এ পথে আমার পর্যটন
এ পথে আমার পর্যটন তেমন নতুন নয়,
তবু কেন হঠাৎ একটি মোড়ে এসে
দাঁড়ালে কেমন যেন অচেনা, অদেখা
মনে হয়; আনন্দে ময়ূর হয় চেতনা আমার।
এই গাছ ছিল না কোথাও, এই ঝিল কোনোদিন
পড়েনি সতৃষ্ণ চোখে, এর জলে ডুবাই নি হাত
আগে কিংবা তীরবর্তী ঘাসে
শুয়ে কায়ক্লেশে ধীরে মুছে নিতে করিনি প্রয়াস।
এ পথে বিশ্রাম নিলে বেশিক্ষণ, কখন যে চোখ
নিভাঁজ, প্রগাঢ় ঘুমে বুজে আসে, ঝরে
শুক্নো পাতা সমস্ত শরীরে, আহরিত জ্বলজ্বল
আশরফি মাটির ঢেলা হয়ে যায় অবলীলাক্রমে।
একটি তালিকা
(কবি-নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেশ্টের একটি কবিতা স্মরণে রেখে)
তানভির আহমেদ খান, প্রতিষ্ঠিত, নামজাদা
লেখক, সাফল্যে তৃপ্ত, অন্ধকার বারান্দায় আজ
আছেন নিশ্চুপ বসে। মনের ভেতর তার কী-যে
তোলপাড়, জানে না দালান কোঠা, গলির জোনাকি।
তবে কি লিখতে না-পারার শুশুনিয়া মাঠ তাকে
করেছে ভীষণ গ্রাস? এইতো সেদিনও তার এক
পয়মন্ত গ্রন্থ হাটে বিকিয়েছে খুব, লেখনীকে
খরা আজো করে নি দখল। জাঁহাবাজ ফ্যাসিবাদী
গোষ্ঠী সদ্য করেছে প্রকাশ এক ঘাতক তালিকা;
সেখানে মুদ্রিত কতিপয় নাম, যেন সূর্যমুখী-
পরিচিত কবি, কথাশিল্পী, নাট্যকার, বুদ্ধিজীবী
এবং সংস্কৃতিকর্মী, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ বান্ধব,
সেই তালিকার অন্তর্ভুক্ত, অথচ সেখানে তার
নাম নেই,তাই আজ
অন্ধকারে মুখ রেখে তিনি
বড় বেশি বিচলিত। ‘তাহলে কি আমি, খ্যাতিমান
শব্দশিল্পী, এখনো যথেষ্ট নই প্রগতির পক্ষে?
করি নি কি অচলায়তনে প্রবল আঘাত কোনো?
এই যদি সত্য, তবে আমার সকল গ্রন্থ থেকে
শব্দ মুছে যাক, ওরা ঝাঁক ঝাঁক পতঙ্গের মতো
আগুনে মরুক পুড়ে। ইচ্ছে হয়, গ্লানি আর ক্ষোভে
চুল ছিঁড়ি, মাথা ঠুকি নীরেট দেয়ালে; ইচ্ছে হয়,
ফ্যাসিবাদীদের দরবারে নতজানু হ’য়ে বলি-
দয়া করে তালিকায় আমার নামটি লিখে নিন’।
একটি দুপুর
শহরে দুপুর ছিল, হৃদয়েও প্রখর দুপুর;
কে এক নবীন পাখি পাহাড়ের নিভৃতির ফুল,
সতেজ ঘাসের ঘ্রাণ, ঝর্ণার জলজ স্মৃতি নিয়ে
আমাদের দু’জনের ওপর ঝরালো বুনো সুর।
তখন ছিল না মনে কী তোমার না, বিয়ে-টিয়ে
কখনো হয়েছে কি না, না কি তুমি সরল বিধবা!
আমাদের চতুর্দিকে বাংলা প্রজাপতি, দূর
আফ্রিকার ড্রামের সঙ্গীত; দেহমন রক্তজবা।
সারা ঘরে তুমি রঙধনু, সমুদ্রের ঢেউ, দু’টি
মানুষের কী মধুর আলিঙ্গন অনন্তের পটে
আঁকা হয়ে যায় আর হৃৎপিণ্ডে গির্জার ঘন্টাধ্বনি;
আমরা দু’জন নীল স্বপ্ন হই, ফুল হ’য়ে ফুটে।
যখন তোমাকে দেখি, মনে হয়, এই মাত্র তুমি
স্বপ্নের কোরক থেকে জন্ম নিয়ে দাঁড়িয়েছ পাশে
নবীনা, নতুন শিল্প সৃষ্টি হবে বলে। আমাদের
হৃদয়ের কান্না-ভেজা মাটি সে শিল্পের জন্মভূমি।
তোমার কি মনে পড়ে সেই দুপুরের মাতলামি
কর্মময়তার কোনো ফাঁকে? যখন বারান্দা থেকে
বৃষ্টি দ্যাখো, তখন কি ভাবো বিগত-যৌবন এক
কবিকে নিঃসঙ্গতায় শরীর আহত স্বপ্নে ঢেকে?
একদা যাদের নাম
একটি গাছের হাত অভিবাদনের
ভঙ্গিতে আমার দিকে উঠে আসে; তাকে
কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে যাই। হাত নাড়া
দেখি, দূরে পাথরের বুকে
জলরেখা ফোটে, তবু গলে না হৃদয়
মানুষের।
বীণার ধ্বনিকে বোবা করে
এখন প্রধান হয়ে ওঠে
অস্ত্রের ঝংকার, চারা গাছের পাতারা
ছোরার আদলে বাড়ে। এক পাল জন্তু
সগৌরবে হেঁটে যায় বিপুল আঁধারে,
একদা যাদের নাম মানুষ বলেই জানা ছিল।
কবন্ধের যুগ
‘এমন বৈভব আমি দেখিনি কখনো’, বলে এক পর্যটক
নগরের দীপ্র দরদালানের দিকে অনিমেষ
তাকান, করেন স্তুতি। দিকে দিকে বিস্ময়-জাগানো
নানা শিল্পে। প্রবীণেরা করেছেন জ্ঞানের সাধনা
আজীবন, মিলিত উদ্যোগে সভ্যতার
সৌধে রেখেছেন কিছু সৃষ্টির স্বাক্ষর। এ নগরে
তরুণ-তরুণী যারা, তারা গ্রন্থ-অনুরাগী; নিসর্গ, প্রযুক্তি,
প্রণয়, সৌন্দর্য, নীতি ইত্যাদির প্রতি
অর্ঘ্যদানে অনলস,-পর্যটক বিশদ জানেন
এ কী হলো? অকস্মাৎ এ কেমন ভূকম্পন? সৌধ ভেঙে পড়ে,
বৃষ্টিপাত, অগ্নিবৃষ্টি। হাহাকার ওঠে
চতুর্দিকে; লুণ্ঠনে হত্যায় মাতে মাতাল দস্যুরা। এ নগরে
এরকম বর্বরতা অন্তরালে ছিল
ভেবে পর্যটক খুব বিমূঢ় বিহ্বল।
দর্শন, নৃতত্ত্ব শিল্প পেঁচার চিৎকারে লুপ্ত হয়
লহমায়; শেয়াল ও নেকড়েরা সদম্ভে রটায়-
‘কবন্ধের যুগ হলো শুরু প্রণতি জানাতে হবে মূঢ়তাকে।
প্রতারিত পর্যটক ছায়া দেখলেই পেছনে দাঁড়ান সরে,
যেন তার দিকে তেড়ে আসে
মনোহীন হন্তারক। পাখিরা নিশ্চুপ বড়, নক্ষত্রমণ্ডলী ঢাকা পড়ে
ধূমায়িত অন্ধকারে, আর্থ ইতিহাস, শুধু জেগে থাকে পেঁচার চিৎকার।
কবির কণ্ঠস্বর
সীসার মতো আকাশ বিনত, গাছগুলি
স্থাপত্য, তরতাজা রৌদ্রর রঙে
অকস্মাৎ ধরেছে জং;
ক’দিন ইঁদুরগুলোর
জোটে নি এক কণা খাদ্য,
বাঁধানো কবরগুলোয় মস্ত ফাটল।
পেঁচা মূক, স্থবির; শ্মশান পেরিয়ে
সৌন্দর্য ব্যান্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে
খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিরুদ্দেশ যাত্রায় লীন।
একজন কবির বুক
বুলেটে ঝাঁঝরা করে উল্লাসে মত্ত ওরা।
ঘাসবঞ্চিত মাটি
সন্তানহারা জননীর মতো
দমকে দমকে ডুকরে ওঠে আর
কবির কণ্ঠস্বর অমর্ত্য উৎসব
স্পন্দমান লোকালয়ের অন্তরে।
কাল রাতে স্বপ্নে
কাল রাতে স্বপ্নে আমি লালনের আরশি নগর
দেখেছি অনেকক্ষণ, মনে হয়, আলো-আঁধারিতে।
কেমন পড়শি ছিল কাছে, ধারে, কিবা তার ঘর
দোর, মনে নেই, বুঝি দেহ তার রঙিন শাড়িতে
ছিল ঢাকা, চোখ দু’টি টানা টানা, অত্যন্ত গভীর,
ছুঁতে গিয়ে তাকে আমি গহীন গাঙের জলরেখা
যেন বা করেছি স্পর্শ, পরিচিত এই গ্রহটির
কেউ নয়, বুঝি তাই আজো প্রকৃত হয় নি দেখা।
লালনের গানের আড়ালে যার পদধ্বনি বাজে,
বাউলের দোতারার সুর যাকে করে বন্ধনীয়,
এ আমি কী করে পাবো তাকে আমার সকল কাজে?
‘সে আছে নদীর পাশে সুর হয়ে, তাকে চিনে নিও,’
বলেই বাউল এক অগোচরে করেন প্রস্থান,
সাথে সাথে আমার নগর হয় লালনের গান।