গরিলারা দলে দলে
গরিলারা দলে দলে তড়িঘড়ি কামিজ পাৎলুন
পরে মসজিদ গুঁড়ো করে আর আগুন ধরায়
দেবালয়ে; মানুষের স্বপ্নের বসতি পোড়ে, তাজা
রক্ত বয় পথে, ত্রাস-তাড়িত তরুণী মূক হয়
যূথবদ্ধ লালসার লকলকে নিঃশ্বাসে এবং
গরিলারা ক্রমশ সংখ্যায় বাড়ে শহরে ও গ্রামে।
কালপুরুষের মুখে পড়েছে বিস্তর চুনকালি,
সূর্যের জ্বলন্ত চোখ থেকে অবিরল অশ্রু ঝরে,
পৃথিবীর দৃশ্য দেখবে না বলে সূর্য বন্ধ করে
চোখ, দুপুরেই ঘোর অমাবস্যা নামে দিকে দিকে।
গালিবের গজলেরা ঘাতকেরা অস্ত্রের ছায়ায়
অশ্রুপাত করে নিশিদিন, রবীন্দ্র রচনাবলী
ব্যর্থতায় অপমানের অবনত, মিলনের ভগ্ন
সেতু দেখে নজরুল নষ্ট নীড়ে বুক চাপড়ান।
কান্নাও আসে না আর; প্রতিবাদ শরাহত পাখি,
যা’ কিছু গৌরবদীপ্ত ত্রস্ত সব বিবরে লুকায়।
মানুষকে দেখেই মানুষ প্রাণপণে পালাবার
পথ খোঁজে, বন্য পশুদের আজ বড় হাসি পায়।
গান থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে
গান থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে, নিরিবিলি
বসে নিশীথের ঘাসে, সমাধিতে। কখনো দেখিনি
তাকে, ছিল কুয়াশার মতো
ছায়ার মেদুর করতলে, পথের চিবুকে লীন।
কিছু কি বলার ছিল তার? চেয়েছিল
নামাতে প্রানী গুরুভার? চিন্তার নিমগ্ন স্তরে
তার ছায়া সঞ্চরণশীল, আমার হাতের কাছে
জল হয়ে বয়ে যায়, নাচের আমার ঠোঁটের ফাঁকে।
এরকম হ’তে থাকে বার বার। ফুলে বোঁচায়,
মৌমাছির সোনালি গুঞ্জনে মিশে থাকে;
কখনো বেরিয়ে আসে কবিতার পংক্তির হৃদয়
ছিন্ন করে, কিন্তু সে আমার ধরা ছোঁওয়ার বাইরে।
পুরুষ অথবা নারী নয়, হঠাৎ লাফিয়ে-ওঠা
মাছ নয়, দেবতাও নয়, নয় কোনো প্রেতযোনি;
তবু আছে মিথ্যার উচ্ছল হাটে সত্যের চেয়েও সত্য হয়ে
নিত্যদিন ব্যবহৃত শব্দের আড়ালে, যেন মেঘে-মেশা হাওয়া।
ঘুম ভেঙে গেলে
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে স্মৃতি মুড়ি দিয়ে শুই
পাশ ফিরে, দেয়ালে নজর, যেন সেখানে স্বপ্নের
কিছু টুকরো লেগে আছে। কারো হাতে ঘড়ি দোল খায়,
জানালা-পেরুনো হাওয়া মেশে
নিদ্রাছুট শরীরে আমার, বোধাতীত
বোধ তৈরি করে ভিন্ন পরিবেশ, অদূরে দাঁড়ানো
কেউ, হাতে ফলময় স্বর্ণথালা দূর তাহিতির,
আমি তাকে শনাক্ত করায় উদাসীন, বেড়ালের ছায়া দেখি।
উপর কাঠামো ভেঙে পড়ে; আমার নজর থেকে
যেন এই গাছপালা, তীরে-বাঁধা নৌকো, আলোজ্বলা
ফ্ল্যাটবাড়ি, বন্ধনমালার ধোঁয়া, প্রিয় মুখগুলি
আর বইপত্র লুপ্ত না হয় কখনো
ঘুরে দাঁড়ানোর পদ্ধতি
(হিতেশ মণ্ডলের স্বগত ভাষণ)
আমাকে বলছ ঘুরে দাঁড়াতে, অথচ
ঘুরে দাঁড়াবার মতো জায়গা
পাচ্ছিলো যে। আমি খুব কিনারে গিয়েছি চলে, তুমি
জেনে গেছ, তবু কেন ঘুরে দাঁড়াবার
বুলি ফোটে তোমার এ মুখে? ওরা তেড়ে
আসে এই শান্ত মাটি কাঁপিয়ে যখন, ঘরদোর
নড়ে ওঠে চিৎকারে, তখন তুমি কেন
আনো না ছুটে? আজ ঘুরে দাঁড়াবার
পরামর্শ বড় ফাঁকা, বড় ফাঁকা মনে হয় এই
সর্বনাশগ্রস্তকালে। ঘুরে দাঁড়াব না।
যত পারে আমাকে দেখাক ভয়, আমি মৃত্তিকায় মিশে যাব।
আমার ঘরের পোড়া মাটি, দলিত পীড়িত
লতাপাতা দেখুক আমার নত মাথা,
দেখুক দোয়েল আমি কেমন নিস্তব্ধ
প্রস্তরখণ্ডের মতো। আমার তরুণ সহোদর
ভিটেমাটি ছেড়ে ছুড়ে বেগানা দিগন্ত পানে ভয়ে
জড়সড় চলে যেতে চায়-এই সব দেখে নিক দেবতার
ভাঙা হাত, মা দুর্গার মুণ্ডহীন অগ্নিদগ্ধ ধড়।
বন্ধু, আর বেশি দেরি করো না, একটু
ঘুরে দাঁড়াবার মতো জায়গা দাও, এক্ষুণি দাঁড়াই।
চিরকেলে প্রশ্ন
আবীর-ছাড়ানো সকালে তুমি এলে আমার ঘরে। পড়ছিলাম
মিশেল ফুকোর
‘উন্মত্ততা এবং সভ্যত। উন্মত্ততা কি আমাকে
স্পর্শ করতে চাইছে? তোমাকে দেখেই
নড়ে-চড়ে বসি; তুমি জিগ্যেশ করলে
স্বতঃস্ফূর্ত হেসে, ‘কী করছো?’
‘এইতো এমন কিছু নয়’, বলে
মিশেল ফুকোর বই রেখে দিলাম টেবিলে।
সারা ঘরে ছড়ানো তোমার ঘ্রাণ,
যেমন জীবনানন্দের কবিতায় রূপরসগন্ধ।
বেশিক্ষণ ছিলে না তুমি,
কয়েকটি কথা বললে, যেন সরোবরে বুদ্বুদ।
এমন কি চা খাওয়ার জন্যেও অপেক্ষা করলে না,
একটা লিটল ম্যাগাজিন উল্টে পাল্টে তুমি রাস্তায়।
কেন এসেছিলো-এই প্রশ্ন আমার দিকে
ছুঁড়ে দেয় কবিতার খাতা, পেয়ারা গাছের পাতা।
উত্তরবিহীন আমার বসে-থাকা শূন্য ঘরে,
তোমার হাতের স্পর্শময় লিটল ম্যাগাজিন হতে চায় দোয়েল।
আমার ঘর তোমার ঘ্রাণ সেই কখন থেকে
বুকে চেপে রেখেছে যক্ষের মতো,
এই আশ্চর্য ঘ্রাণ হারিয়ে যাওয়ার আগে
তুমি কি আসবে আবার?
ছন্নছাড়া ধূলিঝড়ে
অকস্মাৎ বাষট্রির এই ছন্নছাড়া ধূলিঝড়ে
একি লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। আকাশটা বুঝি
ভাঙল কাচের বাসনের মতো আর
গাছপালাগুলোর মাতন
যেন ক্ষ্যাপা সন্ন্যাসীর নাচ,
শেকড় বাকড় ছেড়ে দেবে ছুট। মুখের উপর
তোমার চুলের ঝাপ্টা। আমি পথ দেখি না, আকাশ
অথবা চলন্ত যান-কিছুই দেখি না,
এই দুরু অনুভবে
আমার কেবল তুমি। কখন যে বিদ্যুতের মতো
ঝল্সে উঠে নেমে গেলে পথে,
আমার চাতক ব্যাকুলতা তোমাকে পেল না খুঁজে।
অন্ধ ভিখারির ব্যগ্রতায়
নিঃশব্দে কুড়াতে থাকি টুকরো টুকরো কথা,
তোমার বিব্রত দীর্ঘশ্বাস, ভাঙাচোরা
আমার স্বপ্নের ফিসফিস।
বাষট্রির এই ছন্নছাড়া ধূলিঝড়ে
কোথায় খুঁজব ডেরা? নিজের শরীর থেকে মুঠো
মুঠো ছাই উড়িয়ে, ফুরিয়ে আয়ু-রেণু
টলতে টলতে আজ এইতো আমার পথ চলা।