
তুমি
কিয়দ্দূরে ইঁদারার কাছে দেখি একটি তরুণী
পেয়ারা গাছের পাতা ছোঁয় মমতায়,
তার শরীরের চমকিত
মুদ্রায় তোমার উপস্থিতি ভেবে কাছে যাই; ভুল ভেঙে যায়।
একটি মেয়েকে দেখি রেস্তোরাঁয় বসে আছে একা;
কফির পেয়ালা শূন্য, দু’টি হাত টেবিলে স্থাপিত।
তাকে তুমি ভেবে প্রায় বলে ফেলি, ‘ভীষণ লজ্জিত, কতক্ষণ
বসে আছো?’ নিজের বিভ্রমে লজ্জা পাই।
একদিন মফস্বলী ইস্টিশানে কুয়াশার রাতে
ওয়েটিং রুমে তুমি বসে আছো বিষণ্ন, সুন্দর।
কোথায় চলেছ, কত দূরে? কুয়াশা তোমাকে গিলে খেলো, দেখি
অপরিচিতার হাই; নিষ্প্রভ রাত্রির দিকে খানিক তাকাই।
বেশ কিছুদিন পর সেদিন বিকেলবেলা তোমার নিবাসে
নিভৃত ড্রইংরুমে বসে আছি অস্থির, ব্যাকুল।
তুমি এলে, ট্রলিতে চায়ের সরঞ্জাম; কথা হলো
নিছক মামুলি কিছু। এ কাকে দেখছি? হায়, তুমি নও তুমি।
তৃতীয় পক্ষ
রক্তচক্ষু রাম বলে রহিমকে, ‘এই দ্যাখ আমার রামদা,
তোকে বলি দেবো’
রহিম পাকিয়ে চোখ বলে রামকে, ‘বেদ্বীন, এই
তলোয়ার দিকে তোকে টুক্রো টুক্রো করে
কুত্তাকে খাওয়াবো’। অনন্তর
রামদা এবং তলোয়ারে কী ভীষণ ঠোকাঠুকি।
একজন প্রশান্ত মানুষ, অস্ত্রহীন, ছুটে এসে দাঁড়লেন
দু’জনের মাঝখানে, কণ্ঠে তার অনাবিল মৈত্রীর দোহাই।
দু’দিকেই দুই অস্ত্র দ্বিধাহীন হানে তাকে। নির্মল, নির্বাক
আসমান দ্যাখে রক্তধারা বয়ে যায় চৌরাস্তায়।